চতুর্থ কিস্তি

সে ও নিমবিরিক্ষি যে গুপ্তকথা জানে

আকিমুন রহমান প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৪, ০৪:৪১ পিএম
ছবি কপিরাইট: সংবাদ প্রকাশ

তারপর।


আমার প্রভু দুজনের সেই তাৎক্ষণিকের সিদ্ধান্তেই আমি তখন, চেতনাপ্রাপ্ত হলাম। দীর্ঘ দীর্ঘকালব্যাপী যথাবিধি সুধীরপ্রকারে সৃজিত হবার আগেই, তখন আমাকে চোখ খুলতে হলো। শুরু করতে হলো হুকুম তামিল করে চলার জীবন। আমি যে দেবলোকের অন্যদের মতো বিধিসম্মতরকমে সৃজিত হইনি, সেটা কিন্তু আমি নিজে থেকে বুঝে উঠিনি। আমি তো জেনে ওঠারই সুযোগটা পাইনি যে কাকে বলে যথাবিধি সৃজিত হওয়া। তবে আমার অগ্রগামী ছিলেন যেই প্রভু-দুজন; তাদের উৎকণ্ঠ কথোপকথন থেকে ওই কথা জেনে উঠতে পেরেছি আমি। তাদের নিম্নকণ্ঠ ফিসফাস, তাদের ভ্রূভঙ্গির কঠোরতা, তাদের মুখের বিরক্তির থমথমানি; আমাকে জানিয়েছে, আমি দেবলোকের বটে; তবে আমি অন্য দেববাসীর মতন সুসৃষ্ট, সর্বাঙ্গ-নিখুঁত নই। অমনটা হয়ে ওঠার ভাগ্য হয়নি আমি। আমি খুঁতো, আমি ত্রুটিযুক্ত। আমি এক ভৃত্য শুধু। দেবভৃত্য।


কাকে বলে যথাবিধি সৃজিত হওয়া?


দেবলোকে দেবদূত-সৃজনের প্রক্রিয়াটি বড় অভিনব। সেইখানে কেউই তো জন্ম নেয় না মর্ত্যসন্তানের মতো! সেখানে সকলেই সৃজিত হয়। আবার, একটি বা দুটি দেবদূত গড়ার নিয়মও নেই সেইখানে। গড়তে হয় একসঙ্গে অন্তত দশ গণ্ডা। বা প্রয়োজনে, তারও চেয়ে বেশি। সেইখানে সৃজন-কারিগরদেরও মান্য করে চলতে হয়, বিধির পরে বিধি।


দেবলোকের সৃজনশালায় প্রবেশের আগে, কারিগরেরা নিজেদের ভেতর ও বাহিরকে, পরিশুদ্ধ করে না নিলে, ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পায় না কদাপিও। রশ্মির পরে রশ্মি দিয়ে নিজেদের রগড়ে-নিংড়ে, মুচড়ে-চটকে নিতে হয় তাদের। ওইখানে পরিশুদ্ধ হবার ওই-ই একমাত্র প্রক্রিয়া। কারিগরগণ ধীরে নিজ নিজ অঙ্গ রশ্মি-পরিশ্রুত করতে করতেই, মগ্ন হতে থাকেন মৌনব্রতে। একই সাথে শুরু হয় তাদের উপবাসব্রত। সৃষ্টিকালীন সময়ে বাক্যহীন থাকাই যেমন বিধি সেইখানে; তেমনি রসনাকে কোনো আহার্যের স্পর্শ না দেওয়াই বিধি তখন সেইখানে। কারিগরসকলে থাকেন উপোসব্রতে, থাকেন নিশ্চুপতা-যাপনের ব্রতে। নবসৃজিত দেবদূতদের দেব-রাজন্যসভায় এনে হাজির করার আগ পর্যন্ত, এমত ব্রত পালন করে চলেন তাঁরা; আর তাদের বাহুরা ব্যাপৃত থাকে নব দেবদূত-দেহ সৃজনের কর্মে।


তবে ওই সৃজনের দুনিয়ার চমক-ঠমকের সীমাশেষ নাকি নেই। যেই কারিগরগণ দেবদূতদেহ গড়ে দেন, তারা শুধু কায়া-কাঠামোখানাই গড়ার অধিকার রাখেন, তার বেশি আর কিছু করার হুকুম নেই । 
তাহলে কায়ার ভেতরে কি চিত্ত-জাগানোর বিধি নেই নাকি দেবলোকের কারখানায়? আছে। আছে। কিন্তু ওই দেহের ভেতরে সেই চিত্ত-চেতনাকে জাগিয়ে তোলার কাজ করার দায়িত্ব আছে অন্য জাতের দেব-কারিগরদের ওপর। তারা হলো দেবচিত্ত-জীয়ন-কারিগর। 


দেহ-নির্মিত হয়ে গেলে পরেই, এঁরা দেব নির্মাণশালায় প্রবেশ করার অধিকার পান। তখন ঘোর মৌনমুখে, অতি শব্দহীন চলাচলতি নিয়ে তাঁরা একেকজন এসে, একেকটি দেহের দায়িত্ব নেন। তারপর চেতনা-জাগ্রতকরণ প্রক্রিয়া আরম্ভ করেন। ওই সব দেহে চেতনা-প্রবিষ্ট করানো তো কোনো সহজসাধ্য কর্ম নয়। সেটা বড় এক দুরূহ কর্ম। অসাড় দেহগুলোতে তখন সপ্ত রাত্রি ও সপ্ত দিবস ভরে অবিরল, চালাতে হয় সপ্ত প্রকারের তাপ-প্রেরণ করার ধীর এক কর্ম। বিরাম-বিশ্রামহীন সেই এক যজ্ঞ। 


ওই যে সেই তাপ, তাকে আনতে হয় নানান উৎস থেকে। একজাতের তাপ আহরিত হয়, দেবলোকের সান্ধ্য-তপস্যাকালের অগ্নি থেকে। একজাতের তাপ আসে দেবলোকের পুষ্প থেকে। আসে পুষ্প-সুগন্ধের দীপ্তি থেকে। আসে অন্য সকল দেবদূতের দেহ-বিচ্ছুরিত কিরণ থেকে। তাপ আসে ব্রহ্মাণ্ডে ব্রহ্মাণ্ডে আপনা থেকে জন্ম নেওয়া নক্ষত্রের শরীর থেকে। আসে দেবগণের মন্ত্র-স্তোত্রের ঝনাৎকার থেকে। আর, মাটির দুনিয়ার জলকল্লোল থেকে। সেইখানে জলের ছলাৎকারে ছলাৎকারে তাপ ছিটকে ছিটকে উঠতে থাকে। দেবদেহে চেতনা জাগানোর জন্য সেই তাপও বড়ই দরকার। এ মত সপ্ত তাপের পেষণ-মন্থন-পরশন পাওয়ার পরেই, দেবদূতদেহ পায় চেতনা বা অন্তরকে। পায় দেবদূত হয়ে ওঠার সামর্থ্যখানা।


আমার ক্ষেত্রে তো তেমনটা ঘটার কোনো ফুরসত আসে না। সপ্ত দিবস ও সপ্ত রাত্রিভরে সপ্ত জাতের তাপকে পেয়ে ওঠার ভাগ্য তো আমার হয় না। প্রভু দুজনের তাড়া ছিল, খুব তাড়া। তাই তারা করেন কী, তাঁদের দেহ থেকে ছলকে যেতে থাকা তাপের খানিকটা, আমাতে গেঁথে দেন। তারপর তাঁদের দিব্যশক্তি দিয়ে কোনোমতে আমাকে জাগিয়ে তোলেন। তাঁরা বোধ করতে থাকেন, এই যে এই দেবদেহ, এ তো শুধু এক ভৃত্যদেহ মাত্র। অন্য দেবদূতের মতো অগাধ বিশুদ্ধ দিব্যচৈতন্য পাবার তো এর কোনোই প্রয়োজন নেই। এই সে ভৃত্য। সে কোনোমতে প্রভু দুজনের হুকুম-বরদার হয়ে থাকতে পারে যদি, তো সেটাই হবে যথেষ্ট। 
এমনই ভাবেন তাঁরা আমার সম্পর্কে। এমনই তুচ্ছ একজন আমি, তাঁদের কোনোরকমে কাজ চালিয়ে যাবার দাস শুধু এক। 


তবে ওই তড়িঘড়ি ছুটকা-ছাটকা রকমের চৈতন্য পেয়ে আমি যখন চোখ খুলি, তখন কিন্তু ওই বিষয়টা আমার সম্পূর্ণ অজানাই থাকে। তখন কিন্তু আমি কিছুমাত্র জানতে পাই না যে আমার জন্মটা বড় গোলমালের। আমার জন্মটা শুধু দুজন প্রভুদেবের হুকুম তামিল করার জন্য। আমার জন্মটা শুধু মালিক দুজনের পিছু পিছু অন্য ভূমণ্ডলে গিয়ে, প্রভুদ্বয়ের কর্মসমাপনে সাহায্য করার জন্য। দেবলোকে বসত করার ভাগ্য আমার নয়। এমনকি দেবলোককে আশ মিটিয়ে চেয়ে দেখার ভাগ্যও আমার নয়। 


সেই ভাগ্য যে আমি পেতে যাচ্ছি না, সেই কথা তো ওই শুরুর দিনে, তখন, কিছুমাত্র আন্দাজও করতে পারিনি আমি!


বরং জাগরণের সেই আদিপ্রহরে, চোখ খোলা মাত্র, আমি দেবজগতের শোভা ও বাহার দেখে বিদ্যুৎ-চমকের মতো চিলকে-ঝিলকে উথলে যেতে থাকি। কেঁপে উঠতে থাকি, ছলকে যেতে থাকি। আমি কী দেখতে পাই সেই তখন? আমার চিত্ত-জাগর-কালের একেবারে শুরুতেই? কী!


আমি দেখতে পাই, আমার সামনে ছড়িয়ে আছে বিভা! মিহি বিভা নম্র বিভা উগ্র হতবিহ্বলকর বিভা। মেঘলোকের বিবিধ রঙের বিভা। ওহ! এমত সুন্দর নাকি চরাচর! আমার মন মুহূর্তে ফেঁপে-ঝেঁপে যেতে শুরু করে। ওই যে আলো! ওই যে সবখানে আলো! গতিময় সে। সদা চলিষ্ণু! 


এমন ছুট কেন তার! কোথা ধাও তুমি, হে আলোক! এমত সুষমাময় তুমি হে আলোক, খানিক ধীরগামী হও হে! কিঞ্চিৎ ধীরে বও তুমি! এমন সুতীব্র ছুট কেন দিতে হয়? ওহে সুতীব্রা, কোথা ধাও তুমি! 
এই তবে দেবলোক! আমার অন্তর এমতে কলবলিয়ে উঠতে থাকে, নীরবে নিরলে। আমার ভেতরে আমি এমতে আকুল-উথাল হয়ে ওঠা শুরু করি! একেই তো সুখ বলে? দেবলোকে সুখ তো এমতেই জাগনা দেয়, তাই না?


আমার ওই একলা প্রাণের কাতরতাময় মুগ্ধতার সেই নরম-নম্র প্রহরে, আমি কি কোনো সখা-সহচরের প্রীতি-সম্ভাষণ পেলাম? পেলাম? নহে নহে! তা তো পেলাম না।


বরং পেলাম তাচ্ছিল্যভরা কর্কশ নির্দেশ। তখন শুধু পেলাম কঠোর কণ্ঠের হিম-তীক্ষ্ণ হুকুম। “দাস তুমি। এই মুহূর্তে আমাগণের পদাঙ্ক অনুসারী হও। ওহে দাস, নির্দেশ মান্য করার জন্যই তোমাকে এমত ত্বরাসহ চেতনা দান করা হয়েছে। আলোর বরণ নিয়ে বালখিল্যতা করতে যেয়ো না অর্বাচীন! চক্ষু নত করো। দাসের অক্ষিদ্বয় সদা নিম্ননত থাকার জন্য। আর দাসদেহ শুধু প্রভুর হুকুম পালনের জন্য।” 


নিমেষে আমার সমস্তটা অন্তর বিষক্লিন্ন, তিক্ততা-নিষিক্ত হয়ে ওঠে। আলো-উল্লাস-মুগ্ধতা তবে আমার জন্য নয়! আমি কে? আমি এক দাস। দেবলোকে সৃজিত আমি ঠিক, কিন্তু দেব-ভুবনের প্রভুগোত্রের কেউ না তো আমি। আমি দাস। প্রভুগণের হুকুম তামিলের দাস শুধু এক। 


নিজ অবস্থা অনুধাবনে আমার একটুও ভুল হয় না। আমার চেতনা-প্রাপ্তির সাথে সাথেই তো দেবজগতের সমস্ত বিধিবিধান-পুরাকথা-দেবদূতসকলের পদমর্যাদার ইতিবৃত্ত-স্তরক্রম সকলই আমার মস্তিষ্কের ভেতরে, স্বতঃস্ফূর্তভাবেই, পেয়ে যাই আমি। দেবজগতে অমনটা ঘটার রীতিই তো চালু আছে। তাহলে আমার তখন আর বুঝতে ভুল হবার অবকাশ তো থাকে না কিছুই! আমি বুঝে যাই যে; আমি দেবদূত বটে, কিন্তু উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কেউ নই আমি। আমি নিতান্তই এক হুকুম-বরদার। চির শির-নত করে-চলা, হুকুম মান্যকারী শুধু এক দাস আমি।


বিষয়টা পলকেরও আগে বুঝে ওঠে আমার চিত্ত। পলকেরও আগেই আমার সেই অবোধ চিত্ত, ক্লেশ-ম্রিয়মান হয়ে যায়। নিজেকে বড় মলিন বড় ক্লিন্ন লাগতে থাকে আমার। নিজের ভেতরটাকে মনে হতে থাকে যেন নিভু নিভু এক দীপশিখা! প্রচণ্ড বাতাসে খাবি-খেতে-থাকা দীপশিখা যেনো আমার অন্তর। যেন নিভে যেতে পারলেই আমার ভালো হতো, কিন্তু তা-ও শিখা জাগায়ে রাখার দায় বয়ে যেতে হচ্ছে। উলটি-পিলটি, দিপির-দিপ দিপির-দিপ করে করে। এমন কেন লাগতে থাকে আমার! এমন কেন! 


দেবদূতগণের, বিশেষত দাসগোত্রীয় দেবদূতগণের, চিত্তে তো এবম্প্রকার কোনোবিধ” চাঞ্চল্য জাগ্রত হওয়ার কোনো পূর্ব-নিদর্শন নেই। তেমন কিছু আগে ঘটেনি কখনো। এমত বিষয়ের কোনো দৃষ্টান্ত নেই-ই। তাহলে আমার অন্তরে ঈদৃশ চপলতা জাগছে কেন, কোন কারণে! এমন ক্লিষ্ট ও দগ্ধ - লাগে কেন আমারই অন্তর! এই সদ্য দেহ পাওয়া, সুনবীন এই আমার অন্তর!


এমত বিস্ময় ও গোপন-ঘন বেদনার ভারে কম্পমান পদযুগল নিয়ে আমি দণ্ডায়মান হই। ওই তো আমার আগে, তাঁরা দুইজন। আমার বহু বহু অগ্রজাত, অতি ক্ষমতাময় দেবদূত-প্রভুদ্বয়। তারা ওই তো যাত্রা শুরু করলেন। ওই তো! আমি তাঁদের দুজনের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে থাকি। মেঘে মেঘে তাঁদের জ্যোতিমাখানো পদচিহ্ন পড়তে থাকে। আমি নতনেত্রে তাঁদের পদচ্ছাপ দেখে যেতে যেতে এগোতে থাকি। এগোতে থাকি। প্রভু দুজনকে অনুসরণ করে করে আমি পার হই সপ্ত আকাশমণ্ডলী। আকাশলোককে পেছনে ফেলে পা রাখি বায়ুলোকে। বায়ুলোকও পেরোই। পেরোনো হয় মেঘলোক। তারপর প্রভুদ্বয় ধীরগতি হন। তাঁদের পেছনে-থাকা আমিও হয়ে উঠি শ্লথ-মন্থর।


এবার নেমে যেতে থাকা। ধীরে। ঊর্ধ্বলোক থেকে অতি ধীরে নেমে আসা। 


“কোথায় নামছি আমরা? এটা কোন লোক?” এ-জিজ্ঞাসা আমি গোপনে, মনের ভেতরেই নেড়ে উঠি শুধু। অগ্রবর্তী প্রভুদের কি আমি কিছু শুধাবার এখতিয়ার রাখি নাকি! অতখানি স্পর্ধা আমার থাকতে পারে না। আমি না কেবল পেছনে-থাকা এক হুকুম-বরদার! জিজ্ঞাসিবার অধিকারহীন দাস না আমি?
আমি মনের ঔৎসুক্য মনেই রাখি, তারপরেও কারা জানি বলে যেতে থাকে, ‘এটা মর্ত্যলোক। এই যে মর্ত্যভূমি।’ কে উত্তরখানা দিল? কারা দিল? আমার মনে হতে থাকে, যেন শব্দশূন্য নিরল হাওয়া অথবা ঊর্ধ্বের সমস্তটা আকাশ ও মেঘদল, নাকি অদৃশ্যলোকের আলো; সকলে খুব মিহি রকমে খুব নিচুস্বরে, সমস্বরে ওই কথা বলে উঠছে। বারংবার বলে উঠছে। 


এই মর্ত্যলোকেই তবে আমাদের কাজ!


প্রভু দুজনের পেছনে পেছনে আমি নামা শুরু করি। ধীরে; অতি সন্তর্পণে। নিঃশব্দ, প্রলম্বিত, আলগোছ অবতরণ শেষ হলে আমি দেখতে পাই; সে এক আচরিত ভূভাগে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি। পেছনে যে আকাশ মণ্ডলকে পেরিয়ে এসেছি, তার মতো নয় এই ভূভাগ। বা পেছনের বায়ু, মেঘ কিম্বা আলোক জগৎ-কোনোটার মতোই নয় এটি! এইখানের বাসিন্দাগণ মৃত্তিকালগ্ন। তারা গৃহবাসী। এই মৃত্তিকা আবাসস্থলের ভরসাই জোগায় না, আহার্যও দান করে। মৃত্তিকায় শস্য ফলে, লতাগুল্ম জন্মায়, বৃক্ষ মাথা উঁচোয়। এই মৃত্তিকা যেমন পুষ্প-ফসলের, তেমন তা চতুষ্পদগণেরও। এই মৃত্তিকা দেখ জলেরও; বহমান জলধারারও। 


এইখানে মাথার ওপরে শূন্যতা। সেই শূন্যতারও রং আছে এইখানে। দিবালোকে সেই রং নীল। আর নিশিথে সে পায় তিমিরবরণ। সেই কালো নিশিথ তখন পায় তারাদের দ্যুতি। সেই ঊর্ধ্ব শূন্যতার নিচে হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসে মেঘ। সাদা সাদা মেঘ আর কালো কালো মেঘ। জল ঝরে এইখানে; মেঘ থেকে। কালো মেঘ থেকে। আহা! সেই জল বয়ে বয়ে যায়, বয়ে বয়ে যায়। দূর থেকে দূরে। আহ্! সেই বয়ে-যাওয়া জলের নাম দেখো নদী! সেই জলই কি এইখানের লোকসকলের চক্ষে জাগনা দেয়? তখন তার নাম কি অশ্রু? 


আমি পশ্চাৎগামী। প্রভুগণের থেকে এক শ কদম পেছনে থেকে থেকে আগাতে থাকার জন্য আদিষ্ট আমি। তাঁদের মুখোমুখি হওয়া কিংবা তাদের দিকে চক্ষু তুলে ধরা আমার জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু তাঁদের থেকে এক শ কদম পেছনে থেকে থেকে, চলতে চলতে, আমার আশপাশের সকল কিছুকে দেখে নিতে আমি তো পারি। প্রভুগণের অনুমতি ব্যতিরেকেই কি সেটা করতে পারি না? আমার মন বলতে থাকে, পারি আমি সেটা করতে। পারি পারি। 


কেন তবে শুধু মৃত্তিকা-আবদ্ধ করে রাখব আমার দৃষ্টি! কেন তাকাব না ঊর্ধ্বে! কেন দেখব না পদতলে ছড়িয়ে থাকা মাটিকে! দেখব না নাকি মৃত্তিকার গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলো আর শষ্প-তৃণদের বিবিধ সবুজাভাকে! ওহ! এমন সবুজ বরন এই লতা-গুল্মের! আমার সাধ হতে থাকে আমার সর্বাঙ্গ দিয়ে শুষে নিই এই রং। নিজেকে অমন সবুজ করে তুলি! নিজেকে অমন শ্যাম-হরিৎ করে তোলা যায়? তোলা যায় নাকি?


এমন একটি-দুটি অস্ফুট তৃষ্ণা নিজের ভেতরে নিয়ে, এগোতে থাকি আমি। প্রভু দুজনের পেছনে পেছনে। যেতে যেতে আরও যেতে থাকি, দূর থেকে আরও দূরে। পার হতে থাকি তপ্ত ধুলোর ধূসর পথ, জনহীন তল্লাট, নিঃসীম প্রান্তর। পার হই বনভূমি, পেরোই জলসিক্ত অঞ্চল। হেঁটে যেতে থাকি, যেতে থাকি। তারপর পেয়ে যাই মনুষ্য-বসতি। এইখানে কি তবে আমাদের বিরতি? থামব আমার এখানে? না! অগ্রগামী প্রভুদ্বয়ের পদযুগলেরা ওই তো এগোচ্ছে। এগোচ্ছে আরও দূরের দিকে। 


তাহলে আর কী। আমিও পথ পেরোই তবে। লোকালয়ের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমি দেখতে পাই, ওইখানে কিছু মুখ পরিতোষে ভরা। সুধীর চিক্ক্বন। ওহ! তারা ওই তো ক্ষুধাহীন, সম্পন্ন লোকসকল। আবার দেখো; এইখানেই বহু বহু মনুষ্যদেহ - শ্রমক্লিষ্ট, অর্ধাহারী। ওই দেখো আরও! এইখানেই অযুতজন নিরন্ন, দীনদরিদ্র। আহা! আমার অন্তর বলে ওঠে, আহা! এমন মধুরলোকে এমত বেখাপ দশা কেন! কেউ কেউই শুধু পায়, আর কিনা নিযুত নিযুতজন শুধু ধোঁকে! এমন কেন! এমন কেনো! কিন্তু আমার ওই ধন্দের মীমাংসা তখন কে দেয় আমাকে! কাকেই-বা আমি তখন জিজ্ঞাসা দিই! 


একটা কথা আমার স্মরণে আসে খুব। মর্ত্যলোকে পদযাত্রা শুরু করার একেবারে গোড়ার দিকের কথা সেটা। মাত্রই তখন প্রভু দুজনের একশো কদম পেছনে পেছনে হাঁটছি আমি। পেরোচ্ছি বিরান এক প্রান্তর; তার সবদিক ধূ-ধূ হু হু ফাঁকা। শুধু ছোট ঘাস শুধু অল্পখানিক ঝাড়, এইদিকে সেই দিকে। শুধু নৈঃশব্দ্য। হা হা নৈঃশব্দ্য।


তখন আমার দৃষ্টি মাটিলগ্ন, একদম মাটিলগ্ন। কী জানি, একটুখানি চোখ তুললেই যদি আমার প্রভু দুজনের নজরে এসে যায় সেটা! তাঁরা আগে যাচ্ছেন তাতে কী! তাঁরা যে মহা শক্তিময় প্রভু-দেবদূত! আমার অবাধ্যতা তাঁদের বুঝতে দেরি হবে নাকি! নাহ! এই ভয় তখন আমার অন্তরে। এই ভয়ে জুবুকাবু হয়ে হয়ে, আমি তখন, হাঁটছি সামনের দিকে; কিন্ত দৃষ্টি তখন আমার প্রান্তরের ঘাসেদের ওপর লেপ্টে আছে। লেপ্টে থাকছে।
তেমনকালে হঠাৎ আমি দেখি ক্ষুদে তৃণ-ঘাসের ভেতরেই খাড়া হয়ে আছে ছোট্ট একটা ঝাড়। একটা মাত্র ছোটর ছোট এক গাছ। আর তার সরু ছোট ডালে ডালে কত ফুল, কত যে ফুল! সাদা ফুল। আহ! কত কত ক্ষুদে শ্বেতপুষ্প! কি নাম তোমার? কী নাম! ছোট ঝাড়খানা তার ওই ওট্টুক ফুলদের ফুটিয়ে তুলেই সমস্তটা বিরানকে এমন জ্যান্ত করে দিয়েছে! এমন জ্যান্ত! এমন জীবন্ত সুন্দর আমি তো কোনো দিন দেখিনি! 


তখন আমার অন্তর কেমন একপ্রকারের পুলকে, আচমকাই টলে উঠেছিল! তারপর কোনো বারণ না-মেনে আমার মন হঠাৎই বলে উঠেছিল; ‘আহ! কী সুন্দর!’ আমার কণ্ঠের সেই ধ্বনিগুচ্ছ বেজে ওঠা মাত্র, আমার প্রভু দুজন চলা বন্ধ করে দেন। তারপর আমাকে তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার আদেশ করেন তাঁরা। আমার পা-দুটো ভয়ে ও গ্লানিতে হিম-জরাগ্রস্ত হয়ে যায়। আমি সেই স্তব্ধ পা-দুটাকে হেঁচড়ে হেঁচড়ে কোনোমতে তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। 


আমার দৃষ্টি প্রান্তরের ঘাসের দিকে নত হয়ে থাকে; তা-ও আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি কেমন তীব্র, নিঃশব্দ ক্রোধভরা চোখে তাঁরা দুজন আমার দিকে চেয়ে আছেন! কুণ্ঠায় ও অপরাধবোধে আমি ধকপকাতে থাকি। আমি যে ভয়ংকর অন্যায় করে ফেলেছি! বিধি ভেঙে ফেলেছি আমি। আমি এটা কী করেছি। কী লজ্জা! ছি!
দেবলোকের বিধি এই যে, দেবদূতগণ কদাপি ভূলোকের দুঃখ-সুখ-শোক-উল্লাস দিয়ে দুলে উঠবে না। উঠবে না কদাপি। এই ভূলোকের কোনো রূপ বা কোনো শোভা দিয়ে মোহিত হবে না। তেমনটা হলে, সে আর তার কর্তব্যকর্ম যথাবিধি করে ওঠার সামর্থ্য পাবে না। সে হয়ে যাবে সামর্থ্যলুপ্ত। হয়ে উঠবে পক্ষপাত-দোষযুক্ত। সে তখন হয়ে উঠবে মলিনতাময়।


তাই দেবদূতসকলকে থাকতে হবে নির্বিকার, অসম্পৃক্ত, অসম্পর্কিত, লগ্নতাশূন্য। সে ভূলোকে কেন আসে? আসে নির্ধারিত কর্ম নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করার জন্য। আসে কোনো-না-কোনো প্রকার বিনাশ ঘটাতে। সেটা তাকে করতে হবে বিকারহীন প্রাণে। তারপর সে প্রত্যাবর্তন করবে নিজলোকে, সর্ববিকারশূন্য চিত্ত নিয়ে। 


এ-তাবৎকালে কখনো কোনো দেবদূত মানবিক-বিষাদ দিয়ে, অথবা নিসর্গ-শোভা দিয়ে কিছুমাত্র উদ্বেলিত হয়েছে; এমন কথা শোনা যায় না। আর, দেবদূতগণের অন্তর্লোকও তো অমন কোনো আবেগ বোধ করার ক্ষমতা রাখে না! ওই ক্ষমতা তো তাদের দেওয়াই হয় না। 


তাহলে আমি- এই ভৃত্যজন- প্রভু দুজনের সঙ্গে আসা এই নব অধঃস্তনজন- সে এ কী অশৈলী আচরণ করে চলেছে! সে হর্ষ পায়? মৃত্তিকার পুষ্পঝাড় দেখে হরষিত হয় সে! কীভাবে! সে কিনা কম্পন বোধ করে -ভূলোকের-অনামা এক গুল্মের শোভা দর্শনে! এ কী অসম্ভব উৎকট আচরণ! এটা কেমন করে সম্ভব! এমন বিপত্তি কীভাবে ঘটতে পারে! কীভাবে!


আমার প্রভু দুজন আমাকে তিরস্কার করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে যেতে থাকেন, তখন। তাঁদের কর্কশ বাক্যাবলি যেন শেতলে-পিছলে পড়ে পড়ে যেতে থাকে তখন। যতটা ঝাঁজতপ্ত, যতটা রূঢ়রকমের ভর্ৎসনা তাঁরা করে উঠবেন বলে মনস্থির করেছিলেন, সেটা যেন ততটা ক্রূর-কটু থাকে না। মিইয়ে মিইয়ে যেতে থাকে যেন তাঁদের বাক্য-বচন। নত-নেত্রে থেকেই, আমি বুঝতে পারি, আমার প্রভু দুজন কেন যেন অতি বিচলিত আর বিস্মিত হয়ে গেছেন। কোন একটা বিষয় যেন তাঁদের বড়ই উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে! কী সেটা! আমি তা বুঝে উঠতে পারি না।


আমাকে ভর্ৎসনা দিতে দিতে তাঁরা আমাকে দেবলোকের নিষেধ ও বিধিগুলো আবার স্মরণ করিয়ে দিতে থাকেন। এবং আমাকে তা আত্মস্থ-মুখস্থ করাতে থাকেন। আর বারবার হুঁশিয়ারি দিতে থাকেন এই বলে যে, দেবলোকবিধি ভঙ্গের পরিণাম হয় ভয়াবহ। আমি কিনা নব সৃজনপ্রাপ্ত ভৃত্য-দেবদূত, আমাকে হতে হবে আরও সতর্ক, থাকতেই হবে আরও বিধি ও শাস্ত্র সজাগ। আমি কি প্রভুবাক্য অধিগত করতে সমর্থ হয়েছি? প্রভুরা আমাকে এইমতে প্রশ্ন করেন। আমি বলি, আমি সর্বসত্তা দিয়ে প্রভুগণের হুকুমসমূহ অধিগত ও আত্মস্থ করে উঠেছি। 


তারপর প্রভুগণের আদেশে আবার আমি, তাদের পেছনে যাই। তাঁরা পরিব্রাজন শুরু করেন। আমিও আবার নিজেকে তাঁদের এক শ কদম পেছনে রেখে দিয়ে হেঁটে চলি।


আমি দূরেই থাকি, কিন্তু তা-ও আমি শুনি যে; তাঁরা দুইজনে কী জানি একটা বিষয়ে কথা বলা শুরু করেছেন। বড়ই নিচুতে রাখা তাঁদের কণ্ঠ, কিন্তু তা-ও সেই কণ্ঠের বিচলিত কম্পনটাকে আমি ঠিক ঠাহর করে নিতে পারি। কিন্তু তাতে কি! নিচুস্বরের সেই আলাপ আমি ঠিক শুনে নিতে পারি।


প্রভুরা আশঙ্কা করছেন, এই যে আমি, আমি ভৃত্য বটে; কিন্তু দেবলোকে সেই যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে; আমি কেমন দশায় ছিলাম? ছিলাম কেবলই সদ্য-সৃজিত একজন। অ-জাগর, বোধ ও আবেগশূন্য শুধু এক দেহমাত্র ছিলাম তখন। দেবলোকের জল ও হাওয়ায় দিনে দিনে, ধীরে আস্তে বেড়ে ওঠার কোনো ফুরসত মেলেনি আমার। আমার দেহকাঠামোটি যথাযথ রকমে গড়ে উঠেছিল তখন ঠিক, কিন্তু দেবদূতের তো একটা চেতনালোকও থাকে। আমার সেই চেতনালোক কতটা পোক্ত কতটা সুগঠিত হয়েছিল তখন? কিছুমাত্র সুগঠিত তো ছিল না! কিছুমাত্র না। 


যখন প্রভু দুজন আমাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন, তখন তো সেই কথা তাঁরা আমলে আনেননি! সেটা বিবেচনার অবকাশ তো তাঁদের তখন ছিল না। কী বিপাক! 


প্রভু দুজন আশঙ্কায় জরজর হয়ে যেতে থাকেন। অগঠিত অন্তর্লোক ছিল বলেই, এই ভৃত্যটি দূষণগ্রস্ত হয়ে উঠে নাই তো! ভূলোকের বাতাসে বাতাসে, চিরদিন ধরে ভেসে ভেসে যায় মায়া ও মমতা। ভাসে দরদ ও মুগ্ধ-হওয়ার উসকানি। ভাসে কাম, রতিবাঞ্ছা। ভাসে হিংস্রতা, নির্দয়তা, লোভ আর দয়া। খুব সম্ভব, প্রথম আধি-বালাইটি, ওই যে মায়া যার নাম; সেটা সম্ভবত একঝলক করে হলেও; এই ভৃত্যদূতের ভেতরে ঢুকে গিয়ে থাকবে! সেই কারণেই, এই ভৃত্যের ভেতরে, অমন অদেবদূত-রকমের আকুলতা ঝনাৎকার দিয়ে দিয়ে উঠছে! 


প্রভু দুজনের পদপাত শ্লথ হয়ে আসতে থাকে। পেছনে চলতে থাকা আমি ভেবে পাই না, আমার ওইটুকু ভালো লাগার বিষয়টা নিয়ে অতটা উদ্বেগ-বিচলনের কী আছে! 


প্রভু দুজন তখন আমার অন্তর থেকে, ভূলোকের ওই মায়া-বিষ সরিয়ে দেওয়ার জন্য তীব্র গতিশালী আলোক- মন্ত্র আমার ভেতরে পাঠাতে থাকেন। কিন্তু কাজ হয় না। তাঁরা টের পান যে, মায়া-বিষ যেন আমার ভেতরে আরও ঘন হয়ে আসছে। 


ক্রোধ-বেআকুল প্রভু দুজন তখন আমাকে হুকুম করেন; দেবলোক-বিধিগুলো আমি যেন প্রাণপণে স্মরণ করতে থাকি। আমি যেন অতি নতনেত্র, অতি মূক আর ধীরমতি আর পদাঙ্ক অনুসরণকারী হয়ে থাকি। কোনো ভুল যেন না হয় কোনো দিকে। আমার নেত্রদ্বয় যেন তাকিয়ে থাকে ঠিকই, কিন্তু ভূলোকের কিছুকেই না দেখে।


হুকুমমাফিক আমি তখন অমনই হয়ে থাকার জন্য কঠোর সতর্ক করে চলি নিজেকে। আর, যেতে থাকি তাদের পিছু পিছু, এক শ কদম পেছনে পেছনে। যেতে থাকি। যেতে থাকি। 
এই যেতে থাকাটার কি শেষ হবে না? 

 

(চলবে)