ব্রিটিশ মেজর গ্রিনের উনিশ বছরের সুন্দরী স্ত্রী এলসির সঙ্গে বঙ্গসন্তান মহেন্দ্রর প্রেম একটু একটু করে দারুণ জমে উঠেছিল। তখন এ দেশে ঘোরতর ব্রিটিশ আমল। সাহেবরা নেটিভদের ওপর ছড়ি ঘোরায়, কথায় কথায় ধমকায়, কখনো হাতে মাথা কাটে। আবার খুশি হলে দুহাত ভরে অনেক কিছু দেয় কালো মানুষদের। মেজর গ্রিনের দয়াতেই কেরানির একটি চাকরি পেয়ে গিয়েছিল মহেন্দ্র। মাইনে এক শ টাকা। সেই আমলে এক শ টাকা মানে অনেক টাকা।
বাংলা মুলুকে কাজকর্ম চালাতে গেলে একটু-আধটু বাংলা ভাষা জানতেই হবে বিদেশি শাসনকর্তাদের। মেজরের বাংলার জ্ঞান একেবারেই সুবিধের নয়। সুতরাং বাংলা শেখানোর জন্য ডাক পড়েছিল মহেন্দ্রর। সাহেব ওকে বললেন, তুমি আমাকে বাংলা শেখাও। আমি তোমাকে মাসে কুড়ি টাকা দেব।
মহেন্দ্র এককথায় রাজি। কিন্তু কাকে ভাষা শেখাবে? ভাষা শেখার ব্যাপারে সাহেব মহা ফাঁকিবাজ। নির্দিষ্ট সময়ে কোয়ার্টার্সে গিয়ে সাহেবকে পাওয়া যেত না। সেই অভাব খানিকটা পূরণ করত মেমসাহেব। তাই দেখে সাহেব একটা নতুন পথ পেয়ে গিয়েছিল। এলসিকে বলল, তুমি মহেন্দ্রর কাছ থেকে বাংলাটা শিখে নাও, আমি পরে তোমার কাছ থেকে শিখে নেব।
রাজি হয়েছিল এলসি। কিন্তু ভাষা শিক্ষা কিছুদিনের মধ্যে ঘুরে গিয়েছিল প্রেমলীলার দিকে। এই লীলা এলসির তৎপরতায়। মাঝখানে মেজর অফিসের কাজে করাচি গিয়েছিল দিন পনেরোর জন্য। সেই সময় জমজমাট হয়ে উঠেছিল এলসি-মহেন্দ্রর প্রেমপর্ব।
মহেন্দ্রর নাম মেমসাহেব আর সাহেবের জিবের ধাক্কায় হয়ে গিয়েছিল ‘মোহেন’। একদিন এলসি বলল, ‘মোহেন, আমি দারুণ একটা নভেল পড়ছি, তোমাদের বাংলায় কি নভেল আছে?’
মাথা নেড়ে মহেন্দ্র জবাব দিল, ‘আছে।’
‘তাই! আচ্ছা, ওই নভেলে লাভ-মেকিং আছে?’
ঝলমলে মুখে জবাব দিল মহেন্দ্র, ‘তা আছে বইকি! প্রেমলীলা ছাড়া কি আর নভেল হয়—।’
‘বাহ্ ! তা বাংলা নভেলের নায়িকারা কেমন হয়?’
‘যা হওয়া উচিত, তাই হয়। দেখতে খুব সুন্দরী, তবে বয়সটা একটু কম। ইংরেজি নভেলে নায়িকারা ১৮-১৯। বাংলা উপন্যাসে ১৩-১৪ বছর।
শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল এলসি, ‘এই সব ছোট-ছোট মেয়েরা প্রেম করতে পারে?’
তাল ঠুকে জবাব দিয়েছিল মহেন্দ্র, ‘খুব পারে। আমাদের দেশ তো গরমের দেশ, অল্প বয়েসেই তাই আমরা একটু পাকা হয়ে উঠি।’
কৌতূহলের শেষ ছিল না এলসির। জিজ্ঞেস করল, ‘কার সঙ্গে প্রেম করে ওই সব ছোট মেয়েরা?’
মহেন্দ্রর সোজাসাপটা উত্তর। ‘প্রেম করে বরের সঙ্গে, অথবা যার সঙ্গে বিয়ে হবে তার সঙ্গে।’
শুনে এলসি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠেছিল, ‘এ তো নিতান্তই সেকেলে ব্যাপার। বর বা হবু বরের সঙ্গে প্রেম করে কোনো মজা আছে নাকি?’
জবাবে মহেন্দ্র একটু হেসে উঠে বলেছিল, ‘আমাদের সাহিত্য এখনো তত মজাদার হয়ে ওঠেনি।’
দিব্যি জমে উঠেছিল এলসি আর মোহেনের পরকীয়া প্রেম, কিন্তু আচমকাই সেটা একেবারে কেঁচে যায়। সাহেব ধরে ফেলেছিল মাস্টারমশাই-প্রেমিককে, তারপরেই সাহেবের পকেট থেকে বেরিয়ে আসে পিস্তল। কোনোমতে ছুট লাগিয়ে প্রাণ বাঁচায় মহেন্দ্র। শেষে চাকরি ছেড়ে নিজের গাঁয়ে গিয়ে পাকাপাকি বাস।
এ কাহিনি বিস্তারিতভাবে লেখা আছে সে আমলের জনপ্রিয় লেখক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘যুবকের প্রেম’ গল্পে। আমি এখানে সংক্ষিপ্তসারটুকু দিলাম। রবীন্দ্রনাথ প্রভাতকুমারের লেখা পছন্দ করতেন। পছন্দ করার বড় কারণ ছিল লেখকের পরিচ্ছন্ন রসবোধ, যা তাঁর বেশির ভাগ লেখাতেই থাকত। বিচিত্র বিষয়কে অবলম্বন করে নির্ভার গদ্যে চমৎকার গল্প লিখতে পারতেন প্রভাতকুমার।
‘যুবকের প্রেম’ গল্পটির আগে ও পরে বেশ কিছু রোমাঞ্চকর বৃত্তান্ত আছে, আমি আর সেসবের মধ্যে গেলাম না। উপস্থিত সেই আমলের বাংলা গল্প-উপন্যাসের নায়িকাদের বয়সের দিকেই নজর দিচ্ছি। তখন বাংলা সাহিত্যের পাতায় রোমান্টিক নায়িকা পাওয়া বেশ কঠিন ছিল। নিতান্তই বালিকা বয়সে বাঙালি মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত পটাপট। নিরুপায় হয়ে লেখকদের প্রেমকাহিনি রচনার জন্য পরস্ত্রী বা বিধবাদের দিকে দিকে তাকাতে হতো। তাতেও স্বস্তি ছিল না, সমাজ বড্ড চোখ রাঙাত।
হিন্দুদের মধ্যে বাল্যবিবাহ প্রথা চালু ছিল তখন। মেয়েদের বিয়ের বয়স ছিল সাধারণত আট থেকে এগারো। রীতিটি চলে আসছিল সেই মঙ্গলকাব্যের যুগ থেকেই। মুকুন্দরামের নায়িকা খুল্লনার বয়স বারো পেরিয়ে যেতেই পণ্ডিত এসে রীতিমতো ধমক লাগিয়েছিল মেয়ের বাবাকে। কী ব্যাপার, মেয়ের এত বয়স হয়ে গিয়েছে, অথচ বিয়ের ব্যবস্থা করোনি এখনো!
বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকজন নায়িকা নিতান্তই বালিকা। প্রতাপ ও শৈবলিনী ছিল বাল্যসঙ্গী। বঙ্কিম লিখেছেন, ‘বাল্যকালের ভালবাসায় বুঝি কিছু অভিসম্পাত আছে। ...বার্ধক্যে বাল্যপ্রণয়ের স্মৃতিমাত্র থাকে, আর সকল বিলুপ্ত হয়, কিন্তু এই স্মৃতি কত মধুর।’
রবীন্দ্রনাথের গল্পের বেশ কয়েকজন নায়িকা নিতান্ত বালিকা। বাল্যসঙ্গিনী সুরবালার সঙ্গে ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়কের যখন বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল তখন সুরবালার বয়স ছিল মাত্র এগারো। ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পের হরসুন্দরীর বিয়ে হয়েছিল আট বছর বয়সে। ‘সমাপ্তি’ গল্পের মৃন্ময়ীও ছিল বালিকা। ‘দৃষ্টিদান’ গল্পের নায়িকার বিয়ে হয়েছিল আট বছর বয়সে। ‘অতিথি’ গল্পের চারুশশী ছিল ছোট্ট একটি মেয়ে। ‘হৈমন্তী’ গল্পের হৈমন্তীর বয়স একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল বলে বিয়ের পরে তার বাড়ন্ত গড়ন দেখে রীতিমতো কানাকানি পড়ে গিয়েছিল। দূর সম্পর্কের এক দিদিমা বলে উঠেছিলেন, ‘পোড়া কপাল আমার! নাতবৌ যে বয়সে আমাকেও হার মানাইল।’
ওই কথার জোরালো প্রতিবাদও উঠেছিল। ‘ও মা, সে কি কথা! বউমার বয়স হবে এগারো বই তো নয়, এই আসছে ফাল্গুনে বারোয় পা দেবে। খোট্টার দেশে ডালরুটি খাইয়া মানুষ, তাই অমন বাড়ন্ত হইয়া উঠিয়াছে।’
আসলে হৈমন্তীর বয়স হয়েছিল সতেরো। বিয়ের কনের বয়স হিসেবে সে যুগের পক্ষে মস্ত ব্যতিক্রম।
শরৎচন্দ্রের ‘পথনির্দেশ’ গল্পের হেমনলিনীর বয়স তেরো। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রণয় পরিণাম’ গল্পের নায়িকা কুসুমের বয়স তেরো। তার প্রেমে পড়েছিল হিন্দু বয়েজ স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মানিকলাল। “মানিকের বয়স চতুর্দশ বৎসর। এই বয়সেই সে বাংলা উপন্যাস পড়িয়াছে রাশি রাশি। ‘মৃণালিনী’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘উদ্ভ্রান্ত প্রেম’ হইতে আরম্ভ করিয়া বটতলার ‘পারুলবালা’, ‘সোহাগিনী’, ‘বউরানি’ প্রভৃতি কিছুই আর বাকি নাই।”
প্রেমে কাতর মানিকলাল কুসুমকে নিয়ে কবিতাও লিখেছিল। লিখেছিল, ‘কুসুমলতা মনের কথা শুন সই/ তব মুখখানি দিবারজনী মনে লই।’ গভীর প্রেম, কিন্তু এই প্রেমের পরিণাম সুখের হয়নি। মানিকলালের রাশভারী, নির্দয় বাবা ছেলের প্রেমের কথা শুনে যা বললেন ও করলেন, প্রেমের ইতিহাসে তার বোধ হয় কোনো নজির নেই। ছেলের গালে ঠাস-ঠাস করে কয়েকটা চড় কষিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইস্টুপিড শুয়োর! আজ বাদে কাল এগজামিন—লেখা গেল পড়া গেল, লব্ হচ্ছে?’
মানিকলালের বাবা ছিলেন চিকিৎসক, তাঁর এই বিচিত্র দাওয়াইতে ছেলের প্রেমরোগ দ্রুত সেরে গিয়েছিল। প্রভাতকুমার লিখেছেন, “মানিক ছেলেটিকেও অতি সুবোধ বলিতে হইবে। উপন্যাসের অনুকরণে প্রেমে পড়িয়াছিল, কিন্তু উপন্যাসের অনুসারে গৃহত্যাগ করিল না—বিষও খাইল না। বিষ খাইল না বটে—তবে কুসুমের বিবাহের সময় লুচি খাইল বিস্তর।”
প্রভাতকুমারের অপরূপ এই গল্পটি লঘু রসের, কিন্তু মূল সমস্যাটি বড় জটিল। রোমান্সের ঘরে শূন্য থাকলে বাংলা সাহিত্যের চলে কী করে!
শরৎচন্দ্রের ‘পরিণীতা’র নায়িকা ললিতার বয়স তেরো, এবার সে চোদ্দয় পা দেবে। কিন্তু কথাবার্তায়, চলনে-বলনে রীতিমতো রোমান্টিক নায়িকা। আসলে এই বয়সের মেয়েকে পরিণত নায়িকা হিসেবে মেনে নিতে উনিশ শতকে, এমনকি বিশ শতকের গোড়ার দিকেও, বাংলা সাহিত্য আপত্তি তোলেনি। মূলে আছে এই শতকের বাঙালি লেখকদের অবিমিশ্র শেকসপিয়ার-প্রীতি, যা শুরু হয়েছিল সেই বঙ্কিমের যুগ থেকেই।
সুলেখক ও সুপণ্ডিত নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’ শীর্ষক বইয়ের একটি নিবন্ধে লিখেছেন, তখন শিক্ষিত বাঙালিমাত্রই শেকসপিয়ার পড়াকে ‘ধর্মসংক্রান্ত নিত্যকর্মের মতো মনে করিত।’ এর শুরু হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা থেকেই। কিন্তু নীরদচন্দ্রের মতে তা ‘পূর্ণ পরিণতি’ লাভ করে বঙ্কিমচন্দ্রের সময়ে। “সে জন্যই তিনি ১৮৭৬ সনে লিখিয়াছিলেন, ‘উদ্যান মধ্যে রোমিও জুলিয়েটের প্রণয়সম্ভাষণ জগতে বিখ্যাত এবং পূর্বতন কলেজের ছাত্রমাত্রেরই কণ্ঠস্থ।’”
এই যে রোমিও-জুলিয়েট জুটি, যাদের প্রেমের কথাবার্তা হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মুখস্থ ছিল, সেই জুলিয়েটের বয়স কত? লেডি ক্যাপুলেট ধাত্রীকে জিজ্ঞেস করায় জুলিয়েটের সঠিক বয়সের হিসাব পাওয়া গিয়েছিল। তা হলো তেরো বছর সাড়ে এগারো মাস।
চোদ্দতেও পা দেয়নি, এমন একটি মেয়ে রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছে। প্রেমের সরল, গভীর এমনকি মধুর আবর্ত তৈরিতেও তার ধারেকাছে আসতে পারেনি অনেক বয়স্কা নায়িকাও। সুতরাং নবীন প্রেমিকদের কাছে আদর্শ প্রেমিকার রোল-মডেল হয়ে গিয়েছিল জুলিয়েট। উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাঙালি লেখকরা সাহিত্য রচনায় নায়িকা-সংকটে খুব একটা ভোগেননি, বালিকাদের দিয়ে কাজ চালিয়ে দিয়েছেন দিব্যি। কারণ, তাঁদের সামনে ছিল মনোমোহিনী জুলিয়েট।