প্রথমেই বলে নিই বাংলাদেশের ছবি নিয়ে আসলে বিশেষ কিছু লেখার থাকে না বলে বাংলাদেশের ছবি নিয়ে লেখা হয় না। হাতে গোনা কিছু ছবি তৈরি হয় বাংলাদেশে, যা নিয়ে লেখার সুযোগ তৈরি হয় বা লেখকরা লিখতে প্রলুব্ধ হন, বাহাসে জড়ান। এদিকটা তো বটেই, বিষয়ের দিক দিয়েও যদি বিবেচনা করি তো এককথায় বলা যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ বানিয়েছেন। এটি তার দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র।
আমার এই লেখার বক্তব্য হলো: ছবিটির মূল চরিত্র রেহানা মরিয়ম নূর (আজমেরি হক বাঁধন) যে কারণে শক্তিশালী, ঠিক সেই কারণেই ব্যর্থ। সমান্তরালে দেখি পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ যে কারণে স্বতন্ত্র চিত্রভাষ তৈরি করেছেন এই ছবিতে, অর্থাৎ যেটি তার মূল বয়ানভঙ্গি, ঠিক সেটার কারণেই ছবির দর্শক বঞ্চিত হয়েছে। কথাগুলো হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হতে পারে, তবে চলুন ধাঁধার উত্তরটি খোঁজা যাক।
এই ছবিতে একটি বিশেষ ভঙ্গিতে গল্পটি বলার চেষ্টা করেছেন পরিচালক সাদ। হাতে ধরা ক্যামেরা অর্থাৎ তেপায়ার ওপর ক্যামেরা কখনোই বসেনি স্থির হয়ে, ক্লোজ ও মিডক্লোজ শট এবং নীল কালার পেলেট, ভাঙা ভাঙা সংলাপ—এসব মিলিয়ে সাদ বলার চেষ্টা করেছেন স্কুলের বাচ্চা মেয়ে থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজের পরিণত মেয়ে, সব ক্ষেত্রেই ছেলে বা পুরুষের ‘এবিউসিভ’ আচরণের শিকার হয় নারী। এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে গল্পের প্রধান চরিত্র রেহানা। শুধু এই ক্ষেত্রে নয়, পরীক্ষায় কেউ অসদুপায় অবলম্বন করলে, তার বিরুদ্ধেও রেহানা প্রতিবাদী। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই চরমভাবে নীতিপরায়ণ ও নতি স্বীকার না করতে চাওয়া মানুষ সে।
রেহানা যেন কান্টীয় (ইমানুয়েল কান্ট) নৈতিকতার সর্বজনীন নিয়মের অনুসারী। অর্থাৎ সে কোনো ক্ষেত্রেই অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করবে না বলে ঠিক করে নিয়েছে। মেডিকেল কলেজের শিক্ষক আরেফিনের অপরাধের কাছে বা কর্তৃপক্ষের অন্যায় প্রস্তাবের কাছে সে যেমন নতি স্বীকার করেনি, আবার স্কুলে মেয়ে ইমুর সঙ্গে হওয়া ঘটনার জন্যও সে ‘সরি’ বলতে নারাজ। কান্টের ভাষায়, ‘ইউনিভার্সালাইজেশনে’র নজির আমরা এখানে দেখি রেহানার ভেতর। তবে নৈতিকতার সর্বজনীন প্রয়োগ যে মাঝে মাঝে ব্যক্তির জন্য অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেটি খেয়াল করেই কান্ট বলেছিলেন ‘অটোনমি’র কথা। ব্যক্তির ইচ্ছা ও স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। সর্বজনীন নিয়মের কথা বলে সমাজ কখনো যদি কোনো খারাপ রীতি চাপিয়ে দিতে চায়, সেখান থেকে উত্তরণের পথ এই ‘অটোনমি’। কিন্তু এই কান্টীয় নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন আরেক ভাবুক বেঞ্জামিন কনস্ট্যান্ট। তিনি আপনার ঘরের দরজায় খুনি দাঁড় করিয়ে দেন। খুনি এসে যদি আপনার বাসায় লুকিয়ে থাকা বন্ধুর খোঁজ জিজ্ঞেস করে, তাহলে নৈতিক জায়গা থেকে আপনাকে সত্য বলতে হবে। কান্ট এই জায়গায় কিন্তু বলবেন, বন্ধুকে বাঁচাতে হলে সত্য বললে বিপদ, তাহলে অসত্য বা মিথ্যা বলো না। এমন কিছু একটা বলো যাতে অসত্য না হয়, আবার বন্ধুকেও বাঁচানো যায়। অর্থাৎ কৌশলের কথা বলেছেন কান্ট। এতে করে বন্ধুর বেঁচে থাকার ইচ্ছা (অটোনমি) বজায় থাকল, আবার আপনি সর্বদা সত্য কথা বলার নিয়মও (ইউনিভার্সালাইজেশন) ভঙ্গ করলেন না। এ ক্ষেত্রে অবশ্য খুনির ব্যক্তিগত ইচ্ছা উপেক্ষিত থাকছে। তখন প্রশ্ন উঠবে, খুনটা আসলে কী কারণে? খুনটা বড়, না খুন করতে চাওয়ার কারণটা বড়?
দার্শনিক প্রশ্নের গোলকধাঁধায় না ঢুকে আমরা যদি মোটা দাগে রেহানাকে কান্টীয় ছকের ভেতর ফেলি, তাহলে দেখব রেহানা যতটা ভীষণরকম দায়িত্ববোধসম্পন্ন হাসপাতালের ক্ষেত্রে, কিন্তু নিজের সন্তানের বেলায় ততটাই দায়িত্বহীন অভিভাবক। রেহানা যতটা নীতিপরায়ণ নিজের ছাত্রীদের ক্ষেত্রে, ততটাই নীতিহীন ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রে। সে হাসপাতালে দিনরাত সমান করে দায়িত্ব পালন করে এবং সে যখনই অপরাধ সংঘটিত হতে দেখে, অপরাধীকে শাস্তি দিতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে। মামুলি নকলের জন্য মিমি নামের এক ছাত্রীর পরীক্ষা বাতিল করে বহিষ্কার করে দেয় রেহানা, লঘু পাপে গুরু শাস্তি, আবার ড. আরেফিনের নৈতিক স্খলনের শাস্তি দিতে সে পুরো ঘটনা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিতেও কসুর করে না, চাকরির মায়া ত্যাগ করে। ওদিকে মেয়েকে সহপাঠীর কাছে ‘সরি’ বলতে হবে বলে, সে মেয়ের স্কুলের অনুষ্ঠান বাতিল করছে। সে জেনেছে ইমুর সহপাঠী ছেলেটিই প্রথমে তাকে চিমটি দিয়েছে, দোষ ওই ছেলের, তার মেয়ে ‘সরি’ বলবে কেন? কাজেই ইমু অনুষ্ঠানে যাবে না, দুঃখও প্রকাশ করতে হবে না। কিন্তু রেহানা খেয়াল করছে না, এতে করে ছোট্ট ইমুর ব্যক্তিইচ্ছা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। নীতির জায়গায় রেহানা অটল, কিন্তু ছোট্ট মেয়েটির মন যে ভেঙে দিচ্ছে, সে ব্যাপারে রেহানা বেখেয়ালি শুধু নয়, স্বৈরাচারী। আরও একটি জায়গায় তার এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবিরোধী মনোভাব পাওয়া যায়। অ্যানি নামের শিক্ষার্থীটি, যে শিক্ষক আরেফিনের লালসার শিকার হয়েছে বলে ধারণা করে রেহানা, সেই অ্যানিকে একদিন সে বলে ওঠে, এত কড়া পারফিউম যেন ব্যবহার না করে, সুগন্ধি ব্যক্তিগত জিনিস, সবার জন্য না।
অ্যানি চরিত্রটি অতটা জটিল নয়। হয় সে আরেফিনের কাছে নিয়মিত যেত, নয়তো যেত না। রেহানা যখন তাকে ব্যাপারটি শেষের দিকে আবার জিজ্ঞেস করে, তখন সে সদুত্তর দিতে পারেনি। এতে করে রেহানা আরও বেশি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রেহানা বুঝতে পারে না তাহলে লড়াইটা সে কার জন্য করছে, যদি আরেফিনের দাবি অনুসারে অ্যানির সঙ্গে তার মোবাইলে আগে থেকে যোগাযোগ থাকে এবং পারস্পরিক সম্মতি নিয়েই সব হয়, তাহলে এত কিছু কার জন্য? অ্যানি এখানে গৌণ হয়ে ওঠে, মুখ্য হয়ে ওঠে নীতির প্রশ্ন। ছাত্রীর সঙ্গে একজন পুরুষ শিক্ষক অনৈতিক আচরণ করতে পারে না—এটাই হয়ে দাঁড়ায় মূল বক্তব্য। অ্যানি শুরু থেকেই আরেফিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে মানা করছিল, বেশ জোর দিয়েই সেটা করছিল সে। আর অ্যানির এই অবস্থান রেহানার পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তোলে। এমনিতেই তাকে যন্ত্রণাক্লিষ্ট ও পীড়িত মানুষ হিসেবে আমরা দেখি। এরপর দেখি মেয়ের প্রতি অযথা কঠোর ব্যবহার (কান ধরিয়ে ওঠবস, দরজা বন্ধ করে রাখা, জোরে ধমক দেওয়া), ছাত্রীদের প্রতি সীমা অতিক্রম করা অনমনীয় আচরণ (বহিষ্কার করা, চড় মারা) ও শাসনের মানসিকতা (অ্যানিকে কড়া সুগন্ধি দিতে মানা করা) সম্পন্ন।
রেহানার এমন মনোভঙ্গির পেছনের কারণ বা ব্যাখ্যা আমরা ছবিতে পাই না। রেহানা চরিত্রটি শুরু থেকেই বেশ কঠোর, তাকে হাসতে দেখা যায় না, হাসলেও সেখানে কষ্ট ঝুলে থাকে, পরে বোঝা যায় তার স্বামী বিয়োগ ঘটেছে, সে জন্য সাজপোশাকেও খুব সাদামাটা ও রক্ষণশীল। ওজু ও নামাজ আদায়ের ভেতর দিয়ে তাকে ধার্মিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে দেখা যায় ছবিতে। রেহানা মরিয়ম নূর একজন বাঙালি মুসলমান নারীর নাম। বাঙালি মুসলমানরা যদি আহমদ ছফার বয়ান অনুসারে, হীনম্মন্যতায় ভোগে, তাহলে বাঙালি মুসলমান নারীরা হীনম্মন্যতায় শুদ্ধ নয়, অবদমিতও বটে। রেহানা সেই কারণেই কি বেশির ভাগ সময় ফিসফিস করে, অনুচ্চস্বরে কথা বলে? হীনম্মন্যতার কারণেই কি সে স্কুলের অভিভাবকদের বৈঠকে যায় না, মেয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করে না? অবদমনের কারণেই কি রেহানার ভেতর আমরা প্রেম বা ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাই না? (দয়া করে বাঙালি মুসলমান নারীর বৈশিষ্ট্যের ধারণাটি কান্টের মতো সর্বজনীন হিসেবে ধরে নেবেন না) এসব প্রশ্নের উত্তর ছবিতে নেই। কেন রেহানা চরিত্রটি এমন, তার ব্যাখ্যা ছবিতে থাকতে পারত, অবশ্য থাকতেই হবে তারও কোনো নিয়ম নেই। দর্শক শুধু দেখতে পায় পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশ ও ধর্মীয় অনুশাসনের ভেতর নিজের নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা ছুঁতে বেপরোয়া, এমনকি নিষ্ঠুরও হয়ে ওঠে রেহানা। শেষে তো মনে হচ্ছিল বাচ্চা মেয়েটি কথা শুনতে অবাধ্য হচ্ছে বলে ওর আঙুলগুলো দরজায় থেঁতলে দেবে রেহানা। ছবিটি শেষ হয় বাচ্চাটিকে অফিসকক্ষে বন্ধ করে দেওয়ার ভেতর দিয়ে, আর বাচ্চাটি দরজা খোলো, দরজা খোলো বলে কান্না করছিল।
অনেকেই রেহানার ভেতর নারীবাদ দেখেছেন, দেশ ও বিদেশের অনেকের লেখাতেই সেটা চোখে পড়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে এই আখ্যা দেওয়াটা একটু সমস্যাসঙ্কুল। কারণ, নারীবাদের কথা যদি বলেন, তাহলে বলতে হয় প্রকৃত নারীবাদী আলাপ হয়েছে হাসপাতালে অসুস্থ রেহানাকে দেখতে আসা দম্পতির ভেতর। তারা নারী-পুরুষের সমান সমান কাজ ভাগাভাগি নিয়ে বাহাস করে। পুরো ছবিতে এ জায়গাটির সংলাপই বেশ উজ্জ্বল মনে হয়। বাকি ছবির সংলাপ বলতে গেলে অনুজ্জ্বল। এখানেও মনে করি শিল্পীর স্বাধীনতা ষোলো আনা। তবে সৃষ্টির পর যেহেতু রচয়িতার মৃত্যু ঘটে, তাই দর্শনপূর্বক তরজমায় কিছুটা স্বাধীনতা তো নেওয়াই যায়। লক্ষ করলে দেখবেন, নারী ও পুরুষ নিয়ে বিতর্কের এই অংশটিতে রেহানার কণ্ঠস্বরকে শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। রেহানা এখানে নারীদের পক্ষ নিয়ে কোনো কথা বলে না। সে তার ভাইয়ের সঙ্গে অন্য আলাপে চলে যায়, সে আলাপ দর্শককে শোনানো হয় না।
নারীবাদ যখন ছবিতে মূর্ত হলো, তখন রেহানা ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে থাকে, কিন্তু সেটাও শোনা যায় না, বা সাদ আমাদের শোনান না; নিজের বাচ্চা মেয়ে, তার সামান্য একটা ইচ্ছার ব্যাপারে রেহানা নিজের নৈতিকতার প্রশ্নে একেবারে স্বৈরাচারী ভঙ্গি গ্রহণ করে এবং নিজের মাকেও দেখা যায় রেহানা সারাক্ষণই ধমকাধমকি করছে ফোনে। রেহানাকে আমরা বাড়িতে যেতে দেখি না। এমনকি একটু সময়ের জন্য বিশ্রামও নিতে দেখি না। সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা, টানাপোড়েন ও অবদমনের ভেতর দিয়ে যেতে দেখি। জোর করে ইমুকে বন্দী করার ভেতর দিয়ে নিজের নির্ধারিত নৈতিক সিদ্ধান্তের ফাঁদে নিজেকেই পড়তে দেখি। ওদিকে আমরা দেখি অপরাধী আরেফিনের ‘শাস্তি’ হয়েছে, স্ত্রী আয়েশা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি তার হয় না। বরং উল্টো সে রেহানার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের খেপিয়ে তোলে। শিক্ষার্থীরা রেহানাকে পদত্যাগ করতে বলে, আটকে রাখে। নিজের অটল অবস্থানের কারণে সে নানা জায়গায় পরাজিত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কান্টের সত্য বনাম মিথ্যা নয়ে’র পার্থক্য সে ধরতে পারে না। সে কৌশল করতে জানে না। রেহানা জটিল, কিন্তু কৌশলী নয়। এ কারণেই বোধ হয় চরিত্রটি অসহায় বোধ করে, আবার হালটাও ছাড়তে চায় না। হায় রেহানা, নিজের নির্ধারিত নৈতিকতার যে উচ্চতা সে ঠিক করে রেখেছে, সেই উচ্চতার কারণেই সে ব্যর্থ হতে থাকে, মা হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বোন হিসেবে। ভাই তাকে কথা শোনায়, শেষ কবে সে ইমুকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে? জটিল আবর্তে ঘুরতে থাকা রেহানা, পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকা রেহানা, একগুঁয়ে রেহানা—নারীবাদের জন্য একটি ভালো টেক্সট, কিন্তু রেহানাকে সে জন্য নারীবাদী বলাটা ভুল হবে বলব না, বলব, ঠিক হবে না।
যেটা বলছিলাম, ছবিতে চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সাদ হয়তো আগে থেকেই বেছে নিয়েছিলেন এভাবেই তিনি উপস্থাপন করবেন রেহানাকে, তার কোনো নির্মাণ বা ‘গ্রোথ’ তিনি দেখাবেন না এবং এটাও পূর্বনির্ধারিত যে তিনি রেহানার বাড়ি, বিছানা, বিশ্রাম, খাওয়া, বন্ধুত্ব এগুলো এড়িয়ে যাবেন। চলচ্চিত্রের শেষে জাল গুটাবেন না, এটাও ইচ্ছাকৃত। শিল্পীর ইচ্ছাই শেষ কথা। তবে আমার মনে হয়েছে রেহানাকে যেভাবে তিনি উপস্থাপন করেছেন, পূর্বাপর ছাড়া, কালজ্ঞানকে রোহিত করে, মানে ধরুন কাহিনি কোন স্থানের বোঝা গেলেও, কোন সময়ের, সেটা বোঝা যায় না, আবার সময়টা সকাল কি সন্ধ্যা, সেটাও প্রায় মিলেমিশে যায়। চরিত্রের অস্থিরতা যেভাবে ক্যামেরার ভাষায় রূপান্তর হয়েছে, সেটাকে আরেকটু কমিয়ে আনা যেত (ফ্রেম কাঁপা), বেদনা বা বিষাদখিন্ন জীবন বোঝাতে ব্যবহৃত নীলের প্রলেপটাও আরেকটু কমিয়ে আনলে গোটাটা নীল ফিল্টার লাগানো ছবি মনে হতো না, বা আরেকটু বাস্তবের কাছাকাছি আসত। হয়তো এসব বৈশিষ্ট্যের জন্যই কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘আঁ সাখতা খোগার্দ’ বিভাগে ছবিটি আমন্ত্রিত হয়েছিল। কারণ, নতুন চিত্রভাষ উপস্থাপন করা তরুণদের নিরীক্ষাধর্মী কাজ প্রদর্শনের জন্যই কানের ওই বিভাগটি তৈরি করা হয়েছে। ক্যামেরা, ফ্রেম, সম্পাদনা, রং ও বিষয় যদি এই ছবির শক্তির জায়গা হয়, তাহলে এগুলোই ছবিটির দুর্বল জায়গা। ক্লোজ শট সম্পর্কে চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক রুডলফ আর্নহেইম গত শতাব্দীতেই সতর্ক করে গেছেন, ক্লোজ শট মানেই আপনি আসলে অনেক কিছু বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। দর্শক ছবিটি সম্পর্কে তথ্য কম পাচ্ছে। দৃশ্যগত তথ্যের প্রবাহ কমিয়ে যৌনতা ও নৈতিকতার মতো বিষয়কে কতটুকু ফুটিয়ে তোলা যায়, বা যা বলতে চাইছেন, সেটা সঠিকভাবে বলা যায় কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকে।
সিনেমার প্রধান দুই বৈশিষ্ট্যের কারণে দর্শক নিজস্ব বয়ান করতে পারে, একটি মন্তাজ, অন্যটি মিজোঁসেন। এই ছবির মিজোঁসেন বরাবর মার খেয়েছে সাদের বিশেষ ভঙ্গি অর্থাৎ ক্লোজ ও মিডক্লোজ শটের কারণে। আমরা পুরো ছবিতে তাই শুধু রেহানাকে দেখি, রেহানার পরিবেশ, প্রতিবেশ কিছুই দেখার ও তার রুচির বিস্তারকে বিচার করার সুযোগ পাই না। ছবিটির একপেশে রং দর্শককে বাস্তবতা থেকে আরও দূরে সরিয়ে দেয়। তাই ছবিটি হয়ে ওঠে একক চরিত্রকেন্দ্রিক, অন্য চরিত্রগুলো, এমনকি রেহানার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্রটিও কোণঠাসা হয়ে যায়, মূল্য হারিয়ে ফেলে। দর্শক অনেক বেশি ধাবিত হয় রেহানার মানসিক টানাপোড়েনের দিকে এবং যে টানাপোড়েনের কার্যকারণ দিশা করা যায় না। কেন রেহানা শুরু থেকেই এতটা বিরক্ত ও বিষণ্ণ, তার জবাব নেই এই ছবিতে। জবাব যে নেই, তার বড় কারণ সাদ যে ভঙ্গিটি বেছে নিয়েছেন গল্প বলার জন্য, সে ভঙ্গিটি। নির্দিষ্ট কাঠামোর চিত্রভাষের কারণে সাদ স্বতন্ত্র হয়েছেন বটে, তবে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেহানা চরিত্রটি, তাকে পুরোপুরি পাঠ করা যায় না। আবারও বলছি, হয়তো এটাই করতে চেয়েছেন সাদ।
মন্তাজের ভেতর দিয়ে ছবিতে ইতিহাস চেতনা ও কালপর্বকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। সাদের প্রথম ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ (২০১৯) ছবিতে আমরা কিন্তু দেখেছি সাজ্জাদ নামের চরিত্রটি এমন এক সময়ে বাস করছে, যেখানে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে, হাজার হাজার যুব্ক প্রতারিত, রাজপথে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিপুল অংশের তরুণদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার মরিয়া আকাঙ্ক্ষা। সে রকম একটি নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থায় প্রেম মরে যায়, বিশ্বাস হারিয়ে যায়, রক্তের সম্পর্ক হারিয়ে যায়। ওই ছবিতে বরং ‘আরএমএনে’র চেয়ে বেশি মুনশিয়ানা ছিল, স্থান ও কালকে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে।
‘রেহানা মরিয়ম নূরে’ মূল চরিত্রটি যেমন অতিরিক্ত নৈতিক অবস্থানের কারণে ব্যক্তিজীবনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, এই ছবির পরিচালকও অতিরিক্ত ক্লোজ ও মিডক্লোজ শটের কারণে চরিত্রকে তার চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। অথচ প্রণিধানের বিষয়, রেহানার চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সাদের বিশেষ ভঙ্গির চিত্রভাষটাই মূল শক্তি বা জোরের জায়গা। আর এই শক্তিগুলোই কখনো কখনো দুর্বলতার বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে এই ছবিতে। আবার উল্টোটাও বলতে পারেন। অবশ্য নির্ভর করছে কে কিভাবে পাঠ করছেন।
আরেকটি মজার বিষয় উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করছি, সেটি হলো সাদ এই ছবিতে ধর্ম ও জাতিতে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। কলেজের প্রিন্সিপালকে শাখা-সিঁদুর পরিয়েছেন, মিমি চরিত্রে নিয়েছেন একজন আদিবাসীকে। এমন প্রয়াস বাংলাদেশের ছবিতে খুব একটা দেখা যায় না।
‘আরএমএনে’র ব্যাপারে সব মিলিয়ে আমি মনে করি একটি ছবি কখনোই কাউকে পুরোপুরি তুষ্ট করতে পারে না। তাতে কিছু যায় আসে না। মূল কথা হলো, বাংলাদেশে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ আবার চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলার পরিসর তৈরি করেছে, এটাই অনেক বড় ব্যাপার। এমন চলচ্চিত্র আমাদের আরও বেশি প্রয়োজন, যা নিয়ে কথা বলা যায়, তর্ক করা যায়। যে ছবি বাহাস করার দরজা খুলে দেয়। এতে করে চলচ্চিত্রের যেমন উপকার, তেমনি আমাদের চলচ্চিত্র ভাবনাও শাণিত হয়। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ বাংলাদেশের মরুতে এক উদ্যান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।