শেষ উড়ানের আগে

মণিকা চক্রবর্তী প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২১, ০৩:৪৫ পিএম

আজ কী বার! কত তারিখ! এখন কি দিন না রাত্রি! হোম কোয়ারেন্টাইনে এক অন্তহীন শূন্যতার ভেতর সে নির্দিষ্ট দিনটিকে খুঁজতে থাকে। একটি দিন খুঁজে বের করা, আর তারপর সেই দিনের ভয়াবহ শূন্যতার ভেতর কাজের একটি তালিকা তৈরি করা। সে দৃঢ়ভাবে শপথ নেয়, হ্যাঁ, এটাই এখন করতে হবে। আগে একটি মুক্ত দিনের মধ্যে ছিলাম। এখন দাসত্বের দিন। দাসত্ব কার কাছে! এই মহাশূন্যতার কাছে! নিজের কাছে! এটা কি দাসত্বই! একটি দ্বন্দ্ব যেন ভাবনার পথগুলোকে একেবারেই মুছে দেয়। আগে যাকে মুক্তভাব বলতাম—তা-ও কি সত্যিই মুক্তি! কী জানি! এমন সব চিন্তা তার মাথার ভেতর ক্রমাগত পাক খায়। ক্রমাগত…ক্রমাগত…ক্রমাগত…। সামনে এগোনোর কোনো দিশা নেই। পেছনের পখগুলোও কি মুছে গেছে! 
যে অর্গানাইজেশনে সে কাজ করে, তা আন্তর্জাতিক মানের। আগের চাকরিতে সে দেশেই ছিল। ছেলে-শাশুড়ি-স্বামী সকলকে নিয়ে। ছেলেটা ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষে, তাই সে এই দূর দেশে চাকরি করার ঝুঁকিটা নিয়েছিল। আর নিজেকে একটা চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাবার অন্তর্গত তীব্র ইচ্ছাটিও ছিল। হ্যাঁ, এ-ও ঠিক যে, সংসারের নিশ্চল জীবনের মধ্যে, একটা মুক্তির ভাবনা তাকে গতি দিয়েছিল। তাছাড়া চলতি পৃথিবীর ভোগবাদী রূপটাও তাকে টেনেছিল খুব। সে সুন্দরী, শিক্ষিতা, ভালো রেজাল্ট। সঙ্গে আইটি নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত পড়াশোনা, ও নানা রকম পাবলিকেশনসও ছিল। তাই সহজেই চাকরিটা পেয়েছিল সে। তবে বেশ কিছুদিন পাকাপোক্ত ট্রেনিং নিয়ে, ইংরেজিতে ভালো দক্ষতা অর্জনের জন্য কিছু কোর্স করতে হয়েছিল। এইটুকুই বাড়তি পরিশ্রম। সংসারের একঘেয়ে জীবনের পর এই এক বিরাট আকাশের মতো মুক্তি। তাই চাকরির নির্ধারিত কষ্টগুলোকে মোটেই কষ্ট মনে হয়নি তার।
চাকরির সিদ্ধান্ত নেবার সময়, সংসার থেকে একটা নীরব ধোঁয়াটে প্রতিবাদ ছিল। ছিল কি! হ্যাঁ ছিল। অস্পষ্ট, কিন্তু তীব্র যা তার মধ্যে সঞ্চারিত হতো একটু বিবর্ণভাবে। আর তাই সংসারের প্রতি ভালোবাসার ও দায়িত্বের একটি পরিবর্তিত রূপ সে নিজের মতো করে দিতে চেয়েছিল। তাতে অর্জিত টাকাই ছিল প্রধান ভূমিকায়। পুঁজিবাদ এই কাজটি দীর্ঘদিন ধরে খুব সাফল্যের সঙ্গে করে আসছে। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। কিন্তু প্রতিবাদ কোথায়! মানুষ তাড়িত হয়েছে আরও আরও ভোগ্যপণ্যের দিকে। মেকআপের নিচে ক্লান্ত মুখগুলো রাতের ঘুম চেয়েছে স্লিপিং পিলের কাছে। অথবা পর্নো ওয়েবসাইট বা সেক্সডল হয়েছে তাদের শয্যাসঙ্গী! তবে তাতে দোষই-বা কোথায়! অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তারও, সবার যেমন হয়! 

তার কলিগদের মধ্যে অনেকেই বিদেশি। অনেকেরই কোনো পরিবার নেই। কারো কারো পরিবারের একটিমাত্র প্রিয়জন, তাদের কুকুর বা বেড়াল। কারো কারো রয়েছে বৃদ্ধ বাবা-মা। তা-ও ওরা রয়েছে উন্নত দেশের উন্নত ওল্ড হোমে। নিজেকে চাকরির খাতিরে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা ভালো না খারাপ, তা নিয়ে সে ভাবতে চায়নি কোনো দিন। এই ভাবনাটার গভীরে যেতে তার সব সময়ই অস্বস্তি ছিল। পুঁজিবাদের দাসত্বে একটা মধুরতা ছিল, যা কখনো বুঝতে দেয়নি, গর্ভের অন্ধ ক্ষুধার প্রশমনই পুঁজিবাদের উদ্দেশ্য। তাই সে ক্রমাগত ছুটেছিল এক অন্ধ গলি থেকে আরেক অন্ধগলিতে, যাকে আপাতভাবে মনে হয় রাজপথ। 
যাহোক, এই সময়ের বিরাট স্থবিরতার মধ্যে কর্মস্থল ছেড়ে তার যে যাওয়াটা হয়ে ওঠেনি, এটা ভেবে ভেবে সে ক্লান্ত বোধ করছে। দেশে ফেরার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল সে। কর্তৃপক্ষ হঠাৎ ফ্লাইট বাতিল করাতে তাকে কর্মস্থলেই থেকে যেতে হলো। অর্গানাইজেশন থেকে বলা হলো, অনলাইনে কাজ করে যেতে। তাই করতে হবে। উপায় নেই। বাধ্য।

ইয়াঙ্গুনের এই বিশাল বিদেশি পাড়ায়, তার সঙ্গে আটকে পড়েছে তারই চেনাজানা আরও দুজন কলিগ। একজন বয়স্ক, তার আবার অ্যাজমার সমস্যা। তাই সে শেষ পর্যন্ত ইউকেতে যায়নি। কোভিড-১৯-এর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে ইংল্যান্ডে। খবরগুলো রীতিমতো ভয়ানক। তিনিও রয়েছেন পাশের বিল্ডিংয়ের একটি ফ্ল্যাটে। গ্রোসারিতে দেখা হয়েছিল সেদিন। দেশে ফিরতে না পেরে, ভীষণ বিষণ্ণ আর গম্ভীর দেখাচ্ছিল তাকে। 
বিশাল ফ্ল্যাটের ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের রাস্তাগুলোকে দেখা যায়। একেবারেই জনমানবহীন। যেন এখানে কোনো দিন ছিল না কোনো বসতি। একেই তো এখানে আর্মি শাসন, তার ওপর লকডাউন চলছে। গতকাল সে নিচের সুইমিংপুলে কিছুটা সময় কাটাতে চেয়েছিল। পরে রোগের প্রকোপের কথা ভেবে, আর নামবার সাহস করেনি। সময় কাটাবার অনেক কিছুই আছে এখানে। বিউটি পার্লার, রেস্তোরাঁ, গ্রোসারি। আসলে সে এখনো কোভিড-১৯-এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। সমস্ত দেশে দেশে লকডাইন। অর্থনীতি চলবে কীভাবে! মানুষ একদিন দোকান বন্ধ রাখে না মুনাফার লোভে। আর এখন! সত্যিই বিশ্বাস হয় না! যেন একটা হরর ফিল্ম চলছে।
নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে, সে কিছুটা হালকা বোধ করে, স্তব্ধ বারান্দায়। দিনে দুপুরে হঠাৎ হঠাৎ তীব্রভাবে ডেকে উঠছে কুকুর! সে বোধ হয় ক্ষুধার্ত। খাবার খুঁজছে। এই বিভ্রান্তিকর সময়ে সে-ও কুকুরটির মতোই ক্ষুধার্ত। ঘরে শুধুই দুটি পিজা ব্রেড রয়েছে। আগের মালিকের রেখে যাওয়া, ফ্রিজে পড়ে আছে। কত দিন আগের! সে এখন বড়ই ক্ষুধার্ত। এক্সপায়ার ডেট দেখে আর নতুন করে বিতৃষ্ণা বাড়াতে চায় না। 

ফ্ল্যাটে একটি চমৎকার পিয়ানো রয়েছে। ঝুলবারান্দার চেয়ারে বসে সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল আধো অন্ধকারের ঘরের ভেতরের দিকে। পিয়ানোটা কালো লম্বা শরীর নিয়ে তার টুং-টাং উপস্থিতিকে নিশ্চিত করল। সে-ও অন্ধকারের ভেতর অন্ধকারের সেই লম্বা শরীরের দিকে তাকিয়ে ভাবল, মন খারাপের ভার কিছুটা কমাতে পারবে। মন চাইলে বসে বসে কিছু সুর তুলতে পারবে। কিন্তু ইচ্ছেই তো করবে না। কে যেন টুটি চেপে ধরেছে যাবতীয় ইচ্ছার।


রোগ-শোক তো আর কম দেখেনি জীবনে! ক্রমাগত এসবের ভেতর দিয়েই যাওয়া। চাকরি সূত্রেও অনেক অভিজ্ঞতা আছে তার। গত বছর আফ্রিকার একটি দেশে গিয়ে ইবোলা ভাইরাসের বিষয়ে অনেক কিছুই জেনেছে সে। কিন্তু সে তো একটু দূর থেকে দেখা! রোগের ভেতরে ঢুকে দেখা নয়। জীবনের আগের ধাপগুলোর সঙ্গে এই ধাপটি যেন একেবারেই বেমানান। কোনো যুক্তিতেই যেন রোগটিকে ফেলা যাচ্ছে না। বারবার জিন পরিবর্তন করছে ভাইরাসটি। কোথাও মারছে বৃদ্ধদের, কোথাও যুবকদের। কখনো আটকে থাকছে প্লাস্টিকে, কখনো মানুষের হাতে। হাত থেকে মুখে, তারপর গলার দিকে ওর আক্রমণ। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় মৃত্যু। খবর দেখে আর সঙ্গে সঙ্গে দেশের আপনজনদের কথা ভেবে, তার মন ক্রমশই অস্বস্তিতে ভরে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করে খবর নেয়। তাতেও জড়িয়ে থাকে অপরাধবোধ। বাসায় কাজের লোককে বিদায় দেওয়া হয়েছে। ছেলে আর বাবা মিলে করছে রান্না, ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, বাথরুম পরিষ্কার। নিজের মনকেই সে প্রবোধ দেয়। মাত্র কদিনের জন্য এই ব্যবস্থা। নিশ্চয়ই পনেরো দিন পর সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। আবার গুগলে সার্চ দেয়। নিউজ দেখে। মৃতের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। লকডাউন অনির্দিষ্টকালের। 

গত কয়েক দিনের অস্থিরতা কাটিয়ে আজ সে একটু স্থিত হলো। হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে কল। এগিয়ে গিয়ে দেখে তার প্রবাসী বন্ধু মিতেল। সে খুব জরুরি কারণে ফোন করেছে। ইয়াঙ্গুন ছেড়ে হঠাৎ চলে যাবার সময় সে তার পোষা বিড়াল ফ্যাটিকে রেখে গেছে আরেকজন কলিগের বাসায়। বিড়ালটি সে বাসায় খুব অস্বস্তি বোধ করছে। কারণ সে এই নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটটিতেই থাকত। এখানে মিতেলের খাটের পাশে তার বসবাসের সকল ব্যবস্থা রয়েছে। গত দুদিন সে ক্রমাগত মিতেলকে খুঁজেছে। মিতেলের ধারণা, নির্দিষ্ট বাসায় থাকলে সে আর মিতেলকে খুঁজবে না। মিতেল আরও বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করল, যেন ফ্যাটিকে সে যত্ন করে রাখে। এ বাসায় ওর খাবার-দাবার, পটি করানোর জায়গা সবই নির্দিষ্ট আছে। টিকাও দেওয়া রয়েছে। ছয় মাসে পর্যন্ত ইউকের ভিসা আছে ফ্যাটির। সমস্যা একটু কমলেই মিতেল ওকে নিয়ে যাবে। মিতেলের কথার উত্তরে না বলার দক্ষতা সে অর্জন করতে পারেনি। তাছাড়া ওর বিদেশি কলিগ এত বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করছিল যে, সকালবেলার এই হোয়াটসঅ্যাপের কল খুব নরম ছেঁড়া ছেঁড়া তুলোর মেঘের মতো মোলায়েম মনে হচ্ছিল। ইউকেতে তখন অনেক রাত। মিতেল টেনশনে ঘুমোতে পারছিল না, ফ্যাটিকে ফেলে রেখে যাবার যন্ত্রণায়। তাই সে বারবার অনুরোধ করছিল। এমন একটি নির্জন নিঃসঙ্গ সময়ে যখন সময়ের পরতে পরতে মিশে আছে বিষণ্ণতা, তখন দূর থেকে কোনো এক প্রবাসী বন্ধুর অনুরোধ সে ফেলতে পারেনি। বিকেল তিনটায় নির্দিষ্ট সময়ে একজন পুলিশ অফিসার ফ্যাটিকে নিয়ে এলো তার পরিচিত ফ্ল্যাটে—যে বিশাল ফ্ল্যাটটির এক নির্দিষ্ট প্রান্তে ফ্যাটির বসবাসের জায়গা। আর এক প্রান্তে সে।

প্রথম প্রথম ফ্যাটিকে সে আপন করে নিতে চেয়েছিল। প্রাণপণ চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু এই কোভিডের সময় ফ্যাটিও যেন তীব্রভাবে মৃত্যুর পথটিকেই বেছে নেয়। মিতেলের সঙ্গে যখন সেলোফোনে ফ্যাটির নীরব উত্তাপ বিনিময় হয়, শুধু সেই মুহূর্তটিতেই ফ্যাটি প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। আর বাকি সময়টা মিতেলের পরিত্যক্ত টেবিলল্যাম্পের সুইচটাকে অনবরত অফ আর অন করাই যেন ফ্যাটির একমাত্র কাজ! কখনো কখনো পটি করার নির্দিষ্ট স্থানটিতে না গিয়ে, সে ইচ্ছে করেই যেত ড্রয়িংরুমে। কাজটি দ্রুত সেরে নিত, আর কার্পেটের একটি কোণ দিয়ে ঢেকে দিত অতি দ্রুত। যেন এই নিদারুণ অবস্থা সে-ও সহ্য করতে পারছে না। তাই এসব প্রতিবাদ। তারপর নিজের ইচ্ছায় খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে একরকম ইচ্ছামৃত্যুর দিকেই চলে গেল ফ্যাটি। মৃত্যুর দুদিন আগে, স্থানীয় পশুডাক্তারের কাছে তাকে হস্তান্তর করেছিল সে।

ফ্যাটির মৃত্যুর খবরটি বুকে নিয়ে সে বারান্দায় বসে আছে। সেলোফোনটিতে আর কোনো উত্তাপ নেই। বারান্দায় একাকী বসে, নিজেকে মনে হচ্ছে স্ট্যাচু। যেন আরও অনেক মৃত্যু খবরের অপেক্ষায় সকাল-সন্ধ্যা-দুপুরগুলো ক্রমশই পাথরতর।