চাঁদনি রাতে আখতারি মাহমুদ

সালেহা চৌধুরী প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২১, ০৩:৫৩ পিএম

আখতারি মাহমুদকে এক রাত কাটাতে হয়েছিল কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে। গাড়ি নিয়ে কী এক কাজে বেরিয়েছিলেন। গাড়ি থেমে গেল। গল্পটা একটা চাঁদনি রাতের। তিনি বেরিয়েছিলেন দুইটা নাগাদ। কাজ শেষ হলে পাঁচটার দিকে বাড়ির পথ ধরেছিলেন। একজন ফ্যামিলি প্ল্যানিং প্রধান কোনো এক ছোটখাটো ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিস তদারকিতে গিয়েছিলেন। তারপর বিতিকিচ্ছিভাবে গাড়িটা খারাপ হয়ে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল। একেবারে নট নড়নচড়ন ভঙ্গি। 
অনেক চেষ্টা করেও যখন নড়ল না, তিনি ভয় পেলেন। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলেন না। সেটা তিনি করেন না। সারাক্ষণই একধরনের ভয় পাওয়া ব্যক্তিত্ব তার। তিনি কেবল ভয় দেখান। কিন্তু ভয় পান না। তিনি ফ্যামিলি প্ল্যানিং প্রধান। অফিসের সবচাইতে ছোট কেরানি শরীফ মিয়া আপাতত তার সঙ্গে। গাড়িটা খারাপ হলো শরীফ মিয়ার বাড়ির কাছে এসে। শরীফ মিয়ার বাড়ি এখান থেকে খুব কাছে। সবুজিয়া গ্রামে। তাকে কী বলবে ছোট কেরানি শরীফ মিয়া—গাড়ি যতক্ষণ ঠিক না হয় আমাদের বাড়িতে এসে বিশ্রাম করেন। গাড়ি না বিগড়ালে খানিক পর শহরে যাওয়া যেত ম্যাডাম। এখন তা যাবে না। কোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশা এখানে পাওয়া যাবে না। জায়গাটা একেবারে অজপাড়াগাঁ ম্যাডাম। মনে মনে ভাবে শরীফ মিয়া এখানেই কেন বিগড়াল? এ কি ভালো না খারাপ? গরিব তারা। এই অতিথিকে রাখবেন কোথায়? আর যদি রাখেন এবং রানির মতো যত্ন করেন, তবে তার প্রমোশন হবে? কী জানি কী হবে কে জানে।
আখতারি বেগম মিস না মিসেস, গে না লেসবিয়ান, কেউ তা জানে না। তার বাড়িতে একজন নারী থাকেন। আঁটসাঁট মেয়ে। কাজ করে। লোকজন সে মেয়েটাকে নিয়ে এটা-সেটা বলে। তবে সামনে নয়। কার ঘাড়ে কতটা মুণ্ডু আছে, তাকে নিয়ে এটা-সেটা বলবে? তিনি তাঁর আগুন আগুন ব্যক্তিত্ব দিয়ে সব পুড়িয়ে ছাই করে দেবেন না? তিনি একজন নারী হিমালয়। কিংবা ভিসুবিয়াস।
আসতে আসতে মনে মনে ভাবছিলেন আখতারি ওগুলো সব শর্ষেক্ষেত? হলুদে হলুদ। মনে মনে বলছিলেন। আর দেখছিলেন এটা-সেটা। শর্ষেক্ষেতের ইংরেজি করছিলেন তিনি মাস্টার্ড ফিল্ড। ইংরেজিতে তিনি ভালো। দুই বছর লন্ডনে ছিলেন পড়াশোনার কারণে। 
ওয়াটার লিলি বা শাপলাপুকুরও তার ভালো লাগছিল। বলছিলেন—ওয়াটার লিলি না লোটাস। তবে সেটা মনে মনে। পেছনের সিটে তিনি একা। সামনে ড্রাইভার আর শরীফ মিয়া।
তিনি ভালো মুডেই ছিলেন। আগুনের মতো মুডেই সবাই তাকে চেনে, যদিও তবু শরীফ মিয়া একসময় তাঁকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। 
ঝুড়িনামা বটগাছের ইংরেজি করছিলেন মনে মনে আসতে আসতে। রুটস টাচিং বানিয়ান ট্রি। এমন কিছু। তারপর যখন জানলেন গাড়ি যাবে না তিনি রেগে গেলেন ভয়ানক। কিন্তু ড্রাইভারকে বকলেই তো গাড়ি ঠিক হবে না। বলেন একসময় আগুন হয়ে কোনো এক মেকানিক ধরে আনো। শরীফ মিয়া বলে, ম্যাডাম ওই তো ওখানে আমার বাড়ি। আপনি একটু কষ্ট করে হেঁটে আমার সঙ্গে আমার বাড়ি চলুন। ওখানে একটু বিশ্রাম করেন। তারপর গাড়ি ঠিক হলে চলে যাবেন ম্যাডাম। আল্লাহর কি শান ম্যাডাম আমার বাড়ির কাছে এসে গাড়ি খারাপ হলো। আমি গরিব হলেও আমার একটা বাড়ি আছে ম্যাডাম।
অফিসের ছোট কেরানি শরীফ মিয়া হাত চুলকাতে চুলকাতে বলে সাহস করে। গ্রামের এই সব কীটপতঙ্গের মতো লোকজনের সঙ্গে এটা-সেটা বলে ব্যক্তিত্ব পাংচার করতে চান না। তিনি জানেন, তিনি বড় বস। এবং এরা সব গ্রামের হাবিজাবি। পোকামাকড়। তারপরও তিনি কী ভেবে রাজি হলেন। রাস্তায় অপেক্ষা না করে একজনের বাড়িতে। ভাঙা ধুলো রাস্তা তার ভালো লাগছিল না। কিছু পোকার মতো লোকজন ঘিন ঘিন করছিল। এর সঙ্গে কিছু নেড়ি কুত্তা। 
যখন বাড়িতে চা-টা খেয়ে গম্ভীর মুখে বসেছিলেন শরিফ মিয়া একসময় এসে জানায় আজ ম্যাডামের যাওয়া হবে না। কাল সকালে গাড়ি ঠিক করতে মেকানিক আসবে। এখন সে আসতে পারবে না। আখতারি মাহমুদ রেগে কাঁই। যেন কঠিন ব্যক্তিত্বে শেষ করে দেবেন সবকিছু। শরীফ মিয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করে অতিথি আপ্যায়ন করতে। কিন্তু তিনি এত বিরক্ত কিছু তার ভালো লাগে না। লোকজন যারা তাকে দেখতে আসে, তিনি কারও সঙ্গেই কথা বলেন না। গ্রামের কিছু হ্যাংলা পাতলা পেটমোটা ছেলেমেয়েসহ কয়েকজন মা। হয়তো তারা আশা করেছিল কিছু। কারণ শরীফ মিয়া বলেছে, উনি অনেক বড়লোক। কেঁচোকেন্নোর মতো লোকজনের দিকে তিনি তাকিয়েও দেখলেন না। পারলে হুঁশ করে কাক তাড়িয়ে দেওয়ার মতো তাড়িয়ে দেন। কিন্তু ওরাই চলে যায়। মনে ওদের কষ্ট হলো না দুঃখ হলো, সে নিয়ে ভাবলেন না। 
একটা ঘরকে ঠিকঠাক করে তার থাকার ব্যবস্থা করা হলো। যেসব রান্না হয়েছিল, তিনি খান। কিন্তু বোঝা যায় এসব তার পছন্দ নয়। যারা রান্না করেছিল আশা করেছিল কিছু প্রশংসার কিন্তু তিনি সেদিক দিয়ে গেলেন না। বিষ গেলার মতো মুখের চেহারা তার। ওরা যখন বলে, আর এক টুকরো মাংস দেব? তিনি বলেন, ওসব রেখে চলে যান। পাতে তুলে দিতে হবে না। যত সব গ্রাম্য অভ্যাস! হরিবল! এই বাড়ির একটি ভালো ঘর তারই কারণে সেজেগুজে প্রস্তুত। ধবধবে চাদর গভীর ঘন সুজনি। বালিশের কভারে ভেলভেট। সেগুলো শরীফ মিয়ার হয়তো নিজের নয়, ধার করে এনেছেন। সব খাওয়া হলে দই দিয়ে একটা শরবতের মতো কী জানি আসে। তিনি তাকিয়ে দেখেন। ওপরে সুন্দর গন্ধের কালো জিরা মৌরি। তিনি প্রশ্ন করেন, এটা কি ডেসার্ট। যে পরিবেশন করতে এসেছিল, সে বোকার মতো চোখ করে বলে, দইয়ের শরবত। খালি পরে হজম হয়। ওরা সব বগুড়ার ভাষায় কথা বলে। যথাসাধ্য ভালো করে বলবার চেষ্টার পরেও। তিনি এক চুমুক পান করে পুরোটা শেষ করেন। চমৎকার স্বাদের দইয়ের শরবত। কিন্তু মুখে কিছু বলেন না, বাড়ির লোকজন এর-ওর বাড়ি গিয়ে রাত কাটাবে। না হলে আর একটা ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকবে। এক মেয়ে তার ঘরের সামনে শুয়ে থাকে। যদি তার কিছু দরকার লাগে তাই।
অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। পেটে ব্যথা অনুভব করেন। বুঝতে পারেন কোনো একটা খাবারের জন্যই মাঝরাতে উঠতে হলো তাকে। কতক্ষণ পেটব্যথা নিয়ে চুপ করে থাকবেন। তাকে যেতেই হবে এ পেটব্যথা দূর করতে। ঘরের সামনে মাদুর বিছিয়ে যে শুয়ে খবরদারি, দেখাশোনার জন্য তাকে ডাকেন। বলেন, শোনো আমাকে এক্ষুনি বাইরে যেতে হবে। মেয়েটি ঠিক বুঝতে পারে না। পরে বুঝতে পারে আখতারি মাহমুদ কী বলছে। বলেন, তিনি টয়লেট কোথায়। একসময় মেয়েটা বুঝতে পারে টয়লেট মানে কী।
তিনি বাইরে আসেন। এমন চাঁদের আলো বইতে পড়েছেন আর এই গ্রামে দেখলেন। বলেন, যাচ্ছ কোথায়? টয়লেট কোথায়?
মাটোত বুবুজান। মেয়েটি একগাল হেসে বলে।
মাঠে কেন?
আপনি ওটি বসেন। কেউ দেখবার পাবি না আপনাক। ওই মাটোত। হামি এটি দাঁড়ে আছি ভয় পাবেন না কোলে।
এখানে সকলে মাঠে? তিনি কথা শেষ করতে পারেন না।। এ বাড়িতে তাহলে…। আগুনের মতো ব্যক্তিত্ব ফট করে একটা টয়লেট এনে দেবে না। বা মাটি ফুঁড়ে শিবলিংয়ের মতো গজিয়ে উঠবে না। স্বামীর প্রমোশন পেতেই হবে এমন মরিয়া হয়ে শরিফ মিয়ার বউ যা রেঁধেছিল, তার ফলে হয়তোবা। না সেই মৌরি আর কালি জিরা মেশানো দইয়ের শরবত। কী জানি কী।
মাথার ওপরে হ্যাজাক বাতির মতো দপদপে চাঁদ। তারাগুলো পর্যন্ত একশ পাওয়ারের ইলেকট্রিক বাল্বের মতো আলো বিতরণ করছে। এমনকি এক একটি জোনাকিও কমসে কম চল্লিশ পাওয়ারে আলো রাখে গায়ে। ধবধবে জোছনায় ভেসে যাওয়া প্রকৃতি। 
দূর থেকে ভেসে আসে বরাভয়, আপনি ভয় পাবেন না। এটি জিন টিন নাই।
আখতারি মাহমুদ কী করবেন বুঝতে পারেন না। তারপর একসময় মেয়েটিকে তিনি কাছে ডাকেন। বলেন, আমি এখানে কী করে এসব করব। তুমি আমাকে কোনো টয়লেটওয়ালা বাড়িতে নিয়ে যাও।
মেয়েটি চুপ করে কী ভাবে? তিনি করুণ গলায় মেয়েটির হাত ধরে, প্রায় কেঁদে ফেলেন— প্লিজ। তার সকাতর অনুরোধ। আর একটু হলে তিনি মাটিতে বসে হাঁটু মুড়ে প্রার্থনা করবেন সেই জিনিসটার খোঁজে, যার নাম হাই কমোড। মেয়েটি নরম হয়। একটু বদলে যাওয়া গভীর গলায় বলে, চলেন। একটা আছে। একটু হাঁটা লাগবে। তিনি মেয়েটির হাত ধরেন। মেয়েটা আগে আগে চলছে হারিকেন নিয়ে তিনি তার পিছু পিছু। 
কঠিন ব্যক্তিত্ব নয় একটুখানি করুণ সকাতর নরম গলার স্বর যেন জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করে।
মৌরি মেশানো শরবতটা কি এই কারণে তাকে দেওয়া হয়েছিল। কে জানে কী ছিল ওদের মনে।