বিখ্যাত মনীষী কাজী মোতাহার হোসেনের সাত ছেলে, চার মেয়ের মধ্যে সবাই মা-বাবার শিক্ষা-দীক্ষায় যে যার মতো বড় হয়ে উঠছেন। তিনিও তার বাইরে ছিলেন না। খুব ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিল তাঁর দিনকাল। গানবাজনা, নাটক, লেখালেখি আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেদার আড্ডা। হেসেখেলেই চলছিল সবকিছু। এর মধ্যে এমএ পাসও করে ফেললেন। ইতিমধ্যে সুভাস দত্তর ‘সুতরাং’ সিনেমায় তাঁর গাওয়া ‘এই যে আকাশ, এই যে বাতাস’ গানটিও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গানটি মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। সুধীমহলে গায়ক হিসেবে তিনি একটু-আধটু জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। তখন তিনি ঢাকা বেতারের তালিকাভুক্ত নিয়মিত শিল্পী। তাঁর গান প্রায়ই প্রচারিত হতো। সামনের দিনে নিজেকে নামকরা গাইয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন—এমন আশাও কি তাঁর মনে তখন তৈরি হতে শুরু করেছে!
হলেও তা বাড়তি কিছু চাওয়া হতো না। কারণ, এই তাঁর পরিবারের সবার মধ্যেই কমবেশি সেই গুণটি আছে। তাঁর মধ্যে সেই গুণ ভর করলে তা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু হতো না। বরং তা স্বাভাবিকই হতো। তিনি গায়ক হতে পারতেন, সেই সম্ভাবনার পুরোটাই তার মধ্যে লুকায়িত ছিল। তিনি চেষ্টা করলে একদিন অনেক বড় গাইয়ে হতে পারতেন।
কিন্তু বাঙালি সমাজে মধ্যবিত্ত পরিবার হলে যা হয়। ছেলে এমএ পাস করেছে সুতরাং তাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দাও দেখবে কাঁধে জোয়াল (জোয়াল বলতে সদ্য বিয়ে করা বউ...) পড়লে ছেলে নিজের তাগিদেই কিছু আয়-রোজগারের পথ একটা বের করবেই করবে। তার এমএ পাসের পর পরিবারের বড়রা ধরে বেঁধে তাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। বিয়ে নিয়ে তিনি বলছেন, ‘এমএ পাস করার পর কিছুদিন গানবাজনা নিয়ে সুখেই কাটল। তারপর বড়রা ধরে বিয়ে দিয়ে দিলেন। পড়লাম বিপদে।’
এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে তিনি নতুন করে চিন্তা করতে শুরু করলেন কী করা যায়।
আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন এই জীবনে কখনো আটটা-পাঁচটা অফিস করবেন না। বাংলায় এমএ করেছেন। লেখার হাত ভালোই তাই চিন্তা করলেন লেখালেখির দিকটায় কিছু করা যায় কি না। সেই চিন্তা থেকে শুরু করলেন গোয়েন্দা কাহিনি লেখা পাশাপাশি প্রকাশনার ব্যবসা। ১৯৬৪ সালে সেগুনবাগিচার এক ছোট্ট ছাপাখানা থেকে তিনি শুরু করলেন রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনি, স্পাই থ্রিলার। শুরুটা করেছিলেন কুয়াশা দিয়ে। মৌলিক কাহিনি নির্ভর করে কুয়াশা সিরিজের কয়েকটা বই রহস্য আর রোমাঞ্চ ঘেরা কাহিনি এবং এর ভিন্ন স্বাদের কারণে পাঠক খুব দ্রুতই এই লেখা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। পাঠকের পাঠতৃষ্ণা বাড়তে থাকায় তারা এ রকম আরও বই চাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি একা কীভাবে একের পর এক এত বই লিখবেন! তিনি ভাবতে লাগলেন, মৌলিক কাহিনির ওপর নির্ভর করে একের পর এক রহস্য, থ্রিলারের লেখা খুব কঠিন কাজ হবে। এ সময় তার এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের ডক্টর নো বইটি পড়তে দেন। সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি স্মৃতিচারণায় উল্লেখ করেছেন, ‘ওটা পড়ার পর বিস্মিত ও লজ্জিত হয়েছিলাম। রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যে বাঙালি লেখকেরা যে কতটা পিছিয়ে আছে, বুঝতে পারলাম। ঠিক করলাম, বাংলাতে ওই মানের থ্রিলার লিখব। শুরু হলো বিভিন্ন বিদেশি বই পড়া। কাহিনি সাজাতে মোটরসাইকেলে করে ঘুরে এলাম চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি। সেটা ১৯৬৫ সালের শেষ দিকের কথা। এরপর কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম। কিন্তু লিখতে গিয়ে টের পেলাম, ভাষা নেই। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র আমি। সাহিত্যের ভাষা আসে। এ ভাষায় থ্রিল-অ্যাকশনের দৃশ্য ছবির মতো ফুটিয়ে তোলা বড়ই মুশকিল। তাই লিখছি, কাটছি, আবার লিখছি, পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলছি, আবার লিখছি। এ ধরনের লেখা বাংলা সাহিত্যে ছিল না। ভাষা ও বিষয় কোনোটিই নয়। সে জন্যই চেষ্টা করতে হলো। চেষ্টা-চর্চায় তৈরি হলো ভাষা। সেবার ভাষা। এর মধ্যে কিছুটা রিপোর্টিং স্টাইল আছে। মানে, সহজভাবে বলার চেষ্টা, তার চেয়ে বেশি দৃশ্যপট পাঠকের চোখের সামনে স্পষ্ট ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা। এভাবে চেষ্টা ও পরিশ্রম করে সাত মাস ধরে লিখলাম মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ধ্বংস-পাহাড়। ১৯৬৬ সালের মে মাসে বাজারে এলো বইটি।’
তিনি গায়ক হতে পারতেন—সেই সম্ভাবনার পুরোটাই তার মধ্যে লুকায়িত ছিল। তিনি চেষ্টা করলে একদিন অনেক বড় গাইয়ে হতে পারতেন।
কিন্তু বাঙালি সমাজে মধ্যবিত্ত পরিবার হলে যা হয়। ছেলে এমএ পাস করেছে সুতরাং তাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দাও দেখবে কাঁধে জোয়াল (জোয়াল বলতে সদ্য বিয়ে করা বউ...) পড়লে ছেলে নিজের তাগিদেই কিছু আয়-রোজগারের পথ একটা বের করবেই করবে। তার এমএ পাসের পর পরিবারের বড়রা ধরে বেঁধে তাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন। বিয়ে নিয়ে তিনি বলছেন, ‘এমএ পাস করার পর কিছুদিন গানবাজনা নিয়ে সুখেই কাটল। তারপর বড়রা ধরে বিয়ে দিয়ে দিলেন। পড়লাম বিপদে।’
এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে তিনি নতুন করে চিন্তা করতে শুরু করলেন কী করা যায়।
১৯৬৩ সালে বাবার দেওয়া দশ হাজার টাকা দিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেসের ব্যবসা শুরু করেন। সেকালে আট হাজার টাকা দিয়ে কিনলেন একটি ট্রেডল মেশিন আর বাকি টাকা দিয়ে টাইপপত্র। সঙ্গে দুজন কর্মচারী—শুরু হলো সেগুনবাগান প্রেস। সেখান থেকে ১৯৬৪ সালের জুন মাসে বের করলেন কুয়াশা-১। এর আগে ঢাকা বেতারের গানের শিল্পী হিসেবে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্ যন্তনিয়মি তগান গেয়েছেন, লেখালেখি আর প্রকাশনার ব্যবসা শুরুর পর গানের জগৎ থেকে বিদায় নিলেন।
এরপর তিনি বুদ্ধি করে, নিয়ম করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত সব লেখকের সেরা লেখার অনুবাদ শুরু করলেন পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের অ্যাডাপটেশনের কাজও শুরু করলেন। আস্তে আস্তে সেগুনবাগিচার সেই ছোট্ট প্রেসটাকেই নিজের অফিস করে ফেললেন। প্রকাশনীর নাম প্রথমে দিলেন সেগুনবাগিচা। নাম দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে দেখে তাঁর ভালো লাগল না সেই নাম। পরে সেগুনের সে আর বাগিচার বা মিলিয়ে রাখলেন সেবা। সেবা প্রকাশনী। বাংলা প্রকাশনায় কিংবা বাংলা অনুবাদ, রহস্য আর থ্রিলার সাহিত্যে এক অপরিহার্য প্রতিষ্ঠানের নাম সেবা। শুরুর পর থেকে গত ৫৬ বছর ধরে সেবা প্রকাশনীর বই পাঠকের মন-প্রাণ-অন্তরজুড়ে আছে। সেবা প্রকাশনীর বিচিত্র স্বাদের বই পড়ে পড়ে এ দেশে তৈরি হয়েছে এক বিশাল পাঠক। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন সেবার পাঠক।
২.
তাঁর ডাকনাম নবাব। সারা জীবন কাটিয়েছেন নবাবের মতন জীবন। জন্মেছেন ঢাকায়। বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত শিক্ষক, মুক্তমনা, গণিতজ্ঞ আর জ্ঞানতাপস হিসেবে তাঁর সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। ছোটবেলা থেকে ভাইবোনেরা সেই ঋষিতুল্য বাবাকে অনুসরণ করে বড় হয়েছেন। নিজের বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘আমরা সাত বোন, চার ভাই একই পরিবারে জন্মেছি বটে, কিন্তু আব্বু আমাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে মানুষ করেছেন, প্রত্যেকের প্রতি আলাদা যত্ন নিয়েছেন। যার যেমন অন্তরের তাগিদ ও চাহিদা, তাকে ঠিক তা-ই জুগিয়েছেন। আমরা যে যার মতো নিজ নিজ পছন্দের লাইনে বেড়ে উঠেছি। প্রয়োজন হলেই তিনি এগিয়ে এসে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত।’
বাবার দেখানো পথ ধরে বাকিটা জীবন চলেছেন নবাবের মতোই। তাঁর হাত ধরে এ দেশে অনেক নামকরা সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে। সেবা প্রকাশনী রহস্য পত্রিকার মাধ্যমে এ দেশে তৈরি হয়েছে একটি শক্তিশালী, যোগ্য লেখকদের দল। কারা নেই এই দলে! শেখ আব্দুল হাকিম, রকিব হাসান, নিয়াজ মোরশেদ, রওশন জামিল, আসাদুজ্জামান, খসরু চৌধুরী, শওকত হোসেন, অনীশ দাশ অপু, তাহের শামসুদ্দিন থেকে শুরু অনেক নবীন লেখক উঠে এসেছেন তাঁর হাত ধরে। সারাটা জীবন তিনি নিজের লেখালেখির পাশাপাশি যোগ্য লেখক তৈরিতে পরিশ্রম করেছেন। পাঠকের কথা ভেবে তিনি যে কত কত বিষয়ে আলোকপাত করেছেন, বই বের করেছেন, তা ভাবতেই বিস্মিত হতে হয়।
বাবার দেখানো পথ ধরে বাকিটা জীবন চলেছেন নবাবের মতোই। তাঁর হাত ধরে এ দেশে অনেক নামকরা সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে। সেবা প্রকাশনী রহস্য পত্রিকার মাধ্যমে এ দেশে তৈরি হয়েছে একটি শক্তিশালী, যোগ্য লেখকদের দল। কারা নেই এই দলে!
অনুবাদ, রহস্য, গোয়েন্দা, রোমাঞ্চ সাহিত্য তো আছেই, এর বাইরেও তিনি নন ফিকশন, যৌন বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান, ধূমপান ত্যাগে আত্মসম্মোহন, খালি হাতে আত্মরক্ষা, সঠিক নিয়মে লেখাপড়াসহ নানা বিষয়ের ওপর বিচিত্র সব লেখা ছেপেছেন। তাঁর হাত ধরে এ দেশে তৈরি হয়েছে একটি শক্তিশালী সম্পাদনা বিভাগ, যার মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিক, কিশোর পাঠ্য গোয়েন্দা কাহিনি ‘তিন গোয়েন্দা’ ও বিজ্ঞান কল্প-কাহিনি এবং ওয়েস্টার্ন কাহিনি বের হয়েছে।
সেবা প্রকাশনীর বই মানেই আর সবকিছুর থেকে আলাদা কিছু—এ রকম একটা মিথ তিনি বাংলাদেশের অগণিত পাঠকের কাছে তৈরি করে দিতে পেরেছেন।
৩.
এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কাজী আনোয়ার হোসেন জীবনের শুরু থেকেই পারতেন নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে তৈরি করতে। কিন্তু সে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ইচ্ছে করেই তা করেননি। তার পরিবর্তে তিনি লেখার পাশাপাশি একটি ভিন্ন জগৎ তৈরির স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যেখানে মানুষ তার অলীক কল্পনার সন্ধান পাবেন। রহস্যের সন্ধান পাবেন। অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধান পাবেন। পাঠককে তিনি সেই সন্ধান দিতে পেরেছেন—এখানেই তাঁর সফলতা।