শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়ায় ডাক্তার দেখাতে গিয়ে শিপনের দেহে ধরা পড়লো ক্যানসারের জীবাণু। এরপর টানা তিন মাসের লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে মৃত্যুর কাছে হার মানে শিপন। এই তিন মাস বাবাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে ৫ বছর বয়সী মুন্নী। বাবা তার সব আবদার পূরণ করতো, ছিল তার খেলার সঙ্গী। তার এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না ছোট্ট মেয়েটি।
সুমনের বয়স ৮। তার বাবা নামকরা ডাক্তার, মা ব্যাংকার। কিন্তু সুমনের হিরো তার দাদু। এক কথায় দাদুই ওর পৃথিবী। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দাদুর কাছে একটা গল্প শোনা চাই-ই চাই। শুধু কি গল্প! কত যে নতুন নতুন জিনিস দাদুর সঙ্গে থাকলে শেখা যায়। ছুটির দিনে দাদুর হাত ধরে কোনোদিন মিউজিয়াম, কোনোদিন চিড়িয়াখানা তো কোনোদিন শিশুপার্ক। এরকম এনার্জিতে ভরপুর দাদু যখন হুট করে মাঝরাতে স্ট্রোক করে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন, সুমন কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে পারছিল না।
আপনজনের মৃত্যু ছোটদের মনে এমনই গভীর প্রভাব ফেলে। খুব অসহায় হয়ে পড়ে ওরা। এই ট্রমা আর একাকিত্ব থেকে ছোটদের বের করে আনার দায়িত্ব কিন্তু বড়দেরই। কীভাবে করবেন, তা নিয়েই কিছু পরামর্শ জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার।
মা-বাবার ভূমিকা
অনেক মা-বাবাই ছোট সন্তানের মনে আঘাত লাগবে ভেবে মৃত্যু সংবাদ বাচ্চাদের দিতে চান না। কিংবা নানা রকম গল্প বানিয়ে তাদের ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন। ‘বাবা চাকরি করতে দূরে চলে গেছে, তুমি বড় হলেই ফিরে আসবে’ বা ‘দাদু আকাশের তারা হয়ে গেছে` ইত্যাদি গল্পে শিশুরা হয়তো প্রথমে বিশ্বাস করে। কিন্তু পরে যখন সত্যিটা জানতে পারে তখন তাদের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। জীবনের কঠিন সত্যগুলোকে গ্রহণ করার মতো মানসিক প্রস্তুতি ছোট থেকেই তৈরি করতে হয়। আর তার জন্য বাবা-মায়ের ভূমিকা খুবই জরুরি।
মনের সংবেদনশীলতা বুঝুন
কাছের কেউ মারা গেলে তা শিশুকে সেনসিটিভলি জানান। তবে কীভাবে জানাবেন তা নির্ভর করবে শিশুর বয়সের ওপর। শিশুর বয়স ৫-৬ বছর হলে বুঝিয়ে বলতে পারেন যে খুব অসুখ করলে বা বয়স বেড়ে গেলে শরীর কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফলে মানুষ মারা যায়। শিশু একটু বড় হলে তাকে আর একটু বিস্তারিতভাবে অসুখের কথা বুঝিয়ে বলতে পারেন। তবে বোঝানোর সময় অবশ্যই বলবেন যে, কোনও মানুষ মরে গেলে একেবারে শেষ হয়ে যায় না। আমরা যদিও তাকে দেখতে বা ছুঁতে পারি না; কিন্তু আমাদের মনে, চিন্তায়, স্মৃতিতে সবসময় আমাদের ভালোবাসার মানুষটি বেঁচে থাকেন।
আবেগীয় বাঁধন
নিজের আবেগ শিশুর সামনে পুরোপুরি চেপে রাখবেন না। বরং ওকে স্মৃতিচারণ করতে সাহায্য করুন। দুজনের চোখেই যদি জল এসে যায়, আসুক না। এরপর হালকা লাগবে। কথাগুলো বলার পর শিশুর মাথায় আলতো হাতের ছোঁয়া, জড়িয়ে ধরা, গালে চুমু খেয়ে বুঝিয়ে দিন আপনি সবসময় ওর পাশে আছেন।
বিব্রতকর প্রশ্ন
ছোটদের সব প্রশ্নের উত্তর এই সময় ধৈর্য ধরে দিন। আপনার মন খারাপ থাকলেও বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। যতই আজগুবি বা বিব্রতকর প্রশ্ন শিশু করুক না কেন; উত্তর দিন। অনেক সময় বাচ্চারা একই প্রশ্ন বারবার করে; ধৈর্য হারাবেন না। নিজের রাগ, দুঃখ, বিরক্তি নিয়ন্ত্রণে রেখে ওকে বারবার বুঝিয়ে বলুন, যতক্ষণ না পর্যন্ত ও প্রিয়জনের চলে যাওয়াটা পুরোপুরি মেনে নিতে পারে। এই সময় ওর প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে শিশুরা আরও বেশি করে মৃত ব্যক্তির অভাববোধ করবে এবং নিজেকে আরও গুটিয়ে ফেলবে।
অন্যদের মন্তব্য
শিশুর মনে আত্মীয়স্বজনদের কিছু কিছু মন্তব্য ব্যথা দিতে পারে। আপনার দায়িত্ব সন্তানকে রক্ষা করা। ওর দিকে সবসময় নজর রাখতে চেষ্টা করুন। কেউ যদি অজান্তে এমন কিছু বলেন যা আপনার মনে হয় ওর শোনা উচিত নয়, ওকে সেখান থেকে সরিয়ে দিন। আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধ করুন এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা থেকে বিরত থাকতে।
ট্রমা ম্যানেজমেন্ট
প্রত্যেক শিশুরই শোক প্রকাশের ভঙ্গি আলাদা হয়। কেউ হয়তো খেতে চায় না, কেউ ঘুমোতে যেতে ভয় পায়, আবার কেউ হয়তো একদম চুপ হয়ে যায়। শিশুর ব্যবহারের এই অস্বাভাবিকতা বোঝার চেষ্টা করুন। ওকে মাঝে মাঝে খাইয়ে দিন, ওকে নিয়ে ঘুমোতে যান, বাইরে বের হন। প্রয়োজনে কাউন্সিলরের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
স্বাভাবিক জীবনযাত্রা
শিশুর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। স্কুল, প্রাইভেট পড়া, হবি ক্লাস কিছুই ৩-৪ দিনের বেশি বন্ধ করবেন না। স্কুলের শিক্ষকদের বাড়ির অবস্থা জানিয়ে রাখুন। যাতে পড়াশোনার ফাঁকগুলো তারা পূরণ করে দিতে পারেন।