আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে চৈতি। বারবার দেখছে।
না, নিজেকে তেমন মোটা তো মনে হচ্ছে না! অথচ উঠতে-বসতে, ঘরে-বাইরে ঘনিষ্ঠ সবাই বলে, ‘ওজন কমাও। এত মোটা হচ্ছ কেন?’
একটা ওজনের মেশিন কিনে এনে ও লুকিয়ে রেখেছিল খাটের তলায়। সেদিন মা মেশিনটা দেখে বলেছিলেন, ‘এটা কী?’
প্রশ্নের জবাব দেয়নি চৈতি। মা নিজেই বলে ওঠেন, ‘ওজন দেখার দরকার নেই। এ বয়সে বেশি খেতে হবে। বেশি না খেলে ব্রেন ভালো কাজ করবে না। তোমাকে রেজাল্ট ভালো করতে হবে না? ওজন নিয়ে ভাবার দরকার কী? এ বয়সে গ্রোথ একটু বেশি হয়। বাড়ন্ত মেয়েদের খেতে হয় বেশি। বাড়ন্ত শরীর একটু মোটা মনে হতে পারে, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।’
মাঝে মাঝে মায়ের কথাটা মনে পড়ে। মনে পড়লে ওর মন আরও খারাপ হয়ে যায়। মা ভালোর জন্য বলেছিলেন, বুঝতে পারে। তবে মায়ের কথার মধ্যেও ছিল ওর মুটিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত।
‘বাড়ন্ত শরীর’ শব্দটা দিয়ে ‘মুটি’ শব্দটার গায়ে মোড়ক পরিয়ে দিয়েছিলেন মা, বুঝতে বাকি থাকেনি চৈতির। বান্ধবীরা ‘মুটি’ বলে। ঘনিষ্ঠজনেরাও ‘মুটি’ ডাকে। সেদিন কলেজের বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় এক ছেলে টিজ করে বলেছিল, ‘মোটা হলেও সুইট!’ ‘মোটা’ শব্দটা শুনে মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। ‘সুইট’ শব্দটা মন আলোড়িত করেনি, মোটা শব্দের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছিল সুন্দর শব্দটা। নিজেকে বারবার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে দেখতে গিয়ে বুঝতে পারে, আসলেই মিষ্টি মুখ ওর। এখন এ ভাবনাটা মুখে হাসি ফুটিয়ে দিল।
শীতের শুরুতে একবার রূপবিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েছিল ও। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার মুখটা বেশ মিষ্টি!’ শরীরের কথা কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। মোটা-পাতলা নিয়ে প্রসঙ্গ না তুলে বলেছিলেন, ‘সৌন্দর্যের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার। নিজেকে ফিট রাখতে হলে পুষ্টিবিদের কথামতো চলতে হবে। সেই সঙ্গে শীতে ত্বকের যত্নও নিতে হবে। যত্ন নিলে মুখের জেল্লা আরও বাড়বে, লাবণ্য বাড়বে, বেশি মিষ্টি লাগবে মুখ। মায়াবী মুখের জয় রয়েছে সর্বত্রই।’ কথাটা শুনে মাথা দুলিয়ে হেসেছিল চৈতি। এ মুহূর্তে মন ছুটে গেল ত্বকের যত্নের দিকে। রূপবিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলার পর প্রতিদিন একটা রুটিন মেনে চলে, প্রতিদিন অন্তত তিনবার ক্লিনজার দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে। এখন বাথরুমে ঢুকে ক্লিনজার দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে নিল ও। তারপর ফেসওয়াশ লাগিয়ে তা ধুয়ে ফেলল। ওর ত্বক স্বাভাবিক। তৈলাক্ত নয়। শুষ্ক ও স্বাভাবিক ত্বকে লাগাতে হয় টোনার। ভুলে কিনে এনেছিল অ্যাস্ট্রিনজেন্ট। অ্যাস্ট্রিনজেন্ট লাগাতে হয় তৈলাক্ত ত্বকে। ভুল পরিচর্যার কারণে ত্বক আরও শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। পরে টোনার নিয়ে এসেছে। টোনার ব্যবহারের পর থেকে ত্বকের উজ্জ্বলতা বেড়ে গেছে, নিজেই বুঝতে পারল চৈতি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে আবার দেখল নিজের মুখ।
বাহ্! অন্য রকম লাগছে। টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছে এবার লাগিয়ে নিল ময়েশ্চারাইজার। আবার আয়নায় দেখল নিজেকে। মোটা হওয়ার দুঃখ ভুলে গেল। মনে জেগে উঠল আনন্দ-আলো। নিজের মধ্যে গতি টের পেতে লাগল। বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা লোপ পেয়েছিল। ইচ্ছা আবার জেগে উঠল। বাসায় থাকলে ঘুম আসবে। বেশি ঘুমালে আরও বেশি মেদ জমে যাবে। ভাবনাটা বিদ্যুৎ-তাড়না ঢেলে দিল মনে। বন্ধ হলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রিহার্সেলের জন্য কলেজের উদ্দেশে ও বেরোনোর কথা ভাবল।
শীতে পরা যায় এমন একটা ড্রেস ওয়ার্ডরোবের ভেতর থেকে টেনে নিল চৈতি। সেদিন মামণি কিনে দিয়েছিল চান্দিনার খদ্দর কাপড়ের তৈরি ফুলহাতা সালোয়ার-কামিজ। হ্যান্ড এমব্রয়ডারি কাজ করা সালোয়ার-কামিজটার রং কালো। কালো রং বেশ মানায় ওকে। কালো ড্রেসই চয়েস করল আজ। গায়ে জড়িয়ে নিল খদ্দর কাপড়ের তাঁতের নকশার শাল। আবার এল আয়নার সামনে। বাহ্! গায়ের রংটা বেশ ফুটে উঠেছে! দুর্দান্ত লাগছে! একটু ঘুরে মাথা বাঁকিয়ে দেহের পাশটা দেখল আয়নায়, পেছনের দিকেও চোখ গেল। দুম করে নিভে গেল আনন্দ-আলো। ধোঁয়াশা জেগে উঠল মনে। নিজেকে ছোটখাটো হাতির বাচ্চা মনে হতে লাগল। এত মোটা ও! না। মোটা না। নিজেকে প্রবোধ দিয়ে চাঙা হতে চায়। ভারী কাপড়ের কারণেই মোটা লাগছে! ভাবতে গিয়ে এবার একটু হালকা হয় মন। যেকোনো মেয়েকেই ভারী কাপড়ে মোটা লাগবে, শীতের কাপড়ে মোটা লাগলে অসুবিধে কী? ভাবনাটা আবার গতি ফিরিয়ে দিল মনে। মাকে বলে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে।
রাস্তায় এসে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে গেল চৈতি। একটা রিকশাও খালি যাচ্ছে না। প্রতিটা রিকশায় যাত্রী বসা। রিকশার সংখ্যাও কম না। অনেকক্ষণ পর এক কিশোর রিকশাচালক সামনে এসে দাঁড়াল।
‘এই! যাবে?’
‘কই যাইবেন, আফা?’
‘সিটি কলেজ, যাবে?’
‘ওডেন।’
রিকশায় উঠে বসল চৈতি।
ওঠার পর জিজ্ঞেস করল, ‘কত নেবে ভাড়া?’
‘আফনে যা দেন।’
‘ওহ্। ঠিক আছে।’ খুশি হয় চৈতি। এত ভালো রিকশাওয়ালা আজকাল জোটে না। এই ছেলে ভালো কথা বলছে। মনোযোগ বেড়ে গেলে রিকশাওয়ালার প্রতি। হালকা গড়নের কিশোর চালক সিটে বসে রিকশা চালাতে পারছে না। ওর হাইট অনুযায়ী সামনের রডের ওপর থেকে রিকশা চালাচ্ছে। একবার প্যাডেল চেপে ডান পাশে নামছে বাঁ পাশ উঠে যাচ্ছে ওপরে; আবার বাঁ পাশ নামছে, ডান পাশ উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। এ ছন্দময় তালে রিকশা চালাতে গিয়ে ওর কাঁধ ও পিঠের পেশি শক্ত হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে। ঘামছে সে। ঘাড়ে দেখা যাচ্ছে ঘাম। মাথা থেকে চুল বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। তেল চিটচিটে পাতলা ময়লা শার্টটাও ভিজে যাচ্ছে ঘামে। শার্ট লেপ্টে আছে দেহের সঙ্গে, পিঠের সব পেশি স্পষ্ট ভেসে উঠছে চোখের সামনে। শীতের কাপড় নেই ছেলেটার গায়ে। পরিশ্রমের কারণে সৃষ্ট দেহের তাপের প্রভাবে শীত ওকে কাবু করতে পারছে না, নাকি শীতের কাপড়ই নেই ওর! পাতলা গড়নের কিশোরটির পড়াশোনা করার কথা, অথচ চালাচ্ছে রিকশা। মায়া জাগল চৈতির মনে।
মায়া নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী নাম তোমার?’
‘আবু সুফিয়ান ডাবলু।’
‘ডাবলু, তোমার বাড়ি কোথায়?’
‘হাতিয়া। মনপুরা।’
‘ওহ্। সাগরপারের ছেলে তুমি?’
‘হ।’
‘সিডরে তোমাদের এলাকা ডুবে যায়নি?’
‘সিডর কী, আফা?’
‘ওহ, সিডর বোঝো না?’
‘না। বুঝি না। তয় ‘ঢল’ বুঝি। ঢলে ভাইসা গেছে আমাগো ঘরবাড়ি, গরুছাগল মানুষজন।’
‘এবারের ঢলের আরেক নাম সিডর। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে লোকালয়ে ফুঁসে আসে পানির ঢল। সাগরের পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষজন। জানো না?’
‘হ আফা। সিডর কারে কয় বুঝছি অহন। মা ছাড়া সংসারে আর কেউ নাই। আব্বা আর ভাইজান ভাইস্সা গ্যাছে ঢলে। ছোড বোইনডারও খোঁজ পাই নাই। আমিও ভাইস্সা গেছিলাম, এক মাইল দূরে পাইছে আমারে।’ বলতে বলতে ওর কথা জড়িয়ে গেল। বুকে কষ্ট এসে হানা দিল।
কথা শুনে আরও মায়া বেড়ে গেল চৈতির মনে। পাতলা গড়নের ডাবলুর ফিগারটাও ভালো। দরিদ্র হলেও কৈশোরের দুরন্ত গতি আছে দেহের ছন্দময় ওঠানামায়। সঙ্গে সঙ্গে নিজের দিকে নজর গেল—মোটা শরীরটার কারণে মনে সুখ নেই। আর ডাবলুর মনে দুঃখ আছে, তবু সুখী মনে হলো ওকে। শরীর নিয়ে অন্তত দুঃখ নেই ছেলেটির।
রিকশা ক্রস করছে ধানমন্ডির ৮ নম্বর ব্রিজ। মনে হচ্ছে টানতে পারছে না, কাত হয়ে যাচ্ছে ডাবলু।
চৈতি প্রশ্ন করল, ‘তোমার কি অসুবিধে হচ্ছে রিকশা টানতে?’
‘হুঁ। কিনারথুন এড্ডু মাজে বইবেন, আফা?’
‘কেন? মাজে বসব কেন?’
‘আফনার শইলডা ভার তো, রিকশা কাইত হইবার চায়।’
‘কী? আমি ভারী? এই! দাঁড়াও! দাঁড়াও!’ খেপে ওঠল চৈতি। ভয় পেয়ে ব্রিজের পাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে দিল ডাবলু।
এক লাফে রিকশা থেকে নেমে এলো চৈতি। নেমেই বলল, ‘বেয়াদপ ছেলে! একদম চড় খাবে।’
অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল ডাবলু।
হনহন করে সামনে এগিয়ে গেল চৈতি। আরেকটা রিকশায় উঠে পড়ল। ডাবলুর ভাড়াটা না দিয়েই উধাও হয়ে গেল রিকশাটা নিয়ে।
ঘর্মাক্ত ডাবলু তাকাল সামনে। ছুটে যাওয়া রিকশাটার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইল।
ও গন্তব্যে প্রায় চলে এসেছিল। অথচ ভাড়া পেল না! আচমকা ঝড় এসেছে। ডাবলুর মনে হলো এটাকেই বলে সিডর। আচমকা হানা দেয়। ঘরবাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এক মাইল ভেসে গিয়েও জীবন বেঁচেছে তার। জীবন বাঁচার আনন্দ কম কথা না। ভাড়া না পাওয়ার মধ্যে আনন্দ নেই। আছে কষ্ট। কষ্ট নিয়ে রিকশা টেনে ও এগিয়ে গেল ধানমন্ডি মাঠের দিকে।
নিজের মস্তিষ্কে জেগে ওঠা হঠাৎ ঘূর্ণির দাপট সামাল দিতে পারেনি চৈতি। সাত নম্বর রোডে মসজিদ বরাবর এগিয়ে যাওয়ার পরই মনটা কেঁপে উঠল। এমন অবিচার করে ফেলল রাগের বশে! এতই খারাপ ও! ভাড়া পর্যন্ত দিল না বানে ভাসা ছেলেটাকে!
নরম হয়ে নতুন রিকশাওয়ালাকে বলল, ‘রিকশাওয়ালা ভাই, ভুল হয়ে গেছে। আগের রিকশার ভাড়া দেওয়া হয়নি। একটু ব্রিজের কাছে যাবেন আবার? চলুন না। আপনাকে ভাড়া বাড়িয়ে দেব।’
রিকশাটা ফিরে আসে। ডাবলুর রিকশা নেই! হাহাকার করে ওঠে চৈতির মন। কোথায় গেল সে? কোথায় খুঁজে পাবে তাকে!
‘ভাই। একটু খুঁজে দেখবেন ওই রিকশাচালক ছেলেটাকে!’
‘কই পামু তারে? মনে অয় সোজা রাস্তায় হে চইল্যা গ্যাছে।’
‘তাহলে ওই দিকেই যান।’
রিকশাওয়ালা ডানে ঘুরে ধানমন্ডি মাঠের দিকে এগিয়ে গেল। না। নেই। কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে কিশোরটিকে? রেগে গিয়ে ডাবলুকে চড় মারতে চেয়েছিল, চড় দিতে পারেনি চৈতি। ডাবলুই ‘করুণ-কথার চড়’ মেরে গেছে ওর মুখে। মোটা ফিগার নিয়ে মনে যাতনা থাকে সব সময়। এখন যাতনা নেই, চাপা পড়ে গেছে নিজের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের তলে। এত পাষাণ ও! সিডরে কেড়ে নিয়েছে ডাবলুর সব। চৈতির মনে হলো, হঠাৎ ফুঁসে ওঠা মেজাজের সিডরও কেড়ে নিয়েছে ওর মনের সুখ, আনন্দ। নিজেকে শাস্তি দিতে ইচ্ছা করছে। হঠাৎ মনে হলো, না রিকশায় যাবে না। হেঁটে যাবে কলেজে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল সামনে। চোখ খুঁজতে লাগল পাতলা গড়নের কিশোরটিকে।
পুরো পথে রিকশাটা চোখে পড়েনি। গায়েব হয়ে গেছে ডাবলু। ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে মন। খারাপ মন নিয়ে ক্যাম্পাসে এলো ও। শীতেও ঘামছে। ভালো লাগল নিজের শরীরের ঘাম দেখে। এমন করে হাঁটা হয় না কখনো। হয় রিকশা, না হয় সিএনজিতে চলাফেরা করে ও। নিজেকে সাজা দেওয়ার জন্য হেঁটেছে। হাঁটা তাকে পুরস্কার দিয়েছে। ঘামছে ও ডাবলুর মতো। ডাবলুর মতো পরিশ্রম না হলেও বুঝতে পারল রোজ হাঁটতে হবে। লালমাটিয়া থেকে হেঁটে হেঁটে আসতে হবে কলেজে। কলেজ থেকে হেঁটে যাবে বাসায়। ডাবলুকে ভাড়া না দেওয়া আর দুর্ব্যবহারের শাস্তি এটাই ও বরাদ্দ করল নিজের জন্য।
দুই.
ক্যাম্পাসে ঢোকার আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অবাক হলো চৈতি। সব অজানা মানুষজনের ভিড়―আর্মি, র্যাবের সদস্যদের দেখা যাচ্ছে। কলেজ বন্ধ আজ।
হঠাৎ ব্যানার দেখে বুঝতে পারল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য একদল সেনাসদস্য কাজ করছেন। জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছেন ধানমন্ডি এলাকার মানুষজন। দেখেই ভালো লাগল। ভালো লাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। একটা কিশোর এসে বলল, ‘আপু, একটু জায়গা দেবেন? আপনি তো পুরো রাস্তা দখল করে আছেন।’
চট করে মাথা ঘুরিয়ে চৈতি দেখল কিশোরটিকে। বেশ স্মার্ট, বনেদি ড্রেস গায়ে, পরিচ্ছন্ন ছেলেটা ডাবলুর বয়সের হবে। সপ্রতিভ চাহনি। কথাবার্তায় ঝরঝরা। তার কথা শুনে ডাবলুর কথা মনে হলো আবার। ছেলেটার ওপর ওভাবে রাগ করা উচিত হয়নি। ভাড়া না দেওয়া তো অপরাধই। অপরাধী মন এখন খেপে উঠতে পারেনি। ‘পুরো রাস্তা দখল করে আছেন’ কথাটার অর্থ কী? ও যে মোটা, সেই কথাই কি স্মরণ করিয়ে দিল ছেলেটি! ও তো টিজ করার জন্য বলেনি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেছে। সত্যি কথা বলেছে। সত্য মানার শক্তি নেই কেন? নিরীহ ডাবলুর ওপর রাগ ঝেড়েছে, এ বনেদি ঘরের ছেলের ওপর তো রাগ দেখাতে পারল না! দুর্বলের ওপরই অবিচার করল ও! উহ্ মাথাটা ধরে যাচ্ছে। ধরা মাথায় রাস্তার এক পাশে সরে দাঁড়াল। এ সময় দেখতে পেল রুহিনাকে। হালকা-পাতলা রুহিনাকে খুব ভালো লাগে ওর। রুহিনাও ওকে বেশ পছন্দ করে। ‘মোটা-চিকনের বন্ধু’ অথবা ‘চিকন-মোটার বন্ধু’—এ ধরনের কথা ছুড়ে দিয়ে অনেকে মজা করে। প্রথম প্রথম গায়ে মাখত। কষ্ট হতো। এখন সয়ে গেছে, পাত্তা দেয় না ওসব। অথচ ডাবলুর কথায় চট করে মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল। ভাবনাটা আসার সঙ্গে নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে। হেয় মনে হচ্ছে।
রুহিনা বলল, ‘তোকে আজ দারুণ লাগছে, চৈতি!’
চৈতি প্রশ্ন করল, ‘শাল, না সালোয়ার-কামিজ? কোনটা?’
‘আরে না। তোকে দারুণ লাগছে, ড্রেস না।’
‘কী দারুণ লাগছে, মোটা ফিগার, না মুখটা?’
‘পুরোটাই আজ দারুণ।’
‘খুশি করতে চাচ্ছিস আমাকে?’
‘না। খুশি করতে যাব কেন, দারুণ লাগছে তোকে। তাই প্রশংসা করলাম।’
‘তোকেও জোস লাগছে। তোর গায়ের শালটা কোত্থেকে কিনেছিস?’
‘কে-ক্র্যাফট থেকে। অবশ্য এটি নরসিংদীর শাল। কে-ক্র্যাফটে পাওয়া যায়।’
‘এ ডিজাইনটার নাম কী?’
হাসতে হাসতে রুহিনা বলল, ‘জ্যাকার্ড ডিজাইন। পছন্দ হয়েছে তোর? কিনবি?’
‘কিনতে ইচ্ছে করছে। তবে মানাবে না, আরও হাতির বাচ্চার মতো লাগবে আমাকে।’
‘আজেবাজে বকিস কেন? তোকে মোটা বলে কে? এমন ফিগারই ভালো। আমার মুখটা দেখিস না কেমন ভেতরে বসা, বুকের হাড্ডি বেরিয়ে আছে। হিপবোন ছাড়া পেছনে তো আর কিছু নেই। হাড্ডি। হাড্ডি-মেয়ে আমি। তোর মতো মোটা হতে স্বাদ জাগে। কত যে চেষ্টা করছি, পারছি না।’
‘চুপ। ধমক দেয় চৈতি। কে বলেছে তুই হাড্ডি-মেয়ে? তুই হচ্ছিস স্লিম, অনিন্দ্য সুন্দরী। তোর মতো ফিগার বানাতে পারলে বিশ্ব জয় করে নিতাম আমি।’
‘সর্বনাশ! কখনো এমন ভাবিস না।’
‘কেন? স্লিম থাকার মজা একা ভোগ করতে চাস তুই? বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার সময় শীর্ষ বিজয়িনীকে দেখিসনি, কেমন হাড্ডিসার দেহ, অথচ কী সুন্দর দেখতে!’
‘দূর! কিসের সঙ্গে কী তুলনা করিস!’
‘সত্যের সঙ্গে তুলনা করছি আরেক সত্যের। এ জন্য আমি চাই তোর মতো পাতলা গড়নের ফিগার বানাতে। এটা আমার জনমের সাধনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের কথার খোঁচা থেকে বেরোতে চাই।’
‘মানুষের কথার খোঁচা কি আমাকে কম খেতে হয়! উঠতে-বসতে সবাই বলে হাড্ডি-মেয়ে। কেন তুই হাড্ডি সাজতে চাস?’
‘আরে হাড্ডিতেই মজা! দেখিস না, দলে দলে ছেলেরা তোর প্রেমে পড়ে যায়! আর আমাকে তো আজ পর্যন্ত কেউ অফারই করল না!’
‘ওহ্! এটাই তোর দুঃখ!’
‘হ্যাঁ। গোপনে দুঃখ তো আছেই। গোপন-দুঃখ কি তাড়ানো যায়? তা গোপনেই ভোগায়। আমিও ভুগছি।’
‘ঠিক আছে, তোর জন্য পার্টনার জোগাড় করে দেব।’
‘জোগাড় করে কি আর সম্পর্ক হয়?’
‘আরে হয়। চিকন গড়নের ছেলেরা মোটা গড়নের মেয়েদের পছন্দ করে। আর মোটারা পছন্দ করে চিকন মেয়েদের। মোটা মোটা ছেলেরাই আমাকে প্রপোজাল দেয় বেশি। তুই কি মোটা ছেলে পছন্দ করবি?’
‘ওরে বাবা! নাহ্। মোটা ছেলে আমার চোখের বিষ!’
‘তো, দেখবি, পাতলা ছেলে জুটে যাবে তোর কপালে।’
‘জোটার দরকার নেই। ফিগারটা পাতলা করতে পারলে নিজেই আনন্দ পাব। ওই আনন্দই পেতে চাই এখন।’
এ সময় একজন আর্মি অফিসার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। চৈতি চোখ ঘুরিয়ে দেখতে বাধ্য হলো অফিসারটির দিকে—লম্বা মেদহীন পেটানো শরীর দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলে ও।
রুহিনা বলল, ‘এই! এমন নির্লজ্জের মতো তাকাচ্ছিস কেন?’
‘বাহ্! সুন্দর মেয়েদের দেখলে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে থাকে না ছেলেরা? মেয়ে হয়ে কি অপরাধ করেছি নাকি? সুন্দর পুরুষ দেখতে পারব না আমরা?’
রুহিনা বলল, ‘আস্তে বল। পাশের লোকজন বুঝে ফেলবে আমাদের কথা।’
‘বুঝুক। কে কী বলে দেখি?’
‘দেখার দরকার নেই। চল, ফিরে যাই। রিহার্সেল বাতিল হয়ে গেছে আজ।’
‘তুই গাড়ি এনেছিস, রুহিনা?’
‘গাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেছে। রিকশায় ফিরব। চল। তোকে ২৭ নম্বরে নামিয়ে দেব। একসঙ্গে যাই।’
চৈতি বলল, ‘না। তুই রিকশায় যা। হেঁটে যাব আমি। প্রতিজ্ঞা করেছি।’
‘ওজন কমানোর জন্য হাঁটবি?’
‘ওজন কমানোটা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। মূল বিষয় হচ্ছে নিজেকে সাজা দেওয়া। আসার পথে এক কিশোর রিকশাচালকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। ঘটনাটা ভুলতে পারছি না। নিজেকে শাস্তি দিয়ে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।’
‘ঠিক আছে। অন্যদিন সাজা দিস নিজেকে। রিকশায় ওঠ আজ।’
‘না। হাঁটব আমি। হেঁটেই যাব। তুই স্লিম না হলে তোকেও হাঁটতে বলতাম। যেমন আছিস তেমন থাক তুই। মুটিয়ে যাসনে, এর চেয়ে বেশি চিকনও হোস নে।’
রুহিনা আবার বলল, ‘তাহলে আর কিছুটা সময় তোর সঙ্গে কাটাই।’
‘কোথায় যাবি?’
‘স্টার কাবাবে চল। শিককাবাব আর পরোটা খাব। বসে গল্পও করা যাবে।’
চৈতি বলল, ‘যেতে পারি। তবে খাব না। জিবটা শাসন করতে হবে। তুই খাবি, আমি দেখব। খাওয়ার লোভ সামলানোর ট্রেনিং নিতে হবে। না খাওয়ার ইচ্ছাটা জাগিয়ে তুলতে হবে। পুষ্টিবিদ বলেছেন, হোল্ড ইয়োর টাং, মুখ সামলে চলো—ওজন কমে যাবে।’
‘ঠিক আছে, চল যাই। দেখা যাক। না খেলে না খাবি। স্টার কাবাবের দোতলায় বসে আড্ডা দেওয়া যাবে। এ সময় ভিড় কম থাকে।’
তিন.
দুজনে চলে এলো স্টার কাবাবের দোতলায়। ধানমন্ডির এ জায়গাটা তরুণদের জনপ্রিয় আড্ডার স্থান হয়ে গেছে। অনেক তরুণ-তরুণী আসে। কিশোর-কিশোরীর দল আসে। হইহই করে আড্ডা দেয়। অনিরাপদ তেমন কিছু দেখেনি। দীর্ঘদিন ধরে এখানে আসে ওরা।
শিককাবাবের অর্ডার দিল রুহিনা।
চৈতি বলল, ‘তোর একার জন্য অর্ডার দে। আমি তো খাব না, বলেই এসেছি।’
‘আজ খেয়ে নে। আগামী দিন খাস নে।’
‘মাথা খারাপ! ডিসিশন ইজ ডিসিশন। প্রশ্নই ওঠে না।’
‘তাহলে আমি খাব, তুই দেখবি—সেটা শোভন হবে?’
‘শোভন না হোক। তবু খাব না।’
‘ঠিক আছে, আইসক্রিম খা তুই।’
‘না। আইসক্রিমে ফ্যাট বেশি। ওটা চলবে না।’
‘লাচ্ছি? লাচ্ছি খা।’
‘না, লাচ্ছিও চলবে না।’
‘তো, কোক খাবি?’
‘না। কোকেও ক্যালরি বেশি। পুষ্টিবিদ বলেছেন।’
‘তাহলে কী করবি। এক কাজ কর। ঠান্ডা পানি দিতে বলি।’
‘হ্যাঁ। সেটা বল। একটা একমি মিনারেল ওয়াটার দিতে বল। আর হ্যাঁ, শিককাবাব দুটোর অর্ডার দিয়েছিস। একটার বেশি খাবি না। একটা প্লেটে রেখে দিবি।’
‘কেন? প্লেটে রাখব কেন?’
‘কারণ, বেশি খেলে মোটা হয়ে যাবি। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে হলে মোটা হওয়া চলবে না। চিকনই থাকতে হবে তোকে। মোটাদের একদম সহ্য করতে পারি না। আমাকেও আমি সহ্য করতে পারি না মোটা ফিগারের কারণে। মনে রাখিস।’
‘শুকিয়ে গেলে তোকেও ভালো লাগবে না। বেশি শুকানোর ঢঙ করবি না। শুকিয়ে গেলে তোর প্রতি মনের টান কমে যাবে আমার।’ বলল রুহিনা।
কাবাব চলে এসেছে টেবিলে। সঙ্গে পরোটা। কাঁটাচামচের মাথায় গেঁথে কাবাব মুখে পুরে নিচ্ছে রুহিনা। কামড় বসাচ্ছে পরোটায়। কাবাব-পরোটার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
মিনারেল ওয়াটার খেলে পেটে খাবার ইচ্ছা মোচড় দিয়ে ওঠে। চৈতিরও ইচ্ছা তেড়ে উঠতে লাগল। কাবাবের ভিন্ন ধরনের গন্ধ নাক দিয়ে ঢুকে চৈতির মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। পেটের মোচড় এবং গন্ধটা খিদার তীব্রতা বাড়িয়ে দিল। খাওয়ার ইচ্ছার সিগন্যাল পাঠিয়ে দিয়েছে ব্রেন। কাবাবের দিকে শকুনের মতো চেয়ে আছে চৈতি। জিব ভিজে যাচ্ছে।
রুহিনা বলল, ‘কি রে, খাবি? অর্ডার দেব?’
চুপ করে আছে চৈতি।
রুহিনা বলল, ‘আজ খেয়ে নে তো। সামনের দিন থেকে প্রতিজ্ঞা পালন করিস। একদিন খেলে কিছু হবে না।’
নরম হয়ে গেল চৈতির মন। রুহিনার কথায় নরম হয়নি। বরং নিজেকে ছোট লাগছে। প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে পারছে না বলে খেতে ইচ্ছা হচ্ছে, লোভ হচ্ছে। ভয়ানক লোভ জেগে উঠেছে। খাওয়ার এ ইনস্টিংক্টটা কি কেবলই ব্রেন থেকে আসে? এত বেপরোয়া সিগন্যাল জেগে উঠল কেন?
চৈতি বলল, ‘ঠিক আছে। তোর কথা রাখছি। আমার জন্য অর্ডার দে। বলতে বলতে টিস্যু-পেপার জড়িয়ে এক টুকরা কাবাব ওর প্লেট থেকে তুলে পুরে দিল মুখে। চৈতির মনে হতে লাগল সঙ্গদোষে ছেলেমেয়েরা মাদকে জড়িয়ে যায়। তবে কি সঙ্গদোষের কারণে সে-ও জড়িয়ে যাচ্ছে খাবার-নির্ভরতায়? এমন টান কেন এলো? আজ খেয়ে নিই—এ ইচ্ছাটা কেন হলো? পুষ্টি-আপা ঠিকই বলেছেন, মুখ ও জিবকে শাসন করতে হবে। জিবকে শাসন করা না গেলে ওজন কমানো যাবে না। অবুঝ দরিদ্র কিশোরও ইঙ্গিতে বলে ফেলেছে ও ভারী। আর বাকি থাকল কী? ওজন কমাতেই হবে। কঠিন সত্যের প্রাচীর ভেঙে দেবে ও। প্রমাণ করে ছাড়বে—নিজের ওজন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।’
কাবাব চলে এসেছে। খেল। এক প্লেট খেয়ে তৃপ্তি মিটল না। আবার খেতে মন চাচ্ছে। রুহিনাকে বলল, ‘আরও খাবি?’
‘না। আর না। খাবার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। একদম না খাওয়া কোনো ডায়েটিং না। নিয়ন্ত্রণে রেখে খাওয়ার নামই ডায়েটিং। আমার মামা মোটা ছিল। ডায়েটিং করে শুকিয়েছে। তুইও ফর্মুলাটা ব্যবহার করে দেখতে পারিস।’
‘ফর্মুলা কোথায় পাব?’
‘ওই তো, সামনে ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালের লবিতে চার্ট দেওয়া আছে, লিফলেটও সাপ্লাই দেয় ওরা।’
‘হাতে সময় আছে। চল, ওখান থেকে একটা লিফলেট নিয়ে আসি’, বলল চৈতি।
রুহিনা বলল, ‘হ্যাঁ এটুকু পথ হেঁটে যাওয়া যাবে। আর একটু বোস। দেখছিস না, জুটিরা আসছে। দেখ ওদের। দেখে চোখ জুড়িয়ে নিই।’
‘অন্যকে দেখে চোখ জুড়াতে চাই না। নিজেকে দেখেই তৃপ্ত হতে চাই।’
‘নিজেকে দেখে তৃপ্ত হওয়া সোজা। নিজের ত্রুটি চোখে পড়ে না। মনে হয় সবই সুন্দর। অন্যদের কমেন্টে সেই সৌন্দর্য পালিয়ে যায়।’
চৈতি মেনে নেয় রুহিনার কথা। সামনে তাকিয়ে দেখে একটা টিনএজ জুটিকে। দুজনই নাদুসনুদুস। ওদের দেখে মন ভালো হয়ে গেল। ভারী গড়নের মেয়েদেরও তাহলে অ্যাফেয়ার হয়! হতাশ হওয়ার কিছু নেই। নিজের এ অনুভূতির কথা জানাল না রুহিনাকে।
রুহিনা নিজ থেকে বলল, ‘তোর সামনের দিনে সুবাতাস বইবে।’
‘সুবাতাস কেন? কুবাতাস আসতে পারে না?’
‘সু’ থাকলে ‘কু’ও থাকতে পারে। ‘সু’ ঘূর্ণি তো আরও ভয়াবহ! ‘কু’ ঘূর্ণির চেয়েও বিধ্বংসী।
এটা আবার কী ধরনের কথা?
‘আগে “সু” আসুক। তারপর উত্তর পাবি। সামনের মোটা জুটিটাকে দেখ্—“সু”র আগাম বার্তা পাচ্ছি আমি।’
‘তাহলে, উঠি, “সু” অর্জনের পথে এগিয়ে যাই। আগে হসপিটালে চল।’
রুহিনা রাজি হয়ে গেল। দুজনেই উঠে দাঁড়াল।
ওদের মনে হয় ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে বসা প্রত্যেকের চোখ নড়ে উঠেছে। চৈতি বলল, ‘দেখ, সবাই দেখছে আমার বেঢপ ভারী ফিগার।’
রুহিনা ফিসফিস করে বলল, ‘তোকে না, তুই তো অনেক সুন্দর! আমাকে দেখছে! আমার কাঠির মতো দেহটা দেখছে।’
‘এই! তুই কি কাঠির মতো নাকি?’
‘হ্যাঁ। ও রকমই। এক কাজিন বলেছে, আমাকে নাকি দেখতে ম্যাচের শলার মতো লাগে—দেহটা কাঠি, আর মাথাটা বারুদের কালো টুপি। এ জন্য ও আমাকে ডাকে “ম্যাচের শলা”।’
‘আরে। ওই শলার ক্ষমতা তো সে দেখেনি। একবার স্পর্শ করলেই আগুন জ্বলে উঠবে ফোঁস করে। কাজিনটা ছেলে, না মেয়ে?’
‘ছেলে।’
‘তাহলে ওর দেহে লাগিয়ে দিস আগুন। দেখিয়ে দিস ম্যাচের শলার ক্ষমতা। ছেলেরা বলে, চিকন গড়নের মেয়েরা বেশি সেক্সি। বেশি পোড়াতে পারে ছেলেদের। বেশি জ্বলে, বেশি জ্বালায়।’
চৈতির কথা শুনে হাসল রুহিনা। হাসতে হাসতে স্টার কাবাবের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় নেমে রুহিনা বলল, ‘কই, টিনএজ শেষ হয়ে যাচ্ছে—এখনো তো কাউকে জ্বালাতে পারলাম না। নিজেও জ্বলে উঠলাম না।’
‘আরে। জ্বালিয়ে দিয়েছিস ঠিকই। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তোর সেই কাজিন। এ জন্য আর এগোতে পারেনি।’
‘ঠিক বলছিস?’
‘হুঁ। একদম ঠিক কথা। বাজিয়ে দেখিস একদিন। তোর আর মোটা হওয়ার দরকার নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তো দেহে একটু মেদ জমবে। তখন আরও আকর্ষণীয় লাগবে তোকে। খেয়াল রাখতে হবে, বেশি মেদ যেন জমে না যায়! দেখিস না, ফেলে আসা সময়ের তারকা মডেলরা কেমন মুটিয়ে গেছে! ওদের কেমন লাগে এখন!
চৈতির কথায় সায় দিয়ে রুহিনা বলল, ‘হ্যাঁ। মেদ এমনিতে জমবে। মেদ জমানোর জন্য চিন্তা নেই।’
‘জমানোর চিন্তা না থাকলেও কমানোর চিন্তা তো করতে হবে। দিনে দিনে তো আস্ত একটা হাতির মতো হয়ে যাবে দেহ।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই ওরা চলে এলো হাসপাতালে। লবি থেকে একটা চার্ট নিয়ে পড়তে লাগল দুজনে। রুহিনা বলল, ‘ওরে বাবা! এ যে দেখছি একদম ক্রাশিং ডায়েট চার্ট!’
চৈতি খুশি হয়ে বলল, ‘ক্রাশই হতে চাই।’ বলতে বলতে চার্টের ওপর চোখ বোলায় : সাত দিন প্রোগ্রামের প্রথম দিন হচ্ছে প্রস্তুতি পর্ব—মনের সঙ্গে যুদ্ধ। এ যুদ্ধের একমাত্র ডায়েট হচ্ছে ফ্রুটস, এটাকে বলে ‘ফল দিবস’। কলা ও ডাবের পানি বাদে মোটামুটিভাবে খাওয়া যাবে সব ধরনের ফল, যেমন পেঁপে, কমলা, তরমুজ, আম বা আনারস। অন্যান্য ফল বা ফলের রসও খাওয়া যাবে। দ্বিতীয় দিন হচ্ছে ‘সবজি দিবস’। বেশি বেশি সবজি খেতে হবে। সেই সঙ্গে খেতে হবে প্রচুর পানি। অল্প অল্প করে বারে বারে খেতে হবে পানি। আলু বাদে হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, সব ধরনের সবজি চলবে, যেমন টমেটো, কাঁচা পেঁপে, বরবটি, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, ডাঁটা, শসা, এমনকি তিতা সবজি করোলাও চলবে। মাছে-ভাতে আসক্ত আমাদের মন হাহাকার করবে ভাতের জন্য, মাছ কিংবা ডিমের জন্য। হাহাকার শাসন করতে হবে শক্ত হাতে। মনের মধ্যে জোরালো শক্তি জাগিয়ে তুলতে হবে—এটুকু পড়েই উল্লসিত হয়ে ওঠে চৈতি। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। মনে হতে থাকে ওজন কমানো কোনো ব্যাপারই না। ভারী দেহটাকে সাইজ করে ফেলবে ও। নিশ্চিত বিশ্বাস আসন গেড়ে বসল মনে।
রুহিনা বলল, ‘এত খুশি হয়ে গেলি কেন?’
‘খুশি হব না? ফর্মুলা পেয়ে গেছি হাতে। এবার সব সামর্থ্য খাটাব এ ফর্মুলাতে। এসব কৌশলকে জীবনের অংশ বানিয়ে ফেলব। তোর মামা ওজন কমাতে পারলে আমি পারব না কেন? আমাকেও পারতে হবে।’ বলতে বলতে তৃতীয় দিন থেকে সপ্তম দিনের নিয়মের ওপরও চোখ বোলায় ও। উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। ঝলমল করে ওঠে চোখ-মুখ। মনে হচ্ছে, বিশ্ব জয় করে নিয়েছে ও। জয় করে তা ভরে নিয়ে যাচ্ছে হাতের মুঠোয়। লিফলেটে একবার চুমু দিয়ে সযত্নে হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল ও।
চার.
প্রথম দুই দিন পার করে দিয়েছে চৈতি। ক্রাশ প্রোগ্রামে এখনো সফল ও। আজ তৃতীয় দিন। তৃতীয় দিনে কষ্ট কম হবে মনে হচ্ছে। মসলা ছাড়া সামান্য তেল দিয়ে ভেজিটেবল স্যুপ খাওয়া চলবে আজ। এই তৃতীয় দিন হচ্ছে মিক্সড ডে-ফল ও সবজি দিবস। দুটোই চলবে। তবে আগের মতো কলা ও আলু বাদ রাখতে হবে খাবারের মেনু থেকে। ঝরঝরা লাগছে নিজেকে, হালকা বোধ হচ্ছে। ভাতে লোভ আছে। লোভ সামাল দেওয়া যাচ্ছে। সুন্দর ফিগারের জন্য সব ত্যাগ করতে পারে। হাতের কাছে পাওয়া গেছে বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা, গবেষণার ইতিবাচক ফলাফল। এ গবেষণার সুযোগ অবশ্যই নেবে ও। প্রতিজ্ঞা আরও শাণিত করে ঘর থেকে বেরোনোর পরিকল্পনা করে। এ সময় মা এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এটা কী সিস্টেমের ডায়েটিং? একদম খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ!’
‘ডায়েটিং নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাকে ভাবতে দাও। আমার রেজাল্ট ভালো হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে খোঁজ রাখো। অন্য কোনো বিষয়ে মাথা ঘামিয়ো না, মা।’
কথা শেষ করে বেরিয়ে এলো চৈতি। প্রাইভেট টিচারের বাসার উদ্দেশে রওনা হয়। বাইরে এসে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময় পাশের বাসার শাহেরা আন্টি সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনিও খুঁজছেন রিকশা।
হঠাৎ শাহেরা আন্টি বললেন, ‘মুখটা এত শুকনা লাগছে কেন, মা? মন খারাপ?’
আন্টির কথা শুনে খুশিতে ঝলমল করে উঠল চৈতি। মুখ শুকনা লাগছে শুনে দেহের ভেতর থেকে বিজয়ের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেল ও। টুপ করে আন্টির পা ধরে সালাম করে বলল, ‘দোয়া করবেন আন্টি। ওজন কমানোর চেষ্টা করছি। আজ তৃতীয় দিনে পা দিয়েছি।’
‘ডায়েটিংয়ের কথা ভাবছ কেন? তুমি তো তত মোটা নও।’
আবার অফ হয়ে গেল চৈতির মন। ‘মোটা’ শব্দটা শুনতেই পারে না সে। ‘তত মোটা না’ শুনেও নিজেকে মুটি মনে হচ্ছে। ছেলেদের টিজ তো আছে, বান্ধবীরাও ‘মুটি-মেয়ে’ ডাকে। এ শব্দবাণ থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই শুকাতে হবে। কোনো ছাড় নেই, এ যাত্রায় কমপক্ষে পাঁচ কেজি ওজন কমিয়েই ছাড়বে ও। তারপর ধীরে ধীরে চলবে সাধনা, স্লিম হওয়ার সাধনা থেকে কেউ সরাতে পারবে না।
এ সময় একটি রিকশা এসে দাঁড়াল।
চৈতি বলল, ‘আপনি ওঠেন। আমি পরের রিকশায় যাব।’
শাহেরা চৌধুরী বললেন, ‘কোন দিকে যাবে তুমি?’
‘কলাবাগান।’
আমি মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে যাব। রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘যাবেন ভাই?’
রিকশাওয়ালা বলল, ‘না আফা। হেই দিকে যামু না। কলাবাগান যাইবার পারি।’
রিকশায় উঠে বসে চৈতি। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে রিকশা। মধ্যবয়সী জোয়ান রিকশাওয়ালা শাঁই শাঁই করে উড়ে যাচ্ছে যেন। নিজেকে অনেক হালকা মনে হচ্ছে। চৈতি ভাবে, পাঁচ টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দেবে। সুখের অনুভূতি জাগিয়ে দেওয়ার জন্যই এ বাড়তি ভাড়া দেওয়ার পরিকল্পনা করে ও। রিকশাওয়ালা শাহেরা আন্টিকে বাদ দিয়ে ওকে গুরুত্ব দিয়েছে, বুঝতে পেরেছে ও। কৃষি মার্কেটে না যাওয়ার কোনো কারণ নেই। কমবয়সী মেয়ে পেলে বয়স্ক নারীকে কেন নেবে সে? ঠিক কাজই করেছে রিকশাওয়ালা।
রিকশা মুহূর্তেই উড়াল দিয়ে চলে এসেছে কলাবাগানে। চৈতি বলল, ‘ভাড়া কত?’
‘পনেরো টেহা দেন।’
একটা ধাক্কা খেল চৈতি। প্রতিদিন আসে দশ টাকায়। বিশ টাকার একটা নোট বের করে চৈতি বলল, ‘পুরোটা নিন। দশ টাকা বকশিশ। দশ টাকা ভাড়া।’
রিকশাওয়ালা খুশি হয়ে বলল, ‘বকশিশ দিলেন ক্যান, আফা?’
‘সেটা আপনার জানার দরকার নেই। দেওয়ার ইচ্ছা হয়েছে। দিলাম। এখন যান।’
প্যাডেল ঘোরায় রিকশাওয়ালা। মনে মনে নিজেকে জয়ী ভাবে চৈতি।
টিচারের বাসায় ঢুকতে গিয়ে গলির মোড়ে দেখল এক দোকানে বিক্রির জন্য রাখা সাগর কলা ঝুলছে। আগামীকাল ডায়েটিংয়ের চতুর্থ দিন, কলা দিবস। গেল তিন দিন কলা নিষেধ থাকলেও চতুর্থ দিনে কলা চলবে। সর্বোচ্চ দুই হালি কলা খাওয়া যাবে। সঙ্গে খেতে হবে কমপক্ষে তিন গ্লাস দুধ। ভাবল, পড়া শেষ করে এখান থেকে কলা নিয়ে বাসায় ফিরবে।
পড়তে বসে আজ মনোযোগ টের পাচ্ছে বেশি। মন খুশি থাকলে মনোযোগ বেড়ে যায়। নিজেকে মনোযোগী ভাবতে পেরে প্রত্যয়দীপ্ত হয়ে উঠল মন। সব দিকে জয়ী হচ্ছে। প্রতিজ্ঞা করে ধরে রাখতে হবে এ জয়ের ধারা।
কলা নিয়ে বাসায় ফিরে এলো চৈতি। আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে বলতে হবে মাকে। ডায়েট চার্টের বিশদ বর্ণনা তুলে ধরে মাকে বলল, ‘পঞ্চম দিনে মাংস চলবে খানিকটা গরু কিংবা খানিকটা মুরগিতে আপত্তি নেই। তবে মাংসটা রাঁধতে হবে টমেটো, লাউ কিংবা কুমড়ো দিয়ে। মাংস রান্নার সময় তেল-মসলা বাদ দিতে হবে। পরিমাণ হতে হবে কম। সঙ্গে পানি খেতে হবে প্রচুর।’
মা বললেন, ‘তেল-মসলা ছাড়া কীভাবে রাঁধব মাংস?’
কীভাবে রাঁধবে জানি না। রাঁধতে হবে, ‘সেটাই জানিয়ে রাখলাম। মেয়ের কড়া নির্দেশ পেয়ে সামনে থেকে সরে যাচ্ছিলেন মা।’
চৈতি আবার বলল, ‘কথা না শুনে চলে যাচ্ছ কেন?’
‘ষষ্ঠ ও সপ্তম দিবসের খবরও জেনে রাখো। ষষ্ঠ দিবসে পেট ভরে খেত পারব সবজি-মাংস। মেপেটেপে খাওয়ার দরকার হবে না। পানিও খেতে হবে নিয়ম করে বেশি বেশি। আর সপ্তম দিবসে ফ্রুট জুস, সবজি ও ভাত চলবে। স্বাভাবিক খাবারে ফিরে যাব আমি। পরবর্তী দিনগুলোতেও কাপ মেপে ভাত দেবে। খাবার সামনে দেবে মেপে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে পরিমাণ, বুঝেছ?’
মা বললেন, ‘বুঝেছি।’ মেয়ের এ সংগ্রামে বাড়তি কথা বলে বাধা দিতে চান না তিনি। জানেন, বাধা দিলে বাধবে লড়াই—সেই লড়াইয়ে নিশ্চিত তাঁর পরাজয় হবে। মেয়ের জয় হোক, সেটাই চান। মেয়েকে উৎসাহ দেওয়াটাকে বড় দায়িত্ব হিসেবে নিলেন তিনি।
পাঁচ.
প্রায় এক মাস পরের ঘটনা। একদম অন্য রকম হয়ে গেছে চৈতি। প্রায় দশ কেজি ওজন ঝেড়ে হালকা হয়ে গেছে—মুটি মেয়ে বলে কেউ আর টিজ করতে পারে না। চিকন মেয়ে হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে ও। রোজ হেঁটে যেত কলেজে। হেঁটে আসত। ডাবলুকে কষ্ট দেওয়ার পর প্রায়শ্চিত্তের তাড়না থেকে নিজের জন্য এ সাজা বরাদ্দ করেছিল। আজ পরীক্ষা। দেরি হয়ে গেছে। আজ রিকশায় যেতে হবে কলেজে।
বাসা থেকে বেরিয়েই পেয়ে গেল একটা রিকশা। অনুমতি না নিয়ে বলল, সিটি কলেজে চলেন। দ্রুত। ভাড়া বাড়িয়ে দেব।
রিকশা চলতে শুরু করেছে। কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল চৈতি। টিউটোরিয়াল পরীক্ষা হলেও পরীক্ষাই তো। কোনো পরীক্ষাকেই গুরুত্বহীন ভাবে না ও। পরীক্ষার ভাবনা থেমে গেল। আচমকা চোখ গেল রিকশার গতির দিকে। উড়ে উড়ে যাচ্ছে রিকশা। রিকশাচালকের মুখ দেখা হয় না কখনো। পিঠ দেখা হয় সব সময়। চালানোর ভঙি দেখে চমকে উঠল চৈতি। সিটে না বসে রডের ওপর থেকে ছন্দময় তালে চালিয়ে যাচ্ছে রিকশাচালক। ফুলে ফুলে উঠছে তার পিঠের পেশি। চৈতি প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘এই! তুমি ডাবলু না?’
‘হ আফা। ডাবলু। ঢলে ভাসা ডাবলু। আমারে চিনছেন?’
আনন্দে চৈতির বুক ফেটে যেতে চাচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘এভাবে সাজা দিলে তুমি আমাকে?’
‘আফা। আফনি তো আমারে বকা দিছিলেন। আমি সাজা দিলাম কহন?’
‘হ্যাঁ। তোমাকে বকা দেওয়াটাই হচ্ছে আমার যন্ত্রণা। আমার কষ্ট। তোমাকে বকা দিয়ে কলেজের পথে আর রিকশায় চড়িনি আমি, জানো?’
‘হ। জানি আফা। প্রায়ই খাড়াইয়া থাকতাম আফনাদের বাসার সামনে। কলেজের টাইম হইলে হাইডা যাইতেন আফনে। আমার মুখ তো দেহেননি। হের লাইগ্যা চিনতে পারেন নাই আমারে। আজ চিনছেন রিকশায় উইড্ডা।’
‘হ্যাঁ। তোমার রিকশা চালানোর ঢঙটা খুব সুন্দর। আমার চোখে গেঁথে ছিল এ ঢঙ। এ জন্যই চিনে ফেলেছি।’
ডাবলু বলল, ‘আফা আফনে অনেক শুকাইয়া গেছেন। অনেক সুন্দর হইছেন অহন।’
জুড়িয়ে গেল চৈতির মন। হাসিমুখে বলল, ‘এটা হচ্ছে তোমার ওপর অবিচারের কর্মফল!’
এ কথার অর্থ বুঝতে পারল না ডাবলু।
কলেজের সামনে এসে চৈতি বলল, ‘এই নাও, এক শ টাকা। এটা তোমার জন্য। আর শোনো। বসে থাকবে তুমি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমাকে নিয়ে বাসায় যাবে। তোমাকে আজ নিজের হাতে খাওয়াব। আব্বুকে বলে তোমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করব! আব্বুকে বলেছিলাম তোমার কথা।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ডাবলু।
টাকা দিয়ে, কথা শেষ করে অনেকটা উড়ে কলেজের ভেতর ঢুকে গেল ও। নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেল না চৈতি। মনে হচ্ছে চিকন একটা পরি উড়ে উড়ে ঢুকে যাচ্ছে ওদের ক্যাম্পাসে।
দূর থেকে অবাক হয়ে চৈতিকে দেখে ফেলল রুহিনা। মনে মনে বলল, ইস্! যদি চৈতির মতো অপ্সরা হতে পারতাম!
বুকে হাহাকার জেগে উঠল। হাহাকার নিয়ে রুহিনা ডাকল, ‘চৈতি!’
মাথা ঘুরিয়ে চৈতি দেখল রুহিনাকে। ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল, কী? বল, কী বলবি?
‘তোর মতো পরি হতে ইচ্ছা হচ্ছে। এত স্লিম আর সুন্দর হলি কীভাবে! মনে হচ্ছে “ডানাকাটা এক পরি” উড়ে উড়ে এসেছে আমাদের কলেজে!’