এই মেলা এক ঝলক টাটকা বাতাস

সব্যসাচী সরকার প্রকাশিত: মার্চ ১, ২০২২, ০৬:১১ পিএম

আবার একটা বইমেলা যে এসে পড়ল, সেটা কলকাতার কাগজগুলো দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় একটা সাজো সাজো রব, সল্টলেকের করুণাময়ীতে ছোট বড় প্রকাশকেরা সবাই অসম্ভব ব্যস্ত। কারও দম ফেলার সময় নেই। শেষ মুহূর্তের তুলির টান পড়ছে স্টলগুলোয়।

আবার কবি-লেখকরা যেমন অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত নতুন বইটির জন্য, ঠিক তেমনই পাঠক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন প্রিয় লেখক বা কবির নতুন বইটির জন্য। এ এমন এক মিলনমেলা, যেখানে বড়-ছোট প্রকাশনার কোনও তফাত নেই। নামী স্টলগুলোতে যেমন বই কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ে, ঠিক তেমনই লিটল ম্যাগাজিনের টেবলেও দেখা যাচ্ছে তুমুল ব্যস্ততা। আগ্রহী পাঠক ঠিক খুঁজে নেন তাঁর প্রিয় বইটি। বা পছন্দের ম্যাগাজিন। কেউ যদি না পড়বে, তা হলে কোথা থেকে ছাপা হয় হাজার হাজার লিটল ম্যাগাজিন?

শুধুমাত্র বই ঘিরে এমন মিলনক্ষেত্র আর কোথায় হয় কি না, এই প্রশ্নটা কলকাতা বইমেলা এলেই শহরের সাংস্কৃতিক মহলে ঘোরাঘুরি করে। বাংলাদেশে একুশের বইমেলা হয়তো কোথাও একটা একইরকম আবহ তৈরি করে, তবু কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা নিজ বৈশিষ্ট্যেই স্বতন্ত্র। দিল্লির প্রগতি ময়দানের বইমেলা বা জামার্নিতে ফ্রাঙ্কুফুর্টের আন্তর্জাতিক বইমেলার কথা আমরা জানি, কিন্তু সেই সব বইমেলার থেকেও কলকাতা বইমেলা একেবারে অন্যরকম।

কিন্তু নতুন শতাব্দীতে ধীরে ধীরে ছাপা বইয়ের ঘাড়ে যখন থাবা বসাচ্ছে ই-বুক, তখন বিপুল এই প্রকাশনার বহর দেখে চমকে উঠতে হয়। এ বারে মেলাতেই ছোট-বড় প্রকাশক মিলিয়ে কমবেশি হাজার কুড়ির উপরে নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। বিক্রি-বাটাও প্রচুর হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই বারো দিনের বইমেলা মানেই ই-প্রকাশনাকে অনেক পিছিয়ে ফেলা গেল, তা হলে বিরাট ভুল হবে। বরং মেনে নেওয়া ভালো, পুরোনোকে আঁকড়ে না থেকে ছাপা বইয়ের পাশাপাশি ই-প্রকাশনারও প্রয়োজন আছে।

গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে করোনাভাইরাসের দাপটে বইমেলা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ফলে বড় থেকে ছোট, বইয়ের ব্যবসায়ী ও প্রকাশকদের ক্ষতি কম হয়নি। তাই এবারের মেলা ঘিরে বিপুল আগ্রহ ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন আছে। বইমেলা কি পুরোপুরি বইমেলা থেকেছে? থাকেনি। ফুড কোর্টের নামে খাবারের অসংখ্য স্টল, অফিস, ব্যাঙ্ক, এমনকি খেলনা পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে এই মেলায়। যা যে কোনও বইপ্রেমী মানুষকে কষ্ট দেবে। এই যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বইমেলায় যান, তারা সকলেই কি বই কেনেন? নাকি বইমেলায় যান খাবারের স্টল ঘুরে বিনোদন আর বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সান্ধ্য আড্ডার জন্য? সবাই যদি বই কিনতেন, তা হলে বাংলা প্রকাশনার ভবিষ্যৎ এতটা অনিশ্চিত হত না।

প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে বেআইনী রাস্তায় বই পাচারও প্রকাশনার একটা বড় শত্রু। সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশের অধিকাংশ বই পিডিএফ হয়ে বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে। আইনের ফাঁক গলে। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখকদের বই (যেমন হুমায়ুন আহমেদ) পিডিএফ হয়ে এখানে চলে আসছে চোরা পথে। এই অন্যায় পন্থা কীভাবে বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে দুই দেশের সরকারকে। এই নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। আইনের ফাঁক গলে পিডিএফ করে বই বিক্রি সমানে চলেছে।      

দুই সপ্তাহ চলবে বইমেলা, তার পরে হবে হিসেবনিকেশ। এমন অনেক ছোট প্রকাশক আছেন, যাঁরা এই মেলার উপরে অনেকটাই নির্ভর করে থাকেন। গত বছর মেলা না হওয়ায় বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁদের। শেষমেষ করোনাভাইরাসের দাপট কমেছে, আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে মানুষ। এই সময়ে বইমেলা অবশ্যই বইপ্রেমী মানুষের কাছে এক ঝলক টাটকা বাতাস।

বইপ্রেমীদের মুখে হাসি ফুটুক, প্রকাশকদের মুখেও।