সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা : আবু আহমেদ

মো. মির হোসেন সরকার প্রকাশিত: জুন ৩, ২০২৪, ০৪:৫৬ পিএম
অধ্যাপক আবু আহমেদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও পুঁজি বাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ। দেশের অর্থনীতি ও পুঁজি বাজার নিয়ে কাজ করছেন। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে কথা বলেছেন সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অর্থনীতি প্রতিবেদক মো. মির হোসেন সরকার।

সংবাদ প্রকাশ : আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। দেশের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ এ কাজে এবার বেশ চ্যালেঞ্জ দেখছেন। আপনি কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন?

আবু আহমেদ : বাজেটে চ্যালেঞ্জ সবসময়ই ছিলো। তবে অন্য বছরে যেটা ঘটেছে, সেটা সরকারের জন্য অতটা দুশ্চিন্তায় কারণ ছিলো না। এবার বাজেটের আকার বড় হয়েছে। যেহেতু জিডিপির গ্রোথ রেট ভালো হচ্ছে, বাজেটের সাইজও বড় হচ্ছে। যেমন: প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে। এ বছর কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়। এ বছর ট্যাক্স অব রেভিনিউ কালেকশন কম হতে পারে। আবার বাজেটের সাইজটা বড় করতে গিয়ে তারা যদি ধারদেনা করতে থাকে, তাহলে সেটা খুব ভালো কাজ হবে না। কারণ সরকার অলরেডি ঋণের মধ্যে ডুবে গেছে। এরপরও বাজেটের টাকা সংকলন করার নামে যদি আরও ঋণ করতে থাকে, সেটা গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। সর্বোচ্চ জিডিপির ৪ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি বাজেট হতে পারে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, ঠিকও হবে না। বৈদেশিক ঋণের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে আর্থিক নিয়ম এরইমধ্যে ভেঙে গেছে। সরকারের ঋণ এবং অতি ব্যয় এর মূল কারণ।

সংবাদ প্রকাশ : প্রায় আট লাখ কোটি টাকার বাজেট আসছে। এ বাজেট ঘিরে আপনার প্রত্যাশা কী?

আবু আহমেদ : বাজেট ঘিরে আমার প্রত্যাশার শেষ নেই। এই আট লাখ কোটি টাকার মধ্যে ছয় লাখ টাকার বেশি মনে হয় রেভিনিউ বাজেট। বেতন-ভাতা একটা খাত আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এসব খাতে বেশি থেকে বেশি আপনি বরাদ্দ দিচ্ছেন। এই আট লাখ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে আমি কোনো আপত্তি করতাম না, যদি সরকার কোনো ঋণ না করত। ঋণ করা মানে আপনি দেশের জনগণকে ঋণগ্রস্ত করছেন। সেটা ট্যাক্সের আকারে হোক বা অন্যকিছু; জনগণ এ অর্থ সরকারকে দেবেই। সরকার একটা সময় ব্যর্থ হয়ে টাকা বেশি ছাপাতে পারে। সেটারও মূল্য জনগণকেই দিতে হবে। সত্যি কথা বলতে, বড় বাজেট দেওয়া কোনো বাহাদুরি বিষয় নয়। বরং ছোট আকারের বাজেটে যদি আর্থিক নিয়ম মেনটেইন করতে পারে, সেটি হচ্ছে বাহাদুরি বিষয়।

সংবাদ প্রকাশ : এবারের বাজেটে কোন কোন বিষয়ে মনোযোগ রাখতে হবে?

আবু আহমেদ : বাজেটে মনোযোগে বিষয়ে আগে থেকেই ঠিক করা আছে। এটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি। বরাদ্দের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনি যে অর্থগুলো দিচ্ছেন সেগুলো ব্যবহার হচ্ছে কিনা। অধিকাংশ মানুষ বলে আপনি শিক্ষাখাতে আরও বেশি বরাদ্দ দেন, স্বাস্থ্যখাতে বেশি বরাদ্দ দেন। এসব কথা বুঝলাম। কিন্তু যেসব টাকা দেওয়া হচ্ছে সেগুলো সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। দুর্নীতি খেয়ে ফেলছে সব। আপনাকে আগে নিশ্চিত হতে হবে যে আপনি যে টাকাগুলো দিচ্ছেন, সেগুলো সঠিক ব্যবহার হবে কিনা। দুর্নীতিমুক্ত হবে কিনা। সেটি যদি নিশ্চিত করতে না পারেন, আপনি যত টাকাই বরাদ্দ দেন, কোনো কাজে আসবে না।

সংবাদ প্রকাশ : বাজেটে কোন কোন খাতে খরচ কমানো উচিত?

আবু আহমেদ : আমি মনে করি বেতনের বিষয়ে খরচ কমানো উচিত। যদিও সেখানে সুযোগ আছে, তবে সরকার সেটা করছে না। সরকার কমানোর বিপরীতে আরও বাড়াচ্ছে। সরকারি বাজেটারি বরাদ্দের মাধ্যমে যদি কিছু মানুষ এত সুবিধা পায়, মানে সরকারি কর্মকর্তার নামে। তাদের চার ভাগের এক ভাগ বেকার এমনি। কোনো কাজ নেই তাদের। কিন্তু তাদের আপনি অর্থ দিচ্ছেন। সরকারের বাজেটের আকার সেখানে আরও ছোট হওয়া উচিত। মানে কম লোক দিয়ে দক্ষ সরকার গঠন করা যেতে পারে। এত বেশি লোক দিয়ে কোথাও সরকার এত বেশি দক্ষ হয় না। এতে টাকা খরচ বেশি হয়। ওয়েস্ট অব রেভিনিউ হয়।

সংবাদ প্রকাশ : এবারের বাজেটে সরকারের চ্যালেঞ্জ কী?

আবু আহমেদ : সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। যেহেতু সরকার বাজেটের আকার বড় করছে, সেখানে অর্থ জোগান কোথায় থেকে দেবে। এটাও সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না। বিদেশ থেকে অর্থ চাইলে তো এখন পাবে না। কারণ যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকবে, তখন বিদেশিরা আর ঋণ দেবে না। এটাই সত্য। সুতরাং বাইরে থেকে অর্থপ্রাপ্তি আগের থেকে বেশি হবে বলে আমার মনে হয় না।

সংবাদ প্রকাশ : পুঁজি বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে বাজেটে কী পদক্ষেপ রাখা যায়?

আবু আহমেদ : পুঁজি বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা তো দূরের থাকুক, আস্থা একেবারেই তলানিতে। নেই বললেই চলে। এটার অবশ্য অনেক কারণ রয়েছে। পুঁজি বাজারকে সরকার যথেষ্ট সিরিয়াসলি দেখে কিনা আমি সন্দিহান। কারণ পুঁজি বাজারকে যদি সরকার সিরিয়াসলি দেখতো, তাহলে পুঁজি বাজারে অনেকগুলো প্রণোদনা ছিলো, সেগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে। তালিকাভুক্ত হলে ১০ শতাংশ কম ট্যাক্স দিলেও হতো, সেটা করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স। যারা ভালো ডিভিডেন্ড দিত, ২০ শতাংশের বেশি তাদের ট্যাক্স রিপিট দিত। এ ছাড়া ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ডিভিডেন্ড ইনকাম ট্যাক্স ফি ছিলো। এখন বাজারে সেগুলোর কোনোটাই নেই। প্রত্যাশা বলতে অনুরোধ বলতে যেটা বোঝায় ওইসব প্রণোদনাগুলো আবারও পুনস্থাপন করা উচিত, পুঁজি বাজারকে যদি একটু সাপোর্ট দিতে চায়। আর যদি মনে করে পুঁজি বাজারের অর্থনীতি তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাহলে যা হচ্ছে তাই হবে।

সংবাদ প্রকাশ : আইএমএফ বাজেটের আকার ছোট রাখতে বলেছে, আপনিও কি একমত?

আবু আহমেদ : আইএমএফের অন্যসব সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই। তবে বাজেটের আকার নিয়ে তাদের সঙ্গে আমার মতের মিল আছে। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, সাইজ অব দ্য গভর্নমেন্ট ছোট থাকা ভালো। এখন সেই এজেন্ডা তাদের নেই। সেজন্য বাংলাদেশের মতো অন্য অনেক দেশ সরকারের আকারকে অনেক বড় করে ফেলছে। যতই বড় করছে ততই রেভিনিউ খাচ্ছে। অদক্ষ হচ্ছে, দুর্নীতি বেশি হচ্ছে।

সংবাদ প্রকাশ : আপনাকে ধন্যবাদ।

আবু আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।