বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের শীর্ষ স্থানীয় নেতা হায়দার আকবর খান রনো। ১৯৬০ সালে পদার্থবিদ্যার ছাত্র থাকা অবস্থায় গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য।
হায়দার আকবর খান রনো ৬২-এর সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাই শুধু নয়, তিনি ছিলেন ষাটের দশকে নতুন ধারার শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার। রনোর বৈচিত্রময় জীবনে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য।
রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি হায়দার আকবর খান রনো নিরবিচ্ছিন্নভাবে লিখে চলেছেন। সম্প্রতি তিনি ষাটের দশকের রাজনীতি, কমিউনিস্ট পার্টির ব্যর্থতা ও নিজের লেখালেখি নিয়ে কথা বলেছেন সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে।
সংবাদ প্রকাশ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় আপনি প্রথম সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছিলেন। সেটি নিয়ে যদি একটু স্মৃতিচারণা করেন।
হায়দার আকবর খান রনো: ব্যাপারটা হলো যে, আমি রেখেছিলাম, সেটা বড় কথা নয়। সেদিন থেকেই শুরু হলো। এর আগে সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার হলেন। তখন অলরেডি মাওলানা ভাসানী, কমিউনিস্টরা, বিশেষ করে ন্যাপের লোকজন সবই গ্রেপ্তার হয়েছিল। ১৯৬২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুও গ্রেপ্তার হলেন। তার প্রতিবাদে আমরা মানে তখনকার দিনে আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ করতাম, মধুর ক্যান্টিনে বসে আমরা মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, পরের দিন ধর্মঘট করব। সেই রাতে বসেই আমরা রাত দুটো-আড়াইটার দিকে হবে, খবরের কাগজের ওপরে কালি দিয়ে ধর্মঘটের পোস্টার লিখলাম। ছাপানো পোস্টারের তখন চল ছিলও না। খবরের কাগজে লেখা হলো। সে রাত্রের বেলায় বিভিন্ন হলে সেঁটে দিয়ে এলাম। আমি ছিলাম, ফরহাদ ভাই (কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ) ছিলেন, ফরহাদ ভাই তো প্রয়াত হয়েছেন, শেখ ফজলুল হক মণি ভাই ছিলেন, মণি ভাই ১৫ আগস্ট শহীদ হলেন। আমার মনে আছে, রাতে আমি আর ফরহাদ ভাই ঢাকা হলে এক খাটেই শুয়েছিলাম। সকালে উঠেই আমরা পিকেটিং করলাম। এই আমার প্রথম জীবনে প্রকাশ্য পিকেটিং করার অভিজ্ঞতা। তখন বয়স আমার কত, সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। তারপর দেখলাম, ধারাবাহিকভাবে ধর্মঘট হয়ে গেল। গেটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলা হলো যে, যাবেন না, যাবেন না, যাবেন না। আর হলগুলোতে তো আগেই পোস্টার মেরেই আসা হলো।
তারপর আমতলায় প্রায় শ’পাঁচেক ছাত্র জমায়েত হয়েছিল। তাড়াতাড়ি একটা টেবিল নিয়ে এসে ওটার ওপর দাঁড়িয়ে আমি বক্তব্য রেখেছিলাম। সেখান থেকে শুরু হলো ফেব্রুয়ারি মুভমেন্ট। সেদিন এর বেশি কিছু হয়নি। তবে ছাত্র ঘর্মঘট এবং প্রকাশ্যে বক্তব্য এটাই প্রথম। এটা কোনো কাগজে ছাপা হলো না। এত বড় একটা ঘটনা, ছাত্র ধর্মঘট হয়ে গেছে। কিন্তু কাগজে ছাপা হলো না। একমাত্র স্টেটসম্যানে ছাপা হয়েছিল। স্টেটসম্যানের যিনি প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি এখান থেকে পাঠাতে পারেননি। তিনি প্লেনে করে কলকাতায় যান। কলকাতায় গিয়ে এটা ছাপান। যাই হোক, আমাদের এখানে কোনো প্রেসে আসেনি। না আসার ফলে তার পরের দিন আমরা এর প্রতিবাদে একটা মিছিল করে গেলাম। খুব বেশি না, শ’ দেড়েক ছাত্র হবে। প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আবদুর রহিম আজাদ বক্তৃতা দিলেন এবং আমরা খবরের কাগজ পোড়ালাম।
তারপরের দিন একটা ঘটনা ঘটল। সেটা হচ্ছে যে, মনজুর কাদের নামে পাকিস্তানের একজন মন্ত্রী ছিলেন। তার পূর্বঘোষিত একটা বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টিতে। এখন যেখানে আর্টস ফ্যাকাল্টি, এটা না। এখন মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের যে জায়গাটা, ওই জায়গাটা ছিল আর্টস ফ্যাকাল্টি। ওখানে দেয়াল ছিল, দেখা যেত মেডিকেল কলেজ। সেখানকার দ্বিতীয়তলার একটা রুমে বক্তৃতা দেবেন বলে এটা পূর্ব সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি এলেন, আসার পর তিনি বক্তৃতা করতে পারলেন না। বক্তৃতা করতে উঠেছেন তখন জিয়াউদ্দিন মামুন নামের একজন ছিলেন। তিনি প্রয়াত এখন। তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাকে কতগুলো প্রশ্ন করতে চাই আপনার বক্তৃতা শোনার আগে। মনজুর কাদের মন্ত্রী মানুষ, সেন্ট্রাল মন্ত্রী। বলেন, কী কী? এই পূর্ব বাংলায় বৈষম্য কেন? গণতন্ত্র নাই কেন? ‘মার্শাল ল’ এটা আবার কী ধরনের দেশ। আপনি তার মন্ত্রী ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে বলতে জিয়াউদ্দিন মামুন গিয়ে তার কলার চেপে ধরল। তারপর পুলিশ তাড়াতাড়ি তাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, ছাত্ররা তার গায়ের ওপর থুতু ফেলেছিল। একই সময়ে তার নিচতলায় যে গাড়ি ছিল, সেই গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো। সেখান থেকে পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হলো। জিয়াউদ্দিন মামুন আমতলায় দাঁড়িয়ে খুব জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন। এইভাবে শুরু হয়ে গেল আন্দোলন।
এটা হলো ফেব্রুয়ারি মাসে। ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে আমার বক্তৃতা দিয়ে। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় তারিখে প্রেসক্লাবের সামনে বক্তৃতা দিয়ে। ৩ ফেব্রুয়ারি মঞ্জুরুল কাদেরের ঘটনা। তারপর দুদিন বিরতি দিয়ে ৬ আর ৭ তারিখে এই দুদিন আমরা মিছিল বের করলাম। আমরা প্রথমে কয়েক শ’, তারপরে কয়েক হাজার। তারপর প্রায় ১০ হাজার লোকের মিছিলে পরিণত হয়েছিল। আমাদের মিছিলটা পুরান ঢাকা যাচ্ছিল তখন রাস্তা থেকে লোক নেমে এসেছিল। মানুষ হাততালি দিচ্ছিল। প্রথম দিন ফিরে এসেছি, কোনো কিছু হয়নি। ৭ তারিখে আমাদেরকে রথখোলা মোড়ে আটকে দিল। এবং সেখানে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হলো। তারপর বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন, আরও অনেকে গ্রেপ্তার হলেন। একটা পর্যায়ে আমিও গ্রেপ্তার হলাম। আমি গ্রেপ্তার হয়ে প্রথমে গিয়েছিলাম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে আমাকে কয়েক দিন রাখা হয়েছিল। আমার সঙ্গে ছিলেন ওবায়দুর রহমান। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন, তখন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বিএনপির মন্ত্রীও ছিলেন। তিনিও মারা গেছেন।
প্রথমে ক্যান্টেনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় অনেককে। সব ছেড়ে দিয়ে এ কয়জনকে রাখা হয়। ক্যান্টেনমেন্ট থেকে আমাকে সাত দিন পর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হলো। সেখানে দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে। যেই ওয়ার্ডে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে তিনি আমাকে তখন ডাক দিলেন, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। যারা জেল খেটেছেন তারা জানেন, সন্ধ্যার পরে কখনোই লকাপ খুলতে নেই। কিন্তু উনি যে সার্জেন্ট নিয়ে এসেছিলেন তাকে ডেকে নিয়ে এসে বললেন, এই, এদিকে আসেন তো। আমার লকাপটা খোলেন। দেখুন তার ব্যক্তিত্ব। লকাপটা খুললেন। খুলে তিনি বেরিয়ে এসে আমার মাথায় হাত দিয়ে স্নেহ করলেন। বললেন, ঠিক আছে কোনো চিন্তা নেই, কাল সকালে দেখা হবে। তারপরে আমরা অনেকজন একসঙ্গেই ছিলাম। দিনের বেলায় একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতাম, রাতে যার যার সেলে আটকা থাকতাম। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। উনার সঙ্গে ভলিবলও খেলেছি। লম্বা মানুষ তো, উনি ভালো ভলিবল খেলতেন। তাজউদ্দীন আহমদও ছিলেন। তিনি আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে হরলিক্স খাওয়াতেন। রণেশ দাসগুপ্ত ছিলেন। তার সান্নিধ্যে থাকা মানেই তো কিছু জ্ঞান অর্জন করা। আমি এক কথা বলতে অনেক কথা বলে ফেলাম।
সংবাদ প্রকাশ: ছাত্রজীবন থেকে আপনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। এখনো করে যাচ্ছেন। জীবনের এই সময়ে এসে আপনার প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির কথা শুনতে চাই।
রনো : প্রথম কথা হচ্ছে, আমি যে কমিউনিস্ট আন্দোলন করেছি, এতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই বরং আমি গর্ববোধ করি যে আমি ছেলেবেলা থেকেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, এখনো আছি। প্রাপ্তি যদি বলেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে তখন যে পরিমাণ প্রভাব ছিল, এখন সেটা নেই। কিন্তু প্রাপ্তির মধ্যে একটা বড় প্রাপ্তি হচ্ছে, শুধু কমিউনিস্ট হিসেবে নয়, কমিউনিস্ট হিসেবেও এবং জাতীয়তাবাদী হিসেবেও খুব বড় প্রাপ্তি যেটা আমার একার না, এ দেশের সবারই; সেটা হচ্ছে—স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের যে বিজয়, সেই বিজয়কে মহান বিজয় বলে আমি মনে করি। তার ক্ষুদ্র অংশ হলেও আমার যদি কোনো অবদান থেকে থাকে, সে ক্ষেত্রে আমি খুব বড় প্রাপ্তি মনে করি। কিন্তু কমিউনিজম যদি বলেন, সাম্প্রতিককালে সারা পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন একটা ভাটার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যর্থ হয়ে গেল। অনেক রকম পরিবর্তন হয়েছে। সেই ভাটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশেও কমিউনিস্ট পার্টি, একে তো বহুধাবিভক্ত, তারপরে যেটা আছে সেটা এখনো ষাটের দশকের তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র অবস্থায়। সেটা একটা বেদনাদায়ক ব্যাপার। তবে আমি মনে করি, এটাই ইতিহাসের শেষ রায় নয়। হয় তো আমি দেখে যেতে পারব না, কিন্তু সাম্যের ডাক আসবেই। সেই ডাকে মানুষ সাড়া দেবেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করাই হচ্ছে মানুষের ধর্ম। সেটা মার্কসের আগেও ছিল, মার্কসের পরেও ছিল। সেই স্পার্টাকাসের যুগেও ছিল, সূর্য সেনের আমলেও ছিল। কিন্তু সেটাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চির শোষণমুক্ত একটা সাম্যবাদী সমাজে নিয়ে যাওয়ার পথটাই মার্কস দেখিয়েছেন। এর বেশি কিছু না। তবে এটা বিরাট ব্যাপার। আমাদের দেশে এবং সারা পৃথিবীতেও সেই কমিউনিজমের বিরাট প্রবাহ তৈরি হয়েছিল। সেটা এখন আপাতত ক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, এটা আবার সামনের দিকে এগোবে। সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের যে নিষ্ঠুর থাবা তার বিরুদ্ধে মানুষ আবার রুখে দাঁড়াবে। আবার তখন মার্কসের কাছে, লেনিনের কাছে, মাও সে তুংয়ের কাছে, স্তালিনের কাছে ফিরে যাবে।
সংবাদ প্রকাশ: এককালের বৃহৎ বাম দল সিপিবি, যারা একসময় আওয়ামী লীগের মতো দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, আজ তারা প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। এর পেছনে কী কী ফ্যাক্টর কাজ করছে বলে আপনি মনে করেন?
রনো: প্রথম কথা হচ্ছে, আমি কিন্তু প্রথমে সিপিবি করতাম না। ১৯৬১ সালে আমি সিপিবির সদস্যপদ পাই, তখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে একটাই পার্টি ছিল। ঘটনাক্রমে একটা মজার কথা বলি। সেটা হচ্ছে, আমাকে একটা স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছিল— সিয়াটো স্কলারশিপ। তারা তো তখন আমাকে চিনেও না ভালো করে। তারা বোধ হয় এখানকার কিছু লোককে হাত করার জন্য, মাথা কেনার বা যেকোনো কারণে হোক। তখনকার দিনে ৪০০ টাকার সেই স্কলারশিপ। আমি পুরোটাই কমিউনিস্ট পার্টিকে দিয়ে দিয়েছিলাম, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
আপনার প্রশ্ন ছিল যে সিপিবি আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। কথাটা আংশিক সত্য। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে একটা অংশ এবং সেটা খুব ভুলভাবেও করেছে। বিশেষ করে চৈনিক অংশ যেটা, সেটার মধ্যে আমি ছিলাম। আর এখন আমি যে পার্টিতে আছি, যেটা তখন রুশপন্থী নামে পরিচিত ছিল। তারা কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেনি বরং সহযোগিতার লাইনেই তারা সবসময় ছিল। একেবারে একদম আগে গেলে সেটা পাকিস্তানের শুরুর দিকে তখন আওয়ামী লীগ মাত্র জন্ম নিয়েছে। ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট। ৫৩ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক। তখন কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল। আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থায় তারা কিন্তু সেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। যুক্তফ্রন্ট গঠনে তাদের ভূমিকা ছিল। পরবর্তীকালে কাগমারি কনফারেন্স থেকে একটা বিরোধিতার শুরু হয়। সেই ১৯৫৭ সালের কথা, যখন আওয়ামী লীগের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সিয়াটো-সেন্টো পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিকে সমর্থন জানান এবং স্বায়ত্তশাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। আমি যতটুকু জানি, বঙ্গবন্ধু মেনে নিতে পারেননি। তখন কন্সটিটিউশনে একটা প্যারিটিও হয়েছিল। প্যারিটি অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সমানসংখ্যক প্রতিনিধি হবে। অথচ সংখ্যায় কিন্তু আমরা অনেক বেশি। ৫৬ শতাংশ। এটা ৫৬-এর সংবিধানেও ছিল, আইয়ুব খানের কনস্টিটিউশনের ছিল। আমি যতটুকু শুনেছি বঙ্গবন্ধু মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু দল ভেঙে যাবে ইত্যাদি মনে করে বা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি তার একটা বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ ছিল। যে কারণে প্রকাশ্যে তিনি এটা করেননি। যাহোক, এই পরিপ্রেক্ষিতে তখন ভেঙে ন্যাপের তৈরি হলো। সেই ন্যাপের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। এই ন্যাপটা ভাঙল তো আরও অনেক পরে গিয়ে। ৬৭ সালে ভাঙল। মধ্যখানে একটা পিরিয়ড ছিল, আইয়ুব খানের পিরিয়ড। সেই পিরিয়ডে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয় খুব একটা দেখি না বরং সহযোগিতাই ছিল। তবে একটা খুবই ক্ষুদ্র অংশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা ভুল রাজনীতি গ্রহণ করেছিল। সেটা আমরা কখনো গ্রহণ করিনি। আমি তখন অন্য জায়গায় ছিলাম। আমি এখন যে সিপিবি করি, সেই সিপিবি তো বাকশালেও যোগ দিয়েছিল। কিন্তু এটা সঠিক নয় বলে পরবর্তী কংগ্রেসে তারা বলেছে। ফলে জিনিসটা একতরফা না বা এককথায় এর উত্তর হবে না। এটা বেশ জটিল এবং আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে গেছে।
সংবাদ প্রকাশ: সিপিবি এখন এতোটা নিষ্ক্রিয় কেন?
রনো: নিষ্ক্রিয়ের ব্যাপারটা হচ্ছে প্রথমত বিশ্বব্যাপী একটা প্রভাব। দ্বিতীয়ত, সিপিবি যে জায়গায় ছিল, চিন্তা করে দেখেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ফল করল, আর সিপিবি তার সেন্ট্রাল কমিটির দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি তারা বলল যে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিসহ তারা বলল যে মার্কসবাদ ভুল। তার সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম নাহিদ তো একসময় আওয়ামী লীগের মন্ত্রীও হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ছিল সাইফুদ্দিন মানিক। তারা বলল যে এটা ভুল, বাদ দিয়ে দিলাম। তাহলে এটা কেমন পার্টি ছিল? যে পার্টি আরেকটা দেশের পার্টি ফল করল, সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার সেন্ট্রাল কমিটির প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি সব চলে গেলাম। সেখানে পরবর্তীকালে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মনজুরুল আহসান খান এরা যে ভূমিকা নিয়ে আবার পার্টিটাকে পুনর্গঠন করেছে, এ জন্য তাদের ধন্যবাদ। এখন হুট করে সেই জায়গাটায় আসা যাচ্ছে না।
আরেকটা কথা বলি, এখন একটা ভোগবাদী প্রবণতাও ঢুকেছে। যেটা আগে ছিল না, এটা দুঃখজনক। আমাদের আগে বা আমাদের সমসাময়িকও যারা কমিউনিস্ট আন্দোলন করতেন, তাদের মধ্যে একটা ত্যাগের প্রবণতা ছিল।
সংবাদ প্রকাশ: দেশের বাম দলগুলো আজ বহুভাগে বিভক্ত। এই বিভক্তির পেছনের কারণগুলো কী বলে আপনি মনে করেন?
রনো: প্রথমত, চীন-রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির পলেমিকাল ডিবেট হয়েছিল। মার্কসবাদের ব্যাখ্যায় পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র কীভাবে হবে, এ প্রশ্ন নিয়ে অনেক ঝড় উঠেছিল আরকি! এবং সে বিভক্তি সারা পৃথিবীর প্রতিটা দেশেই হয়েছিল। যেসব দেশে কমিউনিস্ট পার্টি শাসন ক্ষমতায় ছিল না, সেই দেশগুলো বাদ দিয়ে প্রতিটি দেশেই এ বিভক্তি হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে ভারতেও হয়েছিল। আমাদের এখানে ফরমাল বিভক্তি হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। কিন্তু ফরমাল না হলেও ভেতরে ভেতরে বিভক্তির ব্যাপার-স্যাপার চলছিল। এই বিভক্তিটা তো অনিবার্য ছিল বলে আমার কাছে মনে হয়।
দ্বিতীয়ত, চীনপন্থীরা আবার বহুধাবিভক্ত হয়ে গেল। এখানে আমার মনে হয় চীনের একটা বড় ভুল ছিল। তারা বলত যে কালচারাল রেভ্যুলেশনের সময় চীনের পার্টি বলেছিল— বোম্বার্ড দ্য হেডকোয়ার্টার। পান থেকে চুন খসলেই সঙ্গে সঙ্গে হেডকোয়ার্টারে বোম্বার্ড করে একটা দল করে ফেলা। এই প্রবণতা পেটি বুর্জোয়া প্রবণতা, কিন্তু এটাকে উৎসাহিত করেছে চীনের পার্টি।
তৃতীয়ত, অনেকগুলো ভুল করেছিলাম। ভুল একজন করেছে, আরেকজন সেটা মানতে পারেনি। এ কারণে ভাগ হয়েছে। যেমন, নকশাল আন্দোলনের একটা জোয়ার এসেছিল। যারা নকশালপন্থী হওয়ার তারা নকশালপন্থী হয়ে গিয়েছিল। এবং সেই জোয়ারটা উঠেছিল চীন থেকেই। চীনের পত্রিকায় চারু মজুমদারকে একটা বিশাল নেতা হিসেবে চিত্রিত করার ফলে এখানে প্রভাবিত হয়ে নকশালপন্থী আন্দোলন হয়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে নকশালপন্থী রাজনীতি করিনি। যদিও চীনের অন্যান্য বক্তব্যকে, বিশেষ করে ১৯৬৩ সালের ১৪ জুন সোভিয়েত পার্টির কাছে চীনের পার্টি যে চিঠি লেখে তার মর্মবস্তুর সঙ্গে আমি একমত পোষণ করি। তবে সেই জায়গাতেও চীন আজকে দাঁড়িয়ে নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নও নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সমাজতন্ত্র তো উঠেই গেছে। চীন আজকে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে নেই। তো প্রথম কারণ হচ্ছে বিশ্বের দুটি বড় দলের ভেতর তর্ক, দ্বিতীয় হচ্ছে চীনপন্থীদের মধ্যে নকশালপন্থীদের ব্যাপারটা।
তৃতীয় বিষয়টা হচ্ছে, পার্টির একটা অংশ যেটাতে আমি আছি, তারা নিজেরা না দাঁড়িয়ে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি করেছিল। মানে আওয়ামী লীগের পেছন পেছন থাকা। আওয়ামী লীগের সহযোগী হওয়া না। আমি বিশেষ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগিতা নীতিকে সমর্থন করি এবং করেছিও। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত সরকার আমাদের (সিপিবিকে) সহযোগিতা করেনি, কিন্তু বাংলাদেশ সরকারকে আমরা স্বতন্ত্রভাবে মেনেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি। অনেকে এটা করতে পারেনি বা করেনি। যাহোক, এই ধরনের আরও অনেক কারণ আছে, যেগুলোর কারণে এটা ভাগ হয়েছিল। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়, এবং এটাই সব কথা নয়। ভাগের পেছনে আমাদের পেটি বুর্জোয়া দলীয় আকাঙ্ক্ষা, ব্যক্তিস্বার্থ অনেকাংশে কাজ করেছে বলে আমি মনে করি।
পলিটিক্যাল ডিফারেন্সের কারণে আমি ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে দিয়ে এ পার্টিতে এলাম। ওখানে তো আমার কোনো প্রেস্টিজের প্রশ্ন, দলের নেতৃত্বের লোভ বা ক্ষমতার লোভ ইত্যাদি ব্যাপার ছিল না। বহুধাবিভক্তির ক্ষেত্রে কিন্তু কিছু ব্যক্তিস্বার্থও কাজ করেছে। ব্যক্তিস্বার্থ বলতে টাকা-পয়সার স্বার্থ না। ব্যক্তিপদের মোহ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এগুলো কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়।
সংবাদ প্রকাশ: অনেকবার অনেক রকম প্রচেষ্টার পরেও দেশের বাম দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না। এই সংকট কেন?
রনো: প্রথমত, যাদের বাম বলা হচ্ছে তারা কতখানি বাম, সেটা হলো কথা। আমি একটা দল বানিয়ে বললাম, এটাই হলো বাম অথবা তিনজন মিলে বলল যে আমি একটা পার্টি। আমি বাম দল বলতে তাদেরই বুঝি এবং আমি তাকেই পার্টি বলব— প্রথমত, যাদের একটি ঐতিহ্য আছে, দ্বিতীয়ত কিছু সাংগঠনিক বিস্তৃতি আছে, তৃতীয় দৃঢ় মতাদর্শিক ধারণা আছে। এগুলো বাদ দিয়ে আমার ইচ্ছা হলো আমি কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে গেলাম। সিপিএম তখন ওয়েস্ট বেঙ্গলে খুব শক্তিশালী। তখন এখানেও একটা পার্টি গড়ে উঠল— তার নাম সিপিএম। কই আজ তাকে কেউ চেনেও না। বাম নাম দিলেই বাম হয় না। যাদের বাম বলছে আসলেই বাম কি না, তার সেই ঐতিহ্য আছে কি না? তার সেই সাংগঠনিক বিস্তৃতি আছে কি না, এবং একটি লিখিত মতাদর্শিক বক্তব্য আছে কি না, সুনির্দিষ্ট কোনো রণকৌশল আছে কি না, সেটা বিষয়। খুবই আন্তরিকভাবে আমরা কিন্তু কমিউনিস্ট ঐক্যের পক্ষে এখন স্লোগান তুলেছি। কিন্তু কার সঙ্গে মিশব?
সংবাদ প্রকাশ: তৃণমূল মানুষের কাছে বাম দলগুলো বুর্জোয়া দলগুলোর মতো গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না কেন? নির্বাচনের রাজনীতিতে এসেও বাম দলগুলোর ভরাডুবি হচ্ছে। এটার জন্য কোনটা দায়ী?
রনো : নির্বাচনের রাজনীতিতে বাম দলগুলো কখনোই বুর্জোয়াদের সঙ্গে পারবে না। পারলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেটা বিরল ব্যতিক্রম, যেমন নেপাল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, কেরালায়। এখন অবশ্য (বামদল) কেরালায় জিতেছে, পশ্চিমবঙ্গে হেরে গেছে, যদিও সেখানে দীর্ঘদিন ছিল। কিন্তু কই আপনি তো আর কোনো দিকে তাকাতে পারবেন না। এখন অবশ্য লাতিন আমেরিকায় নতুন ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, সেখানে এবার বামরা ক্ষমতায় এসেছে, আবার ক্ষমতাচ্যুত হচ্ছে, আবার ক্ষমতায় আসছে। সাধারণত বুর্জোয়া ব্যবস্থায়, বুর্জোয়া নির্বাচনের জন্য কতগুলো জিনিস লাগে। একটা হচ্ছে টাকা, একটা হচ্ছে প্রচার, আরেকটা হচ্ছে সেই ধরনের ব্যক্তি। যেমন ধরেন, একজন ডাক্তারকে দাঁড় করিয়ে দিলাম, তার বিপরীতে যদি কারখানার শ্রমিককে দাঁড় করাই, কারখানার শ্রমিক জিতবে না। আমাদের মানসিক পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত জিতবে না। ওই ডাক্তার হয়তো কোনো রাজনীতির কাজেরই না।
আমি এমন শ্রমিকনেতা বের করে দেব, যার রাজনৈতিক জ্ঞান অনেক বেশি, কিন্তু পারবে না। এটা পশ্চিমবঙ্গে দেখেছি আমি। একেবারে দর্জির কাজ করেও তিনি পার্লামেন্টের মেম্বার হয়েছেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কী করেছেন? বলল যে, আমি তো কিছু করিনি, পার্টি করেছি। তাহলে প্রচার মিডিয়া কার হাতে? আমরা তো ছোট হলেও ‘একতা’ নামে একটা কাগজ বের করতাম। ‘একতা’ বের করতে জান বেরিয়ে যায়। কিন্তু যদি একটা বড় কাগজ বের করতে হয়, তাহলে তো অনেক টাকা লাগবে। কাজেই ইলেকশনের মাধ্যমে বামদের জেতা সম্ভব না।
সংবাদ প্রকাশ: রাজনীতি নিয়ে আপনি বেশ কিছু বই লিখেছেন। আত্মজীবনীও লিখেছেন। আপনার লেখালেখি নিয়ে বলুন, বর্তমানে কোন বিষয়ে লিখছেন বা অদূর ভবিষ্যতে কোন ধরনের লেখা লেখার পরিকল্পনা আছে?
রনো: শেষ দুই বছর আমি চোখে দেখি না। একটা চোখ তো ভুল ইনজেকশন দেওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। আর আরেকটা চোখের জ্যোতি এত কমে গেছে যে, আমি আর লেখা পড়তে পারি না। আপনি আমার সামনে বসে আছেন, আপনার চেহারাটাও আমি পরিষ্কার দেখতে পারছি না। লিখতে গেলে আমাকে ডিক্টেশন দিয়ে লিখতে হয়। আমার শেষ দুটো বই ডিক্টেশন দিয়ে লিখেছি। সেটা হচ্ছে ‘পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’। বইটি অনেকে ভালোই বলেছেন, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও কেউ কেউ ভালো বলেছেন। আমি নানান ধরনের বিষয়ে লিখেছি। বিজ্ঞান নিয়েও লিখেছি, যেটা বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে। ভারত থেকেও বলেছে যে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের উপরে এ ধরনের সহজবোধ্য লেখা বই অন্তত তাদের জানা নেই। আমিও অন্তত দেখিনি। এখনো আমার লেখার ইচ্ছে আছে, নিউটন থেকে আইনস্টাইন এবং তার পরবর্তী। এটা মাথার মধ্যে আছে। কিন্তু আমি আর পারব না লিখতে।
দর্শনের ওপরে আমার কিছু বই আছে। আর সাহিত্যের ওপরে আমার বেশ কিছু বই আছে। ‘বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা’ দুই খণ্ডে একটা বই বেরিয়েছে। মার্কসের অর্থনীতি— এগুলো তো আছেই। ‘পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা’ বেরিয়েছে কিছুদিন আগে। সব মিলিয়ে আমার বইয়ের সংখ্য ২৩। যেটাকে বই ধরতে হয়, মনে করুন দেড়শ পৃষ্ঠার উপরে যদি হয় তাহলে সেটিকে আমরা বই ধরবো। আর পুস্তিকা যদি বলেন, তাহলে প্রচুর লিখেছি।
এখন যেটা লেখার প্ল্যান করছি, আসলেই প্ল্যান করছি। এবং সেটা চলমান। এটা আমার দ্বারা সম্পাদিত হবে। পুরো লেখাটা আমার না। এটা হচ্ছে নারী ও নারীমুক্তি। তিনটা ভাগে ভাগ করছি। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এটাও কিন্তু আমি কানে শুনে মাথা খাটিয়ে লিখেছি। একজন পড়ে শোনাচ্ছেন, আমি সম্পাদনা করছি। এটার তিনটা ভাগ: একটা হচ্ছে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও—এরা এদের সময়ে যেভাবে নারীমুক্তিটাকে দেখেছিলেন। তার মধ্যে ক্লারা জেটকিন, রোজা লুক্সেমবার্গ, কলোনতাই, স্ক্রুপস্কায়া এদের নিয়ে প্রথম ভাগটা হবে।
দ্বিতীয় ভাগটা হবে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র। বিশেষ করে বেগম রোকেয়া থেকে আমি জোর দিয়েছি। বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পর্যন্ত, তারা সরাসরি নারী প্রসঙ্গে বলেননি, কিন্তু তাদের লেখার মধ্য দিয়ে নারী প্রসঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিটা আছে। কবিতাও আছে তিনটি— সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সতীদাহের ওপর একটি কবিতা। নজরুলের নারী কবিতা। আরেকটা হচ্ছে জীবনানন্দ দাশের কবিতা।
তৃতীয় ভাগ হচ্ছে: এখন আমরা যারা জীবিত আছি, ওই মহাপুরুষদের তুলনায়, বিখ্যাত লেখকদের তুলনায় আমরা কিছুই না। তবু আমরা একেকজন একেক দৃষ্টিকোণ থেকে নারী প্রশ্নটিকে কীভাবে দেখছেন, নারীর অবস্থানটাকে কীভাবে দেখছেন এবং নারীর অধঃস্তন অবস্থান থেকে মুক্তির উপায়টা কী— একেকজন একেভাবে লিখছেন আরকি। এই বইটা প্রায় শেষ হয়ে আসছে।
সংবাদ প্রকাশ: জীবনের এ পর্যায়ে এসে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে জীবন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
রনো: মানুষের জীবন একটাই। সে কত দিন বাঁচবে, কত দিন বাঁচবে না, এটা বলা যায় না। যদি এমন কিছু হতো যে আমি দুইশ বছর বাঁচব, তাহলে কিন্তু জীবনটা খুব বোরিং হতো। কারণ, আমি গোনা শুরু করতাম আর মাত্র একদিন আছে। দুশো-তিনশ বছর হলেও একই জিনিস। আর যদি এমন হতো আমরা কোনো দিন মরব না, তাহলেও জীবনটা খুব বোরিং হতো। জীবনটা খুব ইন্টারেস্টিং এই কারণে যে আমরা সবাই জানি মরব, কিন্তু আমরা জানি না কবে, কখন মরব। এটাই জীবনের মজার ব্যাপার। লাইফকে আমি খুব ভালোভাবেই অতিবাহিত করতে পেরেছি। ভুলত্রুটি অনেক করেছি। জীবনে ভুলত্রুটি করেনি, এমন লোক খুব কম। প্রতিভাবানরা কম ভুল করেন অথবা করেন না। আমি তো সে পরিমাণ প্রতিভাবান না। তারপরও সব মিলে একধরনের সেটিসফ্যাকশনও আছে, ডিসসেটিসফ্যাকশনও আছে।
সেটিসফ্যাকশন হচ্ছে, আমি যা চেয়েছি, যে রাজনীতি করতে চেয়েছি আমি সেটাই করে গেছি; অন্য কিছু করিনি। ডিসসেটিশফ্যাকশন হচ্ছে যে, যৌবনে যেই রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম, সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। আমার এখন যে বয়স আর যে কদিন বাঁচব, তার মধ্যে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা মনে হয় না। তবে হবে, আমার মৃত্যুর পরে হলেও হবে। জীবন সম্পর্কে এই হলো আমার দৃষ্টিভঙ্গি।