জাফর ওয়াজেদ একাধারে একজন কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। শিক্ষাজীবন থেকেই সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। বাংলা সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক ও ১৯৮৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।
সংবাদ প্রকাশ: সাংবাদিকতা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অনেক কথা রয়েছে, সেসব শুনতে চাই।
জাফর ওয়াজেদ : বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে সাংবাদিকদের নিয়ে ৫টি আইন করেছিলেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘সংবাদপত্র কর্মচারী অত্যাবশ্যকীয় আইন’। সেই আইন দ্বারা আমরা দীর্ঘদিন পরিচালিত হয়ে আসছি। সেখানে সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা অনেক ভালো ছিল। এবং একটি পত্রিকার সম্পাদকের পদমর্যাদা একজন বিচারপতির সমান ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালে বিএনপি-জামায়াত চক্র ক্ষমতায় এসে তার আগেই সামরিক শাসকরা অনেক সংশোধন করেছে এবং পুরোটাই পাল্টে গেল। তখন শ্রমমন্ত্রী ছিলেন আমান উল্লাহ আমান। তিনি এই সাংবাদিকদের আইনটিকে শ্রম আইনের অন্তর্ভুক্ত করে দেন। ফলে এখন সাংবাদিকদের অনেক মর্যাদাই ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং অনেকগুলো ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। আমরা আগে দেখতাম পত্রিকার সম্পাদক সাংবাদিকতা-লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতেন, অনেকটা পেশাদার ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এসে আমরা দেখি যে, মালিকরাই সম্পাদক হচ্ছেন এবং যাদের এ ক্ষেত্রে কোনো অভিজ্ঞতা-দক্ষতা-যোগ্যতা কিছুই নেই, এমনকি লেখাপড়া না জানা লোকরাও সম্পাদক হয়েছেন এ দেশে। সার্বিক অর্থে সামরিক শাসনের পর থেকে আমরা যেটা দেখেছি, এ দেশে সম্পাদক হওয়ার জন্য কোনো যোগ্যতা লাগে না, টাকা থাকলেই হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আমলে কী হয়েছিল? বঙ্গবন্ধু যেহেতু নিজে সাংবাদিকতা করেছেন, দলের প্রেস রিলিজ লিখেছেন, পত্রিকা অফিসে প্রেস রিলিজ পৌঁছে দিয়ে এসেছেন এবং সেখানে আড্ডা দিয়েছেন। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে যত সাংবাদিক ছিল সবাইকে বঙ্গবন্ধু কাছ থেকে চিনতেন এবং সবার সাথে সুসম্পর্ক ছিল। কারণ, বঙ্গবন্ধু মনে করতেন যে এরা আমার পূর্ব বাংলার মানুষ, পূর্ব বাংলার সাংবাদিক। এবং ১৯৪৭ সালের আগে যখন বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন, তখন কলকাতার সংবাদপত্র আজাদ, আনন্দবাজার, যুগান্তর ছিল। ’৪৭-এর আগে ঢাকা থেকে আসলে কোনো দৈনিক ছিল না। ফলে সাংবাদিকতা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। শিল্প-সাহিত্য কোনো প্রসার লাভ করেনি। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ হয় সাহিত্যচর্চা করেছে। কিন্তু ব্যাপক অর্থে সাহিত্যের যে অবস্থান বা সাহিত্য পত্রিকা সেগুলো ছিল না। মো. নাসির উদ্দিন সাহেবের ‘সওগাত’ ও ‘বেগম’ পত্রিকা কলকাতা থেকে বের হতো, ঢাকা থেকে তেমন কিছু ছিল না। এবং ঢাকার পাঠককের জন্য কলকাতার আনন্দবাজার, যুগান্তর, আজাদ, ইত্তেহাদ এসব পত্রিকা ট্রেনে করে গোয়ালন্দ আসত। গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে করে ঢাকায় আসত। সেগুলো সারা দেশেও যেত না। সে সময় মানুষের এত চাহিদাও ছিল না। মানুষের জীবনের গণ্ডি ছিল খুব সীমিত। তার নিজস্ব এলাকার বাইরে জগৎ সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে যারা শিক্ষিত শ্রেণি তারা সংবাদপত্র পড়তেন। ডাকযোগে এক দিন-দুদিন পর যেত। আবার ৭০-এর দশকে স্বাধীনতার পর ঢাকার বাইরেও পত্রিকা সন্ধ্যার পরে গিয়ে পৌঁছাত। ঢাকার পত্রিকাগুলো দুটো সংস্করণ করতে। কিন্তু ওই পত্রিকা বিকেল বেলা পৌঁছাত। ৪৭-এর পরে যখন দেশভাগ হলো, বঙ্গবন্ধু এখানে এসে যখন রাজনীতি শুরু করলেন তখন কিন্তু সংবাদপত্র তেমন ছিল না, কলকাতা থেকে আজাদ আসত। ঢাকেশ্বরী এলাকায় আজাদকে বিশাল জায়গা দিল পাকিস্তান সরকার। তারা এখানে প্রেস করল, পত্রিকা বের করা শুরু হলো। ইত্তেহাদ এলো। তারপর ঢাকা থেকে দৈনিক সংবাদ পত্রিকা বের হওয়া শুরু হলো, তখন ক্ষমতায় ছিল মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের মুখপত্র হিসেবে পত্রিকাটি যাত্রা শুরু করল। এরপর অবজারভার পত্রিকা বের হলো। এভাবে আস্তে আস্তে কিছু কিছু পত্রিকা বের হতে থাকল। পরবর্তীকালে আমরা দেখলাম আইয়ুব খানের পুতুল গভর্নর মোনায়েম খান, যাকে ‘বটতলার উকিল’ বলা হতো, তিনি ‘পয়গাম’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। পরবর্তীকালে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর পয়গামের চরিত্র পাল্টে যায়। কারণ, গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্রদের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয় এবং পত্রিকাটিও অ্যান্টি মোনায়েম খানের দিকে ধাবিত হয়ে যায় এবং সেখানেও বঙ্গবন্ধুর নিউজ ছাপা হতো। তারপর ইত্তেফাক চালু হওয়ার পর ইত্তেফাকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ কারণে ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, মানিক মিয়া। এঁরা সবাই আওয়ামী লীগের লোক ছিলেন। তাঁরা একটি পত্রিকার কথা উপলব্ধি করছিলেন যেখানে বাঙালি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, শোষণ-বঞ্চনার কথা থাকবে। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই তাঁরা ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠা করলেন। মানিক মিয়াকে তারা সম্পাদক করেছিলেন। পত্রিকাটি ক্রমান্বয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তাদের একটা অবস্থান তৈরি হয়। ৬ দফা ঘোষণার পর ইত্তেফাক প্রথমে ৬ দফার পক্ষে থাকতে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু ইত্তেফাকই ৬ দফাকে সামনে নিয়ে এসেছিল। এবং ৬ দফা ঘোষণা করেছিল ৬৬ সালে, তার ৫-৬ বছর পরেই এ দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ছিল স্বাধিকার। সে স্বাধীনতার থেকে ক্রমান্বয়ে তা জনগণের কাছে এমনভাবে প্রতিপাদ্য ও এমন গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে জনগণ একাত্তর সালে সরাসরি যুদ্ধেও অংশ নেয় এবং শেখ মুজিবকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। কিন্তু বিজয়ের পর যখন রাষ্ট্রক্ষমতা বাঙালিকে দেওয়া হচ্ছিল না, তখনি বাঙালি জনগণ ফুঁসে উঠেছিল।
সংবাদপত্রের দিক থেকে বঙ্গবন্ধু যে কাজটি করেছিলেন, তিনি পাকিস্তানকালেই ‘নতুন দিন’ নামে একটি সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড আকারে পত্রিকা বের করতেন। সম্পাদনায় ছিলেন তাঁরই এক বন্ধু লুৎফুর রহমান জুলফিকার নামের একজন। মাঝখানে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আবার ‘৬৯ সালে পত্রিকাটি বের হতো। পত্রিকাটি ছিল দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সীমিত কিন্তু এর বাইরে ইত্তেফাক একটা বিশাল ভূমিকা পালন করে। এবং দেখা গেল ইত্তেফাক আস্তে আস্তে সার্কুলেশনও বেড়ে গেল এবং জনগণের কাগজ হিসেবে সামনে চলে এলো।
সংবাদ প্রকাশ : মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকদের ভূমিকা কেমন ছিল?
জাফর ওয়াজেদ : মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ ছিল নামমাত্র। অধিকাংশ সাংবাদিকই পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সরাসরি অবস্থান না নিলেও তাদের অধীনে কাজ করেছে। অনেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেছে, অনেকে বাধ্য হয়ে করেছে এ রকম নানা বিষয় ছিল। এবং যেহেতু ওই মনোবলটা ভেঙে গিয়েছিল এর আগে ৬৯-৭০ সালে যেভাবে আমাদের সাংবাদিকরা প্রবলভাবে লেখালেখি করেছিল, সেটা ভেঙে যায় ১৯৭১ সালে এসে। আমাদের সাংবাদিকরা মেরুদণ্ডটা হারিয়ে গিয়েছিল। যে কারণে দেখি, স্বাধীনতার পরে দেখি, মেরুদণ্ড উঁচু করে সাংবাদিকরা কেউ দাঁড়াতে পারেনি। তাদের কেউ পাকিস্তানিদের দালালি করেছে, কেউ বাংলাদেশের সমর্থনে ছিল এ দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলো সামনে চলে এসেছিল। এবং স্বাধীনতার পরে পঁচাত্তরের পরে পত্রিকাগুলো রাজনৈতিক সচেতন থাকলেও আবার সামরিক শাসন হলো দেশে। সংবাদপত্রগুলো সামরিক জান্তাদের সেন্সরশিপের আওতায় চলে আসে। এবং দেখা গেল পত্রিকাগুলো নিজস্ব নিউজ সেভাবে ছাপতে পারত না। আবার একাত্তর সালে এই সাংবাদিকরাই শহীদে বুদ্ধিজীবী হ্ত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। চৌধুরী মইনুদ্দিন এবং আশরাফুজ্জামান ছিলেন সাংবাদিক। চৌধুরী মইনুদ্দিন পূর্বদেশে ছিলেন, ফেনীর লোক হামিদুল হক চৌধুরীর পত্রিকায় চাকরি নিয়েছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন এবং ফেনীতে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘ করলেও ঢাকায় চলে আসেন ফেরদৌস কোরেশীর হাত ধরে। কারণ, ফেরদৌস কোরেশী তখন বাংলা ছাত্রলীগ করতেন। ঢাকায় এসে চৌধুরী মইনুদ্দিন বাংলা ছাত্রলীগে ঢুকে পড়ে। আল মুজাহিদী তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করেন। চৌধুরী মইনুদ্দিন একাত্তরের পরে ছাত্রসংঘে ফিরে যায় এবং আলবদর বাহিনীর নেতা হয়। সে তার প্রিয় শিক্ষদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিলেন। এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যায় তার বিশাল ভূমিকা ছিল। এই দুই সাংবাদিক এদের বিচার হয়েছে। বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। একজন লন্ডনে আরেকজন আমেরিকায় পালিয়ে রয়েছে।
আবার পঁচাত্তরের জেলহত্যার ইন্ধনদাতাদের মধ্যে সাংবাদিক আতিকুল আলম ছিলেন। তিনি ‘রয়টার্স’, ‘ভয়েস অব আমেরিকা’য় ছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষে, গণহত্যার পক্ষে নিউজ করতেন। স্বাধীনতার পর তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিলেন কিন্তু এবিএম মূসা ও কেজি মুস্তফার সুপারিশে ছাড়া পান। পরবর্তী সময়ে সিমলা চুক্তির সময় তিনি ভারতে গেলে সেখানেও ইন্ডিয়ান সরকার আপত্তি করে এবং বাংলাদেশ সরকার ফিরে আসার পর তাকে গ্রেপ্তার করে। যেহেতু সে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গিয়েছিল। তাকেও সাংবাদিক নেতারা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে দাবি করে মুক্ত করেন। পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বরের আগে যখন ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করল, জিয়াউর রহমান তখন সেনাপ্রধান হলেন তখন এ দেশে কোনো বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন না। সব বিদেশি সাংবাদিককে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিদেশি সাংবাদিকরা কলকাতা-দিল্লিতে ও সিঙ্গাপুরে বসে কাজ করতেন। এখানে তাদের সোর্স ছিলেন আতিকুল আলম। আতিকুল আলম যে নিউজ দিতেন, সেগুলো তারা প্রচার করতেন। এবং আতিকুল সামরিক জান্তা খুনিদের পক্ষ হয়ে নিউজ করতেন এবং ১ নভেম্বর বিদেশি সাংবাদিকদের তিনি জানিয়ে দিলেন তাজউদ্দীন আহমদ জেলখানা থেকে ভারত সরকারকে একটা চিঠি দিয়েছেন যে, তাদের মুক্ত করে সরকারে বসানোর জন্য। কিন্তু পুরোটাই ছিল মিথ্যে। পরবর্তীকালে তার কাছে যখন চিঠি চাওয়া হলো, তিনি বললেন যে, এটা গোয়েন্দা সংস্থার লোকরা নিয়ে গেছেন; তার কাছে নেই। এই আতিকুল আলমই তখনই এই ইন্ধনটা দিয়েছিলেন। এ দেশের গণহত্যা ও জেলহত্যার পেছনে সাংবাদিকদেরও ভূমিকা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরে সাংবাদিকদের জন্য প্রেস ইনস্টিটিউট গঠন করার অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। পরবর্তীকালে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিশাল মহীরুহতে পরিণত হতে যাচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পিআইবির প্রসঙ্গটি রয়েছে শিক্ষা-গবেষণার মানোন্নয়নের জন্য। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকতার বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তিনি বুঝতেন এ দেশে সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটেনি। অতএব তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দরকার। শেখ হাসিনাও তাই উপলব্ধি করেন। এই কারণে তিনি আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছেন।
সংবাদ প্রকাশ : বঙ্গবন্ধুর আমলে সাংবাদিকতা নিয়ে অনেকে বিতর্ক তোলেন।
জাফর ওয়াজেদ : বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে সাংবাদিকতা বিষয়ে নানা কথা বলা হয়, যখন সংবাদপত্রগুলো একেবার যা খুশি তা লেখা শুরু হয়ে গেল। ‘গণকণ্ঠ’সিরিজ আকারে লেখা শুরু করল শহরে গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল। তখন তিনি সেটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন, কারণ তখন দেশে অরাজকতা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তার বাইরে অনেক পত্রিকা দেশের বিরুদ্ধে অনেক লেখালেখি শুরু করে দিল। ১৯৭২ সালে জুলাই মাসে প্রেস ক্লাবে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটা দিলেন, তাতে কিন্তু তিনি এগুলো উল্লেখ করেছেন। সাংবাদিক নেতা এনায়েতুল্লা খান, শহীদুল হক, তোয়াব খানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি কমিটি করেছিলেন এবং সেই কমিটি আলোচনা করে চারটি দৈনিক রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এবং ২০৪টি সাময়িকী। পুরো ব্যাপারটির দায়িত্বে ছিলেন এনায়েতুল্লা খান। যেসব সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দিয়েছেন। একটি লোকও বেকার থাকেনি। অনেকে কাস্টমস, আয়কর বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরে কাজ পেয়েছেন। একজন সাংবাদিকও বলতে পারবে না যে আমি বেকার ছিলাম। এখানে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার ভাবনাটা।
সংবাদ প্রকাশ : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পিআইবি কোনো গবেষণা করছে কি না?
জাফর ওয়াজেদ : পিআইবির একটি প্রকল্প আছে ‘সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু’। ইতিমধ্যে পাঁচটি খণ্ড বেরিয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে দুই খণ্ড এবং ৪৭ থেকে সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যা এসেছে, তা-ও সংকলিত করার কাজ চলছে। ৭০ সাল করব, এরপর ৭১-৭২ বের হবে। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা নিয়ে আমাদের গবেষণাধর্মী বই রয়েছে। সংবাদপত্রে কী ছাপিয়েছিল সেই সময়টায়। ৭ মার্চের ভাষণের ওপর রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নিয়ে সারা দেশে সাংবাদিকদের নিয়ে কর্মশালা করেছি।
সংবাদ প্রকাশ : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে, এখনো যা হচ্ছে, তা কতটা মানসম্মত বলে আপনি মনে করেন?
জাফর ওয়াজেদ : সব বই তো দেখিনি। অনেক বই দেখেছি, অধিকাংশ বই ক্র্যাশ। কোনো বই-ই গবেষণাধর্মী নয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনকর্ম নিয়ে কাজ করার সুযোগ সবার হয়নি এবং করেওনি। এবং অনেক ডকুমেন্টস জোগাড়ও করেনি। ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই তিনটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করে অনেক উপকার করেছেন। না হলে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য ছাপা হতো। সাল-তারিখও ভুল ছাপা হচ্ছে এখনো। বাংলা একাডেমি ১০১টি বই করছে, সেগুলো যদি গবেষণাধর্মী না হয়, ভাষার মারপ্যাঁচে হয়, তাহলে সেগুলো টিকবে না। যেমন ৭ মার্চের যে লেখাগুলো রয়েছে, সেগুলোর অনেক লেখাই লেখা হয়েছে ভাষণের এডিট অংশটা নিয়ে। পুরো ভাষণ নিয়ে কেউ লেখেননি। বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণটা অডিও করার জন্য গত বছর তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ কমিটি করে দিয়েছিলেন। আমি ওই কমিটির সদস্যসচিব ছিলাম। সেখানে শামসুজ্জামান খান, মুনতাসীর মামুন, আশরাফুল রহমান খান যারা ৭ মার্চের ভাষণে উপস্থিত ছিলেন। আমরা অডিওগুলো নিয়ে সংযোজিত করে পূর্ণাঙ্গ ভাষণটি তৈরি করেছি। তার মধ্যে স্লোগানসহ সব মিলিয়ে ২১ মিনিটের। কিন্তু সেই ভাষণটি নিয়ে গবেষণা হয়নি। আমরা খুবই দুর্ভাগ্য জাতি যে, ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর পূর্ণরূপ পেলাম। এর আগে কেউ এটার পূর্ণরূপ দেওয়ার চেষ্টা করেনি।