প্রতি বছর ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী নারী দিবস পালিত হয়। এই দিনটি নারীদের অধিকার, সমতা, মর্যাদা ও অবদানের প্রতি সম্মান জানাতে উৎসর্গ করা হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছে। যার স্বীকৃতি দিতেই বিশ্বব্যাপী পালিত হয় নারী দিবস।
নারীরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাদের উন্নতি মানেই গোটা সমাজের উন্নয়ন। অতীতের তুলনায় বর্তমানে নারীরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি, উদ্যোক্তাবৃত্তি, খেলাধুলা এবং সামাজিক আন্দোলনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছেন। এই অগ্রগতি শুধু ব্যক্তিগত অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এটি একটি জাতির সামগ্রিক বিকাশের প্রতিফলন।
শিক্ষায় নারীর অগ্রগতি
নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এক সময় শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকলেও বর্তমানে নারীশিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রচেষ্টায় নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি, ফ্রি বই বিতরণ, স্কুলে দুপুরের খাবার সরবরাহসহ নানান উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উচ্চশিক্ষায়ও নারীরা দারুণ সাফল্য দেখাচ্ছেন। চিকিৎসা, প্রকৌশল, আইন, ব্যবসায় প্রশাসন, তথ্যপ্রযুক্তি, গবেষণা—প্রায় সবক্ষেত্রে নারীরা নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করছেন। নারী শিক্ষার প্রসার তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতাকে আরও বেগবান করছে।
অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা
বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া নারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বর্তমানে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন স্টার্টআপ, ই-কমার্স এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। প্রযুক্তির বিকাশের ফলে ঘরে বসে অনলাইন ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যা নারীদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করছে। এছাড়া, অফিস-আদালত, ব্যাংক, বীমা, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন পেশায় নারীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি লক্ষণীয়। অনেক নারী কর্পোরেট নেতৃত্বেও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানির শীর্ষ পদে এখন নারীদের নেতৃত্ব দেখা যায়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নারীদের সাফল্য
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীরা একসময় কম দেখা গেলেও বর্তমানে তারা উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে গেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে নারীরা ফ্রিল্যান্সিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইনিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দক্ষতা অর্জন করছেন। নাসার মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করা নারী বিজ্ঞানীরা বা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর নারী প্রকৌশলীরা প্রমাণ করেছেন যে মেধা ও যোগ্যতায় নারীরা কোনো অংশে কম নয়।
রাজনীতি ও নেতৃত্বে নারীদের অগ্রগতি
একসময় রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণভাবে পুরুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি ক্ষেত্র। তবে এখন নারীরা বিভিন্ন দেশে সরকারপ্রধান, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, মেয়র এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীরা নেতৃত্বের গুণে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
নারীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি
নারীরা শুধু পেশাগত সাফল্যের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন না, তারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। নারীরা এখন লেখালেখি, সাংবাদিকতা, সংগীত, অভিনয়, ফ্যাশন ডিজাইন, ক্রীড়াঙ্গন—সবখানেই সাফল্য দেখাচ্ছেন।
নারী অধিকার ও সচেতনতা বৃদ্ধি
নারীর অগ্রগতির ক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। অনেক দেশেই এখন নারী অধিকার ও লিঙ্গসমতার বিষয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বাল্যবিবাহ রোধ, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সচেতনতা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা বৃদ্ধি, নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। নারী আন্দোলন ও নারীবাদী সংগঠনগুলোর প্রচেষ্টায় নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হচ্ছেন। সমাজে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে মিডিয়া, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ
নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে এখনো নানা বাধা রয়েছে। লিঙ্গ বৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি, বেতন বৈষম্য, পারিবারিক ও সামাজিক বাঁধা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি নারীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে এখনো অনেক পরিবার নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিরোধিতা করে। বাল্যবিবাহ, গৃহস্থালির কাজের চাপ এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিভিন্ন নিয়মকানুন নারীদের স্বাধীনভাবে চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
তবে নারীরা এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাচ্ছেন। সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও সমাজের সব স্তরের সহযোগিতায় নারীদের জন্য আরও নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।