এই সরকারের দায়বদ্ধতা তরুণদের কাছে : ড. বদিউল আলম মজুমদার

সানজিদা শম্পা প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২৪, ০৪:৪৩ পিএম

সম্প্রতি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটেছে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীনকালীন সরকার। বাংলাদেশের রাজনীতি, নবগঠিত সরকার ও দেশের সার্বিক বিষয় সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে কথা বলেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানজিদা শম্পা। 


সংবাদ প্রকাশ:  একটি ভয়মুক্ত বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূরীভূত হবে সে আশাই হচ্ছে। ২০১৮ সালে আপনার বাড়িতে নৈশভোজে ঢাকার সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট থাকাকালীন সময়ে একটি হামলা হয়। এবং সেই হামলার বিষয়ে অভিযোগ করেও আপনি তার বিচার পাননি। এখন তার বিচার চান কী? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমরা আইনের শাসন চাই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সব অন্যায়ের বিচার হতে হবে। আমরা গণতান্ত্রিক শাসন চাই। গণতান্ত্রিক শাসনের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো আইনের শাসন। যত অন্যায় হয়েছে, ফৌজদারি অপরাধ, দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন; সব কিছুর বিচার চাই। আইনের শাসনের জন্য সব বিচারের পাশাপাশি আমার বাড়িতে এবং মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলারও বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করি। 

সংবাদ প্রকাশ: দ্য ডন এর একটি প্রতিবেদনে ড. মোহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, তিনি একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। আপনার কাছে নতুন বাংলাদেশের রূপটি কেমন? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা তার সংজ্ঞাটা ড. ইউনূসের কাছ থেকে পাওয়া উচিত। আমি যেটা মনে করি, বাংলাদেশের সৃষ্টিটা কেন, কী জন্য আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছিলেন, রক্ত দিয়েছিলেন? এমন একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যেখানে মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। মানুষ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে তাদের ভোটের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, সাম্য মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এগুলো প্রতিষ্ঠা হবে। এগুলোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এগুলোই ছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় অঙ্গীকার সমাজের প্রতি, জাতির প্রতি। কিন্তু আমরা এখন সেই চেতনা থেকে যোজন যোজন দূরে। আমরা বস্তুত পথ হারানো জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাটা, সেই আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, মানবিক মর্যাদা, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করলে আমরা নতুন বাংলাদেশ পাবো। কিন্তু এই বাংলাদেশ নতুন হওয়ার কথা নয়। নতুন হয়েছিলাম ১৯৭১ সালে। কিন্তু আমরা পারিনি। এখন ৫৩ বছর পর যদি আমরা এগুলো অর্জন করতে পারি এটাই হবে আমাদের নতুন বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বাংলাদেশ। আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। আমাদের আকাঙ্ক্ষাখার বাংলাদেশ। 

সংবাদ প্রকাশ: আপনিও একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন, যেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে। এই নতুন বাংলাদেশ গড়ার চ্যালেঞ্জটি কোথায়? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: চ্যালেঞ্জ তো অগণিত, পর্বত সমান। প্রথমত আমাদের ওই চেতনাই হারিয়ে গেছে। আমরা সেই চেতনা থেকে যোজন যোজন দূরে। আমরা চেতনাকে ব্যবহার করে, অপব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করেছি। এজন্যই আমরা দূরে চলে আসছি। এখন পথ হারানো জাতি আমরা, এমন পথে চলে এসেছি, যা ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করেছে। যেটা মানুষের জন্য নাভিশ্বাস পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মানুষের অধিকার হরণ করেছে। মানুষের প্রতি যে ন্যায় বিচার হওয়ার কথা, সেই ন্যায় বিচারকে সুদূরপরাহত করেছে। এগুলোই হলো বাস্তবতা, এগুলোই হলো চ্যালেঞ্জ। এবং আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, এই সংস্কৃতিই বিরাট চ্যালেঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আমাদের মুখে উচ্চারিত হয়। কিন্তু আমরা এর তাৎপর্য অনুভব করি না, চর্চাতো যোজন যোজন দূরে। অনুভব করতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে এটা গুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই উপলব্ধিই আমাদের চলে গেছে। পুরো রাষ্ট্রটাই একটা ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের, অর্থ পাচার, লুটপাটের এবং মানুষের অধিকার হরণের একটা যথেচ্ছা দাঁড় করানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে।

সংবাদ প্রকাশ: যুব ক্রীড়া মন্ত্রণালয় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলছিলেন, যতদিন প্রয়োজন ততদিন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকবেন। অন্যদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বলছে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া দরকার। এই দুয়ের মধ্যে সমন্বয়ের চ্যালেঞ্জটি কোথায়?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: এই সমন্বয়টাই বিরাট চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রবল চাপ আছে এবং থাকবে। একই সাথে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা, কতগুলো মৌলিক পরিবর্তন যাতে অতীতের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। একই সাথে যারা ফৌজদারি অপরাধ করেছে, লুটপাট করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা। এগুলো সময় সাপেক্ষ। এগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা দুরূহ। এবং যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আছেন তারা কতটুকু দক্ষতার সাথে করতে পারেন এবং আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন সেটি দেখার বিষয়। যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো যদি দায়িত্বশীল না হয়, তারা যদি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে যেটা ঘটেছে ২০০৮ সালে, তাহলে কিন্তু তাদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সহজ হবে না।

সংবাদ প্রকাশ: আমরা এই ১৫ বছর শেখ হাসিনা সরকারের বিরোধী শক্তি বা বিকল্প খুঁজছিলাম, পাইনি। এখন সরকার পতনের পর অনেক রাজনৈতিক দলেরও অভ্যুত্থান হয়েছে। আমরা আওয়ামী লীগের যেমন অপশাসন দেখেছি, বিএনপি জামাতের সময়ও আমরা অপশাসন দেখেছি। এখন এই নতুন সময়ে কি আমরা রাজনৈতিক দলের পরিবর্তন দেখতে পাবো? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: এটাই তো মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। সেটাই তো সকলের মনে জাগ্রত হচ্ছে এই প্রশ্নটা। তাদের দায়িত্বশীল আচরণের প্রত্যাশা। তারা রাজনৈতিক সমাবেশ করতেই পারে, এটা তাদের বাক স্বাধীনতা। তারা তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন চাইতেই পারে, এটা তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য। কিন্তু আসলেই তারা পরিবর্তন চায় কি না। এই যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে, তা পরিষ্কার করতে হবে। যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনী বলতে কিছু নাই। আমাদের পুলিশ বাহিনী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, দেশ রক্ষাকারী বাহিনী রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছিল না। ছিল এক দলীয় বাহিনী। এই প্রতিষ্ঠানটাই ঠিক করতে হবে। আমাদের প্রশাসনে কত স্তর পর্যন্ত দলীয়করণ এবং প্রশাসনে কোনো নিয়োগ হতো না, যদি না তাদের প্রধান বিরোধী দলের সাথে কোনো রকম পারিবারিক সংশ্লেষ থাকে। এগুলো এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তার থেকে উত্তরণ চাট্টিখানি কথা নয়। আমরা আশা করবো প্রবল যে জন-আকাঙ্ক্ষা, তার প্রতি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সম্মান প্রদর্শন করবে, দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে এবং এই সরকারকে সহায়তা করবে। এই সরকার তো কোনো ম্যান্ডেট দিয়ে আসেনি। জন-আকাঙ্ক্ষাই তাদের ম্যান্ডেট। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো সহায়তা কবে। আমি আশা করি এই সরকারও দায়িত্বশীলতার সাথে, স্বচ্ছতার সাথে, আন্তরিকতার সাথে জনগণের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে। 

সংবাদ প্রকাশ: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে ফিরে আসা এবং তাদের এখন যে অচলায়তন তার পরিবর্তন কখন দরকার? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: পরিবর্তনটি আগেই হওয়া উচিত ছিল। যখন পুরোনো কাঠামো ভেঙে গিয়েছে তখনই দরকার ছিল। কিন্তু বাস্তবসম্মত ছিল না। আমি আশা করবো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরোনো কাঠামো ভেঙে নতুনভাবে যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসুক। এই প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি গড়ে তোলা সম্ভবপর নয় এই মুহূর্তে। অন্তত জোড়াতালি দিয়ে এটাকে কার্যকর করা। কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যেন তারা পালন করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা, শান্তি বজায় রাখার জন্য যেন কাজ করতে পারে। 

তবে আশার কথা আমাদের শিক্ষার্থী, সাধারণ জনগণদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেখা গেছে। স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় কোনো কিছু প্রাপ্তির বিনিময়ে নয়। তারা মাঠে নেমেছে, তারা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন, রাস্তা পরিষ্কার করছেন। তাদের চোখের সামনে যে অসঙ্গতিগুলো এসেছে, যেগুলো পরিবর্তন করা তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন, তারা সেখানে নিজেরা আত্মনিয়োগ করছেন। এটা অভূতপূর্ব। এই গণঅভ্যুত্থানের অনেকগুলো অবদান বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আমি মনে করি এটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশটাকে সুন্দর করার ব্যাপারে, পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ, চাঁদাবাজিমুক্ত বাংলাদেশ এবং একটা বিন্যস্ত শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ এবং আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের যে অভিঘাত সবকিছুর ব্যাপারে এইসব তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা এই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। 

আমরা যদি এগুলো কাজে লাগাতে পারি। এগুলোকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারি, তাহলে এই তরুণদের অবদানের ফলে বিরাট পরিবর্তন আসতে পারে, ইতিবাচক পরিবর্তন। আমাদের এক কোটি ছেলেমেয়ে যদি একটা করে ভালো কাজ করে, তাহলে এক কোটি ভালো কাজ। কি অসাধারণ। পরিবর্তনের সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। তারা তো একটা কাজ নয়, তারা তো এখন দিনের পর দিন করছে। যদি এই তরুণদের দিয়ে কাজ করানো যায়, তাহলে বিরাট পরিবর্তন সম্ভব।

আর এই সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই, মানে প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা নেই। নির্বাচনী সরকারের যেমন থাকে। ৫ বছর পর সরকারকে জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবে। তাদের যে দায়বদ্ধতা, নিম্নমুখী দায়বদ্ধতা। আর সমান্তরাল দায়বদ্ধতা সংসদ বা কতগুলো প্রতিষ্ঠানের কাছে।

এই সরকারের সেই দায়বদ্ধতা নেই। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে থাকে দায়বদ্ধতার ওপর। তারা ভোটের মাধ্যমে আসেনি, তারা সংসদে যাবে না, তারা কারো কাছে জবাবদিহি করবে না। এই তরুণরা সেই ভূমিকাটা পালন করতে পারে। তা জরুরি।

কারণ ক্ষমতার অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য থাকে। একটা বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়া। যেখানেই ক্ষমতা সেখানেই কুক্ষিগত হওয়ার চেষ্টা করা হয়, অপব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। ক্ষমতা যাতে অপব্যবহার না হয়, কুক্ষিগত না হয়; সেটা সুনিশ্চিতের ব্যাপারে এই তরুণরা ভূমিকা পালন করতে পারে। এখনো তাদের ডাক দিলে লক্ষ লক্ষ তরুণ মাঠে নেমে যাবে। তাই এ সরকারকে দায়বদ্ধ করতে পারে এই তরুণরা। একই সাথে যারা এই সরকারকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করবে তাদেরও রুখতে পারে এই তরুণরা। 

আমি বলেছি তারা মুক্তিযোদ্ধাদের যোগ্য উত্তরসূরি। তারা প্রাজ্ঞভাবে, দায়িত্বশীলতার সাথে, নিঃস্বার্থভাবে এই ভূমিকা পালন করতে পারবে। 

সংবাদ প্রকাশ: দেড় মাসে প্রায় হাজার কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। যেখানে গত ৩/৪ বছরে আমাদের অর্থনীতি এমনিতেই ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। সেখানে এই দেড় মাসের ক্ষতি যোগ হলো। এই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রথমেই কী করা উচিত বলে মনে করেন? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রথমেই গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করা দরকার। গ্রামীণ মানুষগুলোকে উৎপাদকে পরিণত করা দরকার। এজন্য তাদের সংঘটিত করা দরকার। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর করা দরকার। যাতে বাড়িতে বাড়িতে তারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন করতে পারে। 

একই সাথে বাইরে থেকে সাপ্লাই চেইনে যদি ছেদ পড়ে, তাহলে আমরা যেন আমাদের উৎপাদনের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে পারি। বিরাট সঙ্কট যেন তৈরি না হয়। 

আরেকটি হলো আমাদের রিজার্ভের সংকট। এই রিজার্ভ সংকট আর ডলারের আকাশচুম্বী দাম। এগুলো আমরা যদি অপচয় না করি। এই সরকার যদি দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ না নেয় এবং অন্যকে প্রতিহত করে তাহলে অনেক রিজার্ভ সাশ্রয় হবে। এটা আমাদের অর্থনৈতিক সঙ্কট দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। 

আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা যে রেমিটেন্স পাঠাতো, তা নিম্নমুখী ছিল। আশা করি এখন তারা আবার আগের মত প্রেরণ করবেন। 

তবে অবশ্যই বৈদেশিক সাহায্য লাগবে। আমি নিশ্চিত যে অনেক বন্ধু রাষ্ট্র সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে। বিশ্বব্যাংক থেকেও পাওয়া যাবে। তবে সঠিকভাবে অ্যাপ্রোচ করতে হবে। 

সংবাদ প্রকাশ: নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। নির্বাচন কমিশনের জন্য সুজন থেকে কী পরামর্শ থাকবে। 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: এই নির্বাচন কমিশনটা যেভাবে গঠিত হয়েছে তা সঠিকভাবে গঠিত হয়নি। কমিশনের বৈধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত যে আইনটা করেছে, সেই আইনটা কিন্তু সত্যিকারের আইন নয়। আমরা একটা আইনের খসড়া করে দিয়েছিলাম। তখন আইনমন্ত্রী বলেছিলেন বিবেচনায় নেবেন, তারপর বললেন সময় নাই। কিন্তু তারপর তাদের ঠিকই সময় হলো। এই সময়টাতে তারা যা করলো, তা হলো আগের যে প্রজ্ঞাপন সেটাকেই আইনের খোলস দিয়ে চালিয়ে দিলো। এবং এটা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য। নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে আইনটাও মানা হয়নি। তারা আমাদের যে নির্বাচন উপহার দিয়েছেন তা নির্বাচন নয়। 

ইলেকশন মিনস চয়েস। বিকল্পের ভেতর থেকে বেছে নেওয়া। শুধু বিকল্পই না, বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প। আমাদের একতরফা নির্বাচন কোনো নির্বাচনই হলো না। 

সংবাদ প্রকাশ: বিকল্প যদি তৈরি না হয়, তাহলে বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো থেকে সরকার বাছাইয়ে কোনো ভয় আছে কি না। 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: ভয়তো আছেই। আমাদের যে একটা বড় দল তারা বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। জানি না তারা ভেঙে যাবে কি না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল। দলের মধ্যে ভাঙন ধরবে কি না আমি নিশ্চিত নই। যিনি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন দলের মধ্যে এবং রাষ্ট্রেরও, তিনি আর নেই। এবং আমি নিশ্চিত নই, তিনি আবার ফিরে আসতে পারবেন কি না। তিনি ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা জানিয়েছেন, কিন্তু আমার সন্দেহ হয়, তিনি ফিরে এলে অনেকগুলো হত্যা মামলার মুখোমুখি হবেন। হত্যা মামলার আসামি হবেন নিশ্চিত আমি। এটা ওনার জন্য শুভকর হবে না। তাই তার ফিরে আসা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। ওনার অনুপস্থিতিতে এই দলের কী অবস্থা হবে আমরা জানি না। 

তবে শক্তিশালী একটা প্রতিপক্ষ থাকতে হবে। বিএনপি একটা বড় দল। বিএনপি এখন রাহুমুক্ত। আওয়ামী লীগ এখন রাহুগ্রস্ত। তাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয়ে কিছু লোক এগিয়ে আসবেন আশা করি। আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু আমার বিনীত অনুরোধ, যারা অন্যায় করেছে, দুর্নীতি করেছে, তাদের যেন নেতৃত্বতে স্থান না দেয়। তারা যেন স্বচ্ছ গণতন্ত্র রাজনৈতিক দলে প্রতিষ্ঠা পায় এটাই আকাঙ্ক্ষা। 

সংবাদ প্রকাশ: ছাত্ররা সবসময় রক্ত দেবে না, সব সময় গণঅভ্যুত্থান হবে না। তাই আপনার প্রত্যাশা কী থাকবে। 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমাদের এই ছাত্ররাই রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। কেন দিয়েছে। আমাদের এই রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থতার জন্য, স্বার্থপরতার জন্য। রাজনৈতিক দলগুলোর যে দায়িত্ব তা পালন না করার জন্য। এটার অবসান হওয়া দরকার। রাজনীতিবিদরা যদি সদাচারণ করে, রাজনীতিবিদরা যদি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা করে তাহলে আর তাদের রক্ত দিতে হবে না। তারা যদি সমস্যা সৃষ্টি করা করার পরিবর্তে সমাধান করে, তাহলে বহুলাংশে সমস্যা কমে যাবে। এবং সমাধান হবে। 

রাজনীতিবিদরাই সমস্যা তৈরি করছে, তাদেরই সমাধান করতে হবে। 

সংবাদ প্রকাশ: ধন্যবাদ আপনাকে। 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।