মৃৎশিল্প হচ্ছে প্রাচীন শিল্পকলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আদিম মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে পৃথিবীর আদি ও অকৃত্রিম উপাদান মাটি দ্বারা মৃৎপাত্র নির্মাণ করেন। মৃৎপাত্র নির্মাণ থেকেই আদিম মানুষের শৈল্পিক চিন্তাভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। মৃন্ময়পাত্র বিশ্বের সব উন্নত সভ্যতায় সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে প্রাপ্ত নিদর্শন মৃৎশিল্পের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। সুদূর অতীতে মানুষ কবে মৃৎপাত্র সৃষ্টি করেছিল, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে আনুমানিক ধারণা করা হয়, নব্যপ্রস্তর যুগে মানুষ মৃৎপাত্র নির্মাণ করে। হেনরি মর্গানের (Henry Morgan) মতে, “মৃৎশিল্পের আবিষ্কারকে বন্যদশা থেকে মানুষের উত্তরণের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।”
মানুষ যখন আগুনের ব্যবহার শেখে এবং পশুর মাংস পোড়ানো খাওয়া শেখে, তখন তাদের দৃষ্টিগোচর হয়, যেখানে মাংস পোড়ানো হতো, সেখানের মাটি পুড়ে সাধারণত একটু শক্ত হয়ে যায়। তখন থেকে আদিম মানুষেরা নিজের প্রয়োজনে নমনীয় মাটি দ্বারা জল বা খাবার সংরক্ষণের প্রয়োজনে মৃৎপাত্র নির্মাণ করে। তারা নানাবিধ কৌশলে নরম মাটিকে ইচ্ছেমাফিক পাত্রের আকার দিত। মৃৎপাত্রে প্রথমত জ্যামিতিক ফর্মে নকশা আঁকত। তারপর মাটির পাত্রকে আগুনে পোড়াত। পোড়ানো মাটির পাত্রটি অনেক শক্ত হয়ে যেত। তখন থেকে মাটির পাত্রকে তারা ব্যবহারের উপযোগী মনে করে। আদিম মানুষেরা যাযাবর জীবন পরিত্যাগ করে দলবদ্ধভাবে বসবাস আরম্ভ করে। কালের পরিক্রমায় আদিকাল থেকে অদ্যাবধি মৃৎশিল্প ব্যবহার্য শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়। পূর্বাকালের মৃৎশিল্পকর্ম ক্রমান্বয়ে নান্দনিকতার উৎকর্ষে সমকালীন সময়ে সমধিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মৃৎশিল্পের আবিষ্কার অনুমাননির্ভর হলেও নৃতাত্ত্বিকরা সুদূর অতীতে যে পুরোনো মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ থেকে বাণিজ্যের স্থান ও পথসমূহ নির্ণয় করেছেন, তা থেকে বিভিন্ন সভ্যতা সম্পর্কে জানা যায়। মৃৎশিল্পের ইতিহাস মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীর সব সভ্যতায় মৃৎশিল্পের নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়। আমেরিকায় খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে মৃৎশিল্পের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাচীন মৃৎশিল্পীদের মতো এখনো কুম্ভকাররা প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারায় মৃৎশিল্প নির্মাণ করেন। আমেরিকার শিল্পকলায় সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আদিবাসীরা। তারা মৃৎদ্রব্য নির্মাণ করত কয়েলিং ও ছাঁচের মাধ্যমে। তারা চাকার ব্যবহার ছাড়াই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে মৃৎপাত্র নির্মাণ করত। আমেরিকায় হোহোকাম জাতির এবং মেক্সিকানদের মৃৎপাত্রের সাদৃশ্য বিদ্যমান। তারা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বহু মৃৎমূর্তি নির্মাণ করত। মেক্সিকোর কুইকুইলকো অঞ্চল এবং মেক্সিকোর অববাহিকা ও উপসাগরীয় অঞ্চল অলমেকে (Olmec) মৃৎপাত্রসহ আঙুলে টিপেটিপে বহু পুতুলসদৃশ্য মূর্তি নির্মাণ করত। নৃতাত্ত্বিকদের জ্ঞান আহরণের ব্যাপ্তি প্রসারিত করেছে ঐতিহাসিক মায়া সভ্যতাসমূহের চিচেন ইৎজাসহ টিকাল (Tikal) ও Uaxactun নগরী। পূজা-অর্চনায় ব্যবহৃত মৃন্ময়পাত্র নির্মাণে প্রাথমিক যুগের অনুরূপ হলেও বহু বর্ণের সমাবেশ লক্ষণীয়। মোগলোন জাতি জ্যামিতিক নকশা এঁকে মৃৎপাত্র সৃষ্টি করত। আবার কিছু কিছু পাত্রে শিকারের প্রাণীকে কেন্দ্র করে প্রাণিচিত্রে শিকারি কাহিনির সাতকাহন মৃৎশিল্পীরা অবলীলায় ফুটিয়ে তুলত। আদিম জাতির ব্যবহার্য মাটির পাত্রের মধ্যে দেখা যায় আঁকাবাঁকা রেখা দ্বারা নকশা। তারা মাটির পুতুল বানাত। পুতুলের সাধারণ অবয়ব ছিল। আবার অনেক পুতুলের যৌনাঙ্গ ও স্তন বর্ধিত আকারে রূপ দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার অব্দে চীনে মৃৎশিল্প নির্মাণ করত। নবপলীয় যুগে চীনে মৃৎশিল্প নির্মাণ হতো। ইয়াংশাও এবং লংশাও যুগে তারা মৃৎপাত্রে রং প্রয়োগ আরম্ভ করে। শাঙজি প্রদেশে পোড়ামাটির তৈরি ঘোড়া আবিষ্কৃত হয়েছে। তাঙ (Tang) রাজত্বকালে চীনারা মৃৎপাত্র পোড়ানো ও ভাস্কর্য নির্মাণে খুবই পারদর্শিতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। তাঙ রাজত্বকালে মৃৎশিল্পে অদ্ভুত জীবজন্তুর মৃৎমূর্তি নির্মাণ করত। ইকজিং জিংসু চীনের মৃৎপ্রদেশ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ইকজিং মৃৎপাত্রগুলোর নকশা উৎকর্ষের শীর্ষ স্থান দখল করে। তারা পোড়ানোর আগে মৃৎপাত্রের বহিঃপার্শ্বে মাছ, পাখি ও জীবজন্তুর নকশা আঁকত। ব্যবহার্য সাধারণ পাত্র, ফুলদানি, কাপ, বাতির শেড ঘোড়া, উট, ড্রাগনের মাথাযুক্ত মগ ও নারীমূর্তি তৈরি করত। চীনা লাল রঙের মৃৎপাত্র শ্রেষ্ঠ মৃৎপাত্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিল। হান আমলে শক্ত ও গ্লেজযুক্ত মৃৎপাত্র নির্মাণ করে। কোরিয়ায় খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নারী ফিগার ও প্রাণীর ফিগার নির্মাণ করে। পরবর্তী তিনটি সিল্লা, জোগোরিও ও বোয়েকজি রাজত্বকালে মৃৎশিল্পের উত্থান ঘটে। কিছু কিছু মৃৎপাত্র তন্মধ্যে “বিকজা” মৃৎপাত্রটি ধর্মীয় বা রাজকীয় কাজে ব্যবহৃত হতো। জাপান মৃৎশিল্পীরা মৃৎপাত্রে নীলাভ সবুজ, হালকা নীল, হলুদ এবং লোহিত রং ব্যবহার করত। সে সময় আরিশা ও উমারি মৃৎশিল্পীরা ফুল, পাখি ও জ্যামিতিক প্যাটার্নে পাত্রের গায়ে নকশা করে। সোমেতসুকে ইমারি মৃৎশিল্পীরা মাছ ও বাঁশ ইত্যাদির চিত্র মৃৎপাত্রের সফেদ পটভূমির ওপর ইন্ডিগো নীলে আঁকত। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতার মতো মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মৃৎশিল্পের বিকাশ ও চর্চা ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে মৃৎটালিসমূহে জীবজন্তুর রিলিফ ভাস্কর্য দেখা যায়। মিসরের কিছু কিছু মৃৎপাত্রের সঙ্গে মেসোপটেমিয়া মৃৎপাত্রের অনেক মিল লক্ষ করা যায়। মেসোপটেমিয়া পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য প্রাচীন সভ্যতাসমূহের অন্যতম তথ্যসমৃদ্ধ সভ্যতা। প্রাচীন মিসর ও রোমান মৃৎশিল্পের সঙ্গে ইসলামি মৃৎশিল্পের বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। ইসলাম ধর্মে প্রাণিচিত্র আঁকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মুসলিম মৃৎশিল্পীরা জ্যামিতিক নকশা, ক্যালিওগ্রাফি, বিমূর্ত নকশা এবং তরুলতা ফুলের নকশা মৃৎপাত্রে ব্যবহার করে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ইসলামি শিল্পকলায় মৃৎপাত্র ব্যবহারের প্রচলন ছিল। ইসলামি শিল্পকলায় লক্ষ করা যায় বর্ণিল টালি দ্বারা মসজিদ, রাজপ্রাসাদ অলংকৃত করে। ইসলামি সভ্যতায় মৃৎশিল্পের ব্যবহার, প্রয়োগ ও উৎকর্ষ পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতায় উচ্চস্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তরের মানুষ ব্যবহারে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিল। ইসলামি মৃৎশিল্পের উন্নতির শীর্ষে ছিলেন বাগদাদের মৃৎশিল্পীরা।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতায় হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোয় বিশাল প্রত্নভাণ্ডারে মৃৎশিল্পের নিদর্শন রয়েছে। মহেঞ্জোদারোয় মৃৎশিল্পীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন মৃৎপাত্র নির্মাণ করত। মৃৎপাত্রে প্রাণীর অবয়ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপস্থাপন করত। তারা প্রাণী ভাস্কর্য, মানুষের ফিগার সিদ্ধহস্তে নির্মাণ করে। কিন্তু সর্বাবস্থায় নারী এবং দেবীর ফিগার বা মূর্তি নির্মাণে যৌন আবেদনময়ী রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। তারা পৌরাণিক কাহিনিনির্ভর মূর্তি নির্মাণ করত। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সিলমোহর, ভারবাহী পশু-টানা ঘোড়া গাড়ি, তৈজসপত্র, পুতুলসহ নানাবিধ মৃৎপাত্র নির্মাণ করে।
বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। বাংলার মৃৎশিল্পকে পাল যুগের কুম্ভকাররা সমৃদ্ধ করে। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের ইতিহাস জানতে গেলে পাল যুগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। দীর্ঘ চারশ বছর পাল রাজত্বের নানা উত্থান-পতনের মধ্যে আর্য জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে সংস্কৃতি, ভাষা ও শিল্পদর্শন প্রভৃতির ফলে বাঙালির নিজস্ব ভিত তৈরিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখে। মৌর্য ও কুষান যুগে প্রতিমাপূজা হতো। এ জন্য অসংখ্য পোড়ামাটির প্রতিমার প্রচলন ছিল। গুপ্ত যুগে টেরাকোটা শিল্প অতিশয় উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। প্রাচীন ঐতিহ্যের সূচনা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে। এসব স্থাপনা সম্পর্কে জানা যায়। মাটির স্তূপ ও গড় অঞ্চল খনন করে কয়েকটি জনপদের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে যেমন পাহাড়পুর, ময়নামতি, মহাস্থানগড়, উয়ারী-বটেশ্বর এবং নাটেশ্বর সভ্যতা। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন “পালপর্বের আগে প্রস্তর ভাস্কর্যের নিদর্শন যে বাঙলাদেশে খুব বেশি নাই, তাহার প্রধান কারণ সুলভ মৃৎশিল্পের প্রসার নমনীয় মাটির নিজস্ব একটা গুণ ও প্রকৃতি তো আছেই; সহজ দ্রুত অঙ্গুলি ও করতালু চালনার ফলে বিচিত্র দ্রুত ভঙ্গি সহজেই রূপ গ্রহণ করে, ডৌলের মার্জনা সহজ নয়। এই মাধ্যমে কাজ করার ফলে বাঙলার লোকায়ত শিল্পের কতগুলো বৈশিষ্ট্য আপনি ধরা দিয়েছিল”। বাংলার ঐতিহ্যবাহী পোড়ামাটির ফলক চিত্রমণ্ডিত বিখ্যাত ইমারতগুলো হলো কুসুম্বা মসজিদ, বাঘা মসজিদ, ষাটগম্বুজ মসজিদ, সাতগম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলী মসজিদ, তারা মসজিদ, বিনত বিবির মসজিদ, খান মোহম্মদ মৃধার মসজিদ, এগারো সিন্দুর সাদী মসজিদ অন্যতম। মূলত হিন্দু শিল্পীদের মধ্যে মন্দিরের কারুকার্য রচনার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন কান্তজিউ মন্দির, সতেরো রত্ন মন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ আরও এমন পুরাতন স্থাপনাতে কারুকার্য শোভাবর্ধন করছে। বাংলার মৃৎশিল্পীর শিল্পকর্মে মানুষের জীবনধারা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতি, চিন্তন-প্রণালি, বিশ্বাস-সংস্কার, উৎসব-প্রার্বণ, ধর্ম-সংস্কৃতি ও তাদের শিল্পচেতনা জড়িত। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে “...লৌকিক মৃৎশিল্প পূর্বতন সু-অভ্যস্ত ছিল, বাঙলাদেশে ছিল সমগ্র গাঙ্গেয়ভূমি জুড়িয়া ছিল। প্রাকৃত ভাবনা কল্পনার তাৎক্ষণিক রূপের ভাষাই তো মৃৎশিল্প। কিন্তু মনে হয়, এই শিল্প আজও যেমন তখনও তেমনই গ্রামে গ্রাম্য জনসাধারণের লোকায়ত জীবনের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল এবং তাহাই ছিল সাধারণ নিয়ম”। প্রাচীন ঐতিহ্যে বংশপরম্পরায় কুম্ভকাররা এখনো বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় যেমন রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, ফেনী, বরিশাল, রংপুর সদরের মোমিনপুর, পীরগাছা উপজেলার অন্তরাম, তাম্বুলপুর, মিঠাপুকুর উপজেলার শান্তিপুর, ডাবরা, চণ্ডিপুর, কুড়িগ্রামের কৃষ্ণপুর, চন্দ্রঘানা, গণ্ডিমারি, সৈয়দপুরের চওড়াপাড়া, দিনাজপুর, সিলেট, ঢাকা রায়েরবাজার, গাজীপুরে কালিয়াকৈর, সাভারের নবীনগর, নলাম, ভাগলপুর, ময়মনসিংহের বলাশপুর, কৃষ্ণপুর, রাণীগঞ্জ, বালিপাড়া, বইলর, মুক্তাগাছার সোনারগাঁ, মণ্ডলসেন, ফুলবাড়িয়ার ধামর, টাঙ্গাইল গোপালপুরে পাকুটিয়া, ডুবাইল, সুতি, নতুন শিমলাপাড়া (দক্ষিণ হেমনগর), শেরপুর, জামালপুর সদরে বজ্রাপুর, সরিষাবাড়ী, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহের মেঘারবাড়ি পাল বাড়িতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চাকের সাহায্যে এবং হাতে টিপে টিপে মৃৎদ্রব্য নির্মাণ করে। মৃৎপাত্র নির্মাণে অঞ্চলভেদে এই মাটিকে কুম্ভকাররা রাগমাটি, বালিমাটি, মইনমাটি, মাইটাল মাটি নামে অভিহিত করে। আবহমান গ্রামবাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের নিদর্শন, কুম্ভকারের সুনিপুণ স্পর্শে কাদামাটিকে যেভাবে তার চাকে পাত্রটিকে “শেপ” দেন তা সত্যিই এক দর্শনীয় ব্যাপার। বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ মৃৎশিল্পীরা হলেন মৃৎরাজ মরণচাঁদ পাল, লালচান পাল, হরিপদ পাল, সন্তোষচন্দ্র পাল ও গোবিন্দচন্দ্র পাল প্রমুখ। বৈদিক কাল থেকে শূদ্র শ্রেণির সম্প্রদায়গণ কুম্ভকার নামে চিহ্নিত হয়ে আসছে। এদের উপাধি পাল। বংশপরম্পরায় এঁরা মৃৎশিল্পে কর্মরত থাকলেও সমকালীন সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এ পেশা সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষ মৃৎশিল্প পেশায় নিয়োজিত। বর্তমানে এ পেশায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা মৃৎশিল্পী বা শিল্পী হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় মৃৎশিল্পের ব্যাপ্তি সম্প্রসারিত হয়েছে। “কলকাতার স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট” নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ১৮৬৪ সালে সরকার অধিগ্রহণ করে এবং এ-প্রতিষ্ঠানে হেনরি হোভার লককে অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। হেনরি হোভার লক স্কুলের পাঠক্রমে “মডেলিং এবং মৃৎশিল্প” বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করেন। শিল্পচর্চা ও শিল্পবোধের ভিত প্রতিষ্ঠায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তৎকালীন ঢাকায় “গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস” প্রতিষ্ঠা করেন। এ-ইনস্টিটিউটে মৃৎশিল্প বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মরণচাঁদ পালকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পাঙ্গনে আধুনিক ধারার প্রবর্তক মৃৎরাজখ্যাত মৃৎশিল্পী মরণচাঁদ পাল। তিনি মৃৎশিল্পের আধুনিক ও লোকজ ধারা সংমিশ্রণে স্বকীয়তার এক যুগান্তকারী পথপ্রদর্শক। গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস এ মৃৎশিল্প বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে মীর মোস্তফা আলী। মীর মোস্তফা আলী ইংল্যান্ডে স্টুডিও সিরামিক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিরামিকের ওপর শিক্ষা গ্রহণ করেন। তার হাত ধরেই বের হয়েছে এ দেশের প্রথম শিক্ষিত মৃৎশিল্পী। মীর মোস্তফা আলীকে দেশের আধুনিক মৃৎশিল্পের পথিকৃৎ বলা যায়। মৃৎশিল্পকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারুকলা কলেজসমূহে মৃৎশিল্প বিভাগ রয়েছে। প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী মৃৎশিল্প বা সিরামিক বিভাগে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প বিভাগের অধ্যাপক ড. আজহারুল ইসলামসহ মাজহারুল ইসলাম ইকবাল, সাইদ তালুকদার, দেবাশীষ পাল, ফজলুল করিম কাঞ্চন, আব্দুল মতিন তালুকদার, স্বপন শিকদার সফলতার সঙ্গে শিল্পচর্চা করে চলেছেন। প্রতিবছর মৃৎশিল্পের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
মৃৎশিল্পী অধ্যাপক স্বপন শিকদারের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পী মুহাম্মদ আব্দুর রউফ মৃৎশিল্পচর্চা করে চলেছেন। মুহাম্মদ আব্দুর রউফ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিরামিক ডিপার্টমেন্টে কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। অধ্যাপক আব্দুল মতিন তালুকদারের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র আব্দুর রউফ। লেখাপড়া শেষ করে আব্দুর রউফ ঢাকা সাভারে কয়েকজন মিলে “মৃন্ময়” নামে একটি মৃৎশিল্প কারখানা গড়ে তোলেন। আব্দুর রউফ কিছুদিন পর “মৃন্ময়” মৃৎশিল্প কারখানা ছেড়ে দেন। এরপর আব্দুর রউফ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চারুকলা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহে অধ্যাপনায় আত্মনিয়োগ করেন। বর্তমানে মুহাম্মদ আব্দুর রউফ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চারুকলা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহে অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) পদে কর্মরত। আব্দুর রউফ স্যারের শিক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে এক উদার নৈতিক চেতনা বিদ্যমান। তিনি “একুশে স্মৃতি পদক” ও “শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড ”সহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন। তার অনেক শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে অধ্যাপনা করছেন। তিনি মেলান্দহে নিজস্ব স্টুডিওতে ইতিহাস ঐতিহ্যসংবলিত মৃৎদ্রব্য, টেরাকোটা, লক্ষ্মীসরা, ব্যবহার্য তৈজসপত্র, প্রতিকৃতি, প্রাণীর প্রতিকৃতি, শোপিস, ডাইনিং আইটেম, ইনডোর গার্ডেন আইটেম এসব নান্দনিক মৃৎশিল্পে সমৃদ্ধ করেছেন। মৃৎফলকে ফুটিয়ে তুলেছে লৌকিক জীবনের বহুতা রূপ। অনেকগুলো ফলকে যুগলনারী, নৃত্যরত নারী, কর্মরত নারী, বাউল, সন্ন্যাসী, লাঙলে জমি কর্ষণরত কৃষক, নিসর্গ, লোকায়ত জীবনের রূপায়ণ সহস্রাব্দ বছরের ঐতিহ্যের নিরূপম নিদর্শন। মৃৎশিল্পের নকশায় পরিবর্তন, পণ্য উন্নয়নে নানা বৈচিত্র্য মাটির কষ দিয়ে রং তৈরি করেন।
বাংলাদেশের কুম্ভকাররা নদীতীরবর্তী অঞ্চলে আবাস্থল গড়ে তোলে। বংশপরম্পরায় তারা এ কর্ম গতানুগতিক পদ্ধতিতে শেখে। মেলান্দহ মেঘারবাড়ি আম্রিতলা পালপাড়া রনজিত পাল, পলিন চন্দ্র পালসহ ২০-২৫ জন মৃৎশিল্পের কাজ করে। তারা প্রাচীন আবহমান গ্রাম্য ঐতিহ্য হাঁড়ি-পাতিল, কাদা (জলকান্দা), সাজের ডোগা, মটকি, মুড়ি ভাজার ঝাঁজর, ধূপদানি, পিঠা তৈরির পাত্র, দইভাণ্ড, লবণের বাটি, সানকি, শস্য রাখার গোলা, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক (টাকা রাখার জন্য), পানির কলস, ডাকনা, কড়াই, পুতুল, ঘোড়া-গাড়ি, শিব, গণেশ, নারায়ণ, সরা, বিভিন্ন খেলনা সামগ্রী, প্লেট, বিভিন্ন ধরনের ফলফলারি, নানা ধরনের জীবজন্তুর প্রতিকৃতি, শখের হাঁড়ি ইত্যাদি নির্মাণ করে। পলিন পালের ভাষ্যমতে, “পারিবারিকভাবে শৈশব থেকে আমরা এ পেশায় সম্পৃক্ত। এখন মানুষ প্লাস্টিক, স্টিলের এবং মেলামাইনের তৈজসপত্র কেনে তাই বিক্রি তুলনামূলক অনেক কম। হাঁড়ি-পাতিল বেশি একটা চলে না ফুলের টব এর জন্য বিভিন্ন নার্সারি থেকে অর্ডার আসে ইদানীং এর চাহিদা বেড়েছে। পূজা-অর্চনা এবং পয়লা বৈশাখে যখন গ্রাম্য মেলা হয় তখন কিছু বিক্রি হয়। তা ছাড়া বেশির ভাগ সময় বেকার বসে থাকি। অর্থাভাবে দিন যায় বেশির ভাগ সময়। ছেলে (রিপন পাল) লেখাপড়া শিখেও বেকার বসে আছে”। জামালপুর বজ্রাপুরের রবীন্দ্র কুমার পাল বলেন, “শীত মৌসুমে পিঠা বানানোর হাঁড়ি-পাতিল, ঢাকনা বিক্রি বেশি হয়। ফেরি করে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করি। সরকারের কোনো আর্থিক সহায়তা পাই না। সরকারের আর্থিক সহায়তা পেলে আমাদের গর্বের, অহংকারের এই মৃৎশিল্পসামগ্রী পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে টিকিয়ে রাখতে চাই”। পুরুষের সঙ্গে নারী কুম্ভকাররা হাতে টিপে টিপে পুতুল ও বিভিন্ন খেলনা তৈরি করে। প্রাচীনকালে পুতুল ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর তৈরি করত। এখন কুসংস্কার কেটে গেছে, পুতুল খেলনাসামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পুতুলের উল্লেখযোগ্য স্থান কার্তিকপুর, রাজশাহী ও বগুড়া অঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি নামক স্থানে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী ‘কৃষ্ণনগরের পুতুল’ এবং “টেপা পুতুল” বিশ্বব্যাপী পরিচিত। সরাচিত্র বাংলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মধ্যে প্রচলন ছিল। সম্প্রতি মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এর ব্যবহারের প্রভাব লক্ষ করা যায়। মুসলিমদের ঘরে এখন শোভা পায় বিভিন্ন আঙ্গিকের আলপনায় আঁকা সরাচিত্র। লোকায়ত শিল্পের সর্বাধিক ব্যবহৃত “শখের হাঁড়ি” বাংলাদেশের সব কুম্ভকাররা নির্মাণ করে থাকেন। অঞ্চলভেদে এর নানা রকম নাম, ঢাকা ও রাজশাহী জেলার শখের হাঁড়ির খ্যাতি দেশব্যাপী। মৃৎশিল্পীদের শৈল্পিক ভাবনা থাকলেও নেই বিলাসিতা। গ্রাম্য মৃৎশিল্পীরা সাধারণত নিম্ন শ্রেণির হওয়ায় অর্থাভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তাদের জীবন। গতানুগতিক ধারায় এ পেশাকে অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশে মৃৎশিল্পের বিপণন ব্যবস্থা ভঙ্গুর। মৃৎশিল্পের তীর্থস্থান ফিলিপাইনের মতো বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন, গ্রাম্য মৃৎশিল্পের উন্নয়ন ও মৃৎপণ্য রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ সহজলভ্যসহ নানাবিধ সুবিধার উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা রাখা দরকার।
কালের পরিক্রমায় শিল্পায়নের যুগে কুম্ভকারদের কাজে আগের মতো আর জৌলুশ নেই। কাজের ব্যস্ততা কমে গেছে, বাঁচার তাগিদে অনেকেই অন্য পেশা গ্রহণ করেছে। অনেকেই আবার পৈতৃক পেশা চালাতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতায় জর্জরিত। প্রাচীন আমলের উৎপাদন পদ্ধতিতে পালেরা মৃৎপণ্য তৈরি করেন। গতানুগতিক পদ্ধতি যতটা সম্ভব পরিহার করে আধুনিক উৎপাদনে অগ্রসর হতে হবে। আধুনিক ইলেকট্রিক্যাল চাক, ইলেকট্রিক্যাল চুল্লি, ফায়ার ব্রিগ স্লাব, ফার্নেস অয়েল, গ্যাস ফায়ার, গ্লেজ ফায়ার, অক্সাইট, সিলিকেট, ব্যবহারে প্রশিক্ষিত করতে পারলে কুম্ভকারদের দুঃখ লাঘব হবে। তাছাড়া মৃৎশিল্প সামগ্রী প্রাচীন ঐতিহ্যে নির্মাণ হলেও মৃন্ময়পাত্রের সমকালীন চাহিদা অনুযায়ী সরকারি, বেসরকারি, আর্থিক সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কিংবা মৃৎশিল্পীদের উদ্যোগে একটি সংগঠন করে পর্যায়ক্রমে এর পরিধি প্রসারকল্পে তদারকি প্রয়োজন। মৃৎশিল্পী ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ঐতিহ্যময় মৃৎশিল্পের সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিপণন গবেষণা প্রয়োজন বোধ করি। মৃৎশিল্প সামগ্রী শুধু নিম্ন শ্রেণির মানুষদের তৈজস নয়, বরং আধুনিক জীবনযাত্রায় এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অভিজাত বিপণন প্রতিষ্ঠানে মৃৎশিল্প (কিছু কিছু আইটেম) সামগ্রী বিক্রির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের মৃৎদ্রব্য পণ্য বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ৫২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশের মৃৎশিল্পীরা আমাদের ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছেন।
লেখক : প্রভাষক (শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ), শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চারুকলা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ।