বর্ষবরণে শোভাযাত্রা কেন করা হয়

সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক প্রকাশিত: এপ্রিল ১১, ২০২৫, ০৯:৪৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল, বাংলা ১লা বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন হয়। বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতির অন্যতম ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এই দিনে দেশের সারাদেশে আনন্দ-উৎসব হয়। পাশাপাশি নববর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো শোভাযাত্রা। প্রতিবছরই ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় "মঙ্গল শোভাযাত্রা"। সম্প্রতি যার নাম বদলে রাখা হয়েছে " আনন্দ শোভাযাত্রা"। এই শোভাযাত্রা শুধুমাত্র আনন্দ প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ।

শোভাযাত্রার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ প্রথম শুরু হয় ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে। ওই সময় দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বৈষম্য ও অশান্তি বিরাজমান ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একটি শান্তিপূর্ণ ও মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এই শোভাযাত্রার আয়োজন করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মঙ্গল কামনা, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য ও সাম্যের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। এছাড়াও শোভাযাত্রার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে _

সামাজিক ঐক্য
শোভাযাত্রায় বিভিন্ন বয়স, ধর্ম ও শ্রেণির মানুষ একত্রিত হন। এতে সামাজিক বিভাজনের দেয়াল ভেঙে পড়ে এবং একটি সাম্যবাদী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে।

অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বার্তা
শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত নানা রঙিন মুখোশ, বিশাল আকৃতির মূর্তি ও শিল্পকর্মের মাধ্যমে অশুভ শক্তিকে প্রতীকায়িত করা হয় এবং তা পরাজিত করার বার্তা দেওয়া হয়।

মানবিক মূল্যবোধের উন্মেষ
এই আয়োজন একটি মানবিক, শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতির সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। যা আমাদের জাতীয় পরিচয়ের একটি গর্বিত অংশ।

সংস্কৃতির জাগরণ ও সংরক্ষণ
শোভাযাত্রায় বাংলা লোকসংস্কৃতি, শিল্প, সংগীত এবং ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। এতে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সংস্কৃতি চর্চার আগ্রহ জন্মায় এবং ঐতিহ্য রক্ষা পায়।

শোভাযাত্রার উপাদান ও প্রতীকী অর্থ

শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের বিশালাকৃতির মুখোশ, পাখি, বাঘ, হাতি, সূর্য ও অন্যান্য জন্তুর প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়। এসব প্রতীক সাধারণত লোকজ সংস্কৃতিতে রক্ষাকবচ বা মঙ্গলজনক প্রতীকে রূপে বিবেচিত হয়। যেমন_ সূর্য, নতুন দিনের সূচনা ও আলোর প্রতীক। পেঁচা ও বাঘ মন্দের প্রতীক, যা জয় করতে হবে। মাছ, হাঁস, পাখি গ্রামীণ জীবনের প্রতীক। ঘুড়ি ও নকশাকাঁথা বাঙালি সৃজনশীলতার নিদর্শন। এই সব উপাদান একত্রে একটি সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক চিত্র তুলে ধরে। যা আমাদের শেকড়ের সাথে সংযোগ স্থাপন করে।

ইউনেস্কোর স্বীকৃতি
২০১৬ সালে “মঙ্গল শোভাযাত্রা”কে ‘Intangible Cultural Heritage of Humanity’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। এই স্বীকৃতি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং গোটা বাঙালি জাতির জন্য গর্বের বিষয়। এটি প্রমাণ করে যে, এই শোভাযাত্রা শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, বরং বিশ্বমানবতার এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।

নববর্ষের এই শোভাযাত্রা শুধু ঢাকা নয়, বাংলাদেশের প্রায় সব বড় শহরে পালিত হয় এবং দেশের বাইরেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন। এটি এখন একটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে, মানুষ একত্রিত হয় একটি সুন্দর, মানবিক ও সাংস্কৃতিক সমাজের স্বপ্ন নিয়ে।

বর্ষবরণে শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালি নিজেদের  শেকড়কে নতুন করে আবিষ্কার করে, অশুভকে পরাজিত করার সংকল্প নেয় এবং একটি সুন্দর, মানবিক সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে এগিয়ে যায়।