কোনো রোগ যখন বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব চালায় তখন সেটিকে মহামারির নাম দেওয়া হয়। পুরোপুরি অজানা রোগের সংক্রমণে একের পর এক মৃত্যু ঘটতে থাকে। ছোঁয়াচে ভাইরাস হয় এসব রোগ। বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাস তেমনই একটি মহামারি। নিত্যদিন নতুনভাবে এই ভাইরাস নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে। মহামারির এমন তাণ্ডবের ইতিহাস এটাই প্রথম নয়। ৫০০ বছর আগেও ছিল এমন মহামারি।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে আচমকাই হানা দেয় এমন ভাইরাসগুলো। ৫০০ বছর আগের এক ভাইরাসের সন্ধান মেলে ইউরোপেই। ১৪৮৫ সালে এর সূচনা হয় ইংল্যান্ডে। এরপর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে। কী কারণে, কীভাবে ওই রোগ ছড়াচ্ছে তা বোঝার আগেই মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেন হাজারো মানুষ। তবে ৫০০ বছর আগের এই রোগের কারণ এখনও অজানা বিশ্ববাসীর কাছে। কারণ ওই মহামারি রোগের কারণ নিয়ে হয়নি কোনো গবেষণা। এক সময় ইতিহাসের পাতায় ছাপ ছেড়ে দিয়ে নিজেই উধাও হয়ে যায় মহামারির সেই রোগ।
৫০০ বছর আগের মহামারির ওই রোগের উপসর্গও ছিল অদ্ভূত। রোগীর শরীরে ঘাম হতো। কপাল-গলা দিয়ে গড়িয়ে পড়তো ঘাম। ঘামাতে ঘামাতে শুরু হতো কাঁপুনি। সেই সঙ্গে অবস হতে থাকতো হাত ও পা। শরীরের পেশিগুলোও শক্ত হয়ে যেত। এরপর আধা ঘণ্টার মধ্যেই রোগী মৃত্যুকোলে ঢোলে পড়ে। মানে প্রথমে ঘাম হয়, এরপরই হয় মৃত্যু।
তত্কালীন চিকিত্সকরা আচমকা ঘাম হয়ে এই মৃত্যুর কারণ হৃদরোগকে দায়ী করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, এটি ভাইরাস। কারণ ঘাম থেকে এই রোগ ছড়িয়ে যেত। ঘাম যার গায়ে লাগত, তারও নিশ্চিত মৃত্যু হতো কিছুদিনের মধ্যেই।
মহামারি ওই রোগের প্রভাব পুরো লন্ডনে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় রাজপরিবারের দাসদাসী, কর্মচারীসহ সবাই সংক্রমিত হতে থাকে। অজানা এই রোগকে ছোঁয়াচে ঘাম সংক্রামক মহামারির আখ্যা দেওয়া হলো।
১৫৫১ সালে অজানা এই রোগকে প্রথম শনাক্ত করেন শ্রিউসবারির চিকিৎসক জন কেইয়াস। তিনি এই রোগের নাম দিলেন ‘সোয়েটিং সিকনেস’। ঘাম থেকেই এই রোগ ছড়ায় বলে 'সোয়েটিং সিকনেস' নাম দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ইতিহাসবিদরা এই রোগের বাংলা নামও দিয়েছিলেন। যার নাম দেওয়া হয় ‘স্বেদন রোগ’ বা ‘স্বেদন বালাই’।
ডাক্তার থমাস ফ্রস্টিয়ার অজানা ওই রোগের বিশদ বিবরণ দিয়ে তত্কালীন রাজা সপ্তম হেনরিকে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে সোয়েটিং ডিজিজ নিয়ে গবেষণা তথ্য জানান। ডাক্তার থমাস জানান, তিনি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের পরীক্ষা করেছেন। তিনি প্রমাণ পেয়েছেন ওই রোগ বসন্তকাল আর গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণেই ছড়াচ্ছে। তবে ঘাম হওয়ার কারণ তিনি জানাতে পারেননি।
চিঠিতে থমাস লিখেন, ঘাম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রোগীর হার্ট ও ফুসফুসের চারপাশে বাষ্প জমে। সে থেকে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে রোগীর। শরীরের ভেতর উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাতেই দম বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
যদিও ইংল্যান্ডবাসী ওই রোগকে ভয়ঙ্কর অভিশাপ বলে মনে করতে থাকেন। তাদের ধারণা, বসওয়ার্থ ফিল্ড যুদ্ধের দোহাই দিয়ে রাজা সপ্তম হেনরিকে জোর করে সিংহাসনে বসানো হয়েছে। তাতেই দেবতারা অখুশি হয়ে এমন অভিশাপ দিয়েছে।
১৫০২ সালে রাজপরিবারের বদ্যিরা বলেন, এটি ‘বাষ্প-রোগ’। তাদের ধারণা ছিল, এই রোগ ব্ল্যাক ডেথ, টিউবারকিউলোসিস, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই ছোঁয়াচে। এটি বাতাস থেকে ছড়াচ্ছে। জীবনযাপন পদ্ধতি এই রোগের কারণ।
১৫০৭, ১৫১৭ সালে আবারও হানা দেয় ওই রোগ। চতুর্থ মহামারি দেখা দিয়েছিল ১৫২৮ সালে। ওই সময় ইংল্যান্ডের বাইরে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলসেও সংক্রমণ শুরু হয়। তবে ঘাম-রোগের আসল কারণ তখনও জানা সম্ভব হয়নি।
পরে গবেষকরা এই রোগ নিয়ে গবেষণা চালান। গবেষকরা বলেন, হান্টা ভাইরাস থেকে এই রোগ হতে পারে। ইঁদুর, বাদুড় থেকে ওই রোগ ছড়িয়েছে। হান্টাভাইরাস পালমোনারি সিন্ড্রোমের সঙ্গে সোয়েটিং সিকনেসের বিস্তর মিল রয়েছে বলে দাবি করেন বিজ্ঞানীরা।
আরও একদল গবেষক জানান, সোয়েটিং সিকনেস হচ্ছে অ্যানথ্রাক্স রোগ থেকে। ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামে ব্যাকটেরিয়া নিঃশ্বাস, ত্বকের ক্ষত দিয়ে বা খাবারের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ায়। গবাদি পশুর থেকেও ছড়াতে পারে। তাদের দাবি, এই ব্যাকটেরিয়া বহু শতাব্দী সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে।
১৭১৮-১৯১৮ সালের দিকে ফ্রান্সে ‘পিকার্ডি সোয়েট’ নামে আরেকটি মহামারি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। যার উপসর্গ ছিল অনেকটা ‘সোয়েটিং সিকনেস’এর মতোই। ওই মহামারিতেও মৃত্যু হয় হাজারো মানুষের। তবে সেই রোগের কারণও ছিল অজানা।
সূত্র: দ্য ওয়াল