সলিমুল্লাহ খান ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ—সংক্ষেপে—ইউল্যাবের অধ্যাপক। চিন্তাবিদ, লেখক ও তাত্ত্বিক। তিনি গণবুদ্ধিজীবী হিসেবেও পরিচিত। তাঁর জন্ম ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট। কক্সবাজার জেলায়। তিনি ইউল্যাবে যোগদানের পূর্বে রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। বর্তমানে তিনি ইউল্যাবে সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড থিওরির পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আদমবোমা, বেহাত বিপ্লব ১৯৭১ এবং স্বাধীনতা ব্যবসায় প্রভৃতি তাঁর রচিত গ্রন্থ। গত বছরের মাঝামাঝি ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষক সৈয়দ মিজানুর রহমান সলিমুল্লাহ খানের এই সাক্ষাৎকারটি নেন।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
সলিমুল্লাহ খান: ধন্যবাদ।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: কোভিড-১৯ মহামারিকালে পৃথিবীজুড়ে প্রাণে বেঁচে থাকাই মানুষের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধনী-দরিদ্র এবং উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সকলে বেঁচে থাকাকেই সাফল্য মনে করছি। বেঁচে থাকাই এক গ্র্যাজুয়েশন। এই সময়ে শিক্ষা নানা ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে। আপনার ভাবনাগুলো এখন কিভাবে আপনাকে তাড়িত করছে? বিশেষত শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার ক্ষেত্রে?
সলিমুল্লাহ খান: আপনি ঠিকই বলেছেন আমরা এখন সংকটে আছি। সংকটেই বন্ধুত্বের সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলায় বলি, ‘বিপদেই বন্ধুর পরিচয়’। বিপদের মধ্যে আন্দাজ করা যায় আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা বা সমাজ-ব্যবস্থা কতটুকু শক্ত। একটি দড়ি কতটুকু শক্ত সেটি পরিমাপ করতে হলে দড়িটি যেখানে সবচেয়ে বেশি দুর্বল ঠিক সেখানে মাপতে হবে। সেটি হলো দড়ির শক্তির মাপ। সংকটের সময়ে শিক্ষার অনেক ত্রুটি আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়েছে।
শিক্ষা নিয়ে অনেক কথা হয়। কেউ কেউ শিক্ষার সঙ্গে কিছু আলংকারিক শব্দ জুড়ে দেন। এগুলোর কোনো সারবস্তু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তে গিয়েছিলাম, অধিকাংশ শিক্ষকের ক্লাসে এক ঘণ্টা থাকা আমার জন্য ভীষণ কষ্টকর ছিল। শিক্ষকের বক্তব্য যদি আমার অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রশ্নের সঙ্গে কোনোভাবে সংযুক্ত না হয় তবে সেখানে থাকা কঠিন। আমার অভিজ্ঞতার সার হলো, অধিকাংশ শিক্ষকের পড়ানোয় আমি আনন্দ পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়িয়ে চলেছি আজ প্রায় আটত্রিশ বছর। আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি প্রায় সাত বছর। চার বছরের জায়গায় সাত বছর পড়তে হয়েছে। শিক্ষক যদি ভালো না হন তবে শিক্ষা হয় না। শিক্ষা একটি জীবন্ত বিষয়। শিক্ষক ছাড়া পড়তে পারলে তো বাড়িতে বসে বই পড়লেই হতো।
এখন বাজারে নানা ধরনের শ্লোগান দেওয়া হচ্ছে—‘লাইফ-লং এডুকেশন’ বা জীবনব্যাপী শিক্ষা। আমি মনে করি এসব ভুয়া কথা। শিক্ষা শব্দটি আমাকে বুঝতে হবে। আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সীমা আঠারো। এই সময়ে শিক্ষার জন্য আমাদের কারো না কারো তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। এর পরের শিক্ষা হলো পেশাগত শিক্ষা বা আরো পরে উচ্চশিক্ষা। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা বুনিয়াদি শিক্ষা। আপনি বলছেন শিক্ষায় দর্শন, দর্শনের শিক্ষা। এসব কথা কবিতার মতো মনে হয়। দর্শনের যে সহজ অর্থ রয়েছে তা না বলে আমার বন্ধু অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ পূর্বের এপিসোডে বলেছেন বিশ্বদৃষ্টি। এটি তো একই কথা আবার বলা।
দর্শন মানে দেখা। ‘দেখা’ একটি বাংলা শব্দ। ‘দর্শন’ একটি সংস্কৃত থেকে আগত শব্দ। আমরা বলি, যা খালি চোখে দেখা যায় না তা যদি আপনি অন্তরের চোখে দেখেন তাকে ‘দর্শন’ বলে। তবে দৃশ্যমান দুনিয়াতে বা দর্শন কি জিনিস? এই যে সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, পশ্চিমে অস্ত যায়—তা প্রতিদিনই আমরা দেখছি। কোন স্কুলপড়ুয়া শিশুকে যদি আপনি বলেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে তবে তার চোখে কিভাবে তার প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হবে? খালি চোখ পৃথিবীকে ঘুরতে দেখছে না সে। পৃথিবীকে সে স্থির দেখছে। শিশুর মনে কৌতূহল জাগাতে হবে। পদার্থবিদ্যার অংক কষে তাকে দেখাতে হবে এভাবে ঘটছে। সে যখন গাড়ি বা ট্রেনে চড়বে তখন তাকে বলতে হবে—দেখো গাছগুলো দৌঁড়ায়। বুঝিয়ে বলতে হবে গাছ দৌঁড়ায় না, তোমার গাড়ি দৌঁড়াচ্ছে। একইভাবে তাকে বোঝাতে হবে পৃথিবীটা স্থির মনে হলেও আসলে পৃথিবীই ঘুরছে। শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকের এই যে কৌশল তা শিক্ষার্থীকে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে।
আমরা যে সকল বিষয় দেখি, কথাবার্তায় বলি বা শুনি সেগুলোকে প্রশ্ন করি না। বলা হয়, অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে ‘নোবেল’ পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বড় পন্ডিত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এতে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। আমি যদি বলি তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাননি তবে সকলে বলবেন ‘এত বড় কথা আপনি কিভাবে বললেন!’ অর্থনীতিতে কোন নোবেল পুরস্কার রয়েছে কিনা সেটি খোঁজ নিয়ে যে কেউ দেখতে পারেন। তিনি একটি পুরস্কার পেয়েছেন সেটি সত্য। এটি জুয়েল আইচের যাদুর মতো। চোখের দেখায় মনে হয় মানুষটিকে কেটে আমি দুই টুকরা করলাম।
অর্থনীতিতে কোন ‘নোবেল’ পুরস্কার নেই। তিনি সুইডেনের রাজার হাত থেকে যে পুরস্কার নিয়েছেন—তার নাম ব্যাংক অব সুইডেন প্রাইজ ইন ইকোনমিক সায়েন্স। একে ইকোনমিকস প্রাইজও বলা হয়। অন্য প্রাইজগুলোকে বলা হয় ‘নোবেল মেমোরিয়াল প্রাইজ’। এমনটি বলা হয় কেন? এটি মূল পুরস্কার প্রবর্তনের প্রায় সত্তর বছর পরে চালু হয়েছে। পুরস্কারটি সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফে দেওয়া হয়। (এর অর্থটা) নোবেল ফাউন্ডেশন থেকে দেওয়া হয় না। এটাই পার্থক্যের কারণ।
আইন করে নিষিদ্ধ করা চলে বলেই শুধু নয়, নৈতিক কারণেও একে নোবেল পুরস্কার বলা যাবে না। অথচ সাংবাদিকদের বলতে কে বাঁধা দেবেন! বাংলাদেশেও তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। তিনি যে অর্থনীতিতে পৃথিবীসেরা পুরস্কারটা পেয়েছেন সে সন্দেহ আমি করছি না। তবে এটি ‘নোবেল’ পুরস্কার নয়। আলফ্রেড নোবেল বলেছেন আমার নামে পাঁচের বাইরে আর কোন পুরস্কার প্রবর্তন করা যাবে না। অতএব আমার ফান্ড থেকে কোনো অর্থও দেওয়া যাবে না। এজন্য সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (‘স্বেরিয়াস রিকসব্যাংক’) পুরস্কারের অর্থটা দিতে সম্মত হয়েছে। এই অর্থটি অন্যান্য ক্যাটেগরিতে নোবেল পুরস্কারের সমান হবে। একই দিনে এটাও প্রাপকের হাতে তুলে দেবেন সুইডেনের রাজা। আদি পাঁচটি পুরস্কারের মধ্যে একটি দেওয়া হয় নরওয়ের পার্লামেন্ট কর্তৃক—নোবেল শান্তি পুরস্কার। বাকি চারটি পুরস্কার দেবেন সুইডেনের একাডেমি। তাঁরা এর সঙ্গে ছয় নম্বর পুরস্কারটি যুক্ত করেছেন অর্থশাস্ত্রে। ১৯৬৯ সালে। সকলেই জানেন, মূল পুরস্কারগুলি চালু হয়েছিল ১৯০০ সাল থেকে। আলফ্রেড নোবেলের উইল লেখা হয়েছিল ১৮৯৬ সালে। এই কথাগুলো যদি শিক্ষার্থীদের বলা হয় নিশ্চয়ই তারা বুঝবেন।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: সকলে বুঝবে।
সলিমুল্লাহ খান: আমাদের শিক্ষকরা বলেন—এটি অর্থনীতির ‘নোবেল’। সবচেয়ে বড় পুরস্কার, সুতরাং নোবেল বলা চলে। অথচ আপনি আইনের শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছেন, কপিরাইট বা প্যাটেন্ট না করলে একজনের আবিষ্কার আরেকজন নিয়ে যায়। সকল ব্যবসায়ের ট্রেডমার্ক থাকে। কপিরাইট, প্যাটেন্ট ও ট্রেডমার্ক এগুলো ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস বা মেধাস্বত্ত্বজাত অধিকার। এগুলো আইনের শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে আপনি যদি মিথ্যামিথ্যি বলেন—অমর্ত্য সেন ‘নোবেল’ পুরস্কার পেয়েছেন তবে আপনি খামোকা মিথ্যাবাদী হয়ে গেলেন।
আজকের অনুষ্ঠানে আপনারা শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে চান। শিক্ষা কি জিনিশ? শিক্ষা তাহাই যাহা মনুষ্য আপন সন্তানকে শিক্ষা দেয়। আমি আপনার চেয়ে হয়তো দশ বছরের বড়। আপনার ছাত্র আপনার চেয়ে পনেরো বছরের ছোট। ইংরেজিতে বলে সিনিয়র স্কলার, জুনিয়র স্কলার। আমরা সবাই জানি, স্কলার মানে শিক্ষার্থী। আমিও শিক্ষার্থী, আপনিও তো শিক্ষার্থী। যিনিই পড়াশোনা করেন তিনিই শিক্ষার্থী। শিক্ষকদের আগে মনে রাখতে হয় তাঁরা শুধু শিক্ষক নন, তাঁরাও প্রত্যেকেই একেকজন শিক্ষার্থী। কার্ল মার্ক্সের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘আ টিচার হিমসেলফ্ নিডস্ টু বি এডুকেটেড’ বা ‘দি এডুকেটর হিমসেলফ্ নিডস্ টু বি এডুকেটেড’। বাংলাদেশের শিক্ষার ক্ষেত্রে যে প্রধান সমস্যা আমি দেখি সেটি হলো, শিক্ষকের অভাব। শিক্ষার্থীকে দোষ দেওয়া যাবে না।
দেশের শিক্ষানীতি কি হবে, তা আমাদেরকে পরিষ্কার করে বলা উচিত। প্রাথমিক বিদ্যালয় মানে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। একে আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয় বলি। কিন্তু সরকারের একজন মন্ত্রী বললেন, প্রাথমিকে দেশীয় শিক্ষা ইংরেজি মাধ্যমে দেওয়া হবে। প্রথমে পাইলটিং হবে। প্রত্যেক জেলা থেকে একটি করে বিদ্যালয় বেছে নেওয়া হবে যাতে ইংলিশ ভার্সন চালু করা যায়। তারপর সব বিদ্যালয়ে চালু করা হবে। জাতির সামনে ব্যাখ্যা দিতে হবে—কেন ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষা প্রাথমিকে চালু করবেন যা ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজরাও করেননি?
আমরা লর্ড মেকলের কথা বলি—তিনি সরকারি পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমের লেখাপড়ার প্রবর্তক। ১৮৫৪ সালের ব্রিটিশ শিক্ষানীতি পাওয়া যায়—উড’স ডেসপ্যাচ ১৮৫৪ নামক দলিলে। সেই দলিলেও প্রাথমিক শিক্ষা ইংরেজিতে দিতে হবে এমন কোন কথা বলা হয়নি। তাঁরা শুদ্ধ উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির কথা বলেছিলেন। অমর্ত্য সেনের উদাহরণ টেনেছি এটি বোঝাতে যে মানুষকে কিভাবে শুভংকরের ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও ফাঁকি রয়েছে।
অনেকে বলবেন ইংরেজ আমলে ইংরেজি মিডিয়াম চালু হয়েছে। প্রকৃত সত্য হলো, তখনও সাধারণভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যম চালু হয়নি। শুধু ইংরেজদের স্কুলে হয়েছিল, আমাদের স্কুলে হয়নি। এখন কেউ কেউ স্বেচ্ছায় ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ছেন কিন্তু এটি বাধ্যতামূলক নয়। উড’স ডেসপ্যাচ দলিলে আদৌ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর কথা বলা হয়নি। দেশীয় ভাষায় পড়ানোর কথাই বলা হয়েছিল। শুধু প্রদেশে বা বিভাগে নয়, অঞ্চলে অঞ্চলে নয়, জেলায় জেলায় যে যে মাতৃভাষা—সেই সেই ভাষায় পড়ানোর কথা বলা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মাতৃভাষা যদি চাকমা ভাষা হয় তবে সেখানে ওই ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দিতে হবে। গারো অঞ্চল হলে গারো ভাষা। এটিই ইংরেজদের নীতি ছিল। অথচ আমাদের স্বাধীন দেশের মন্ত্রী-সরকার বলছেন, বিশ্বায়নের কারণে ইংরেজিতে পড়তে হবে। ইংরেজি মাধ্যমে ইতিহাস ও গণিতের মত বিষয়গুলো পড়ালে দেশব্যাপী সাধারণের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে বাধার সৃষ্টি হবে।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: আপনি দর্শনের বিষয়টি সহজ বলে দিয়েছেন। তাকিয়ে থাকা আর দেখা তো এক নয়। দার্শনিক চিন্তা মানে অনেকে মনে করেন চুলে জট থাকবে। এলোমেলো ভাব। দর্শনের বিকৃত উপস্থাপনাও আছে আমাদের সমাজে।
সলিমুল্লাহ খান: এখন যে বিষয়টিকে আমরা পদার্থ বিজ্ঞান বলি নিউটনের সময় তাকে বলা হতো পদার্থ দর্শন। ইংরেজিতে বলতো ‘ন্যাচারাল ফিলোসফি’। নিউটনের বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা ফিলোসফিয়া নাতুরালিস’। ল্যাটিন ভাষায় ‘প্রকৃতি দর্শন’ কথার নাম ‘ফিলোসফিয়া নাতুরালিস’। ইংলন্ডেও ল্যাটিন ছিলো শিক্ষার মাধ্যম। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত। অষ্টাদশ শতাব্দীতেও অনেকটা ছিল। সেদেশেও ইংরেজি মিডিয়াম চালু হয়েছে দুইশ বছরের বেশি নয়। আমাদের দেশে এখন বড়লোকদের মধ্যে ঘোড়ারোগ দেখা দিয়েছে। তাদের ধারণা, একমাত্র ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করলেই আমরা ভালো শিখতে পারব।
ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত হতে কে না চায়! আমরা সকলেই চাই। কিন্তু ভালো শিক্ষার কথা বলে এখন যে পথে তাঁরা হাঁটছেন এটি ধ্বংসাত্মক পথ। ধ্বংসাত্মক পথ মানে নিম্নমানের শিক্ষার পথ। স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছর হলেও এদেশে এখনো শতভাগ লোক কেন সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হলেন না? শতভাগ লোক কেন প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করতে পারলেন না? এই প্রশ্ন করতে পারলেই শিক্ষার দর্শনের সব কথা শেষ হয়ে যায়।
সরকার এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি মিডিয়ামের কথা বলছেন। আপনি ‘ভিশন ২০৭১’ ও শত বছরের ডেল্টা বা বদ্বীপ পরিকল্পনা দেখুন, বুঝতে পারবেন পঞ্চাশ বছর পরে বাংলাদেশে বাংলা ভাষা থাকছে না। এই কি স্বাধীনতার অঙ্গীকার! আমি প্রধানমন্ত্রী সমীপে এ বিষয়ে একটি নীতি ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছি। তাঁরা যে শিক্ষানীতি বলে একটি দলিল বের করেছেন তা ছেলেখেলার মতো। জাতির সঙ্গে এত বড় মশকরা করা যায় না।
প্রথমেই ঠিক করতে হবে শিক্ষার ভাষা কি হবে? পৃথিবীর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব, নাকি দর্শন থেকে নেব? ইতিহাস ছাড়া কোন দর্শন হয় না। ইংরেজ, ফরাশি, জার্মান, রুশ বা জাপানি—প্রত্যেক জাতির শিক্ষা হয়েছে মাতৃভাষায়। কিছু তর্ক থাকতে পারে। যেমন ভারতের জাতীয় ভাষা কি? ঐদেশে সবাইকে হিন্দি শেখানো যাবে না। তখন লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা বা যোগাযোগের ভাষার কথাটা আসে। সন্দেহ নেই যে পৃথিবীতে এখন ইংরেজি হলো এক নম্বর যোগাযোগের ভাষা। সুতরাং ইংরেজি শিখতে হবে। কিন্তু নিজের দেশের ভাষাকে লুপ্ত করে ইংরেজি আমরা প্রতিস্থাপন করতে পারব? চৌবাচ্চার পানি বদলানোর মত? এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। সংবিধানে ঘোষণা রয়েছে—শিক্ষায় সকলকে সমান অধিকার দিতে হবে। সেই ঘোষণা প্রতিপদে এখন লঙ্ঘিত হচ্ছে।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকের কথা শুনছি। সেখানে দেখা গেছে, ৪৩ শতাংশ র্যাঙ্কিং নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান। কারিগরি শিক্ষায় যারা ডিপ্লোমা করেছেন তাদের অবস্থান ৫৩ শতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ সম্ভবত ২৩ শতাংশ। এই নিম্নস্তরে অবস্থানের কারণ কি? আমাদের শিক্ষার দার্শনিক ভিত্তি নেই বলে?
সলিমুল্লাহ খান: ইংরেজ আমলে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা চালু হলো ১৮৩৫ সালের পর থেকে। তার আগেও আমরাই, প্রজারাই তো ইংরেজি শিখতে চেয়েছি। ইংরেজি না শিখলে তো আমাদের চাকুরি মিলবে না। দেশভাগের সাত বছর পূর্বে—১৯৪০ সালে—কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বললেন, এন্ট্রান্স পরীক্ষা বাংলা, উর্দু বা ইংরেজি মাধ্যমে দেওয়া যাবে। পাকিস্তান আমলে আমরা লড়াই করলাম উর্দুর বিপক্ষে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। এখন ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট্রের দেওয়া ২১ দফা দাবির কি হবে? তখন তাঁরা বলেছিলেন, একটা বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলা একাডেমি হলো, কিন্তু বাংলায় উচ্চশিক্ষা হলো না। কেন হলো না? অথচ এখন বাংলাদেশ হওয়ার পরে ইংরেজির দিকে চলে এলাম। পৃথিবী কি তখন গ্লোবাল ছিল না?
শিক্ষার কলেবর ও শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে চাইলেও মাতৃভাষার বিকল্প নেই। বিশেষত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলায় শিক্ষা দিতেই হবে। এখন আমরা ইংরেজির দিকে ঝোঁকা, পক্ষপাতদুষ্ট। আমাদের বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম যে বাছাই প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়—সেটি হয় ইংরেজিতে। এই পরীক্ষায় যে প্রশ্ন হয় তাতে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ নম্বর বরাদ্দ থাকে ইংরেজির জন্য। কিছুটা গণিত থাকে। প্রথম পরীক্ষাটি ইংরেজিতে—মিল্টনের এই কবিতাটি কত সালে লেখা হয়েছিল? বিসিএস বাছাইয়ের সঙ্গে এই প্রশ্নের যোগ সূত্র কি? ইংরেজি ভাষায় একজন প্রার্থী বলতে পারেন, লিখতে পারেন—এটিই যেন যথেষ্ট। ইংরেজি সাহিত্যে অভিজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই তাঁর। ফাংশনাল বা কাজের মতো ইংরেজি জানলেই কাজ চলবে। এই পরীক্ষার শুরুতে ইংরেজিতে যাঁরা ভালো করবেন তাঁদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত সৃষ্টি করা হয়।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা বিশেষ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করছেন। ওই শিক্ষার্থীদের একটি বিরাট অংশ বিসিএসের দিকে ঝুঁকছেন। নিজেদের পড়া বিষয়টি হয়তো চাকুরিক্ষেত্রে প্রয়োগের সুযোগ থাকছে না। এই সব বিশেষ বিষয়ে পড়া তাহলে নিশ্চয়ই একেকটি ভুল বিনিয়োগ।
সলিমুল্লাহ খান: এটি আমাদের ইনফিওরিটি কমপ্লেক্সের একটি প্রকার। ঢাকার অদূরে সাভারে রয়েছে ‘বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। সেখানে আমি কয়েক বছর লেকচার দিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। সেখানে সকল ফেস্টুন ঝুলছে ইংরেজিতে। বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা হিসাবে সবকিছু বাংলায় লেখার পরে তো তাঁরা ইংরেজিতেও লিখতে পারেন। কিন্তু না, সেখানে সবকিছুই ইংরেজিতে। কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে বলবেন। এটাই নিয়ম। ইংরেজিতে কথা বলে লাভ কি! তাদেরকে ইংরেজি শেখাতে চাইলে ছয় মাসের ইংরেজি কোর্স করান।
এটি মূলত দর্শনের ঘরে অন্ধকার বলেই সম্ভব। এক অন্ধ যদি আরেক অন্ধকে পথ দেখায় তখন উভয়েই গিয়ে গর্তে পড়ে। আপনি বাংলা জানার পরে ইংরেজি, চীনা, জাপানি ভাষা শিখতে পারেন। ফরেন সার্ভিসে যারা কাজ করবেন তারা বিদেশি ভাষা শিখবেন, জানবেন। বিদেশি ভাষা শেখার জন্য তাদেরকে ফ্রান্স বা জার্মানি পাঠালেই হয়, না পাঠালেও সমস্যা নেই। সরকারি চাকুরিজীবী যদি ঘাসরোপণ দেখতে বিদেশে যেতে পারেন, তবে ভাষা শিখতে বিদেশে গেলে অসুবিধা থাকবে কেন! আমাদের বিশেষজ্ঞ দরকার। এজন্য বলছি, সকলকে নষ্ট না করে ভাষা হিসাবে বাংলা শেখান। তারপর ইংরেজি শেখান, জাপানি শেখান।
শিক্ষার মাধ্যম যদি বাংলা না হয় তবে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে না। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ইংরেজদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘অ্যা শপকিপার’স নেশন’। আমাদের সরকারও একটি বড় দোকান হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সরকারের তো জাতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা। এটি ইংরেজি প্রতিষ্ঠান হবেন কেন? বিপিএটিসির অভ্যন্তরীণ ইংরেজিচর্চা ছাড়াও বিপিএটিসি কথাটাও বড় বড় করে বাংলা হরফে তবে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে। এটি জাতীয় নীতির লঙ্ঘন। এসব বললেই ডিজিটাল আইনে মামলা দেওয়া হবে। কিছুই যদি বলা না যায় সে ক্ষেত্রে দেশের উন্নতি হবে কিভাবে?
আমরা শিক্ষকদের যোগ্যতার কথা যদি বলি তবে লংকাকাণ্ড হবে। পৃথিবীর যে কোনো দেশেই যদি আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি চান তবে আপনাকে সে দেশের ভাষা জানতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত। শিক্ষকতার চাকুরিতে প্রবেশের সময় পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে। দেখতে হবে প্রার্থী বিশুদ্ধভাবে বাংলা পড়তে ও লিখতে পারেন কিনা। পরীক্ষা হলে শতকরা পঞ্চাশজনই হয়তো উত্তীর্ণ হবেন না। একথা অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। আটত্রিশ বছর আমি এ সকল দোকানে কাজ করেছি। আমাদের শিক্ষার গোড়ায় গলদ। আমাদের ভাষা শিক্ষার ও বিজ্ঞান শিক্ষার বুনিয়াদ খারাপ। শিক্ষার কারিকুলাম যাঁরা তৈরি করেছেন তাঁদের অশিক্ষার জন্যই এমনটি হয়েছে। তাঁরা বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কথার নকল করেছেন।
অশিক্ষিত লোকের হাতে শিক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হলে উন্নতি কষ্টসাধ্যই হবে। পৃথিবীতে বহুদেশে একাডেমি আছে। ফ্রান্সে, সুইডেনে ও জাপানে—এক কথায় সব দেশে—আছে। বাংলাদেশে বাংলা একডেমি হয়েছে নামে, কাজে এটি একাডেমি হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি চালান অশিক্ষিত লোকেরা। তাঁদের কোনো প্রয়োজনীয় যোগ্যতা নেই। তারা ফিবছর যত গরু-ছাগল ধরে এনে পুরস্কার দিচ্ছেন। এধরনের কর্মকাণ্ড গোটা জাতিকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। এটি তো ব্যক্তিগত বন্ধু ও নিজের চাচাতো ভাইকে ডেকে এনে পুরস্কার দেওয়ার বিষয় নয়।
যাঁরা শুদ্ধ বাংলা লিখতে জানেন না, বাংলা ভাষা সম্পর্কে যাঁদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই তাঁদের দিয়ে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ তৈরি করা হচ্ছে। এর চেয়ে শোচনীয় পরিণতি আর কি হতে পারে!
নৈরাজ্য কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা বোঝা যায় শিক্ষার্থীদের ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক দেখলে। অজান্তে ভুল হচ্ছে না, তারা জেনেশুনেই ভুল করছেন। বিষপান করছেন, ‘কয়ে দীর্ঘ-ইকার’ দিয়ে লিখছেন। বাংলা ভাষায় ‘কয়ে দীর্ঘ ইকার’ কোন একক শব্দ নেই। ‘কয়ে হ্রস্ব ইকার’ দিলে যে অর্থ প্রকাশ করে ‘কয়ে দীর্ঘ ইকার’ দিয়ে সেটিই প্রকাশিত হয়। ‘তোমার নাম কি?’ এবং ‘তুমি কি খেয়েছ?’ দুটোতেই তারা এখন ‘দীর্ঘ ইকার’ দিচ্ছেন। একি স্বেচ্ছাচার! বাংলা সম্পর্কে না জানা সত্ত্বেও, শুধুমাত্র আমি বাংলা বিভাগে পিএইচডি করেছি বলে আমাকে কেউ অধিকার দেয়নি বাংলা বানান সংস্কার করার। বানান মানে যা দিয়ে বানানো হয়। আক্ষরিক অর্থে। ঐ যে দর্শন মানে—দেখা। আমরা এখন ইউরোপ থেকে আমদানি করেছি ‘ফিলোসফি’ শব্দটি। দর্শনের বদলে আমরা দুচোখ বন্ধ করেছি।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: কেউ বানানের অর্থ জিজ্ঞেস করলে বলি, বানান হচ্ছে মিনিং। যা দিয়ে বানানো হয়—এই অর্থে আমরা যাই না।
সলিমুল্লাহ খান: ‘অর্থ’ মানে টাকা, ‘অর্থ’ মানে মিনিং। তাহলে ‘কি’ শব্দের বানান বদলান কেন? ‘বর্ণ’ শব্দটি দেখুন। ‘বর্ণ’ মানে [হিন্দু সমাজের] কাস্ট। আর ‘বর্ণ’ মানে রং। ‘বর্ণ’ মানে আমাদের ভাষার অক্ষর। আরও বহু অর্থ আছে এই শব্দের। এতে কি বানান বদলাতে হয়? একটি শব্দ প্রয়োগ অনুসারে নানান অর্থ গ্রহণ করতে পারে। এই সত্য তাঁরা জানেন না (বা মানেন না)। চোখের সামনে তাঁরা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আসেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ক’য়ে দীর্ঘ-ই-কার দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের এ প্রস্তাবকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে প্রত্যাখ্যান করেছিল, এমন একটা যুক্তি দিয়ে যার বিরুদ্ধে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও দাঁড়াতে পারেননি। সেই প্রত্যাখ্যাত যুক্তি পঞ্চাশ বছর পরে কেন পুনরুদ্ধার করছেন তাঁরা?
ইংরেজি মাধ্যমকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাপানোর চেষ্টা জাতীয়ভাবে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। কিন্তু কিছু বলছেন না কেউ। এ কথা ঠিক, একটি অচল ঘড়িও দিনে এক কি দুই বার সঠিক সময় দেয়। বর্তমান সরকারও এমন সঠিক কাজটি করেছেন নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক প্রভৃতি বিভাগ বিভাজন তুলে দিয়ে। যতদিন এই বিভাজন কায়েম ছিল অর্থাৎ প্রায় ষাট বছর কেউ কোনদিন প্রতিবাদ করেননি। এই দুরবস্থাটি পাকিস্তান আমলে চালু হয়েছিল। অষ্টম শ্রেণির পর থেকে পৃথিবীর কোনো দেশেই এই গ্রুপ বিভাজন করা হয় না। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও হচ্ছে না।
এরকম আরো ভুল বিস্তর আছে। গরীবের সন্তানের জন্য নন-ফর্মাল এডুকেশন বা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করেছেন। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আমাদের মিসকিনের জাত মনে করেন বলেই এমনটি হচ্ছে। নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার জন্য এবং সংবিধান লঙ্ঘন করার ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা এগুলো করেন। তাঁরা কিভাবে এই সিদ্ধান্ত নেবেন—কতক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়লে তাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে? কতক শিক্ষার্থীর বেলায় একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি না শেষ করলে শিক্ষা পূর্ণ হবে না? এমন পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব একই দেশে থাকে কিভাবে? এসব নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। এজন্য বলছি আমাদের দেশ এখন বুদ্ধিজীবী বিহীন হয়ে গিয়েছে। আমাদের কোনো শিক্ষক নেই। পূর্বে উল্লেখ করেছিলাম, ‘দি এডুকেটর হিমসেলফ নিডস টু বি এডুকেটেড’। শিক্ষকেরও শিক্ষার প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমি এখন অসহায়বোধ করি। কার কাছ থেকে শিখব? চোখে অন্ধকার দেখি, অন্ধ বোধ করি।
আপনি বিদেশিদের মূল্যায়নের কথা বললেন। এগুলোতে আমি আস্থা রাখি না। এগুলো অসম আলোচনা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এনডাউনমেন্ট ফান্ড ত্রিশ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এর সঙ্গে আমরা কিভাবে নিজেদের তুলনা করব? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ বছর চাকুরি করলেও এক সেমেস্টার সবেতনে ছুটি দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। শিক্ষকেরা পড়াশোনা করবেন কিভাবে? আমাদের বলা হচ্ছে গবেষণা করুন। অথচ আমাদের এখানে গড়ে উঠছে পড়ানোর বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় নয়।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: আমরা তো দেখছি, গবেষণা ও গবেষণা প্রবন্ধ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষা প্রকাশনা দিয়ে ভরপুর প্রতিষ্ঠান।
সলিমুল্লাহ খান: এগুলোকে গবেষণা বলে না। এসব গবেষণার নিকুচি, কু-গবেষণা। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকা’ পঞ্চাশ বছর যাবত প্রকাশিত হচ্ছে। এখানে প্রকাশিত দশটি প্রবন্ধের কথা বলুন যা এখনও লোকে পড়বে। যে গবেষণা প্রবন্ধ জন্মের আগেই মারা যায় তাকে গবেষণা বলা যায়? এখন দুয়েকজন অধ্যাপককে গবেষণা প্রবন্ধে নকলের অপরাধে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা শাস্তি এড়িয়েছেন, এভয়েড করেছেন, তাঁদের প্রকাশনায়ও অনুসন্ধান করলে এমন অসংখ্য নকল ধরা যাবে। আমি ছাত্রজীবনেও শনাক্ত করেছিলাম যে, কতক শিক্ষক নকল করে আর্টিকেল লিখেছেন, বই প্রকাশ করেছেন।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: আমরা অনেক সময় দেখি শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় নকল করেন। আবার এমনও দেখেছি, অনেক শিক্ষকও নকল করেন। এ বছর ‘বিলাসীর চরিত্র’ পরীক্ষায় এলে পরের বছর ‘হৈমন্তীর চরিত্র’ পরীক্ষায় আসবে। অথচ ছাত্রদেরকে নকল করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শিক্ষক হিসেবেও আমরা প্রশ্ন নকল করি। শিক্ষার্থীরা উত্তর নকল করে। এই দুয়ের মাঝে তেমন পার্থক্য নেই।
সলিমুল্লাহ খান: ধরুন, বাংলাদেশে দশ কোটি ভোটারের জন্য একটি জরিপ হবে। দুই থেকে আড়াই হাজার লোকের স্যাম্পল নিয়ে একটি রায় দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তাই হয়। একটি সাধারণ স্যাম্পল নিয়ে কি আমরা পুরো পপুলেশনের রায় কি হতে পারে তা বলতে পারি না? পারি। পরীক্ষাও তাই। একজন শিক্ষার্থীকে আপনি পরীক্ষা করছেন—সে পুরো বই পড়েছে কিনা। আপনি তাকে আকস্মিক পদ্ধতিতে বা র্যান্ডমলি তিনটি পৃথক জায়গা থেকে প্রশ্ন করবেন। তাহলে তাকে বুঝতে পারবেন। এজন্য আমরা সেমেস্টারের মধ্যেই বাড়ির কাজ বা অ্যাসাইনমেন্ট দিই, সেমেস্টার শেষে পরীক্ষা নিই। একজন মনোযোগী শিক্ষক যে প্রশ্নই হোক না কেন শিক্ষার্থী কিভাবে উত্তর লিখছেন দেখে তার মেধার মূল্যায়ন করতে পারেন।
গোটা বইয়ের ওপর শিক্ষার্থীর দখল রয়েছে কিনা আমরা তো তাই জানতে চাই। এতগুলো পরীক্ষার পরেও শিক্ষক যদি বুঝতে না পারেন—ভুলগুলো কোন ধরনের—তবে ধরে নিতে হয় শিক্ষকের নিজেরই জানাশোনায় গলদ রয়েছে। কেউ যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঠিকভাবে না পড়েন তিনি উপরের ক্লাসে ক্রমশ দুঃখই পাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বাছাই করে আমরা ভালো ভালো শিক্ষার্থী ভর্তি করাই। তাহলে পরীক্ষার সময় নকল কোথা থেকে আসে? আমরা শিক্ষার ভেতরে অনেক ফাঁক বা গ্যাপ রেখে দিয়েছি। ফাঁক থেকেই ‘ফাঁকি’ কথাটা এসেছে। এটি আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির ত্রুটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্লাসে ১৬০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। সেখানে একজন শিক্ষককে মাইক নিয়ে বক্তৃতা দিতে হয়। কথা ছিল, চারজন, দশজন, পনেরো জনের ছোট ছোট টিউটোরিয়াল গ্রুপ থাকবে। ১৯২১ সালে যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম বছর শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল সাতশোর কাছাকাছি। শিক্ষকরা তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে জানতেন। ধীরে ধীরে ছত্রিশ হাজার শিক্ষার্থী হয়েছেন এখানে। শিক্ষক হয়েছেন দুই হাজার। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে কোন চেনা-পরিচয় নেই এখন।
শিক্ষার বিষয়ে তিনটি কথা বলতে হবে। শিক্ষকের গুণ, শিক্ষার্থীর গুণ এবং তাদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম। শিক্ষক বলবেন ‘তুমি এই বইটি পড়’। শিক্ষার্থী যদি না বোঝেন তবে শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করবেন। কিন্তু শিক্ষক যদি নিজেই না বোঝেন! ইংরেজি বিদ্যার গৌরব করলেও তাঁরা ইংরেজিটা পর্যন্ত যথেষ্ট শেখেননি। আজ পর্যন্ত কয়টি গ্রন্থ ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে? প্রত্যেক শিক্ষক একটি করে ইংরেজি বই অনুবাদ করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হাজার শিক্ষকের অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা হবে দুই হাজার। দশ বছরে এই সংখ্যা বিশ হাজারে পৌঁছবে।
আমাদের দেশে একসময় সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থীরা অর্থনীতিতে পড়তেন। অর্থনীতি নিয়ে লেখা প্রধান বইগুলোই অনুবাদ করা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন অ্যাডাম স্মিথ, স্যার উইলিয়াম পেটি, কিংবা কার্ল মার্ক্সের মতো ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের গ্রন্থ অনুবাদ করেন না? তাঁরা যা পড়াচ্ছেন—সেগুলো তাঁরাই বোঝেন কি-না আমার সন্দেহ রয়েছে।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: অনুবাদ হতে পারত।
সলিমুল্লাহ খান: এ কাজের ক্ষমতা তাঁদের নেই। যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলবেন, পরিভাষা নেই। এটা নেই-ওটা নেই। দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। শিক্ষকদের পরীক্ষা নিয়ে যাচাই করা প্রয়োজন যে তাঁদের লেখাপড়া ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: আমেরিকায় দুই বছর পর পর পরীক্ষা নেওয়া হয়। উত্তীর্ণ না হলে এমবিবিএস ডাক্তারও রোগী দেখতে পারবেন না।
সলিমুল্লাহ খান: আমাদের শিক্ষকরা গবেষণা করতে বিদেশে যাচ্ছেন। খুব ভালো। দেশেও তাঁরা ডিগ্রি নিচ্ছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই একটি করে বই লিখুন। তা প্রকাশ করুন। অনুবাদ করুন। বহুদিন যাবত ইংরেজি পড়ছি আমরা। ইংরেজি সাহিত্যের কতজন প্রধান সাহিত্যিকের গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়েছে? প্রকৃত কথা, আমরা ইংরেজিও ভালোভাবে শিখতে পারিনি। ইংরেজি শিখে থাকলে ইংরেজি থেকে বাংলা ও বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর কারণে আমাদের নিজেদের বইয়ের বাজার নষ্ট হচ্ছে। বাংলায় আমরা লিখছি না, কারণ বাংলা বইয়ের চাহিদা নেই। চাহিদা নেই কেন? কারণ বাংলায় পড়ানো হয় না। আমেরিকা থেকে নয়, ভারত থেকে বই আমদানি করে ইংরেজিতে পড়ানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। আমরা এখন স্লাইড বানাই। নিজেরা লিখি না। স্লাইড থেকে স্লাইডে কপি করে শিক্ষার্থীদের পড়াই। ইংরেজি হলো গোয়ালের দুষ্টু গরু। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। ফলিত-ইংরেজি বা ফাংশনাল ইংলিশ শেখার অহংকারে মাটিতে আমাদের পা পড়ছে না।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: কুশিক্ষার চেয়ে অশিক্ষা ভালো।
সলিমুল্লাহ খান: এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি প্রস্তাব দেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রী দেওয়ার জন্য বাড়তি একটি কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। বিদেশি কোন ভালো বা উপযুক্ত ভাষার গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করে উপযুক্ত ভূমিকা আর পাদটীকা বা ফুটনোট দিয়ে লিখলে গ্রন্থটিকে পিএইচডি দেওয়ার উপযুক্ত হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন মনোগ্রাফের পরিবর্তে থ্রি এসেস লেখার পদ্ধতি রয়েছে। মানসম্পন্ন বিশ পৃষ্ঠার তিনটি প্রবন্ধ হলেই গবেষকের লেখা পিএইচডির জন্য বিবেচ্য গণ্য হবে।
স্বাতন্ত্র্য প্রমাণের বহু জায়গা আছে। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুখে বলছেন আমরা গবেষণা করতে চাই। গবেষণায় বরাদ্দ যাচ্ছে। এর মধ্যেও শুভংকরের ফাঁকি আছে। অমর্ত্য সেনকে দিয়ে শুরু করেছিলাম। এজন্য নয় যে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত অভিযোগ-অনুযোগ আছে। তাঁর মানবতাবাদ এবং উদারপন্থাকে অভিনন্দন জানাই। একদিকে তিনি নৈতিকতা প্রচার করেন, কিন্তু নিজে পালন করেন না। তিনি কোনদিনও বললেন না তার এই পুরস্কারটা নোবেল পুরস্কার নয়। নিজে অনৈতিক হয়ে অন্যকে নৈতিকতা শেখানো যায় না। অমর্ত্য সেনে আমার ভক্তি নেই তখন থেকেই, যখন দেখেছি তাঁর গ্রন্থের প্রচ্ছদে লেখা হয় উইনার অব দ্য নোবেল প্রাইজ ইন ইকোনমিকস। তিনি হয়তো বলবেন তিনি এমনটি লেখেননি, প্রকাশক লিখেছেন। কিন্তু তিনি প্রতিবাদ করছেন না কেন?
এহেন ঢের মিথ্যাচারের উপর পৃথিবী দাঁড়িয়ে রয়েছে। শেষ বিচারে ধনতন্ত্রের পক্ষে যাঁরা ওকালতি করেন তাঁদের জন্য এধরনের পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। অমর্ত্য সেন নিজেও জানেন তাঁর দাদার চেয়েও বড় পন্ডিত পিয়েরো স্রাফা। নোবেল কমিটি তাঁকে কোনদিন পুরস্কার দেয়া দূরের কথা, পুরস্কারের জন্য প্রাসঙ্গিক বলেও বিবেচনা করেননি। পৃথিবী জুড়ে এই ভ্রান্তি রয়েছে।
অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ ছয়শ বছরের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়। সুইডেনের উপসলা ও আমেরিকার হার্ভার্ড—এগুলো একসময় ধর্মতত্ত্বের বিদ্যালয় ছিল। ধীরে ধীরে তাঁরা জাগতিক শিক্ষার দিকে ফিরেছেন। আমরা সেটিও পারিনি। আমাদের দেশে শিক্ষা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ইংরেজি শিক্ষাকে একদিন যাঁরা বর্জন করেছিলেন তাঁরা কওমি মাদ্রাসায় পড়েছেন। আর আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে ইংরেজি স্কুল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সেটা ভুল নয়। মাধ্যমিক স্তরে আমি যে বিদ্যালয়ে পড়েছি একসময় সেই বিদ্যালয়টির নাম ছিলো ‘মহেশখালী মিডল ইংলিশ স্কুল’। সংক্ষেপে সকলে বলতেন এম.ই. স্কুল। মিডল ইংলিশ মানে জুনিয়র। যা পরে হাইস্কুল হয়ে আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় হয়েছে। তার মানে সেটিও ছিল ইংরেজি বিদ্যালয়। নকলে বাংলায় পড়লেও আসলে ইংরেজি শিক্ষাই নিচ্ছি আমরা।
ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের নীতি বিভ্রান্ত। বিষয়ের ক্ষেত্রেও তাই। কোথায় বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু করতে হবে, কোথায় মানবিক কিছুই জানি না আমরা। আরেকটি বড় ফাঁকি হলো এই, আমরা যে সকল বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছি সেগুলো কি আসলেই বিশ্ববিদ্যালয়? এগুলো বৃত্তিশিক্ষা বা প্রফেশনাল বিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় যাকে বলা হয়—তেমন প্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।
জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় বলা হয়েছে, শিক্ষার তিনটি স্তর। প্রথম স্তরের নাম ‘এলিমেন্টারি অ্যান্ড ফান্ডামেন্টাল এডুকেশন’। বাংলায় ‘মৌলিক ও বুনিয়াদি শিক্ষা’ বা প্রাথমিক ও বুনিয়াদি শিক্ষা। জাতিসংঘ বলছেন, এই শিক্ষা ক্ষেত্রবিশেষে বাধ্যতামূলক ও সর্বত্র বিনামূল্যে হবে। তারপর শুরু হবে পেশাগত এবং কারিগরি শিক্ষা। বিনামূল্যে না হলেও এ শিক্ষা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এটিই এখন হচ্ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এম.ফিল. বা পি.এইচ.ডি.র অনুমতি এখন পর্যন্ত নেই। এর অর্থ আমাদেরকে কারিগরি এবং পেশাগত শিক্ষাতেই আটকে থাকতে হবে। এখন ফ্যাশন টেকনোলজিকেও বিশ্ববিদ্যালয় বলা হচ্ছে। এগুলো অধিকাংশই কারিগরি এবং পেশাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জাতিসংঘের ভাষায় ‘প্রফেশনাল এবং টেকনিক্যাল এডুকেশন’। এরপরে থাকে উচ্চশিক্ষা। সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা রয়েছে। সাহিত্যে, মেডিসিনে ও প্রকৌশলে। আমাদের দেশে এটা কম আছে। জাতিসংঘের হিসাবে উচ্চশিক্ষা কেবল মেধাবীদের জন্য সীমিত হবে তবে জাতিগত বা অন্য কোন বৈষম্য দেখানো যাবে না।
এই অল্পশিক্ষা দিয়ে আমরা কিভাবে হার্ভার্ড আর অক্সফোর্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যাব? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার বিশ্ববিদ্যালয় নয়। আপনাকে জোর করে বলা হচ্ছে আপনি বেশি বেশি গবেষণা পাবলিশ করুন। আমি তখন নকল (প্লেজারিয়াজম) করতে বাধ্য হচ্ছি। অফিশিয়ালি বলা হচ্ছে বছরে বা এক সেমিস্টারে এত সব প্রকাশনা সম্পাদন করতে। একজন প্রভাষক এতগুলো কোর্স পড়ান। বছরে তিনটি সেমিস্টার চলছে। তবে তিনি এত গবেষণা লিখবেন বা প্রকাশ করবেন কিভাবে?
সৈয়দ মিজানুর রহমান: লিখতে হলে তো শিক্ষার্থীকে ফাঁকি দিতে হবে।
সলিমুল্লাহ খান: অতএব আমরা সময় চুরি করে গবেষণা করছি। যৌবনে চুরি করা যায়। রাত বারোটা থেকে লিখতে বসে ভোর পর্যন্ত আমি নিজেও অনেক কাজ করতাম। বেঁচে থাকার জন্য।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: যৌবন চুরি।
সলিমুল্লাহ খান: এখন বয়স হয়েছে। সম্ভব হয় না।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: আপনার বক্তব্যে ভাষা এবং বিষয় স্পষ্ট হয়েছে।
সলিমুল্লাহ খান: আরেকটি কথা বলেছি শিক্ষার স্তরবিন্যাস নিয়ে। সর্বজনীন বুনিয়াদি শিক্ষা খুব দরকার। এটি সর্বজনীন হলে কারিগরি শিক্ষা নেবে অনেক মানুষ। এক্ষেত্রে মেধার প্রশ্ন তুলব না। মানুষ যে দেশে জন্মেছে সে দেশের ভাষায় কথা বলতে পারে। অতিরিক্ত মেধাবী লোক কথা বলতে পারে, বোকা লোক কথা বলতে পারে না—বিষয়টি এমন নয়। মানুষ মাত্রই প্রতিভাবান।
আমরা উচ্চশিক্ষা কাকে দেব? মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে উচ্চশিক্ষা সীমিত করতে হবে। সবাই উচ্চশিক্ষায় যাবেন না। অনেকে পেশায় প্রবেশ করবেন। আমাদের দেশে বর্তমানে সকল প্রফেশনই এখনো পুরনো দিনের পেশা ওকালতিতে আটকে রয়েছে। আপনার বাপ উকিল না হলে শ্বশুরকে উকিল হতে হবে। নয়তো ওকালতিতে প্রবেশ কঠিন।
জাতিসংঘের দলিলে বলা হয়েছে, টেকনিক্যাল অ্যান্ড প্রফেশনাল এডুকেশন শুড বি জেনারেলি এক্সেসিবল উইদাউট ডিসক্রিমিনেশন। এখানে মোটেও মেধার প্রশ্ন নেই। মাত্র উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে তা ‘জেনারেলি এক্সেসিবল’ হবে না। তবে হবে ‘উইদাউট ডিসক্রিমিনেশন অন দি ব্যাসিস অব মেরিট’। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ নেই। সেজন্য অযথা ভর্তি পরীক্ষার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এটি স্রেফ অপচয়। যে সকল শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবোর্ড থেকে সনদ দেওয়া হয়েছে তাঁদের অধিকার রয়েছে কোন না কোন পেশাগত বা কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। মনে রাখার দরকার আছে, এখন যে পরীক্ষাকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাড়পত্র পরীক্ষা বলা হয়, তার নাম আগে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষা—ইংরেজি ‘ম্যাট্রিকুলেশন’ শব্দের মানে তাই। পরে বলা হতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশিকা বা এন্ট্রান্স পরীক্ষা।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: মনোনয়ন।
সলিমুল্লাহ খান: অবশ্যই। এখন বলা হচ্ছে বেশি পাশ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন নেই। আসন তৈরি করা রাষ্ট্রের কাজ। এখানে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বেরও বিষয় রয়েছে। তখন বলবে এত শিক্ষা আমাদের প্রয়োজন নেই। পরিবার পরিকল্পনা করতে করতে তাঁরা এতদিনে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার প্রায় শূন্যের কোটায় নিয়ে এসেছেন। রিপ্লেসমেন্ট রেটের কাছাকাছি। এর পরে জনসংখ্যা কমতে থাকবে। রাষ্ট্র কর্মসংস্থান করতে পারছে না তবু মানুষকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, ব্যবসা করেন। উপর পর্যায় থেকে উপদেশ আসে ব্যবসা করবেন, চাকরি খুঁজবেন না। এটি কাঠামোগত ব্যর্থতা বা ডিসফাংশন। তাহলে এই জনসংখ্যা কি করবে? বিদেশে যাওয়া যাবে না। বিদেশ তালাবদ্ধ। গ্লোবালাইজেশন মানে মোবিলিটি। তবে আমাদের দিক থেকে এই মোবিলিটি জনসংখ্যার নয়, কেবল পুঁজির।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: ক্যাপিটালের আরেকটি অর্থ রয়েছে। বিদেশি পণ্য আমার দেশে আসতে পারবে। আমরা যেন ভোক্তা হয়ে উঠতে পারি।
সলিমুল্লাহ খান: তা বটে। আমাদের দেশ তাঁহাদের সংরক্ষিত বাজার হয়েছে। যথা প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাজার। আমরা শুনলাম ভারত বাংলাদেশকে টিকা উপহার দিয়েছে। উপহার বলা হচ্ছে কেন? তারা তো বিক্রিই করছেন। আমাদের রাস্তার পাশের রেস্তোরাঁয় একবার খাওয়ার পর আরেকটু তোলা খাওয়ানোর মতো। আমাদেরকে শিশু হিসেবে ট্রিট করা ঠিক নয়। তিন কোটি ডোজ আনা হবে। পয়সা আগাম দিয়ে দিয়েছি। কিছু কমিশন দিয়েছেন মাত্র। আপনি এটিকে উপহার বলছেন কেন? আগাম বা ছাড় বলতে পারেন। ভাষার ব্যবহার বিষয়ে বলছি। গরীবকে অসম্মান করা হয় এসব বলে।
আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো শতকরা একশো ভাগ শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়নি। আমরা উন্নতির নানারকম পোস্টার দেখি। আমরা আনন্দিত, আমাদের পদ্মাসেতু হয়েছে। আরও তিনটি পদ্মাসেতু হওয়া উচিত। এগুলো প্রয়োজনীয় কাজ। অনেক আগে হওয়া উচিত ছিলো। এই পদ্মার উপরেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়েছে একশো বছরেরও বেশি আগে। ১৯১৫ সালে। লেখাপড়ায় কি হয়েছে? ইংরেজরা দুইশো বছরে এদেশের শতকরা ছয়জন লোককে স্বাক্ষর করেছিলেন। আমরা চুয়াত্তর জনকে করেছি। স্বাক্ষর-দস্তখত করতে পারে এমন।
শিক্ষার দর্শন হলো এই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান—শিক্ষা সকলের জন্য, না মাত্র কয়েকজনের জন্য? আমরা এখন কয়েকজনের শিক্ষানীতিতে আটকা আছি। এই অবস্থাকে তাঁরা বলেন—শিক্ষার গুণগত মানবৃদ্ধি। মানুষের প্রাণ বাঁচাতে হবে। ভাতের শিক্ষা, কাপড়ের শিক্ষা দিতে হবে। তারপর সাড়ে তিন হাত দেহের জন্য সাড়ে তিন হাত স্থান যথেষ্ট না—সে ব্যাপারেও শিক্ষা দিতে হবে।
লোকে বলে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞানের মত শব্দগুলো আমরা ভারতীয় নানাভাষার পুরনো শব্দভাণ্ডার থেকে ধরে এনেছি। আরবি আলকিমিয়া—লাতিন ‘আলকেমি’ হয়ে—ইংরেজিতে কেমিস্ট্রি হয়েছে। ভারতে এনে আমরা রসায়ন করেছি। গ্রীসে বলা হয় ফিলোসোফিয়া। ‘সোফিয়া’ মানে জ্ঞান, জ্ঞানের প্রেম। বাংলায় এর কাছাকাছি অনুবাদ হলো ‘তত্ত্বজ্ঞান’। তত্ত্ব মানে অনুসন্ধান। তত্ত্বদর্শন মানে তত্ত্বজ্ঞান। বাংলাদেশে ভারতীয় আঙ্গিকে ‘দর্শন’ শব্দ প্রচলিত। ফলে ফিলোসফির অর্থ কেন দর্শন তা শিক্ষার্থীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমাদের বর্তমান শিক্ষা হলো এই ধরনের কার্যকারণহীন ভুয়া শিক্ষা। লাঠি দেখিয়ে বলেন—আমি তোমাকে উচিত শিক্ষা দেবো। আমাদের এখন ‘উচিত শিক্ষা’ হচ্ছে।
শিক্ষা শব্দটির বহু রকম অর্থ রয়েছে। ভাষার মধ্যে বিভিন্ন রেজিস্টার রয়েছে। যেমন—তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। তিনি মৃত্যুবরণ করিলেন। তিনি পরলোকগমন করিলেন। তিনি ইন্তেকাল করিলেনও বলতে পারেন। ইন্তেকাল করা মানে স্থানান্তরিত হওয়া, যেমনটা আরবিতে বলে। কারণ মানুষ কখনো মরে না। এই জগত থেকে অন্যজগতে যায়। এ তো অতি উঁচুমানের সভ্যতার কথা। আপনি হয়তো বলবেন, এটি সাম্প্রদায়িক হয়ে গেল। সাম্প্রদায়িক হবে কেন? এটিই তো সভ্যতা। কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিলেন তিনি মরেন নাই। বাংলা ভাষার কত সম্পদ রয়েছে। এসব না বলে তারা বলেন, বাংলায় এটা বলা যায় না, ওটা বলা যায় না। তারা সব বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের পূজা করেন, শুদ্ধমাত্র ‘কয়ে দীর্ঘ ইকার’ বানান দেওয়ার জন্য।
‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান’—আজ সেই সত্য কোথায় গেল? নিউজিল্যান্ড থেকে অ্যাংকর দুধ আমদানি করে খাওয়ানো হচ্ছে। তাতে মেলামাইনের পরিমাণ বারো শতাংশ হলে প্রথম আলো লেখে এটি বিপদসীমার নীচে রয়েছে। যে দেশে বড় দুর্নীতি বিদ্যমান সেখানে শিক্ষায় দর্শন কোথা থেকে আসবে! ৭১-এর চিঠি প্রকাশ করে কি মেলামাইন খাওয়ানোর পাপটা লুকানো যাবে? বর্তমান মিডিয়া বা তথাকথিত সিভিল সোসাইটি সকলেই ভাবের ঘরে চুরি করছেন।
শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে হবে। সবাইকে শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। এজন্য দেশীয় ভাষার বিকল্প নেই। অন্তত প্রথম বারো বছর পর্যন্ত। তারপর কারিগরি শিক্ষা। এই সত্যটা সকলেই লুকোনোর চেষ্টা করছেন। যেগুলো এখন বাংলায় করা সম্ভব নয় সেগুলো ইংরেজিতেই করতে হবে। ডেল্টা পরিকল্পনা বা ২০৭১ পরিকল্পনার ভেতরে সেগুলোকেও পরবর্তীকালে বাংলায় প্রচলনের কথা উল্লেখ রাখতে হবে। শিক্ষা ক্রমশই ইংরেজির দিকে নেওয়া হলে শিক্ষার মান বাড়বে কিভাবে!
বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতার মানে হচ্ছে বিশ্বকে অনুসরণ করা। বিশ্বকে অনুসরণ করার অর্থ ইংরেজির অনুসরণ নয়। মাতৃভাষায় শিক্ষা নিয়েই জাপানিরা এতদূর এগিয়েছেন। তাঁরা ইংরেজি, জার্মান, ফরাশি, রুশভাষাও শিখেছেন। বছর বছর দলে দলে লোক পাঠিয়েছেন বিদেশে। উনিশ শতকের আশির দশক থেকে। এই উদ্যোগের সুফলও তাঁরা পেয়েছেন। রুশেরা যে সকল স্পেস স্টেশনের দায়িত্বে রয়েছেন সে সকল স্টেশনের আন্তর্জাতিক ভাষা দুটি—ইংরেজি ও রুশ।
জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে ২০০৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি এটি। এজন্য এখন অনেক আনুষঙ্গিক কাজ আমাদেরকে করতে হবে। সর্বপ্রথম নিজের দেশে সর্বস্তরে—লেখাপড়ার ক্ষেত্রে—বাংলা চালু করতে হবে। আরব দেশগুলোর দাবির মুখে জাতিসংঘে ১৯৭৩ সালে আরবিকে দাপ্তরিক ভাষা করা হয়েছে। জাতিসংঘের আদি ভাষা ছিল ইংরেজি ও ফরাশি। এখনো জার্মান-জাপানিকে গ্রহণ করা হয়নি। যুক্ত হয়েছে রুশ, চীনা, হিস্পানি ও আরবি। সপ্তম ভাষার পদে বাংলার প্রতিদ্বদ্বী হিসেবে রয়েছে তুর্কি, হিন্দি, মালয় ও আরো আফ্রিকার কিছু ভাষা।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: আপনার কথা যুক্তিনির্ভর। ভেতরে কোনো আবরণ নেই। আপনি যদি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য আরো কিছু বলতে চান।
সলিমুল্লাহ খান: শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টি হলে কঠিন বিষয়ও সহজ হয়ে যায়। দোষ শিক্ষার্থীদের নয়, শিক্ষা-ব্যবস্থার। প্রয়োজন শিক্ষা-ব্যবস্থার সংস্কার। আমাদেরকে শিক্ষার লক্ষ্যটা কি তা পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করতে হবে। শিক্ষার বিষয় যেন শিক্ষার্থীদের মাঝে আগ্রহের উদ্দীপন করে।
আমরা এখন শিক্ষার্থী কথাটি চালু করেছি। ‘শিক্ষার্থী’ শব্দটি ব্যাখ্যামূলক শব্দ হিসেবে মন্দ নয়। প্রাচীন ‘ছাত্র-ছাত্রী’র মত দুইবার বলতে হয় না। কিন্তু ছাত্র-ছাত্রী শব্দটা কি দোষ করেছে? ছত্র মানে ছাতা। আগে নিয়ম ছিলো, একজন শিক্ষকের বাড়িতে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে পড়বেন। ছাতার নীচে এলে ছায়া পাবে—এই আহ্বান যিনি জানান তিনি হলেন ‘ছত্রী’ অর্থাৎ শিক্ষক। ছাত্র হলেন তিনি যিনি ছাতার নীচে বসবেন। মিউজিক একাডেমিতে এখন মানুষ গান শেখে। নানা ঘরানা সম্পর্কে শিখতেন। আগে মানুষ গুরুর বা ওস্তাদের ঘরে গিয়ে শিখতেন। পাঞ্জাবের পাতিওয়ালা থেকে মধ্যপ্রদেশের মাইহারে—যেখানে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর আবাস—এখনও সেখানে গিয়ে শেখে। শিক্ষা আগে এমনই ছিল। ঘরানা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে।
আগের আইডিয়া ছেঁটে ফেলার দরকার কি? ছাত্র বলতে অসুবিধা কোথায়? জেন্ডার বায়াসড মনে হলে ছাত্র-ছাত্রী বলেন। আমাদেরকে এখন শিক্ষক বলা হচ্ছে। গুরু বললে পছন্দ হতো না। ইংরেজদের কাছ থেকে শিখেছি মাস্টারমশাই। এখন এটিকে আমরা শিক্ষকে নিয়ে গিয়েছি। এর চেয়েও কঠিন শব্দ চালু করেছি আমরা—অধ্যাপক।
আমরা ডক্টর অব ফিলোসফি ডিগ্রি দেই। একে পিএইচডি বলা হয়। ডক্টর অব সায়েন্সকে ডিএসসি বলে। অক্সফোর্ডে বলে ডিফিল বা ডক্টর অব ফিলোসফি। এই ডক্টরের বাংলা অনুবাদ করার সময় আমরা ডক্টরই লিখি। মেডিকেলে পড়ে কেউ যখন এমবিবিএস ডক্টর হন আমরা তাকে বলি ডাক্তার। একই ইংরেজি শব্দ বাংলায় এসে দুইভাগ হয়ে যায় কিভাবে? দেখুন অষ্টাদশ আর ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান কবি গ্যেটে যখন ‘ফাউস্ট’ লিখলেন তখন শুরুতে ফাউস্ট চরিত্রের ভাষ্য: ‘আমি অনেক বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। মেডিসিন, ফিলোসফি, আইন, থিওলজি ইত্যাদি।’ বলে, ‘এগুলোতে আমি ডক্টর হয়েছি।’
ডক্টর কথাটি ইউরোপ থেকে আমরা পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ডাক্তার বললে তাঁরা অপমান বোধ করেন। ডক্টর বলতে হবে। বাংলা বিভাগের ডক্টররা ‘ড’ এ ডট দিয়ে লেখেন না। পুরো ‘ডক্টর’ লিখতে হবে। ডক্টর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন। ডক্টর সৈয়দ আকরম হোসেন। ডক্টর অমুক, ডক্টর তমুক। হীনমন্যতা কত প্রকার ও কি কি তা আমাদের শিক্ষার্থীরা শেখেন শিক্ষকদের কাছ থেকে। এজন্য শিক্ষার সংস্কার জরুরি। আমরা শিক্ষকরা চাকর মাত্র। ব্যবস্থার চাকর। এই অবস্থা বদলাতে শিক্ষার সংবিধান বা শিক্ষানীতি বদলাতে হবে। আজ আমাদের শিক্ষার কোন সত্যকার নীতি নেই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন নিয়ে কথা হচ্ছে। দেশীয় মূল্যায়ন কতদূর? আন্তর্জাতিক মানে কত হলো তা পরের বিষয়। দেশে আপনার অবদান কি? বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট তৈরি করেছেন, গ্রাজুয়েটরা চাকরি করছেন—এটি বলাবাহুল্য। স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক অবদান আছে আমাদের। অপরাজেয় বাংলা তৈরি করে আমরা সেটি স্মরণ করি। আমাদের সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, বিদ্যাচর্চায়, ভাষাচর্চায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কি বা কতটুকু! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একশ বছর পার করে একশটি ভালো বাংলা গ্রন্থ প্রকাশ করতে পেরেছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিপুল ব্যর্থতার কথা না বলে শতবর্ষ উদযাপন কি লজ্জাজনক নয়?
আমার একজন বন্ধু রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তাব্যক্তি। তিনি আমাকে বললেন, শতবর্ষ উপলক্ষে যে বক্তৃতামালা সেখানে তুমি একটি বক্তৃতা দাও। তিনি আমার নাম প্রস্তাব করেছেন পাঁচটি কমিটিতে। অন্যরা বিরোধিতা করে বলেছেন, তাকে তো ডাকা যাবে না, কারণ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী। পদাধিকারবলে তবু তিনি ডেকেছেন। টপিক হলো ‘দি ইউনিভার্সিটি অব দি ফিউচার।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তো বর্তমানই ঠিক নেই। বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান থাকলেই না ভবিষ্যৎ ঠিক হবে।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: যথার্থ বলেছেন।
সলিমুল্লাহ খান: বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রাখিনি। তাকে উচ্চবিদ্যালয়ের চেয়েও নীচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে কি পড়ানো হয়? সবাই বিসিএসের বই-নোটবই পড়ে। এগুলো এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য কোথায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে আগা মাহদী হোসেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রমেশচন্দ্র মজুমদার, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ ও ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতন শিক্ষকরা পড়িয়েছেন। এখন এমন পণ্ডিত বিজ্ঞাপন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের লন্ঠন দিয়ে সূর্য দেখানো হচ্ছে।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: যদি অযোগ্য ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন তবে তাঁর দায়িত্ব হলো আরো অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে নিজের অবস্থানটা ঠিক রাখা। একটি শেকলের মতো, একটির সঙ্গে আরেকটি। শব্দ আর ভাষার প্রয়োগ প্রশ্নে আপনি বলেছেন। আমাদের মামা, চাচা, ফুপা—প্রত্যেকটির আলাদা অর্থ রয়েছে। এখন আংকেল দিয়ে পুরো কভার করছে। যেমন বাংলায় ডক্টর হবে নাকি ডাক্তার হবে? এ যেন আমাদের নিজস্ব শব্দগুলোকে একটি ইংরেজি শব্দের আবরণ দিয়ে ঢেকে দেওয়া।
সলিমুল্লাহ খান: রসিক লেখক প্রমথ চৌধুরী ও সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ বলেছেন, ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়। এগুলো ব্যাধিই হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশ থেকে ফল পেড়ে আনলেও রাখবেন কোথায়? ঝুড়ি লাগবে। ইংরেজি থেকে বিদ্যা আহরণের কথা বলা হচ্ছে। ইংরেজি তো দুয়েকদিনে সমৃদ্ধ হয়নি। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তুচ্ছ করে বলেছিলেন—আন্তর্জাতিক তলাফুটো ঝুড়ি। অর্থনীতিতে আমরা সক্ষমতা প্রমাণের চেষ্টা করেছি। মনের ক্ষেত্রে তা প্রমাণ করতে পারিনি। নিজের ভাষায় বিদ্যা ধারণ করতে না পারলে বিদেশি ভাষার চাপে পড়ে নষ্টই হবে। এজন্য আংকেল বলছি, আন্টি বলছি। আংকেল-আন্টি সুন্দর শব্দ। আমাদের প্রতিবেশী ভারতীয় হিন্দি শব্দ ‘আয়া’ ইংরেজিতে যুক্ত হয়েছে। পর্তুগিজ শব্দ চাবি, সাবান, বালতি ও বোতাম আমরা নিয়েছি। কৃপণতা করিনি। ইংরেজি থেকে নেওয়ার বিরোধীও নই আমরা। প্রশ্ন হলো, বাংলা শব্দ বাদ দেব কেন? ইংরেজি থেকে ‘নার্স’ নিতে হবে কেন, বাংলায় ‘সেবক’ ও ‘সেবিকা’ থাকতে? আবার কম্পিউটারকে গণনাযন্ত্র বলার দরকার নেই। ম্যাথমেটিশিয়ানদের এখন ‘গণিতবিদ’ বলছি। সুন্দর বাংলা শব্দ।
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে রাজেন্দ্রলাল মিত্র আর শ্যামাচরণ গাঙ্গুলী হয়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পর্যন্ত বাংলা ভাষাচিন্তার যে উন্নতি হয়েছে আমরা সেই ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলবো কেন? বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দ থেকে যা এসেছে—বেতমিজ, গরহাজির—এগুলো তাড়ানো ঠিক নয়। আবার বাংলা ভাষার প্রাণ সংস্কৃত শব্দের ভাঁড়ার। বাংলা তো ইংরেজি, জার্মান, ফরাশি ভাষার মতোই শক্তিশালী। এ ভাষাকে না জেনে না বুঝে উচ্চশিক্ষার উপযোগী নয় বলা পাপ বটে। ধর্মীয় নয়, ঐতিহাসিক পাপ।
সৈয়দ মিজানুর রহমান: অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
সলিমুল্লাহ খান: আপনারাও ভালো থাকবেন। সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কারো কারো মনে কষ্ট হতে পারে। আমার জবান খুব একটা মিষ্ট নয়।