লাল মোরগের ঝুঁটি: জাতীয়তাবাদের রূপ ও রূপান্তর

বিধান রিবেরু প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৬, ২০২১, ১২:১৩ পিএম

“জাতীয়তাবাদের অর্থ ছিল জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য করা এবং এটাও স্পষ্ট যে কোনো সরকারই জাতির অধিকার নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। সার্বভৌমত্ব নিহিত থাকে জাতির মধ্যে, সরকারের মধ্যে নয়।” (রোমিলা থাপার: ২০১৯)

 

জাতীয়তাবাদের ধরন নানা সময়ে, নানা জনগোষ্ঠীর ভেতর সময়ে সময়ে পাল্টে গেছে। সাতচল্লিশের আগে ও পরে ভারত উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদের উপরিভাগে ছিল ধর্মীয় চেতনা। অবশ্য তার তলে প্রবহমান ছিল অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয়। এরপর পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে পূর্ববঙ্গে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে, সেটি ষাটের দশকে এসে রূপ নেয় ভাষাভিত্তিক, উপনিবেশবিরোধী ও অসাম্প্রদায়িক এক জাতীয়তাবাদে। যার সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। এই ভূখণ্ডের মানুষ, বাঙালি জাতি, পাকিস্তানি সরকারের জুলুম থেকে নিজেদের মুক্ত করে সার্বভৌমত্ব অর্জন করে, এরপর সরকার নির্মাণ করে নিজেদের ভেতর থেকেই। সেই নিজস্ব শাসক কেমন করে জাতির অধিকারের কথা ভুলে গেল, বা যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ যুদ্ধ করেছিল ও স্বাধীন হয়েছিল—সেটা বিস্মৃত হলো, বেঈমানি করল—সেসব স্বতন্ত্র আলোচনা। আজ আমরা আলাপ করব নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ (২০২১) ছবির ভেতরকার জাতীয়তাবাদ ও নির্মাতার শিল্প প্রয়াস নিয়ে।

‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত কাহিনিচিত্র। সেখানে বাংলাদেশে প্রচলিত ইতিহাসের খণ্ডাংশ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে সাধারণের ভেতর যুদ্ধের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার আখ্যান। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার নিজস্ব যুদ্ধ, বলা যেতে পারে জনযুদ্ধের এক বয়ান এই চলচ্চিত্রে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে। ছবির প্রেক্ষাপট ১৯৭১ সালের সৈয়দপুর রেলস্টেশন ও তার আশপাশের এলাকা। ওখানকার বিমানবন্দর ও রানওয়ে মেরামতের জন্য সে সময় স্থানীয় বিহারিদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রায় তিন হাজার সাধারণ মানুষকে বন্দি করে নিয়ে আসে এবং আটকে রাখে বিমানবন্দর-সংলগ্ন স্কুলঘরে। সেখানে তাদের দিয়ে বিমানবন্দর মেরামত করানোই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না পাকিস্তানি সেনাদের, তাদের অনৈতিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের ভেতর জাতিবিদ্বেষ যেমন ছিল, তেমনি ছিল বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পাশবিক বাসনা।

এই ছবি বাংলাদেশের অন্য মুক্তিযুদ্ধের ছবির চেয়ে একটু ভিন্ন তিনটি কারণে। প্রথমত, ছবিটিতে সরাসরি কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা দেখি না। শুধু শুনি কে বা কারা যুদ্ধে গেছে, বা যাচ্ছে। অন্য ছবির মতো এখানে সম্মুখসমরে পাকিস্তানি সেনা ও মুক্তিসেনাকে দেখা যায় না। দ্বিতীয় ভিন্নতা হলো, এই ছবিতে শান্তি কমিটির কমান্ডার হিসেবে বা পাকিস্তানি সেনাদের দোসর হিসেবে কোনো বাঙালিকে দেখা যায়নি, কাহিনির প্রয়োজনেই দেখা গেছে বিহারিদের। আর তৃতীয় কারণটি হলো, নির্মাতা এমনভাবে নিজের রূপক ও লক্ষণা ব্যবহার করেছেন, যা বিগত মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোতে বিরল।

যুদ্ধের ভেতর আমরা জানি দুটি সশস্ত্র পক্ষ থাকে। এটাই প্রচলিত গল্প বলার ঢং। কিন্তু নূরুল আলম আতিক বেছে নিলেন নিরস্ত্র মানুষ কেমন করে সশস্ত্র সেনাদের মোকাবেলা করল, ইতিহাসের সেই পিঠকে। আমরা চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখি দুটি মোরগ লড়াই করছে, অ্যানিমেশনে, আর পেছন থেকে ভেসে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ, স্বাধীনতার আহ্বান। নির্মাতার রূপকের প্রয়োগ শুরু এখান থেকেই। নতুন ভোরের আগমন যেমন করে মোরগের ডাকে নিশ্চিত হয়ে যায়, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল এই জাতি নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। উপনিবেশবিরেধী এই জাতীয়তাবাদকে মানুষ সে সময় অন্তরে ধারণ করেছিল বলেই যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। যুদ্ধের সময় ধর্মের নামে অধর্ম শুধু নয়, যে ধরনের অন্যায় ও অত্যাচার করেছে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা, সে কারণেই অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের প্রতিফলন আমরা দেখি বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে। নূরুল আলম আতিকের ছবিতেও আমরা দেখি কেমন করে বৈষয়িক লাভালাভ ও জাতিগত বিদ্বেষের কারণে বিহারিরা হিন্দু বাঙালিদের ওপর নৃশংসতা চালায়।

শামছু কমান্ডার ও তার শ্যালক গোলাপকে তাই আমরা দেখি সাহেব আলীর প্রতি অতটা নিষ্ঠুর নয়, যতটা নিষ্ঠুর হিন্দু পরিবারের ওপর। ধরণী মোহনকে সস্ত্রীক গাছের সঙ্গে বেঁধে যেভাবে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো, শুধু গয়নার বাক্স ও বাড়িটি দখলের জন্য, অতটা কিন্তু দেখা গেল না আপন ধর্মের মানুষের সঙ্গে করতে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের প্রতি এই বিদ্বেষ আরও স্পষ্ট হয়, যখন আমরা দেখি লুট করে আনা গয়নার বাক্স থেকে বালার সঙ্গে শাখাও হাতে পরছে শামছুর স্ত্রী, তখন শামছু সফেদ শাখাটি কেড়ে নিয়ে শুধু ছুড়েই ফেলে না, ধমক দিয়ে স্ত্রীকে বলে, বালা হলো ফুল, আর শাখা হলো কাঁটা, ওটাকে ফুল থেকে বেছে ফেলে দিতে হয়। তো এই শামছু একসময় নিজ ধর্মের সাহেব আলীদের বাড়িতে পোষ্য ছিল। তাই হয়তো তাদের প্রতি কিছুটা নমনীয় থাকতে দেখা যায় শামছুকে। যেমন সাহেব আলীর পা ধরে সালাম করা, বাড়ি গিয়ে সাহেব আলীর মাকে সাবধান করে দেওয়া, সাহেব আলী ক্যাম্পে গিয়ে ধরা পড়ার পর তার জন্য জীবন ভিক্ষা করা ইত্যাদি। তবে সাহেব আলীর মেয়ে রাবু ও ধরণীর মেয়ে দীপালী যখন ভারত পালাতে গিয়ে একসঙ্গে ধরা পড়ে, তখন অবশ্য তাদের ছাড় দেয় না শামছুর শ্যালক গোলাপ। এই গোলাপই জাতিবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক কারণে খুন করে দীপালীর স্বামী পরিমলকে।

বিহারিদের এমন সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষমাখা জাতীয়তাবাদের দেখা মুক্তিযুদ্ধের আর কোনো ছবিতে দেখা যায় না। তবে এ ধরনের ভাবধারাকে খুব উদার লোক উপজাতীয়তাবাদ বললেও, এগুলোকে বলা যায় ছদ্ম-জাতীয়তাবাদ। আদতে এগুলো কোনো জাতীয়তাবাদই নয়। যদিও আমরা সে সময় দেখেছি পূর্ব পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে যে ধরনের পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের আমদানি করা হয়েছিল, সেখানে শতভাগ মেশানো হয়েছিল ধর্ম ও বিদ্বেষ। পাটাতনে ছিল প্রাণে বাঁচার চেষ্টা ও লোভ-লালসা। তাদের জাতীয়তাবাদে গণতান্ত্রিক চেতনা ও মানবাধিকার ছিল ভূলুণ্ঠিত। অথচ ওই দুটি বিষয় না থাকলে জাতীয়তাবাদ দানাই বাঁধবে না, তা সে যে জাতিই হোক না কেন।

জাতীয়তাবাদ বিষয়টি জটিল ও পরিবর্তনশীল, কখনো সরল, কখনোবা গরল, তাই অতিরিক্ত চর্চা ও প্রয়োগ হলে এটি উগ্র চেহারা নিতে থাকে, বাইরে তাকে শোভিনিজম বলে। আবার কোনো ঔপনিবেশিক জুলুম ও অত্যাচারের হাত থেকে মুক্ত হতে হলে এই জাতীয়তাবাদেরই প্রয়োজন হয়। ইতিহাস কিন্তু দুদিকেই সাক্ষ্য দেয়। ভারতের প্রখ্যাত পণ্ডিত রোমিলা থাপার ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এরিক জে হবসবমের বরাত দিয়ে বলেছেন, জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে ইতিহাসের ভূমিকা অনেকটা হেরোইন আসক্তদের ক্ষেত্রে আফিমের ভূমিকার সমান। আমরা তো জানি, হেরোইন উন্নত ধরনের নেশাদ্রব্য, যেটাতে প্রাথমিক উপাদান হিসেবে আফিম ব্যবহার হয়। কাজেই ইতিহাসের ওপর ভর করেই জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। আর ইতিহাসের ওপর ভর করে নির্মিত চলচ্চিত্রও জাতীয়তাবাদ গঠনে ভূমিকা রাখে। এখন প্রশ্ন হলো ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ কোন ধরনের জাতীয়তাবাদকে উপস্থাপন করছে বা পুনঃগঠিত করছে? এটা ঠিক এখানে অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা দেখিনি, যাদের দেখেছি তারা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার লোক। কিন্তু যুদ্ধের সময় তারা পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে। একজন আরেকজনের জন্য ভরসার জায়গা হয়ে ওঠে। তবে ব্যবসায়িক কারণেও অনেকে ভরসা বিলাতে থাকে। যেমন রউফ ব্যাপারী, এই লোক শামছুর সহযোগী হলেও যুদ্ধের ভেতর ভারতে পারাপারের বাণিজ্যটি ঠিকই ধরতে পেরেছিল। ঘরের আগুনে এ রকম আলু পোড়া খাওয়া লোকের অভাব অবশ্য কোনোকালেই হয় না। এরা সাহেব আলী বা দেশপ্রেমিকদের মতো আবেগ আক্রান্ত নয়। এরা সব সময় অর্থলোলুপ ও হিসাবি।

অন্যদিকে আমরা দেখি সাহেব আলী আর ধরণী মোহনের বোঝাপড়ার ভেতরে রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যে জাতীয়তাবাদ শোষণ ও নিপীড়নবিরোধী। তারা দুজন যখন নদীর ওপর রেললাইনে দাঁড়িয়ে কথা বলে, তখন তারা আশাবাদী বাঙালি যোদ্ধারা পাকিস্তানিদের পরাজিত করবেই। ওই মুহূর্তে আমরা দেখি নদীতে এক নৌকা থেকে জাল ফেলা হচ্ছে পানিতে। বাঙালিরা যেন নৌকায় ভেসে থাকা জেলে। পানির নিচে থাকা হাঙরদের তারা শিকার করবে। এই হাঙর নদী গ্রেনেডের গল্পটিতে আদতে যে জাতীয়তাবাদ আছে, সেটি আমাদের প্রচলিত ইতিহাস বা বয়ানের ভেতর থেকেই সংগঠিত হয়েছে। তবে বাড়তি যদি বলি, তো ওই বিহারিদের ছদ্ম-জাতীয়তাবাদ, যা আর কোনো মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে উঠে আসেনি।

অভিনয়শিল্পীদের দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন নির্মাতা নূরুল আলম আতিক। ছবিটি ২০১৬ সালে চিত্রায়ণের প্রথম পর্বে কুষ্টিয়ায় তোলা। ছবি: ঈয়ন

বলছিলাম যে নূরুল আলম আতিকের এই ছবি আরও একটি কারণে স্বতন্ত্র, তা হলো ছবিতে রূপক ও লক্ষণার ব্যবহার। দুটির উদাহরণ তো আগেই দেওয়া হলো। আরও যদি বলি তো দেখা যাবে শুরুর দিককার দৃশ্যে। পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে রানওয়েতে যখন জিপটি প্রবেশ করে, তখন এই রূপকই তৈরি হয় যে ঔপনিবেশিক শক্তি প্রবেশ করছে একটি দেশের সীমানায়। আরেকটি রূপকের দেখা মেলে সাহেব আলী যখন ভাঙা রেডিও ঠিক করছিল, তখন টেবিলে রাখা পানির জগ মাটিতে পড়ে যায়, সেখান থেকে কয়েকটি শিং মাছ মেঝেতে পড়ে পানির অভাবে ছটফট করতে থাকে। সাধারণ বাঙালির দুর্দশার এক সফল রূপক চিত্র এটি। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, সাহেব আলীর টেবিলে মাছ এলো কোথা থেকে? সাহেব আলীকে এখানে কিছুটা অপ্রকৃতস্থ দেখা যায়। পাগলাটে এই লোকটি জয় বাংলার লোক। সে যেভাবে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে মৃত্যুকে আহ্বান করে, তার পক্ষে তো টেবিলে জগভর্তি করে মাছ রাখা অবাস্তব নয়। এই লোক সারা রাত বাড়ির ছাদের শুয়ে রেডিও শোনে। পায়চারি করে। যে বাড়িতে সে থাকে, তার ছাদের পলেস্তারা খসে খসে পড়ছে, সেদিকে সে অপলক তাকিয়ে থাকে আর দেশ স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ক্ষয়ে যাওয়া ছাদ যেন ক্ষয়িষ্ণু পূর্ব পাকিস্তানেরই আরেক রূপ। বাতুল সাহেব আলী অপেক্ষায় থাকে কখন সেটি ভেঙে পড়বে। সাহেব আলীকে আমরা একপর্যায়ে দেখি প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ভেঙে ফেলা রেডিওটি ঠিক করতে। ‘পাগল’ না হলে কি কেউ ও রকম ভাঙা রেডিও ঠিক করতে দিনরাত সমান করে দেয়? ‘পাগল’ বলেই তো জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশের জনগণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে যায়। সাহেব আলী আসলে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা বাঙালি জাতীয়তাবাদেরই নামান্তর মাত্র। 

নূরুল আলম আতিক যে জাতীয়তাবাদ এখানে রচনা করেছেন, লক্ষ্য করার মতো বিষয়, তিনি সেখানেও ইতিহাসের পরম্পরা বুনে দিয়েছেন। ছবির বিভিন্ন দৃশ্যে পেছনে দেখা যায় মাস্টারদা সূর্যসেনের ছবি ও জহির রায়হানের 'জীবন থেকে নেয়া'র পোস্টার। অর্থাৎ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক যে জাতীয়তাবাদ সেটি কোন সয়ম্ভূ বস্তু নয়, তার পেছনে ব্রিটিশ তথা উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান রয়েছে। 'লাল মোরগের ঝুঁটি'তে তাই বলা যায় একাত্তরের পেছনে না গিয়েও ইতিহাস কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের নির্মাণ ও পরিবর্তনকে ঠিকঠাক স্থাপন করেছেন নির্মাতা। একাত্তরকে তিনি অন্য মুক্তিযুদ্ধের ছবির মতো বিচ্ছিন্ন করে ফেলেননি।

এবার শেষ দিকের একটি দৃশ্যে আসা যাক। সেখানে দেখা যায় মোরগ লড়াইয়ের মতো করে পা বেঁধে, অত্যাচার করতে করতে, রাবুকে নাচতে বলে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা নাগভি, তখন পর্দায় লক্ষণার আবির্ভাব ঘটে। অনেকটা মনে হয় রাবুর স্মৃতি থেকেই যেন উঠে আসছে স্কুল অনুষ্ঠানের কোনো নাচের দৃশ্য। কিন্তু দর্শকের বুঝতে সমস্যা হয় না, রাবুর হাত-পা বাঁধা অত্যাচার আর নাচের দৃশ্যে শিকল পরা শিল্পীদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম একই সূত্রে গাঁথা। দর্শকদের এটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না—রাবুর মা যখন যে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মোরব্বা বানাচ্ছিল, তখন একপর্যায়ে সে খোঁচা নিজের হাতে এসে লাগে—সেটা আসলে অত্যাচারিত ও অত্যাচারীর কথাই বলা হচ্ছে।  দর্শক হয়তো এটাও বুঝতে পারেন, মোরগের ডাকের পাশাপাশি কেন বেতার তরঙ্গ এই ছবিতে ঘুরেফিরে আসে। বেতার যে স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে জড়িত, এ যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত শতশত উপনিবেশবিরোধী কথিকা ও উদ্বুদ্ধকারী গানের সঙ্গে সংযুক্ত, মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলাযুদ্ধের কৌশলগত সহযোগী হিসেবে বিজড়িত, তা তো কারও অজানা নয়। মোরগের মতো এই রেডিওটাও ছবির এক ব্রতে পরিণত হয়, যাকে বলে মোটিফ। দুটোই কিন্তু বার্তাবাহকের কাজ করে। এই চলচ্চিত্রে খাঁচাকেও একটি রূপক আকারে ধরণী ও সাহেব আলীর মুখমণ্ডলের সামনে দেখা যায় একাধিকবার। তাছাড়া মোরগের নাম রাখা হয়েছে বাঘা, বাঘ আমাদের জাতীয় পশুও বটে। জাতীয় পশুর ধারণাটিও জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের অংশ। যাহোক, বেতার তরঙ্গ ছাড়াও আরেকটি শব্দ আমরা শুনি— চাবুকের। সাউন্ড মন্তাজ। অত্যাচারের আরেক রূপ এই চাবুক ও চাবুকের শব্দ। ডায়াজেটিক ও নন ডায়াজেটিক—দুইভাবেই চাবুকের শব্দ আমাদের সামনে হাজির হয়। কখনো চাবুকের শপাং-শপাং শব্দের উৎস আমরা দেখি, কখনো দেখি না। বেতার তরঙ্গ ও চাবুক এ দুটোই শব্দের রূপক ও লক্ষণা হিসেবে এসেছে এই ছবিতে।

এখন এই ছবিতে সেই অর্থে মূল চরিত্র বা সরলরৈখিক কোনো গল্প নেই। জনযুদ্ধের সময়কার খণ্ড খণ্ড ঘটনার এক কোলাজ। একটি যুদ্ধ যেমন বহুবিধ অংশগ্রহণে সংগঠিত হয়, তেমনি এই ছবিটিও যুদ্ধের মতোই অনেকগুলো ক্ষেত্র প্রস্তুত করে আমাদের সেখানে নিয়ে যায়। কখনো সাহেব আলীর বাড়ি, কখনো ধরণী মোহনের বাড়ি, কখনো ডোম বাবা-মেয়ের সংসারে, কখনো আবার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া ভীত পরিবারের অন্দরমহলে, কখনো বন্দিশালার ভেতরে নির্যাতিত মানুষগুলোর দুর্দশার চিত্রে, অথবা সেই পাগলিনী মেয়েটির নির্বাক অভিব্যক্তিতে। এই পাগলিনী চরিত্রটির উপস্থিতি খুব কম, কিন্তু অসম্ভব রকম শক্তিশালী একটি চরিত্র। নির্যাতনের একপর্যায়ে প্রাণ হারানো পাগলিনী বোবা মেয়েটির মৃত চোখের চাহনি যে কারও মনে শেলের মতো বিঁধবে। তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও ডোম-কন্যা পদ্মের চরিত্রে অভিনয়শিল্পী নির্বাচনে আরেকটু সাবধানী হলে ভালো হতো। পদ্ম চরিত্রে অভিনয় ভালো হলেও, ওই চরিত্রে অভিনেত্রীকে মানায়নি। আর পাকিস্তানি দুই সেনা নগভি ও মুনওয়ারের চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীরা কখনোই মাপকাঠি উতরে যেতে পারেননি। এছাড়া এই ছবিতে কিছু দৃষ্টিনন্দন শট আছে। বৃষ্টির সময়কার দৃশ্যটির কথাই যদি ধরা যায়। সেগুলো শুধু সৌন্দর্যকেই যেন ধারণ করে আছে। গোটা ছবির সারবস্তু সেখানে প্রতিফলিত হয়নি। কলাকৈবল্যবাদে আক্রান্ত কি? হতে পারে।

তবে সবকিছুর পর এটা বলেই শেষ করতে চাই, যেকোনো শিল্পসৃষ্টিতে ইতিহাস থেকে তুলে আনা ঘটনার সঙ্গে, অর্থাৎ কালিক কাহিনির সঙ্গে, স্থানিক আবহমান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মিলন ঘটানোর প্রচেষ্টা মহৎ শিল্পীর লক্ষণ। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’তে সেটি আছে। মোরগ লড়াই বাংলাদেশের গ্রামবাংলার এক পরিচিত খেলা। শুধু মোরগে মোরগে নয়, মানুষও নিজেদের ভেতর একপায়ে টিকে থাকার খেলাকে মোরগ লড়াই আখ্যা দিয়ে খেলে চলেছে বহু বছর ধরে। এই যে গ্রামীণ একটি খেলাকে এই ছবিতে সত্যিকারের জীবন-মরণ যুদ্ধের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হলো, তা অসাধারণ। আর যুদ্ধটা শহরের লোক করেনি, করেছে সেই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীই। তাই ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’কে আপাতত ভালো সিনেমা বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে কাল পরিবর্তনে অনেক কিছু পাল্টায়। এটি যদি একসময় ভালো থেকে মহতের দিকে যাত্রা শুরু করে তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না, কারণ এর ভেতর সেসব উপাদান রয়েছে।     

 

সহায়

রোমিলা থাপার, জাতীয়তাবাদ ও ইতিহাস প্রসঙ্গে, প্রসঙ্গ জাতীয়তাবাদ, ভাষান্তর: অসীম চট্টোপাধ্যায় (কলকাতা: সেতু প্রকাশনী, ২০১৯)