আমার মৃত্যু যন্ত্রণা যেন দীর্ঘ না হয়: জয় গোস্বামী

পার্থ সনজয় প্রকাশিত: মে ১, ২০২২, ০৬:৫৩ পিএম

গেলো মার্চের এক মধ্যাহ্নে ঢুঁ মেরেছিলাম কলকাতায় কবি জয় গোস্বামীর বাড়িতে। সাথে কবি অমিত গোস্বামী। কোয়ার্টার বাড়ির দরোজা খুলে দিয়েছিলেন সেদিন তার স্ত্রী কাবেরী গোস্বামী। করোনা উৎকন্ঠা তখনো ঘিরে আছে বাড়িটিকে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এই পরিচয়েই হয়তো ঘরে ঢোকার অনুমতি মিললো। মিললো কবির সাথে সাক্ষাতও। করোনা থেকে সেরে ওঠার পর এখন ঘরেই থাকেন ঝাউপাতার এই কবি! সাক্ষাৎকারটি প্রশ্নোত্তর আকারে না দিয়ে, কথা বলার বিষয় ধরে উপশিরোনামের অধীনে দেওয়া হলো।

 

কে বেশি কে কম

একজন কবির সঙ্গে আরেকজন কবির কোন তুল্যমূল্য বিচার হয় না। কেন হয় না বলুন তো? দৌড় প্রতিযোগিতা দেখেছেন? সবাই একই লক্ষ্যের দিকে ছুটে যান। কে আগে পৌঁছাবে? কিন্তু কবিতা বা সাহিত্য রচনা সেইরকম নয়। একজন ডান দিকে চলে গেল। একজন বাম দিকে চলে গেল। একজন সম্পূর্ণ পেছনে চলে গেল। তা যদি না হতো, আমরা দস্তয়ভস্কির পর তলস্তয়কে পাই না। রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দকে পাই না। জীবনানন্দের পর শঙ্খ ঘোষকে পাই না। আবার আল মাহমুদকে পাই না। শহীদ কাদরীকে পাই না। সৈয়দ শামসুল হককে পাই না। এরা এক রাস্তায় কেউ যাননি। তুল্যমূল্য বিচার সাহিত্যের ক্ষেত্রে হয় না। 

হ্যাঁ, হতে পারে। পাঠকের কাছে। একজন পাঠক বললেন, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা পড়া যায় না। কেউ কেউ বলেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা খুব শক্ত। কিন্তু আমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকেও গ্রহণ করতে পারি। তাঁর রচনায় যে আনন্দ তাও পাই। আবার হুমায়ূন আহমেদের হিমু, তার যে নন্দিত নরকে বই, তাও গ্রহণ করতে পারি। আবার ধরুন, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাও গ্রহণ করতে পারি। আমি ভাবি, আমি যা জানি, তার বাইরে অনেকখানি জানার জগৎ ছড়িয়ে আছে। আমি যদি সমস্ত লেখকের বই ভালো করে অনুধাবন করার চেষ্টা না করি, তাহলে আমার ক্ষুদ্র আয়ুস্কালের মধ্যে আমি জানব কতটুকু? ওমুক ভালো নয় বলে, তাকে সরিয়ে রাখি, তাকে বোঝার চেষ্টা না করি, তাতে তো আমার ক্ষতি হবে। আমি তো কম জানবো। 

সে কী দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবী দেখছে? কী দৃষ্টিতে তার চরিত্রগুলো তৈরি করছে? তার চরিত্রের জীবনপথ তৈরি করছে, তার চরিত্রগুলো কেমন করে পাল্টাচ্ছে। কী করে সম্পর্কের মিলন ঘটছে, বিচ্ছেদ হচ্ছে। এসব বড় বড় লেখকরা দেখিয়ে গেছেন তাঁদের লেখায় সারাজীবন। 

আমি যদি কাফকা পড়ে মনে করি সার্ত্রে পড়বো না, তাহলেও তো আমিই হারবো। আমিও বঞ্চিত হবো। সেজন্য আমি সবার লেখাই পড়ার চেষ্টা করি। তুল্যমূল্য বিচার করি না।

 

৬৮ বছরে এসেও নেশাটা ছাড়তে পারলাম না

লেখার জন্য পরিশ্রম জরুরি। অন্তত আমার কাছে। আমার নিজের মনে হয়, অন্যের ক্ষেত্রেও। আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখেছি, অফিসের টেবিলে বসে অনায়াসে ধারাবাহিক উপন্যাসের কিস্তি লিখে যাচ্ছেন। অথবা শারদীয় সংখ্যায় বের হবে, এমন গল্প উনি লিখছেন অফিসের টেবিলে বসে। আমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে দেখেছি বসে বসে লিখছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছি, পানশালায় বসে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদককে কাগজ নয়, টিস্যু পেপারে কবিতা লিখে দিতে। এবং সেটা অসাধারণ হয়েছে। তারা এত সহজে লিখতে পারেন, তাদের ভেতরে লেখাটা থাকে।

আমি এত সহজে লিখতে পারি না। আমার খালি মনে হয় আমার ভুল হচ্ছে। আমি ঠিক করে কথাটা বলতে পারছি না। ঠিক জায়গাটা ধরতে পারছি না। আমার মনে যে কি হচ্ছে তা নিজে বুঝতেও পারছি না। কি করে তা বলব, তাও বুঝতে পারছি না। বলতে বলতে দেখছি, যা বলতে চাইছি, তা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। ফলে এ এক কঠিন কাজ। অথচ ১৩ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেছি। এই ৬৮ বছর বয়সেও আমি এই নেশাটা ছাড়তে পারলাম না।

 

আজ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো

আমার উত্তর প্রজন্মের প্রতিটা মন আলাদা। একরকম মন সবার নয়। আমার যা মনে হচ্ছে, আমার মেয়ে সেভাবে চিন্তা করবে, এটা আমি ভাবি কী করে? এটা তো জুলুম হয়ে গেল। আমি যেভাবে ভাবছি, তুমি আমার উত্তর প্রজন্ম, আমার থেকে বয়সে ছোট, এজন্য আমার মতো ভাববে, এরকম কোন ভাবনা আমার জীবনে কখনো আসেনি। আমি এটাও মনে করি, আমার চেয়ে বয়সে যারা ছোট, পরে যারা লিখতে এসেছে, তাদের শ্রদ্ধা করা উচিত নয়, এটা আমি মনে করি না। আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। তাদের সম্পর্কে আমি লিখিও। ২০১৮ সালে যার কবিতার বই বেরিয়েছে, তার কবিতা নিয়েও আমি আশাবাদী। এবং স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনাও করেছি।

সব অন্ধকার ফুলগাছ

আমার কর্মজীবন নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করে। আমি একসময় আনন্দবাজার পত্রিকা, সংবাদ প্রতিদিনের সাথে জড়িত ছিলাম। শামীম রেজা বলে একজন খুব ভালো কবি আছেন। বাংলাদেশের। খুব ভালো কবি। আমাকে আমন্ত্রণ করে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। অনেক যত্ন করেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন আমার সাক্ষাৎকার নিলেন, সেই সাক্ষাৎকারের মধ্যে প্রধান হয়ে রইলো আমার কর্মজীবন। আমার শব্দজীবনটা প্রধান হলো না। আসলে তো আমি একজন শব্দজীবী। শব্দের উপর নির্ভর করে আমার যাবতীয় কাজ। কিন্তু আমার কর্মজীবনকে নিয়েই তার আগ্রহ বেশি। তখন বুঝলাম, তিনি একজন শব্দজীবী হলেও, শব্দকে তিনি ব্যবহার করলেও, তিনি আসলে অন্যের কর্মজীবনকে গুরুত্ব দেন। কী আর করা, মেনে নিলাম। আমার এখন যে বয়স, তাতে প্রতিবাদ করার মতো শক্তি নেই। আমি মেনে নিলাম। 

 

এ জল মাটির মধ্যে, এই আলপথে

চার-পাঁচবার বাংলাদেশে গেছি। খুব ভালো লেগেছে। মানুষেরা খুব অতিথিপরায়ন। তারা বাংলাভাষাকে সত্যিকারের ভালোবাসেন। বাংলাভাষাকে বুকে জড়িয়ে রাখার প্রচণ্ড যে আকুতি, তা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলা ভাষাকে তারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন।

 

কবি বেশি, না পাঠক?

আমার কবিতা যখন ছাপা হয় ১৯৭৩ সালে, তখনও আমি এ কথা শুনতাম। ২০০২ সালেও তা। ২০২২ সালেও আমি আপনার কাছে একই কথা শুনছি। এ কথাটা চলে আসছে। তারপরও তো কত নতুন কবি কবিতা লিখতে এসেছে। আপনা্দের বাংলাদেশেও কত লেখক লিখেছেন। পশ্চিববঙ্গেও কত লোক লিখেছেন। ফলে পাঠক কমে আসছে, কবির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। প্রকাশকরা কিন্তু কবিতার বই বের করছে। পাঠকের সংখ্যাটা যদি নেহাতই কম হতো, প্রকাশকরা যে অর্থ লগ্নি করেন, তা কি করতেন?

 

সম্মান

১৯৯২ সালে তসলিমা নাসরিন আনন্দ পুরস্কার পান। ১৯৯৪ সালে শামসুর রাহমান আনন্দ পুরস্কার পান। এই কিছুদিন আগে হাসান আজিজুল হক আনন্দ পুরস্কার পেলেন। সনজীদা খাতুন রবীন্দ্র পুরস্কার পেলেন। আনিসুজ্জামান পেলেন। এবার আপনি আমাকে পশ্চিমবঙ্গের একজন লেখকের নাম বলুন, যিনি বাংলাদেশ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের লেখকদের বারবার সম্মানিত করেছে।     

 

ঘুমিয়েছো, ঝাউপাতা?

আমি যে জীবনে আছি, আমি চাই, আমার পরিবারের কারো বড় অসুখ না হয়। আমার মৃত্যুযন্ত্রণা যেন দীর্ঘ না হয়। হাতে যেটুকু সময় আছে, আমি বই পড়া, গান শোনা, আরো কিছু জানার পথে যেন থাকতে পারি।