স্মরণ

যেভাবে লিখতেন হাসান আজিজুল হক

সাজ্জাদ বকুল প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২১, ০৭:৪১ পিএম

আমুদে, আড্ডাপ্রিয় মানুষ হিসেবে খ্যাতি ছিল কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের। তাঁর আড্ডায় একবার কেউ বসলে ওঠার কথা ভুলে যেত। কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্য শুনতে গিয়ে শ্রোতারা ভুলে যেত কখন যে এক-দেড়-দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে অনায়াসে! আবার খুব সক্রিয় ছিলেন নানা ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও। রাজশাহীতে এমন কোনো ইস্যুতে বা জাতীয় কোনো সংকটে তাঁকে মাঠে দেখা যেত হামেশাই। তাঁকে পাশে পেয়ে কর্মীদের সাহস বেড়ে যেত অনেকটাই। আবার শিক্ষকতার কাজ তো ছিলই। তাঁর ক্লাস করার জন্য অন্য ক্লাসের শিক্ষার্থীরাও উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করত বলে শোনা যায়।

লেখালেখির বাইরে এতো কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকা এই মানুষটা এতো বড় সাহিত্যিক হয়ে উঠলেন কীভাবে? এতো লিখলেনই বা কীভাবে? এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তবে তাঁর লেখার সঙ্গে যারা পরিচিতি তাঁরা জানেন, হাসান আজিজুল হক লিখেছেন বেশ কম। ‘ছোটগল্পের বরপুত্র’ হিসেবে ডাকা হয় তাঁকে। অথচ ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে পরের ৬০ বছরের সাহিত্যজীবনে হাসান ছোটগল্প লিখেছেন একশোর মতো। কয়েকটি সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে সেসব গল্প। তাঁর উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে মাত্র দুটি: ‘আগুনপাখি’ ও ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’। ‘শিউলী’ নামে একটা বড় লেখা আছে যেটিকে তিনি উপন্যাসিকা বলতেন। 


হাসান আজিজুল হক প্রবন্ধ লিখেছেন বেশ কিছু। লিখেছেন শিশুদের জন্য কিছু গল্প। আর শেষ জীবনে এসে লিখতে শুরু করেছিলেন আত্মজীবনী। চারটি খণ্ডে তাঁর সেসব স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়েছে। আরো লেখার ইচ্ছে ছিল। হয়ে উঠল না। আরো দুটি উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী এই কথাশিল্পী। এর একটি ‘মাটির বাড়ি: যতোদিন চন্দ্র, সূর্য’। এটি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের যবগ্রামে তাঁর ছেলেবেলায় তাঁর বাবার মাটির বাড়ি তৈরির গল্প। এই গল্পেও আগুনপাখির মতো উঠে আসত সে সময়ের রাঢ়বঙ্গের জীবন, সংস্কৃতি, সংগ্রাম, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির চিত্র। আমার সঙ্গে আলাপে তেমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এই লেখক। কিন্তু মাত্র ১০-১১ পৃষ্ঠা লেখার পরে করোনা মহামারিতে গৃহবন্দী হয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ায় আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। 

আরেকটি উপন্যাস লেখার খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর। এর নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘তরলাবালা’। বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন নারীকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে বড় পরিসরে এই উপন্যাসটি তিনি লিখতে চেয়েছিলেন। তবে তা আর হয়ে ওঠেনি। বেশ ছোট পরিসরে তা লিখে বাংলাদেশে তাঁর বেশ কিছু বইয়ের প্রকাশক ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের জহিরুল আবেদীন জুয়েলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এটি এখনো প্রকাশিত হয় নি। তবে যে মাপের উপন্যাস হিসেবে এটি লিখতে চেয়েছিলেন তা আর হয়ে ওঠেনি। 
আসলে হাসান আজিজুল হক খুব বেছে বেছে লিখতেন। তাঁর প্রায় সব লেখাই তাঁর অভিজ্ঞতাজাত। বাস্তব থেকে রসদ নিয়ে তিনি লিখেছেন অসাধারণ সব ছোটগল্প। সেসব গল্পের ভাষাশৈলি, তাঁর জীবনবোধ গল্পগুলোকে বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তব করে তুলেছিল। তাই তো বাস্তব ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ বাংলা সাহিত্যের একটি অমর ছোটগল্প হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ রকম তাঁর বাস্তব থেকে নিয়ে লেখা বহু গল্প কালোত্তীর্ণ হয়েছে।

এই বেছে বেছে লেখার জন্যই তিনি লেখালেখির বাইরেও প্রচুর সময় পেতেন। তিনি আমাকে অনেকবার বলেছেন, ‘এতো প্রসব করে কী হবে?’ তিনি একটা গল্পের প্লট বহুদিন ধরে মাথায় নিয়ে ঘুরতেন। গল্পের কাঠামো, চরিত্র নিয়ে অনেক ভাবতেন। যখন সবদিক দিয়ে তাঁর মনে হতো, এবার গল্পটা জমাট বেঁধেছে, তখনই লিখতে বসতেন। আবার লিখতে লিখতেও এগিয়েছে, কিছুটা বিরতি দিয়েছেন, আবার কলম ধরেছেন। এভাবে একেকটা ছোটগল্প লিখতেই তিনি অনেক সময় নিয়েছেন। এভাবে তিনি লিখেছেন খুব কম। কিন্তু তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে একেকটা অগ্নিগোলকের লক্ষ্যভেদী ছোটগল্প। 

এসবই তাঁর কাছ থেকে আমার শোনা। তাঁর সঙ্গে যখন আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে তখন তিনি গল্প লিখে রীতিমতো বিখ্যাত। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেবার পরেই তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি পরিচয়। এরপর আমার প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদে তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা রাখা এবং আমি তাঁর স্বপ্নপ্রসূত সংগঠন ‘বাংলাদেশ চর্চা পাঠচক্র’-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে ধীরে ধীরে আমি রাজশাহীতে হাসান আজিজুল হকের অন্দরমহলের মানুষ হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছি। 

এভাবে নানা আড্ডায় তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু, লেখালেখি নিয়ে ভাবনা, সমাজভাবনা, রাষ্ট্রভাবনা- এসব জানার সুযোগ হয়েছে আমার। তাতে দেখেছি, তিনি যতোটা ভাবতেন, লিখতেন তার চেয়ে কম। তবে যা লিখেছেন সেগুলো একেকটা হীরে-মণি-মুক্তার মতো জ্বলজ্বলে। এতো কম লিখে এতো খ্যাতি আর ক’জন সাহিত্যিকের ভাগ্যে জুটেছে তা বলা মুশকিল। মেধা ও সৃজনশীলতার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সকল পুরস্কার ও সম্মাননাই পেয়েছেন। সেই যে ১৯৭০ সালে মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু, এরপর বহু পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় ও প্রথম সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক (১৯৯৯) ও স্বাধীনতা পুরস্কারও (২০১৯) রয়েছে। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের জন্য ২০০৮ সালে কলকাতার সম্মানজনক ‘আনন্দ পুরস্কার’ও হাতে উঠেছে এই গুণি লেখকের। 

এই লেখকের মহাপ্রয়াণ ঘটল। সেই যে ১৯৬০-এর দিকে রাজশাহীতে এলেন এরপর প্রায় ৬০ বছর রাজশাহীতেই কাটিয়ে দিলেন। রাজধানীতে স্থায়ী হবার সকল আমন্ত্রণ সযত্নে উপেক্ষা করেছেন। রাজশাহীকে ভালোবেসে এখানে বসেই তিনি সৃষ্টি করে গিয়েছেন তাঁর কালজয়ী সব সাহিত্য। রাজশাহী শহরের প্রবেশমুখে বিহাসে তাঁর নিজ বাসভবন ‘উজান’ ছিল তাঁর সৃষ্টিকর্মের একটা বড় অংশের আঁতুড়ঘর। এখানে বসেই রাজশাহীর নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আড্ডার সময় কেটেছে। সেই ‘উজানে’ই তিনি ১৫ নভেম্বর রাত সোয়া নয়টার দিকে শেষ নিঃশ্বাসটুকু বিলিয়ে দিলেন। আজ রাজশাহীবাসী পরম মমতায় তাঁকে চিরদিনের মতো শায়িত করল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে। 

সারাজীবন লেখালেখি, বই নিয়ে কাটানো মানুষটার শেষ ঠিকানাও হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বইভাণ্ডারের সামনে। রাবি ক্যাম্পাসের প্রতিটি মাটিকণা হাসান আজিজুল হকের স্মৃতিধন্য। এই বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভুলবে কীভাবে? এই দেশ তাঁকে ভুলবে কীভাবে? পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের যবগ্রামের মাটিতে নাড়ি পোঁতা এই মানুষটার পুরো শরীর যে পোতা রইল এই বাংলার রাজশাহীর মাটিতে। এ বন্ধন অবিচ্ছেদ্য।

শারীরিকভাবে হাসান আজিজুল হক হারিয়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-স্মৃতিকথায় তিনি চির অমর হয়ে রইবেন। দুই বাংলার মানুষের সম্প্রীতিময় সহাবস্থান হবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উপায়। যে মানুষটি বলেছিলেন, ‘দেশভাগ মেনে নিয়েছি, মনে নেই নি’- সেই মানুষটা দুই বাংলার মধ্যে একটা সেতুবন্ধন রয়ে রইলেন। যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তিনি দেখতে চেয়েছিলেন সেটা আমরা গড়ে তুলতে পারলে এই কৃতী কথাসাহিত্যিকের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারব। আজ সমাহিত করে এসে হাসান আজিজুল হকের প্রতি ভালবাসা জানিয়ে এই প্রত্যাশাই রেখে যাচ্ছি।