মানুষ ধনী হচ্ছে, কিন্তু কর আদায় হচ্ছে না : ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ

সানজিদা শম্পা প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২৪, ১০:৪৬ এএম

দেশের অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই এখন নেতিবাচক। টানা ১৫ মাস ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে বাংলাদেশ। অনেক উদ্যোগ দেওয়ার পরও অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। অর্থনীতির এই বহুমুখী চাপের মধ্যেই ৬ জুন পেশ হয়ে গেল ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটটি কেমন হলো, কোথায় সংস্কারটি প্রয়োজন, তা নিয়ে সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে কথা বলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানজিদা শম্পা

সংবাদ প্রকাশ: প্রস্তাবিত বাজেট কেমন হলো? 

ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ: প্রতিবছর বাজেট হয়, হয়ে আসছে এবং আগামীতেও হবে। এটার ধারাবাহিকতা থাকে। বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়, বিভিন্ন খাত থেকে অর্থ নেওয়া হয়। কোন খাতে জোর দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করা হয় ওই বছরের বাস্তবতার নিরিখেই। 
কোনো কোনো বছর কোনো বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয়, ধরুন বন্যা হলো বা আন্তর্জাতিক মহলে কোনো ঘটনা ঘটে গেল, তখন সেদিকে নজর দিতে হয়। এ ছাড়া মোটামুটি এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এবারের সবচেয়ে বড় সমস্যা যা সরকার নিজেও বলেছে এবং নির্বাচনী ইশতেহারে এক নম্বর সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছে, তা হলো মূল্যস্ফীতি। এবারের বাজেটে সংকোচন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রতিবছরই বাজেটের আকার বেশ বড় করা হয়, এবার মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকার মতো বাড়ানো হয়েছে। আরও কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য। যেমন নিত্যপণ্যের শুল্ক-কর কমিয়ে নিয়ে আসা এবং বাজেটের ঘাটতির পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে। 

অর্থমন্ত্রীর হাতে অনেকগুলো হাতিয়ার তো নেই। যে হাতিয়ারগুলো আছে, সেগুলো প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে আর্থিক নীতিতে আগে থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু যখন করার কথা ছিল বলে আমরা মনে করেছিলাম, তখন করা হয়নি। কিন্তু দেরিতে হলেও নেওয়া হয়েছে। যেমন সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এই নীতিটি ভারত, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে কাজ করছে না। নতুন আরও দুটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তার জন্য সময় লাগবে। আমরা দেখি বাজেট পেশ হওয়ার পরে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। 

মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এর পেছনে যুক্তিটি কী? কোনো যুক্তি দেওয়া হয়নি। চলতি বাজেটে (২০২৩-২৪) ৬ শতাংশ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা আমরা অর্জন করতে পারিনি। বরং তা ১০ শতাংশে উন্নীত হয়ে গেছে। এবারের বাজেটে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ কীভাবে অর্জিত হবে, তার কোনো উত্তর আমরা পাইনি। যুক্তিটা জানলে আমরা প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। সাধারণভাবে প্রতিবারেই প্রতিকারের নীতি গ্রহণ করা হয়। নীতি কেন কাজ করছে না, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

এটার একটা উত্তর আছে, উত্তরটা হচ্ছে, বাংলাদেশে দুষ্টচক্র আছে অনেকগুলো। যাকে আমরা সিন্ডিকেট বলি। এই দুষ্টচক্রগুলো বাজারে সঠিক নীতি বা পদক্ষেপকে কাজ করতে দেয় না, যদি তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে। এবং অনেকেরই স্বার্থে আঘাত লাগছে। সুদের হার বাড়ানো হলে যাদের সমস্যা হবে, যারা ঋণ নেয় এবং অন্যান্য পদক্ষেপে যাদের সমস্যা হবে। 

এই দুষ্টচক্রগুলো সব জায়গায় আছে। আলুর বাজারে আছে, পেঁয়াজের বাজারে আছে, ডলারের বাজারে আছে। আগেও ছিল। সম্প্রতি আমরা দেখলাম বিদেশে শ্রমশক্তি পাঠানোর ব্যাপারে। যারা যেতে চেয়েছিল, যেতে পারেনি এই দুষ্টচক্রগুলোর কারণে। 

বাজেট নিয়ে তো বলাই যায় অঙ্ক ধরে, এত বাড়ানো উচিত ছিল। কিন্তু যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হবে কি না, তা প্রশ্ন থেকেই যায়।

সংবাদ প্রকাশ: মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাজেটটি পেশ করল, ৬ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্য। একদিকে নিত্যপণ্যের শুল্ককর কমানো হলেও, অন্য দ্রব্যের ক্ষেত্রে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, মূল্যস্ফীতি রয়েই যাবে বাজারে। এমন পরিস্থিতিতে বাস্তবতার কোনো চিত্র বাজেটে আছে কি?

ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ: কিছু পদক্ষেপ তো রয়েছেই। অন্যদিকে তো সরকারের আয় দরকার। সরকারের যে সামর্থ্য, সেটা নির্ভর করছে সরকার কর কত আদায় করছে। অন্য কিছু মাধ্যম আছে আয়ের, কিন্তু তা সামান্য। এই কর জিডিপির যে অনুপাত, বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুপাতের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, ৮ শতাংশের কাছাকাছি। যদি আশপাশের দেশের কথা বলি, তাহলে নেপালে ১৮-১৯ শতাংশ, ভারতে ১১ দশমিক ২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ, এমনকি যে দেশ আমাদের থেকে সব সূচকে পিছিয়ে; পাকিস্তানেরও ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে ধনী হওয়ার হার খুবই উঁচু। বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ মানুষ ধনী হচ্ছে। কীভাবে হচ্ছে, তা ভিন্ন প্রশ্ন। মানুষ ধনী হচ্ছে, কিন্তু কর আদায় হচ্ছে না। এখানে আসল ব্যাপারটা হচ্ছে সিন্ডিকেট, যোগসাজশ যাকে আমি বলি। যারা আদায় করবে এবং যারা দেবে, তাদের মধ্যে যোগসাজশ থাকতে পারে। যারা নিয়ন্ত্রণ করবে, আরা যারা নিয়ন্ত্রিত হবে, তাদের মধ্যে যোগসাজশ থাকতে পারে। যারা নজরদারি করবে, যাদের করা হবে; তাদের মধ্যে যোগসাজশ আছে। এই ধরনের যোগসাজশ এবং দুষ্টচক্র, সেগুলো সঠিক যে সিদ্ধান্ত তাকে কাজ করতে দেয় না। 

আমরা কিন্তু অগ্রগতি অনেক করেছি। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমাদের যে উন্নতি হয়েছে, তা বিশ্বের কম দেশেই হয়ে থাকে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, সামাজিক খাতে উন্নতি হয়েছে, নারী ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা এগিয়ে আছি। 

সব অগ্রগতি হওয়ার পরে আমরা যখন এগোচ্ছিলাম, ঠিক তখনি বৈশ্বিক সমস্যা বাধা হয়ে দাঁড়াল। এই সমস্যাগুলোর ব্যবস্থা করতে গিয়ে আমরা একটু লন্ডভন্ড করে ফেলেছি। এত দিন এক ধারায় চলছিল দেশ। দুনিয়ার কোথাও এক ধারায় দেশ চলতে পারে না, পরিবর্তন করতে হয়। খালি অগ্রগতি হবে সমস্যা হবে না। এটা হয় না।

সমস্যাগুলো সমাধান করার প্রচেষ্টায় সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যখন নেওয়া হলো তখন তা হলো একচোখা। কোনো পদক্ষেপ নিলে, তার প্রতিফলন অন্য জায়গায় পড়তে পারে, তার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। 

যেমন ডলারের দাম বাড়ানো হলো, ১১০ থেকে ১১৭ টাকায়। এটা হয়তো বাড়ানো উচিত। কিন্তু হঠাৎ করে বাড়িয়ে দেওয়া উচিত হয়নি। বলা হলো, ডলারের বাজারকে স্থিতিশীল করার জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার যে প্রতিফলন মূল্যস্ফীতিতে পড়বে সেটি বিবেচনায় নেওয়া হলো না। রপ্তানি বলা হলো বাড়বে, কিন্তু আমদানি খরচ যে বেড়ে গেল সেটি অবলোকন করা হলো না। 

কাজেই একচোখা সিদ্ধান্ত। বহুমাত্রিকতাকে ধারণ করে, বিশ্লেষণ করে বাস্তবতার নিরিখে যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে জানব কোথায় কী প্রতিফলন পড়ছে। এখন ব্যাপার হচ্ছে, সেসব আমরা জানি না, হঠাৎ করে নীতি পরিবর্তন। বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে। পরিবর্তনটা মানুষ বুঝতে বুঝতে আবার নতুন নীতি গ্রহণ করা হয়। 

আরেকটি হচ্ছে, সমন্বয়ের অভাব। সমন্বয় না থাকালে বাস্তবায়ন হয় না। সে জন্য মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করতে হলে যে কাজগুলো সমন্বিতভাবে করা দরকার, সেটা অতীতে আমরা দেখেছি ঘটেনি। আগামীতে ঘটবে কি না, আমরা জানি না। যদি ঘটে, তাহলে অগ্রগতি হবে এবং ৬ দশমিক ৫ শতাংশও অর্জন হবে। 

সংবাদ প্রকাশ: বাজারে গেলে দেখতে পাওয়া যায়, মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াকেই দায়ী করা হয়। আমদানি মূল্য বেশি, ফলে পণ্যটির দাম বেড়ে যায়। সমস্যাটি কি বৈশ্বিক নাকি অভ্যন্তরীণ সমস্যাও রয়েছে? 

ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ: আমাদের দেশে যে পণ্যগুলো উৎপাদন করি, তার সঙ্গে তো আমদানির কোনো সম্পর্ক নেই। আছে তৈরি পোশাকে। ৪০ শতাংশ আমদানি খরচ দিতে হয়। আমরা যে আলু পেঁয়াজ দেশে উৎপাদন করছি, তার সঙ্গে তো সম্পর্ক নেই। এটা আমাদের মানসিকতার সমস্যা, মূল্যবোধের অবক্ষয়। সুযোগ পেলেই অর্থ বানানোর প্রচেষ্টা। অনেক দেশই আছে, বিশেষ বিশেষ সময়ে ছাড় দেয়—যেমন ঈদ, পূজা। কিন্তু আমরা দেখি, ওই সময়ে বেশি দাম থাকে। এই দাম তো বাড়ানোর কথা না, যা দেশে উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে ডলারের কোনো সম্পর্ক নেই, তারপরও করা হচ্ছে। 

বাজার অর্থনীতি বলে একটা কথা আছে। বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ হবে। এখানে বাজারকে কাজ করতে দিতে হবে। কিন্তু এখানে যে দুষ্টচক্রগুলো থাকে তারা বাজারকে কাজ করতে দেয় না। বাজার ব্যর্থ হতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে দুষ্টচক্র। উদার বাজারে আমি বিশ্বাস করি না, বাজারকে কাজ করতে দিতে হবে। 

ডলারের দাম বাড়লে আমদানি ব্যয় তো বাড়বেই। কিন্তু সেটা তো অন্তর্নিহিত সমস্যা। ডলারের দাম হঠাৎ করে এক জায়গায় স্থির করাটা ঠিক হয়নি। আমদানি আমরা যেসব জায়গায় করছি, সেখানে বিনিয়োগের ব্যাপারে সমস্যা হতে পারে। 

ডলারের অধিক মূল্যায়ন শেষের দিকে এসে আইএমএফের চাপে করা হয়েছে। আমাদের নীতি নেব আমাদের অবস্থা বিশ্লেষণ করে। ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশের জন্য কিছুই না। আমাদের যে জাতীয় উৎপাদ, সেটা ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। সেখানে আইএমএফের ঋণ তো কিছুই না। সেটা নিয়ে আমাদের তাদের কথা শুনতে হচ্ছে। সেখানেও কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। বিদ্যুতের দাম বাড়াতে বলছে, আমরা বাড়িয়ে দিচ্ছি। কিন্তু সেখানে করজাতীয় উৎপাদ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। সেটা আমরা বাড়াতে পারছি না।

কাজেই যেগুলো করতে পারছি, সেগুলোর অভিঘাত সাধারণ মানুষের ওপর গিয়ে পড়ছে। সহজেই করে ফেলা যাচ্ছে। কিন্তু যেগুলো একটু কঠিন কাজ, যাদের হাত লম্বা, তাদের ধরার যে ব্যাপার, সেখানে আমরা পারছি না।  

বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল বাড়াতে হলে অর্জন বাড়াতে হবে, রপ্তানি বাড়াতে হবে। রেমিট্যান্স তো অনেক বাড়ছে খরচ কমাতে পারছি না। 

এগুলো প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব পড়ছে। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সেটাও কোন যুক্তিতে ধরা হয়েছে, জানা নেই। এগুলো অর্জন করার জন্য যে দুষ্টচক্র কাজ করে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্জন সহজ হবে না। 

সংবাদ প্রকাশ: ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার যে সুযোগটি দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে সামাজিক ন্যায্যতা কতটুকু? 

ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ: এটা একেবারে অন্যায় একটা জিনিস। টাকাকে কালো বানিয়েছে, তার মানে এটা চুরি। তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, কোনো প্রশ্ন করা হবে না, ১৫ শতাংশ কর দিলেই তোমার টাকা সাদা হবে। আর যে সৎভাবে অর্জন করে কর দিতে চাচ্ছে, তার টাকার পরিমাণ করের আওতার পরিধির বেশি হলে তাকে ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে। তার সৎ যে, তার ওপর আমরা খড়গহস্ত হচ্ছি, আর যে অসৎ তাকে আমরা টেনে তোলার একটা সুযোগ করে দিচ্ছি। এটা কোনো পরিস্থিতিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু এটা অতীতেও দেওয়া হয়েছে। তা-ও আমরা অর্জন করতে পারিনি। এর বড় কারণ হচ্ছে, যারা কালোটাকা বানিয়েছে, তারা দেশে নেই। তাদের তো আমরা ধরতে পারছি না। বিদেশ থেকে আনার ব্যবস্থা করা গেলে, সেটা ভিন্ন কথা। আমার মনে হয়, এ সুযোগ থেকে বেশি কিছু পাওয়া যাবে না। আসল ব্যাপার হচ্ছে, আপনি এর মাধ্যমে অন্যকে কালোটাকা বানানোতে উৎসাহ প্রদান করছেন। 

মূল লক্ষ্য কী বাংলাদেশের? মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেটা ঘোষণা করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, উদার, গণতান্ত্রিক, কল্যাণ রাষ্ট্র। কল্যাণ রাষ্ট্র মানে হচ্ছে, সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা। বঙ্গবন্ধুর একটা কথা আছে, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। যারা পিছিয়ে আছে, যাদের সামর্থ্য কম, তাদের দিকে নজর দিতে হবে। 

এখানে যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তাতে দেখা যায়, যাদের আছে তারা আরও বেশি সুযোগ পাচ্ছে। বৈষম্য সে জন্যই বাড়ছে। তাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, ক্ষমতার সামর্থ্য আছে, তাদের উঁচু চেয়ার আছে, ক্ষমতা অনেক বেশি, সম্পদ অনেক বেশি তারাই এগিয়ে যাচ্ছে। 

কাজেই আমাদের যে অর্জন এবং লক্ষ্য যেগুলো সামনে, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সবার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এবং সবাই মানব মর্যাদায় বসবাস করবে। তাড়াহুড়ো করে বাস্তবায়ন না করে, সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, যেন কেউ নয়ছয় করার সুযোগ না পায়। 

সংবাদ প্রকাশ: সামাজিক নিরাপত্তা খাতে এবার ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, আপনি কি মনে করেন এই কঠিন সময়ে দরিদ্রদের জন্য এ বরাদ্দ যথেষ্ট? 

ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ: সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে পেনশন যুক্ত রয়েছে। সরকারি চাকরি যারা করেছেন, তারা যে পেনশন পাবেন, এটা এর মধ্যে সংযুক্ত। আমরা বহুদিন ধরে বলছি, এটা এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা না। এটা হচ্ছে তাদের অধিকার। তারা কাজ করেছেন, তাদের চাকরির শর্ত অনুযায়ী সেটা তারা পাবেন। এটা তাদের কোনো সহায়তা করা হচ্ছে না। এটা তো এমন ব্যাপার না যে, তারা অসুবিধার মধ্যে আছেন, তাদের সহায়তা করে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা তাদের প্রাপ্য। সুতরাং পেনশনকে আলাদা করতে হবে। আলাদা করলে দেখা যায়, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ অনেক কমে যায়। তবু সেদিকে বরাদ্দ বেড়েছে, সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে, এটা একটা ইতিবাচক দিক। যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন বা আছেন, তাদের সংখ্যাটা বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু সরকারের সামর্থ্য দরকার তো। সামর্থ্য না থাকলে কী করে করবে। আমাদের কর রাজস্বের অনুপাত ১০ শতাংশের কম। তার মানে হচ্ছে ঋণ করতে হবে। ঋণ করা ছাড়া সরকার যেটা করতে চায়, সেটা করতে পারবে না। অন্যদিকে সরকার ঋণের সুদ পরিশোধ করতে সব থেকে বেশি ব্যয় করে। ঋণের দুটি দিক আছে, বৈদেশিক ঋণ, দেশীয় ঋণ। সরকার এবার ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ করছে। ব্যাংক থেকে ঋণ করতে গেলে আবার বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। কিন্তু তা আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণের চেয়ে ভালো। কিন্তু এখানে যদি বিনিয়োগের ওপর অভিঘাত পড়ে, টাকা না পায় তাহলে সমস্যা তো সৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। নানান ধরনের টানাপোড়েন আছে। যা বলছিলাম পূর্বাপর চিন্তা করতে হবে। পদক্ষেপ নিলেই হবে না। আমাদের লক্ষ্যই সব না, লক্ষ্যের বাইরেও প্রতিফলন ঘটে। এগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। এটা তো বরাদ্দের ব্যাপার। বরাদ্দের পরে কাজ হচ্ছে কি না, সেটা বড় ব্যাপার। প্রকল্প পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রণয়ন করতেই বছর শেষ হয়ে যায়। সেখানে জবাবদিহি থাকতে হবে। বাজেট শুরু করতে হবে একদম গোড়া থেকে, কিন্তু সেটা হয় না। এর পরিবর্তন দরকার। টেকসই উন্নয়ন এর কথা আমরা যা বলছি, সেখানে কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। অল্প বরাদ্দ দিয়ে অন্তর্ভুক্তি করে ফেললাম, কিন্তু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখালাম না, তাহলে হলাম না। 

সবাইকে অন্তর্ভুক্ত না করে আমরা উন্নত ও স্মার্ট রাষ্ট্র হয়ে যাব। আমাদের কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতানায় যেভাবে দেশকে গড়ে তুলতে হবে, সেভাবে কাজ করতে হবে। এবং সেখানেও দুষ্টচক্রকে দমন করতে হবে। 

সংবাদ প্রকাশ: আপনাকে ধন্যবাদ। 

ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।