আহমেদ মুজতবা জামাল : ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবের কর্ণধার

দেবযানী হালদার প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০২১, ০৫:২৭ পিএম

পৃথিবীব্যাপী করোনা সংক্রমণের মতো বিপজ্জনক সময়েও তিনি প্রয়োজনীয় সবরকম নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে DIFF (Dhaka International Film Festival) বা ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব  আয়োজন করে চলেছেন আর এখান থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় '।

২০১২ সালের দিকে আমি যখন ঋত্বিক ঘটকের উপর ডকুমেন্টারি তৈরীর কাজে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসি, তখন ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে আমার একজন চলচ্চিত্রপ্রেমীর সাথে দেখা হয়, তাঁর নাম আহমেদ মুজতবা জামাল—যাকে আমরা শোভন ভাই  নামেও চিনি। তিনি অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন। তাকে হাসিমুখে তরুণ কর্মীদলকে সাথে নিয়ে আয়োজনটিকে সার্থক করতে তুলতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করতে দেখে আমি রীতিমতো অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।

এরপর আমি প্রায় চারবারের মতো ঢাকায় এসেছি আর আমি যতবারই আহমেদের সাথে দেখা করেছি, কথা বলেছি—সিনেমা আর ছাত্রবৃত্তির প্রতি তার অনুরক্তি, একনিষ্ঠতা আমাকে প্রেরণা দিয়েছে;  শুধু আমিই না বিশ্বের সকল চলচ্চিত্রপ্রেমী আর চলচ্চিত্র তত্ত্বাবধায়কদের জন্য তিনি এক মহান অনুপ্রেরণা।

কাজেই যখনই আমি নিজেকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাই, আমি চলচ্চিত্র বিশ্বে আহমেদের যাত্রাপথ বিশ্লেষণ করতে তুমুল আগ্রহ প্রকাশ করি।

ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামাল, সাথে চলচ্চিত্র সমালোচক ক্লাউস এডার আর চলচ্চিত্র পরিচালক অদূর গোপালকৃষ্ণন আইএনপি/ম্যাথিউ সৌজন্যে

 

শুরুর ঘটনা

আহমেদ মুজতবা জামাল টাঙ্গাইল জেলায় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাসায় ভালোবাসা, সততা, নৈতিকতাকে প্রাধান্য দেয়া হতো। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। তার বাবা-মা দুজনই চাকরিজীবী ছিলেন। তার বাবা একজন সৎ,  নীতিবান সরকারি কর্মচারী ছিলেন আর তার মা একজন স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন যিনি স্বল্প আয়ে সুন্দরমতো সংসার গুছিয়ে নিতেন।

একজন শিক্ষিকা হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জীবনে আর্থ-সামাজিক আর বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষাই সবচেয়ে শক্তিশালী  মাধ্যম। শিক্ষার প্রতি মায়ের এই প্রবল বিশ্বাস আহমেদ আর তার ভাইবোনদের ছোটকাল থেকেই প্রভাবিত করে আর তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নগুলোকে আরও প্রসারিত করে তোলে।

 

সাফল্যের পেছনের প্রভাবক শক্তি

আহমেদ ১৯৮৯ সালে পড়াশোনা শেষে নিজের প্রেমিকার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি যখন দুই কন্যা সন্তানের পিতা হন, তখন তার জীবন পুরোপুরি বদলে যায়। এবার তার মায়ের পাশাপাশি স্ত্রী আর দুই কন্যা হয়ে দাঁড়ায় তার অনুপ্রেরণা ও শক্তি।

সেই সময়ে তার ডিআইএফএফ ( DIFF) এর চলচ্চিত্রগুলো বাংলাদেশে সুনাম অর্জন করতে শুরু করে। ২০১৩ আর ১৪ সালে তিনি তার বাবা-মা দুজনকেই হারান। কিন্তু আহমেদের বিশ্বাস যে তার বাবা-মায়ের দোয়া সবসময় তার সাথে রয়েছে আর তার স্বপ্ন পূরণে তাকে সহায়তা করছে৷ তার সকল স্বপ্নের কেন্দ্রে ছিল ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পরিধি আরও বিস্তৃত করা।

 

স্মৃতিকাতরতা আর সিনেমার প্রতি ঝোঁক

আহমেদ শুরু থেকেই বেশ কল্পনাপ্রবণ ছিলেন, যা তাকে বস্তুবাদী জগতের কঠিন বাস্তবতা হতে নিষ্কৃতি লাভ করে সবকিছুর উর্ধ্বে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ করে দেয়। সিনেমার প্রতি আহমেদের খুব আগ্রহ আর ঝোঁক ছিল, তিনি সিনেমা নির্মাতা হিসেবে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন। এক কথোপকথনে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ঢাকায় অবস্থিত সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ( ১৯৭২ সালে স্থাপিত) তার জীবনে বিশাল প্রভাব রাখে।

আহমেদ বলেন, “সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আমার খুব যাওয়া হতো। সেখানে আমার এতবার চলচ্চিত্র দেখা হয়েছে যে সঠিক সংখ্যাটা আমার জানা নেই। চলচ্চিত্রগুলোর মূল বিষয়টা ধরতে পারি বা না পারি আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতাম সেগুলো। প্রতিটা সংলাপ মন দিয়ে শুনতাম। তখন আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ছিল—খুব ভালো অনুভব করতাম আমি। একই সিনেমা বারবার দেখলেও কোনো সমস্যা হতো না আমার। আমি যখন আস্তে আস্তে সেখানে আরও ঘনঘন আসা-যাওয়া শুরু করলাম, আমি সিনেমাগুলোর বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত অর্থ ভালো মতো বুঝতে শুরু করলাম। সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আমার দেখা সর্বকালের বিখ্যাত কিছু সিনেমা হচ্ছে—সের্গেই আইজেনস্টাইন পরিচালিত ' ব্যাটলশিপ পটেমকিন' আর 'অক্টোবর: টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড', মিখাইল কালাতোজভ পরিচালিত 'দ্য ক্রেন্স আর ফ্লায়িং',  সের্গেই বন্দারচুক পরিচালিত 'ফেট অব এ ম্যান', গ্রিগরি চাক্রাই পরিচালিত 'ব্যালাড অব এ সোলজার', ভাসিলিয়েভ ব্রাদার্স পরিচালিত ' চাপায়েভ ', আন্দ্রেই তার্কভস্কির 'ইভান'স চাইল্ডহুড', 'আন্দ্রেই রুবলেভ' আর 'সোলারিস', স্ত্যানিসলাভ রোস্তত্স্কির 'দ্য ডনস হিয়ার আর কোয়াইট', সের্গেই প্যারাজনভ পরিচালিত 'আশিক কেরিব', আকিরা কুরোসাওয়া পরিচালিত 'দার্সুই উযালা', মেটোডি এন্ডোনভ পরিচালিত বুলগেরিয়ান  সিনেমা 'দ্য গোট হর্ন' ইত্যাদি।”  আসলে রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তার সামনে সিনেমার একটি নতুন জগৎ তুলে ধরে ধরে।

খুব অল্পবয়স থেকে আহমেদের মনে সিনেমা আর সাহিত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্ম নেয়। তার শৈশবকালে যদিও যেকোনো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য টেলিভিশন ক্রয় করা বিরাট ব্যাপার ছিল, ১২ বছর বয়সেই সে সিনেমা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করে।

১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন তিনি রুশ সিনেমার অন্যতম দর্শকে পরিণত হন, তখন তিনি সুপরিচিত চলচ্চিত্র পরিচালক অজয় করের বিখ্যাত বাংলা সিনেমা 'হারানো সুর'ও দেখেন। দাবি করে বলা যায় যে, ১৯৫০ সালের শুরুর দিক থেকে বিতর্কিত এবং হারিয়ে যাওয়া জাতির ভাষাগত এবং স্থানিক সমতুল্য বাংলা সিনেমার আলোচনার ফলে এটি কলকাতাকে ক্রমাগত স্থানিককরণের চেষ্টা করে। এটি উত্তর-ঔপনিবেশিক শহরের মহানগর দৃশ্যতাকে পুনর্ব্যাখ্যা করার বিভিন্ন সম্ভাবনাকে তুলে ধরে। কলকাতা বাংলা সিনেমাকে আশ্রয়, আধুনিকতার একটি রূপক, জাতির স্থানিক সমতুল্যতা প্রদান করে। বাংলা সিনেমার স্থানিক আবর্তনের একটি মূল অংশ চাঞ্চল্যকর নাটকের আনুষ্ঠানিক রূপরেখায় নিহিত ছিল। উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেন সেই রূপরেখার উজ্জ্বল তারকা ছিলেন। তাদের উভয়ের সহজ শহুরে প্রভাব উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় আধুনিকতায় অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে৷ তাদের সিনেমাগুলো নিয়ে আবার সমালোচনাও কম হয় নি।

রেইনবো পরিবার

চলচ্চিত্র সমাজ আন্দোলন : রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি : সংগ্রামের শুরু

আগের দুনিয়ার ইতিহাস সম্পর্কিত জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সিনেমা প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতারা চমৎকার বাংলাদেশি চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিচ্ছিন্ন আর অপহৃত ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করে বিকশিত করার সর্বাত্মক চেষ্টায় নিয়োজিত হন। এই সময়টাতেই আস্তে-ধীরে বিভিন্ন চলচ্চিত্র সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করে আর মোটামুটি ৭৯টি চলচ্চিত্র ক্লাব ও সংসদ স্থাপিত হয়।

রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের যাত্রাও এভাবে একই লক্ষ্যকে সামনে রেখে শুরু হয়। ১৯৭৭ সালের ২৫শে জুলাই গ্রীন-রোড কলোনি কমিউনিটি সেন্টারে চলচ্চিত্রকর্মীদের নিয়ে একটি সভা আয়োজন করা হয় আর সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে 'রেইনবো' নামে একটি চলচ্চিত্র সংসদ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ ১৯৭৭ সালের ৯ আগস্ট একদল আগ্রহী ব্যক্তি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সমাজ সংগঠনের মহাসচিবের কাছে এই বিষয়ে আবেদন জানান।  মোস্তফা কামাল, এম.লতিফুর রহমান, রেস্তাদুল ইসলাম, খন্দকার কামরুজ্জামান, খন্দকার মশিউর রহমান, বেলায়েত হোসেন, পিনু মোস্তফা, মোকাম্মেল হোসেন, জাফরিন আলম আর আহমেদের উদ্যোগে রেইনবোর যাত্রা শুরু হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে রেইনবোর যাত্রা আরও কয়েক মাস পর ১৯৭৭ সালের ২৬শে ডিসেম্বরে রাশিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে  শুরু হয়। ধারাবাহিকভাবে ২৬, ২৭ আর ২৮ শে ডিসেম্বর তারা পূর্ববর্তী সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হতে রেইনবোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য অনুমতি গ্রহণ করে। তৎকালীন সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন খান সদ্য প্রতিষ্ঠিতি সংসদটি উদ্বোধন করতে রাজি হন। তায়েব উদ্দিন আহমেদ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। রেইনবোর মহাসচিব মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল আর সভাপতি লতিফুর রহমান অনুষ্ঠানটিতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। প্রধান অতিথি ছিলেন সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তৎকালীন  প্রধান— ভি.আই.টিটায়েভ। অনুষ্ঠানটি শেষে একটি সিনেমা প্রদর্শন করা হয়।

সেদিন সোভিয়েত দূতাবাসের সৌজন্যে 'হোয়াইট বার্ড উইথ ব্ল্যাক মার্ক' সিনেমাটি প্রদর্শন করা হয়েছিলো, যা মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে স্বর্ণপদক দ্বারা পুরস্কৃত হয়। পরের দিন ২৭শে ডিসেম্বরে 'চলচ্চিত্র ও সমাজ' বিষয়ের উপর সেমিনার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে আনিস ফিল্মসের (ঢাকা) সৌজন্যে রাজেন তরফদার পরিচালিত সিনেমা 'পালঙ্ক (The Bed) ' প্রদর্শন করা হয়। ২৮শে ডিসেম্বর—উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের তৃতীয় অর্থাৎ সর্বশেষ দিন স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে একটা খুবই আনন্দদায়ক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি শেষে সোভিয়েত সিনেমা 'দ্য পোয়েম অফ টু হার্টস' প্রদর্শন করা হয়।

রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ, অর্থমন্ত্রী এ.এম.আব্দুল মুহিত আর প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের তত্ত্বাবধানে পনেরোতম ডিআইএফএফ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়।

রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ শুরু থেকেই সিনেমা প্রদর্শন, সেমিনার আয়োজন, কর্মশালা পরিচালনা, সভা-সম্মেলন আহ্বান, চলচ্চিত্র অধিবেশনের মতো কার্যকলাপ সম্পাদনে সক্রিয় থেকেছে আর এটা সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জায়গা করে নিয়েছে। সে সময়ে বিভিন্ন জেলায় এর শাখা ছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সেগুলো চট্টগ্রাম, রাজশাহী, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ আরও অনেকগুলো জেলায় বিস্তৃত ছিল। তাছাড়াও, রেইনবোর প্রত্যেক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চলচ্চিত্র সংসদ থেকে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় যা প্রথম প্রথম 'নিক্কন' নামে প্রকাশিত হতো, পরে এই নামটি কয়েকবার পরিবর্তিত হয়ে ১৯৮২ সালে স্থায়ীভাবে 'সেলুলয়েড' নামটি স্থির হয়। তারপর থেকে ম্যাগাজিনটি বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছে কিন্তু রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ নিজের যাত্রাপথে অচল ছিল।

রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ বেশ কিছু বছর ধরে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সিনেমা প্রদর্শন চালু রেখেছিল। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ভিন্ন চিন্তাধারা আর মূল্যবোধের কারণে দুর্ভাগ্যবশত সিনেমা প্রদর্শন, সেমিনার আয়োজন আর অন্যান্য মাসিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় যেগুলো শুরুর দিকের বছরগুলোতে বেশ জনপ্রিয় ছিল৷যাইহোক, আহমেদ আর অন্যান্য সদস্যরা সবচেয়ে বড় উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯৯২ সালে, যা আজ অবধি ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে আর অন্যতম সুপরিচিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সাময়িক পত্রিকা 'সেলিউলয়েড' প্রকাশ করার মাধ্যমে উদযাপন করা হয়।

একেবারে শুরু থেকেই বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, প্রফেসর কবীর চৌধুরী, ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ডক্টর সেলিম জাহান, আবদুস সেলিম, কিশ্বর কামাল, এম.শফিকুর রহমান, মফিদুল হক, রবিউল হোসেন, সৈয়দ মারগুব মোরশেদ, মিজারুল কায়েস, মিজানুর রহমান, ডক্টর নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ আর অন্যান্য গুণী ব্যাক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়।

উৎসবটির সাধারণ বিষয়বস্তু বা লক্ষ্য হচ্ছে— 'শ্রেষ্ঠতর সিনেমা, শ্রেষ্ঠতর দর্শক আর শ্রেষ্ঠতর সমাজ'। রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ নিয়মিত ভাবেই উৎসবটি আয়োজন করে থাকে যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু সিনেমা সংস্কৃতির অগ্রগতি নিশ্চিত করা আর ১৯৭৭ সাল থেকে সিনেমার বিশ্বব্যাপী মূলধারা এবং এর সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার বিকাশ সাধন।

ডিআইএফএফ বাংলাদেশের সর্বসেরা চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম—যা বৃহৎ পরিসরে  ক্রমবর্ধিত সুস্থ আর ইতিবাচক জাতীয় চলচ্চিত্র সংস্কৃতি গঠনে সহায়তা করেছে। ডিআইএফএফ অবক্ষয়, উগ্রতা আর সস্তা ব্যবসাভিত্তিক মনোবৃত্তি যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের মূলধারাকে কলুষিত করে—এগুলোর বিরুদ্ধে একটি সাহসিকতাপূর্ণ অভিব্যক্তি। এই উৎসবটি আবার বাংলাদেশ ও বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বিশ্বব্যাপী শৈল্পিক প্রবণতার সাথে সংযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দেয় আর বাংলাদেশি সিনেমার ক্ষেত্রে সমান্তরাল উন্নয়ন নিশ্চিত করে।

আগে ডিআইএফএফ-এর পরিচিতি লাভ করতে একটু বেগ পেতে হয়েছিলো। কিন্তু ১৯৯৭ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ডিআইএফএফ উদ্বোধন করেন তখন তা সবার মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়। সময়ের সাথে সাথে সংগঠনটি আরও বিকাশ লাভ করে আর ২০১০ সালটি ডিআইএফএফের জন্য আবারও সৌভাগ্যময় প্রমাণিত হয় যখন প্রধানমন্ত্রী আবারও ডিআইএফএফ নিজ হাতে উদ্বোধন করেন। তারপর ডিআইএফএফ সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে পৌছাতে শুরু করে। আর তারপর মাননীয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ২০১৬ সালে ডিআইএফএফ-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূখ্য ভূমিকা পালন করে নিজের মহানুভবতার পরিচয় দেন। তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, গত কয়েক বছরে ডিআইএফএফ বেশ ভালো সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

আহমেদ আর তার কর্মীদল বেশ পারদর্শিতা আর উৎসাহের সাথে ডিআইএফএফের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে শাহরিয়ার আলম এমপি, এম হামিদ, জালাল আহমেদ, সামিয়া জামান অন্যতম। তাদের অংশগ্রহণ রেইনবোর সদস্যদের অনুপ্রাণিত করেছে আর তাদের মানসিক শক্তি প্রদান করেছে। ঊনত্রিশ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়সীমায় ডিআইএফএফ ১৯৯২, ১৯৯৩, ১৯৯৪, ১৯৯৫, ১৯৯৭, ২০০০, ২০০২, ২০০৪, ২০০৬, ২০০৮, ২০১০, ২০১২, ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ আর ২০২১ সালে ১৯ টি উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ডিআইএফএফ এ বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী যে উৎসবগুলো আগের মতোই উন্নতমানের সিনেমা তৈরি ও দেখার প্রতি সচেতনতা সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য  ভূমিকা রাখবে।

একবার এক কথোপকথন আহমেদ উল্লেখ করেন—"আপনারা ইতিমধ্যে জানেন যে আমি এই উৎসব আয়োজন শুরু করি ১৯৯২ সাল থেকে আর এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। আর যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তাহলে সামনের বছর—২০২২ সালের জানুয়ারিতে উৎসবটির ২০তম আয়োজন আর ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষীকি অনুষ্ঠিত হবে (কেননা মাঝখানে আবার তা এক বছরের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হতো)। ডিআইএফএফ বা ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব একটি স্বাধীন চলচ্চিত্র উৎসব আর এটি দক্ষিণ এশিয়া নিজের মর্যাদা স্থাপন করেছে। আর আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের তাদের শৈল্পিক কাজে সহায়তা করা৷ আমরা কখনো ব্যবসায়ীক মনোবৃত্তিকে প্রাধান্য দেইনি আর শিল্পের নামে সস্তা বিনোদন প্রচার করিনি। আমাদের মূল পরিকল্পনা ছিল সাংস্কৃতিক আর নান্দনিক চলচ্চিত্র সংস্কৃতি গড়ে তোলা। ডিআইএফএফের স্থাপনা সহজ ছিল না, অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। প্রতিটা সংস্করণ নতুনভাবে করতে হয়েছে, যেহেতু স্থায়ী কোনো কেন্দ্র ছিল না। হলগুলোর ব্যবস্থা করা—সাধারণ মানের হলগুলো দিয়ে কাজ চালান, সেখানে উন্নত সব সরঞ্জামের ব্যবহার, আর সিনেমা প্রদর্শনের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার তত্ত্বাবধানে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে, যেন সবকিছু  নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়। আর যেহেতু কোনো স্থায়ী তহবিল ছিল না, যা অর্থনৈতিক উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করবে—তাই আমরা সবসময় একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতাম, আমরা অনিশ্চিত থাকতাম যে আগের স্পন্সররা আমাদের সহায়তা জারি রাখবেন কি না। আর এই বিষয়টা আমার উপর শারীরিক আর মানসিকভাবে প্রচুর চাপ ফেলে। এখন আমি উৎসবটির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু চিন্তিত। সবকিছু ঠিক থাকলে আমি হয়তো পরবর্তী পাঁচ বছর এটা ভালোমতো চালিয়ে নেবো, কিন্তু এরপর কী হবে তা নিয়ে আমি অনিশ্চিত। ভবিষ্যতের এর কী হবে এই ব্যাপারটা আমাকে বেশ ভাবায়। এটার কী হবে, পরবর্তী সময়ে কেউ এটাকে একইরকম উৎসাহ আর দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে নিয়ে যাবে কি না, এসব বিষয় উদ্বিগ্ন করে তোলে আমাকে।”

আহমেদ বছরকে বছর ধরে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন। এমনকি তিনি সেলুলয়েড প্রকাশনাও কখনো থামতে দেন নি। তিনি প্রকাশ করেছেন যে কখনো কখনো লেখার অভাবের কারণে সেলুলয়েড প্রকাশ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াতো৷

সাময়িক পত্রিকাটির সম্পাদক আহমেদ বলেন, "অবশেষে এটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেহেতু প্রবন্ধের খুব অভাব দেখা দিয়েছে বর্তমানে। ভালো লেখা পাওয়া এখন ধনরত্ন পাওয়ার সমান হয়ে গেছে। বিশেষ করে বিপণন নীতি এতটা ব্যবসাভিত্তিক হয়ে গেছে যে নিজেদের ব্যবসায়িক অভিব্যক্তি প্রকাশ ব্যতীত নিজেদের কথাগুলো রাখারও সুযোগ হয়ে ওঠে না। সেলুলয়েডের মতো একটি ম্যাগাজিনের প্রচার তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ কিংবা বিপণন সুবিধার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখে না। আমাদের এই চলচ্চিত্র প্রকাশনাটির বয়স এখন চল্লিশ বছর। আমরা একে ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত নিজেদের সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে সংগ্রাম করে যাচ্ছি যেন সেলুলয়েডকে একটি মুদ্রিত বইয়ের রূপে আরও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারি। অবশ্য মাঝখানে আমরা তিনবছর ম্যাগাজিনটি না ছাপিয়ে অনলাইনে প্রকাশ করার মাধ্যমে একটা নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যে মিডিয়া হাউজটি সেলুলয়েডের জন্য আমাদের ওয়েবসাইট চালাতে সাহায্য করছিলো সেটা কিছু ঝামেলার মুখোমুখি হয়, আর দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সব ডকুমেন্ট হারিয়ে যায়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা ছিল যা আর উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি, আর লেখাগুলোর কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট ছিল না আর, হার্ডকপি-সফটকপি কিছুই না। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনবার ওয়েবসাইট হ্যাক করা হয়, একশবারেরও বেশি ক্রাশ করে। কাজেই আমাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হতে ভরসা উঠে যায়, আর আমরা আবারও কাগজে মুদ্রণের দিকে নজর দেই। আমরা বিশ্বাস করি যে মুদ্রণ শিল্প একটি বড় রকমের হুমকির মুখে রয়েছে কিন্তু আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে বইপ্রেমীদের বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না। সেলুলয়েড সবসময় বই আকারেই বের হবে আর মানুষ একটা সময় তাক ভর্তি শব্দ-চিত্রের সমাহারের মূল্য অনুধাবন করবে। এতরকম প্রতিবন্ধকতা আর কাঠিন্য সত্ত্বেও রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ শেষাবধি সেলুলয়েড প্রকাশিত করতে থাকবে আর ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন জারি রাখবে, তার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করবো। মুদ্রিত মিডিয়া আর সুস্থ চলচ্চিত্র সংস্কৃতি চিরজীবী হোক...।"

চলচ্চিত্রে বিশ্বে আহমেদের যাত্রা এত সবকিছুর মধ্য দিয়েও খুব ভালো কেটেছে। একজন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তিনি অনেকগুলো প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন যার শুরুটা ছিল ২০০৬ সালের 'ট্রুথ এন্ড বিয়ন্ড' দিয়ে, এরপর ২০০৭ সালের 'স্মৃতির মিনার', আর ২০১১ সালে 'পহেলা বৈশাখ'। তাছাড়াও তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থান ঘুরে বিভিন্ন জায়গা, সংস্কৃতি আর ভাষায় অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।

মৃণাল সেন আর অন্যান্য চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব

 

মিউনিক থেকে বুসান: অসমাপ্ত অধ্যায়

আহমেদ বিশ্বভ্রমণে আগ্রহী ছিলেন। তার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবতার রূপ ধারণ করে যখন রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের অংশ হিসেবে তার মিউনিখ পরিদর্শনের সুযোগ হয়। গ্যাটে ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক  এইচ. লাকনার আহমেদের কাজ দেখে আনন্দিত হয়ে তাকে ১৯৯১ সালে জুন মাসের শেষের দিকে মিউনিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেন। সেখানে তার আদুর গোপালকৃষ্ণন, ডেরেক ম্যালকম আর ক্লাউস এডারের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়।

 

এফআইপিআরইএসসিআই (FIPRESCI)-এর সাথে যাত্রা

১৯৯৪ সালে, আহমেদ কলকাতায় অনুষ্ঠিত ২৫তম ভারতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেন, যা তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল। সেখানে আদুর গোপালকৃষ্ণনের সাথে তার দ্বিতীয়বারের মতো দেখা হয়। তিনি তাকে রাতের খাবারের দাওয়াত দেন যেখানে ডেরেক ম্যালকমও উপস্থিত ছিলেন।

যদিও এর আগেও একবার দেখা হয়েছিলো, এবারের দেখাটা আহমেদের জীবনে একটা চমক এনে দেয়। সেদিন রাতের খাবারের আয়োজনে আহমেদের এই দুই ব্যাক্তিত্বের সাথে ভিন্ন মাত্রায় সংযোগ স্থাপিত হয়।

সেদিন রাতে ডেরেক মাইকেল ম্যালকম আহমেদকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক সংগঠন—এফআইপিআরএসসিআই-এর বাংলাদেশ অধ্যায় আরম্ভ করার উপদেশ দেন। তিনি আহমেদকে ৫-৭ জন সদস্য নিয়ে একটি বিশেষ দল গঠন করার পরামর্শ দেন, যা এই প্রক্রিয়ায় তার সহায়ক হবে। সেই পরামর্শটি মনের মধ্যে ধারণ করে আহমেদ ঢাকায় ফিরে আসেন, আর এই বিষয় নিয়ে প্রফেসর কবীর চৌধুরী, ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সন্তোষ গুপ্ত আর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করেন। আহমেদ জানান এটা ছিল ২৪শে জানুয়ারি, ১৯৯৪ সাল। 

এখান থেকেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচক সংগঠন—আইএফসিএবি-এর যাত্রাপথের সূত্রপাত ঘটে। আর ১৯৯৫ সালে আইএফসিএবি আনুষ্ঠানিক পরিচিত লাভ করে যখন এফআইপিআরএসসিআই তাদের বার্ষিক সাধারণ সম্মেলনে এর সদস্যপদ গ্রহণ করে। ১৯৯৭ সালে আইএফসিএবি ক্লাউস এডারের সাথে চলচ্চিত্র সমালোচনা বিষয়ে একটি ওয়ার্কশপ আয়োজন করে। এখান থেকে তাদের এফআইপিআরএসসিআই-এর সাথে একত্রে কাজ করার সূত্রপাত ঘটে। ১৯৯৮ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি এফআইপিআরএসসিআই-এর নির্ণায়ক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে আহমেদ এফআইপিআরএসসিআই-এর বার্ষিক সাধারণ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন যা ইতালির সেইন্ট ভিনসেন্টে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তারপর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে এফআইপিআরএসসিআই এর বার্ষিক সাধারণ সম্মেলনে যোগ দিতেন।

বারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ( ইতালি, ২১-২৮শে মার্চ, ২০১৫) এফআইপিআরএসসিআই-এর বার্ষিক সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেদিন আবার এর ৯০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীও ছিল। অ্যালেন পার্কার, জিন-জক আনোদ, কোস্টা গাভরাস, এতোরা স্কোলা, আন্দ্রে ওয়াইদা, এডগার রিজ, মার্গারেট ভন ত্রোতা আর নানি মোরেতিকে উৎসর্গ করে একাধারে অনেকগুলো মাস্টার ক্লাস আর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করা হয়। এত জনপ্রিয় ও গুণী ব্যাক্তিবর্গের মাঝে উপস্থিত হতে পেরে আহমেদ গর্ব অনুভব করছিলেন।

২৩তম ফজর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, তেহরান, ইরান। ৩১ জানুয়ারি- ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫। পুরস্কার বিতরণী আধ্যাত্মিক চলচ্চিত্র নির্ণায়ক সভায় পিটার ম্যালোন, তাডাও সাতো, ক্রেযটফ জ্যানুসি, আব্দুল্লাহ ইসফানদিয়র আর আহমেদ মুজতবা জামাল।

 

ইরানি চলচ্চিত্র

বিপ্লবের পর থেকে ইরান নানারকম সামাজিক উত্থান অতিক্রম করেছে আর তাদের চলচ্চিত্রগুলোতেও তা প্রকাশ পেয়েছে। আহমেদ সেই বিষয়গুলো অনুধাবনের সুযোগ পেয়েছিলেন আর তিনি এ নিয়ে খুব আগ্রহী ছিলেন, এই প্রথম তিনি ইরানীয় চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করছিলেন। যাইহোক ইরান রাষ্ট্র হিসেবে কেমন তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন না। ১৯৯১ সালে মিউনিকে থাকাকালীন আহমেদ একদিন গাস্তাইগে ( মিউনিকের একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র) দুপুরের খাবার সেরে পরবর্তী চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখন তিনি একটি দীর্ঘ সারি লক্ষ করেন যেখানে আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত কয়েকজন নারী তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হলের প্রবেশপথের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের আগ্রহ দেখে আহমেদ অবাক হন আর শিল্প ও সংস্কৃতিতে তাদের অংশগ্রহণের ব্যাপারটা তাকে অভিভূত করে। সেই লম্বা সারির প্রতি আগ্রহ দমাতে না পেরে আহমেদ অনুসন্ধানে নামলেন যে সেখানে আসলে কোন চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন করা হচ্ছিলো।

আর সেটা ছিল তার প্রথম ইরানীয় চলচ্চিত্র—'বাশু, দ্য লিটল স্ট্রেনজার'। আহমেদ সেই চলচ্চিত্রটির প্রতি নিজের অনুরক্তি প্রকাশ করে বলেন, "... বাহরাম বেযাইয়ের এই মাস্টারপিস চলচ্চিত্রের অদ্ভুত সুন্দর সিনেমাটোগ্রাফি আজও আমাকে অভিভূত করে। দক্ষিণ ইরানের যুদ্ধের বিধ্বস্ততা কাটিয়ে বাশু নামের এক অল্পবয়সী ছেলে বিদেশগামী একটি ট্রাকে লুকিয়ে উত্তরের দিকে যাত্রা শুরু করে। তার আগে সে ইরান-ইরাক যুদ্ধে বোমা বিস্ফোরণে নিজের বাবা-মায়ের করুণ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে। সে ইরানের উত্তরাংশের একটি গ্রামে গিয়ে ওঠে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে এক পর্যায়ে সে ধানক্ষেতের একটা কোণায় ঘুমিয়ে পড়ে। ধানক্ষেতটি নাই নামের একজন অল্পবয়সী মায়ের ছিল যে কিনা নিজের দুই সন্তানকে একাই লালনপালন করত। চলচ্চিত্রের কাহিনীটি একটি সুন্দর, বিষাদময় কিন্তু শক্তিশালী বার্তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় যা শুধু দক্ষিণ আর উত্তর ইরানের সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্যকেই নয়, বরঞ্চ সামগ্রিক রূপে ইরানের একতা আর সম্প্রীতিকে দেখিয়ে দেয় । আর এভাবেই সবকিছুর আরম্ভ—ইরান, ইরানীয় চলচ্চিত্র আর সেখানকার মানুষজনদের সাথে আমার যাত্রার আরম্ভ সেখান থেকেই।"

সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের পর থেকে তিনি ডিআইএফএফে ইরানীয় চলচ্চিত্র সংযুক্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। যাইহোক, ১৯৯২ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের সময় একটাও ইরানি চলচ্চিত্র সংযুক্ত করতে না পেরে তিনি খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি আশাহত না হয়ে ১৯৯৩ সালে ডিআইএফএফের দ্বিতীয় সংস্করণে একের অধিক ইরানি চলচ্চিত্রের এন্ট্রি নিশ্চিত করেন। ইরানি চলচ্চিত্রের প্রতি তার উপচে পড়া ভালোবাসা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৯৪ সালে ঢাকার ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহায়তায় তাকে ফজর চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য নিমন্ত্রণ দেয়া হয়।

বর্তমানে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানীয় চলচ্চিত্রগুলোর জন্য পৃথক স্লট থাকে আর ইরানি চলচ্চিত্রকে প্রাধান্য দেয়া হয়। ইরানি চলচ্চিত্র ব্যতীত ডিআইএফএফ অকল্পনীয়। আহমেদ সবসময় তার ইরানি সহকর্মীদের উৎসবে যোগদান করে অনুষ্ঠানের শোভা বর্ধনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। ইরান, ইরানি চলচ্চিত্র আর ইরানি মানুষজন তার জীবনে একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে যা কোনোদিন বদলাবে না।

বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবের বিচারকের পরিচয়পত্র

ধর্ম আর বর্তমান চলচ্চিত্র উৎসব

চলচ্চিত্র বিষয়ক যে কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আহমেদের মনে সবসময়ই উত্তেজনাপূর্ণ আর মনোমুগ্ধকর অনুভূতি কাজ করে। কারণ এই সমস্ত অনুষ্ঠানের বিশ্ব চলচ্চিত্রের সাথে বিভিন্নভাবে সংযুক্ত হওয়ার অবকাশ অর্জিত হয়। বিভিন্ন ধারার অভিনেতা, পরিচালকদের সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়। ২০০৪ সালে তিনি ইরানে ফজর চলচ্চিত্র উৎসবে যোগদান করেন যেখানে তার সাথে লিয়া জোভিনাযি বেলত্রামির দেখা হয়। তিনি ট্রেন্টো, ইতালির ' আজকের ধর্ম চলচ্চিত্র উৎসব ' এর প্রতিষ্ঠাতা। আয়োজনটি কেন অসাধারণ? আজকের ধর্ম—নামটাতেই তার অসাধারণত্ব নিহিত।

বেলত্রামি যখন আরও ব্যাখ্যা করল, আহমেদ তখন সাথে সাথেই উৎসবটি নিয়ে ব্যাক্তিগতভাবে আরও বেশি জানতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। আজকের ধর্ম উৎসব মূলত মানবজীবনে বিশ্বাস আর আধ্যাত্মিকতার অবস্থানভিত্তিক জনমতকে প্রচার করে। মূল ধারণাটি হচ্ছে মৌলবাদের বিশ্বাসের অপব্যবহারের বিপরীতে আধ্যাত্মিকতায় পরিচয়ভিত্তিক উপাদানের ব্যবধান ধরতে দর্শকদের অনুপ্রাণিত করা। আধ্যাত্মিকতার উপর নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরের মিশ্র সংস্কৃতির বোধগম্যতা আর সহনশীলতার প্রচার আর সম্প্রদায়গুলোর মধ্যকার সংলাপ সহজতর হয়।

এক কথোপকথনে আহমেদ আধ্যাত্মিক চলচ্চিত্রগুলোর প্রতি তার শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন—"তার সাথে কথা বলার সময় আমার নিজের দেখা একটি তিউনিসীয় চলচ্চিত্র 'দ্য থাউজ্যান্ড এন্ড ওয়ান ভয়েজেজ'-এর কথা মনে পড়ে যায়, যা মাহমুদ বিন মাহমুদ পরিচালনা করেছিলেন। আমি সেটা ২০০১ সালে ৫৮তম ভেনিস আন্তর্জাতিক সিনেমাটোগ্রাফি শিল্প প্রদর্শনীতে দেখেছিলাম। সেখানে পরিচালক যেভাবে আধ্যাত্মিকতার উপর ভিত্তি করে একটা চরিত্রের সাথে তার পরিবারের জীবনযাত্রাকে তুলে ধরেছিলেন তার সাথে নিজের জীবনকে মেলাতে পেরে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আর এভাবে আমার মনে ধর্ম নিয়ে আরও কৌতুহল জাগে। কেননা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নির্মিত সেই চলচ্চিত্রটি আমার মনে ধর্ম বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করে। লম্বা-চওড়া আকৃতির বিন মাহমুদ চলচ্চিত্রে কিছু সময়ের জন্য দেখা দিয়েছিলেন, তিনি জানিয়েছিলেন তার বাবা তিউনিসিয়ার একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উঁচু পদের সদস্য ছিলেন। এটা ত্রয়োদশ শতাব্দীর ইমাম চাধিলির ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো যিনি আধ্যাত্মিক চর্চা আর জপের মাধ্যমে স্রষ্টার পুনর্মিলিত হওয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন। তো, লিয়ার সাথে দেখা হওয়ার বছরটাতে আমি আজকের ধর্ম উৎসবের নির্ণায়ক-সভার একজন আন্তর্জাতিক সদস্য হিসেবে অনুষ্ঠানটিতে যোগ দেই। আধ্যাত্মিক জগতে সেখান থেকেই আমার পদচারণার শুরু। আর এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমি নিজেই নিজ দেশের জনগণের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে 'ট্রুথ এন্ড বিয়ন্ড' নামক ডকুমেন্টারি বানিয়ে ফেললাম..."

বর্তমানে, আধ্যাত্মিক শাখাটি ডিআইএফএফের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা যা ২০০৮ সালে প্রথম পরিচিতি লাভ করে আর এতে কাতিয়া মালাতেস্তা আর সাইমন সেম্প্রিনি সহায়তা করেছিলেন। এটি এখনও ডিআইএফএফের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত।

 

কাজান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

আহমেদের দুঃখ ছিল যে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করতে তার অনেক দেশেই যাওয়া হয়েছে, কিন্তু রাশিয়ায় যাওয়া হয় নি। তার শুরু থেকেই রাশিয়ায় যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। ২০১৭ সালে ইরানে ফজর চলচ্চিত্র উৎসবের সময় তার কাযান আন্তর্জাতিক মুসলিম চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক আলবিনা নাফিগোভার সাথে দেখা হয়। তিনি আহমেদকে কাযান আন্তর্জাতিক মুসলিম চলচ্চিত্র উৎসবের নির্ণায়ক-সভার আন্তর্জাতিক সদস্য হিসেবে যোগ দেয়ার জন্য জন্য নিমন্ত্রণ দেন (যা কাযান, তাতারস্থান আর  রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়)। এটা ছিল ১৩তম কাযান আন্তর্জাতিক মুসলিম চলচ্চিত্র উৎসব যা ৫-১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।

সেখানকার অসাধারণ সংস্কৃতি, শহর আর মানুষজনদের আতিথেয়তা দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। সেখানে আবারও আহমেদের নতুন নতুন মানুষদের সাথে, বিভিন্ন অবস্থান হতে আগত প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছিলো; একইসাথে ভালো কিছু চলচ্চিত্র দেখারও অবকাশ পেয়েছিলেন তিনি।

এখনও যখন তিনি তাতারস্থানে যাওয়ার কথা মনে করেন, তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন।

"...আশ্চর্যজনকভাবে, আমি এই হাজার বছর পুরনো শহরটি আবিষ্কার করি ২০ লক্ষ মানুষ বসবাস করে আর অর্ধেক জনগণই মুসলিম। আমি বিভিন্ন মসজিদ থেকে আযানের শব্দ পেতাম আর তরুণদের ইসলামি পোশাক পরে মসজিদগুলোতে যেতে দেখতাম, মনে হতো যেন আরবের কোনো শহর। তাদের সহাবস্থান দেখে আমি অবাকই হয়েছিলাম। মুসলিম আর খ্রিস্টানদের একত্রে শান্তিতে থাকতে দেখে খুব আনন্দ অনুভূত হতো। অর্থনৈতিকভাবে শহরটি খুব উন্নত। মস্কো আর সেইন্টপিটার্সবার্গের পর এটাই রাশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল শহর। শহরটি ঘুরতে পেরে আমি খুব খুশি ছিলাম। আর ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সাথে কাযান আন্তর্জাতিক মুসলিম চলচ্চিত্র উৎসবের সখ্যতা গড়ে ওঠা নিয়েও আনন্দিত ছিলাম আমি। আশা করছিলাম যে এমরা একযোগে কাজ করতে পারবো। এই বিষয়ে আমার তাতারস্থান প্রজাতন্ত্রের সংস্কৃতি মন্ত্রী আইরাত সিবাগাতুলিন আর উৎসব পরিচালক মিলায়ুসা আইতুগানোভার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখা করি। ভবিষ্যতে আমার তাদের সাথে কাজ করার তীব্র ইচ্ছা রয়েছে..."

 

বার্লিন

২০১৮ সালে, ৬৮তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বার্লিন পরিদর্শনে তিনি এফআইপিআরইএসসিআই এর নির্ণায়ক-সভার সদস্য হিসেবে তৃতীয়বারের মতো নিমন্ত্রণ পান। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব হতে তিনি জানতে পারেন চলচ্চিত্র ব্যবসা বিশ্বের দ্রুত-অগ্রসরমান ব্যবসায় পরিণত হয়েছে যেখানে নতুন প্রযুক্তি বিদ্যমান চলকে পালটে দিচ্ছে আর সবাই এই উন্নয়নের ধারায় যোগ দিতে উঠে-পড়ে লেগেছে৷

এটা একটি অসাধারণ উদ্যোগ যা শিক্ষা আর পেশাগত উন্নয়নের নিয়মিত প্রচেষ্টাকে প্রতিষ্ঠা করে। তখন দেখা যেত, সুপ্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র স্কুল হতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলেও চলচ্চিত্র নির্মাতার শিক্ষায় কোনো প্রতিবন্ধকতা আসে না। বরঞ্চ, মূল অনুশীলনের বেলায় প্রতিভাবান যুবসম্প্রদায়ের দীক্ষা এই পর্যায় থেকেই শুরু হয় আর ভাগ্যবান কয়েকজনের প্রধান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগপ্রাপ্তি হয়, যারা কিনা সাফল্য অর্জন করে, আর বাকিরা নিজেদের পেশাগত জীবনে সাফল্যের পথে চেষ্টা চালিয়ে যায়।

নিজের ব্যাক্তিগত স্মৃতিকথায় তিনি লিখেন, "১৮ বছর পর আমার বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আর গুরুত্বপূর্ণ উৎসব—৬৮তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেয়ার সুযোগ হয় যা ১৫-২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়। আমার শুরু থেকেই বার্লিনাল ফোরাম অথবা যুবসমাজকে কেন্দ্র করে নির্মিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ফোরামে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ছিল যেখানে তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আর নতুন আঙ্গিকের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাজে গুরুত্ব দেয়া হতো। প্রগতিশীল ধারার পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত পরিচালকদের প্রথম চলচ্চিত্রে এই বৈশিষ্ট্যগুলো চোখে পড়ত। ফোরামটিতে সারা বিশ্ব হতে সংগৃহীত তরুণদের নির্মিত ভিন্ন ধারার পরীক্ষামূলক আর ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্রগুলোকে জায়গা দেয়া হয়েছিলো। এখানে নির্দিষ্ট কোনো কাঠামো বা ধরনগত বিধিনিষেধ ছিল না। আর ফোরামের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় কোনো  প্রতিযোগিতা চলছিলো না। ক্রিসটোফ টারহেকটে ২০০১ সাল থেকে এই ফোরামটি পরিচালনা করছেন..."

আইসল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি ওলাফুর রাগনার গ্রিমসনের সাথে (২০১৩)

 

হেনরিক ইবসেনের দেশ: নরওয়ে

আহমেদ নির্ণায়ক-সভার একজন উৎসাহী সদস্য হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলেন। প্রতিটা উৎসবে তিনি বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন যা কেবল জ্ঞানের পরিধিই বৃদ্ধি করে নি, বরঞ্চ ডিআইএফএফের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকেও দৃঢ়তা প্রদান করেছে। হগেসান্ডে অনুষ্ঠিত ৪৭তম নরওয়েজিয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৯শে আগস্ট যখন তিনি অসলো এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছান, তখন দুপুর প্রায় বারোটা বাজে। একইসময়ে এয়ারপোর্টে অনেকজন এসে পৌঁছানোতে অভিবাসন বিভাগে প্রায় পাঁচশত মানুষের ভিড় জমে যায়। এক ঘন্টা পেরোনোর পর মানুষজন আস্তে আস্তে হল ছাড়তে শুরু করে। হঠাৎই, তিনি একজন মানুষের হাতে একটা বাক্স দেখতে পান। মানুষটি সবাইকে পানির বোতল বিতরণ করছিলো। আহমেদ প্রথম প্রথম বুঝতে পারেননি, কিন্তু পরে তিনি জানতে পারলেন, এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগেই ব্যাপারটা ঘটছে, অপেক্ষারত সবাইকে পানি খাওয়ানো হচ্ছে৷ তখন তিনি অনুধাবন করলেন এখানে সবাই মানবতা বা মনুষ্যত্ববোধকে প্রাধান্য দেয়। নরওয়ের এমন মাহাত্ম্যপূর্ণ মনোবৃত্তি দেখে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। এটাকে আপাতদৃষ্টিতে একটি ছোটখাটো উপকার বলে মনে হতে পারে,  কিন্তু ছোট ছোট মানবিক আচরণগুলোই সামগ্রিক মনুষ্যত্ববোধের পরিচায়ক। তার অন্যতম প্রিয় বান্ধবী গাইদা মিকলেবাস্ট আর তার স্বামী ওগে হফার্ট দুজনই নরওয়ের স্থানীয় আর সুন্দর ব্যক্তিত্বের অধিকারী, আহমেদের খুবই কাছের মানুষ। তিনি যতবার নরওয়ে যান তাদের বাসায়  থাকেন আর তারা আহমেদের  সাথে নিজেদের আপনজনের মতোই ব্যবহার করেন। তাদের আতিথেয়তায় তিনি বরাবরই মুগ্ধ হন।

“মানুষ কেবল প্রার্থনা করে, নিষ্পত্তি স্রষ্টার হাতে”। এটা খুব প্রচলিত প্রবাদ। নরওয়ে ভ্রমণের আগে তিনি ফেস্টিভ্যাল হোটেল স্ক্যান্ডিক মারিটিমের স্বপ্ন দেখতেন যেখানে তার ইতিমধ্যে থাকা হয়েছে। তিনি সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, “...আবহাওয়াটা চমৎকার। সকালে নাস্তা করার সময় জানালার বাইরের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য, একপাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীতে ছোট ছোট নৌকা দেখা যাচ্ছিলো। নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত সেই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারা সম্ভব না, জায়গাটা এমনই প্রশান্তিদায়ক আর আকর্ষণীয়। কিন্তু আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যখন জানতে পারলাম যে আমরা এবার ভিন্ন একটা  হোটেলে থাকতে যাচ্ছি। প্রতি বছর আমার মেরিলিন মনরো মূর্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হয়। কিন্তু এবার তা করা হবে না। যাইহোক, সেই স্মৃতিগুলো আমার হৃদয় জুড়ে রয়েছে আর আমি সামনের বছরগুলোতে সেই জায়গায় ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা করছি। আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এটাও আমার অনেকগুলো আশার মধ্যে একটি।” 

 

বর্তমান ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

তার অনেক জায়গার ভ্রমণ করে অভিজ্ঞতা অর্জনের পর—চলচ্চিত্র জগতের অভিজ্ঞতা লাভের পর আহমেদ ভেবেচিন্তে ডিআইএফএফে কতগুলো নতুন বিষয় সংযোজন করেন। সেগুলোর মধ্যে ডিআইএফএফের গুরুত্বপূর্ণ দুটো অংশ হচ্ছে চলচ্চিত্রে নারী বিষয়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক সম্মেলন আর পশ্চিমের সাথে পূর্বের মিলন।

চলচ্চিত্রে নারী বিষয়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক সম্মেলন নারী বিষয়ক সমস্যাগুলো তুলে ধরে। কেননা, নারীরা জনগোষ্ঠীর অর্ধেক অংশ জুড়ে রয়েছে আর বৈশ্বিক উন্নয়নের খাতিরে তাদের সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ ও সমাধান অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মতো দেশে এই বিষয়ে আলোকপাত করা খুব জরুরি কেননা সারা বিশ্বে এখন নানারকম পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, যার প্রভাব নারীদের উপর কখনো ইতিবাচক আর কখনোবা নেতিবাচক হয়ে দেখা যাচ্ছে।

“দ্য ওয়েস্ট মিটস ইস্ট স্ক্রিনপ্লে ল্যাব ঢাকা” আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের একটি বিশেষ অংশ যা পশ্চিমা চলচ্চিত্র শিল্প আর নির্মাতাদের সাথে প্রাচ্যের চলচ্চিত্র শিল্প আর নির্মাতাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। অনুষ্ঠানগুলোর সাফল্যের পর ডিআইএফএফ প্রত্যেকবার অনুষ্ঠানগুলো আরও আধুনিকভাবে আয়োজন করার চেষ্টা করে। আর এই কাজে সহ-আহ্বায়ক একেএ রেজা গালিব আর সাদিয়া খালিদ রীতি সহযোগিতা করেন। “দ্য ওয়েস্ট মিটস ইস্ট স্ক্রিনপ্লে ল্যাব ঢাকা” দক্ষিণ এশিয়া থেকেও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বাছাই করে থাকে। তাদেরকে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ এবং পেশাদার প্রযোজক, চিত্র-পরিবেশক আর প্রোগ্রামারদের সাহচর্যে কাজ করার সুযোগ করে দেয়।

আহমেদ এমনকি করোনার ভয়াবহতার মধ্যেও প্রথম লকডাউন শেষে সবরকম নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ডিআইএফএফের কার্যক্রম চালু রাখেন। সৌভাগ্যবশত উৎসব আয়োজনের সময় বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিলো। যাইহোক, চাপ খুব বেশি ছিল।

 

উপসংহারের পরিবর্তে

আহমেদের যাত্রা হতে আমরা শিক্ষা লাভ করি, ইচ্ছার জোরেই স্বপ্ন পূরণ সম্ভব। চলচ্চিত্রের প্রতি তার ভালোবাসা আর সততার বলেই আহমেদ ডিআইএফএফকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন।

আমি তার এই প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা দেখে অনুপ্রাণিত হই। করোনা পরিস্থিতিতেও সকল নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ডিআইএফএফের কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন—"ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়"।

অনেক রকম বিধিবদ্ধতার মধ্য দিয়েও আহমেদ হাল ছেড়ে না দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। আর তার এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে তার পরিবার আর রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ ও ডিআইএফএফের চমৎকার সদস্যদল তার গুরুত্বপূর্ণ খুটির ভূমিকা পালন করেছে৷

আহমেদ হচ্ছেন চলচ্চিত্র জগতের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব যিনি শত বাঁধা সত্ত্বেও কখনো হার মানেন নি। তার স্বপ্ন আরও বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত আর আমার আন্তরিক বিশ্বাস তিনি তার স্বপ্ন পূরণে একদিন না একদিন নিশ্চয়ই সফল হবেন।

 

লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও ইতিহাসবিদ