’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান আর সবশেষে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা, এরই মাঝে আরও কত না সংগ্রাম। তারপরে পাওয়া আমাদের এই বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়েছে। এরই মাঝে একটু একটু করে এগিয়েছে বাংলাদেশে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন খাতে যুক্ত করেছে নতুন নতুন মাত্রা। সম্মান কুড়িয়েছে বিভিন্নভাবে।
অপর দিকে, গত দুই বছর ধরে দেশের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করছে এই দেশেই গড়ে ওঠা অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘সংবাদ প্রকাশ’। এর বাইরে ‘সংবাদ প্রকাশের’ চোখ ছিল আন্তার্জাতিক খবরেও। আর এমনইভাবে সময়কে অতিক্রম করার প্রত্যয় নিয়ে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে হাজারো পাঠকের কাছে। হাঁটি হাঁটি, পা-পা করে দুই বছর পেরিয়ে ‘সংবাদ প্রকাশ’ পদার্পণ করল তৃতীয় বছরে।
দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে ‘স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় বাংলাদেশের উন্নয়ন’ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের একান্ত আলাপ হয় ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিনের সঙ্গে। আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছেন স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন উন্নয়নের কথা।
সংবাদ প্রকাশ: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে চাই।
ডা. এম এইচ চৌধুরী: স্বাধীনতার ৫২ বছরে বৈশ্বিক দরবারে বাংলাদেশ যে কটি বিষয়ে সম্মান এবং শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। তার মধ্যে অন্যতম একটি ‘স্বাস্থ্য খাত’। আমরা আজ থেকে যদি ৫০ বছর পেছনে তাকাই। তবে দেখতে হবে, পূর্বে প্রতি ১ লাখ প্রসূতি মা যখন সন্তান প্রসব করতেন। তখন মা এবং নবজাতক মৃত্যুর হার বেশি ছিল। কিন্তু আজকের দিনে মাতৃমৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু কিংবা শিশুমৃত্যু অনেকাংশই কমে এসেছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৮ বছরের মত। এসব স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন। তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে।
সংবাদ প্রকাশ: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে কোন কোন বিষয়গুলোতে বেশি এগিয়েছে বলে আপনি করেন?
ডা. এম এইচ চৌধুরী: স্বাস্থ্যসেবার বেশ কতগুলো বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে ‘প্রতিরোধী, চিকিৎসা, উপশম’মূলক স্বাস্থ্যসেবা। ‘প্রতিরোধী স্বাস্থ্য’সেবা অর্থাৎ রোগ থেকে প্রতিরোধ করে সুস্থ রাখা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিশুদের টিকা প্রদান করায় সাফল্য রয়েছে। বর্তমান বিশ্বে যে কটি দেশ শিশুদের টিকা দিয়ে সাফল্য অর্জন করেছে, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
‘চিকিৎসা’মূলক স্বাস্থ্যসেবা। লক্ষ করলে দেখা যাবে, দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলাসহ মহানগরে হাসপাতাল রয়েছে। পাশাপাশি গ্রাম পর্যায়ে রয়েছে ইউনিয়ন সাব সেন্টার এবং কমিউনিটি ক্লিনিক। ফলে স্বাস্থ্যসেবার যে কাঠামোগত রূপ, তাতে আমাদের মতো অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
আর ‘উপশম’মূলক স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালে’ উপশমমূলক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গড়ে উঠেছে। সেখানে আলাদা একটি ওয়ার্ড রয়েছে।
এ ছাড়া ডায়ারিয়া ও কলেরাজাতীয় রোগগুলোর জন্য ওরস্যালাইন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পাশাপাশি টিকা প্রদান এবং গ্রহণের মধ্য দিয়ে পোলিও রোগ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। ধনুষ্টংকার, হুপিংকাশ-জাতীয় রোগগুলো দু-একটি দেখা গেলেও, তা এখন অতীতের ব্যপার। আমরা যদি বিষয় ভিত্তিকভাবে দেখি, তবে বলতেই হয়, ২০০০ সালের আগে হার্টের চিকিৎসা দেশে খুবই কম হয়েছে। এখন অধিকাংশ হার্টের চিকিৎসা দেশে হয়। এর পাশপাশি কিডনি ও লিভার প্রতিস্থাপন, নিউরো সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এখন অনেক দূর এগিয়েছে।
সংবাদ প্রকাশ: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্বাস্থ্য খাত কী ধরনের ভূমিকা রাখছে?
ডা. এম এইচ চৌধুরী: আমরা জানি, একটি দেশের প্রবৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির প্রধান শর্ত হচ্ছে ‘সেই দেশের নাগরিকদের সুস্থতা।’ বাংলাদেশের মানুষের ‘গড় আয়ু বৃদ্ধি’ একদিকে যেমন সংক্রামক রোগকে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করা গিয়েছে। আর অসংক্রামক যে ব্যাধিগুলো রয়েছে, তার ক্ষেত্রেও চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন মানুষ রোগে আক্রান্ত হলে সেই রোগের চিকিৎসা পায়। এই যে গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়া, মানুষের সুস্থ থাকা। এটি জাতীয়ভাবে শ্রম ঘণ্টায় যোগ করছে। ফলে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে।
সংবাদ প্রকাশ: বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের ব্যাপারে কতটুকু উন্নয়ন করেছে বাংলাদেশ?
ডা. এম এইচ চৌধুরী: বাংলাদেশের অন্যতম একটি শিল্প ‘ওষুধশিল্প’। ওষুধ নীতির মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালে শিল্পের একটি নতুন ধারা শুরু হয়, যা অদ্যাবধি চলমান এবং দৃশ্যমান। ওষুধ নীতির প্রভাবে জাতীয়ভাবে যে শিল্পের পথ সুগম হয়েছিল, তারই হাত ধরে আজকের বাংলাদেশে ওষুধশিল্প অনেক দূর বিস্তৃত। এখন পৃথিবীর অনেকগুলো দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।
সংবাদ প্রকাশ: বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা কেমন?
ডা. এম এইচ চৌধুরী: দেশে যেসব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যাপীঠে এখন বিশ্বের অনেক শিক্ষার্থীরাই অধ্যয়ন করতে আসেন। অধ্যয়ন শেষে তারা যখন নিজ দেশে যাচ্ছেন, তখন কিন্তু আমাদের দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞান প্রয়োগ করছেন। এতে ‘বাংলাদেশে ‘মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা’ রয়েছে তার যেমন প্রচার হচ্ছে, ঠিক তেমনইভাবে বাংলাদেশের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাসের স্থানটিও তৈরি হয়।
যেমন ধরুন বাংলাদেশ থেকে অনেক রোগী ভারতে যায়। ঠিক তেমনইভাবে ভারত থেকেও অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশে আসেন চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন করতে। সব মিলিয়ে এটা সত্য যে বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে।
সংবাদ প্রকাশ: চিকিৎসা খাতে বাংলাদেশ যেমন এগিয়ে রয়েছে, তেমনিভাবে জনসচেতনতারও একটি অভাব লক্ষ করা যায়। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ডা. এম এইচ চৌধুরী: দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞান অগ্রসর হচ্ছে। একইসঙ্গে দেশের মানুষও সচেতন হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং জনসচেতনতার যে সেতুবন্ধ, অবশ্যই এ বিষয়ে একটি কর্তৃপক্ষ কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন যারা চিকিৎসাসেবা প্রদান করবেন, তাদের অবশ্যই জনবান্ধব হতে হবে। অন্যদিকে যারা সেবা নেবেন, তাদের সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
একটি বিষয় না বললেই নয়, চিকিৎসক, জনসাধারণ এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এই তিন পক্ষের কতগুলো দায়দায়িত্ব এবং অধিকার রয়েছে। এসব দায়দায়িত্ব এবং অধিকারকে নির্দিষ্ট করে যে ধরনের আইনি কাঠামো প্রয়োজন, তা বাংলাদেশে এখনো পরিপূর্ণভাবে হয়নি। এটি হওয়া খুবই জরুরি। তা না হলে জনগণের সচেতনতা অন্য পথে গিয়ে, চিকিৎসক ও সেবা গ্রহণকারীর মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হবে। এর জন্য বাংলাদেশে একটি আইন প্রণয়ন করা দরকার। যে আইন চিকিৎসক, জনসাধারণ এবং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের দায়দায়িত্ব এবং অধিকার নির্দিষ্ট করবে।