স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। দেশের করোনা পরিস্থিতি, সংক্রমণ মোকাবেলায় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা, লকডাউন, সংক্রমণের নতুন ধরন ও এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণসহ কয়েকটি বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে আলাপ করেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।
সংবাদ প্রকাশ: করোনা মোকাবেলায় সরকার একাধিকবার লকডাউন দিয়েছে, এখনো লকডাউন চলছে। সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন বলে মনে করেন কি?
বে-নজির আহমেদ: পারেনি তো বটেই। বরং ২০২০-২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিলে যে করোনা পরিস্থিতি, তারচেয়ে মৃত্যু ও আক্রান্তের দিক থেকে এখনকার অবস্থাটা আরো ভয়াবহ। এবারের চিত্রটা অনেক ভিন্ন। আগে শহরে হতো, এবারে গ্রামে। এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, এটা নিয়ে সারা দুনিয়া চিন্তিত। যে দেশগুলো অনেক টিকা দিয়েছে যেমন যুক্তরাজ্য সেখানে পর্যন্ত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে আবার সংক্রমণ বেড়ে গেছে। কাজেই আমরা করোনা যথার্থভাবে মোকাবেলা করতে পারিনি।
সংবাদ প্রকাশ: কেন পারিনি?
আহমেদ: না পারার প্রথম কারণ হল আমাদের নেতৃত্বে সমস্যা। করোনা মোকাবেলায় নেতৃত্বটা দেওয়া উচিত ছিলো জনস্বাস্থ্যের পক্ষ থেকে। ২০১৮ সালের সংক্রামণ রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধ আইন আছে সেখানে কিন্তু ন্যাশনাল এডভাইজারি কমিটির প্রধান হলেন মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিন্তু এই কমিটির আমরা কার্যক্রম দেখলাম না। আমরা বিধিবহির্ভূতভাবে আরেকটা পরামর্শক কমিটি করলাম যেটার প্রধান একজন শিশু বিশেষজ্ঞ। এবং এই কমিটির তেমন কোনো ক্ষমতাও নেই। তারা শুধু পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু আন্তঃমন্ত্রণালয় পরামর্শক কমিটির প্রধান যদি মন্ত্রী থাকত এবং সেখানে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো ওটা পরামর্শ হতো না, সেটা হতো সিদ্ধান্ত এবং সেটা অবশ্যই বাস্তবায়ন হতো। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটা জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি হওয়ার কথা ছিল। সেই টেকনিক্যাল কমিটির কাজ ছিল জাতীয় পরামর্শক কমিটি যে সিদ্ধান্তগুলো দেবে তারা সেটা বাস্তবায়ন করবে, কিন্তু সেটাও কার্যকরী না। এই দুটো কমিটি ঠিক না হওয়ার ফলে আমাদের কখনোই কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে না।
মন্ত্রী মহোদয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা থাকলেও আমরা সেটা দেখিনি। কখনো নেতৃত্ব দিয়েছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী, কখনো মন্ত্রী পরিষদ সচিব, কখনো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী। কেননা উনারা বাধ্য হয়ে দিয়েছেন। ইদানিংকালে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু ২০১৮ সালের যে সংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ আইন আছে সেখানে লকডাউন থেকে শুরু করে যাবতীয় বিধিনিষেধ এবং কেউ না মানলে তার জরিমানা ইত্যাদির দায়িত্ব হলো স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের অথবা তার প্রতিনিধি সিভিল সার্জন অথবা এইচএপি’র। কিন্তু সেখানে প্রধান হয়েছেন কে? ডিসি অথবা ইউএনও। সব মিলিয়ে আমরা যে কাজটা ভালোভাবে করার কথা সেটা ঠিকমতো করতে পারছি না। কারণ উনারা কারিগরী দিক থেকে জনস্বাস্থ্যের লোক না। সুতরাং যখন কোনো লকডাউন দরকার পড়ছে, উনারা বুঝতে পারছেন না যে কী দরকার। সিভিল সার্জন ডিসিকে অনুরোধ করছেন। কখনো অনুরোধ রাখছেন, কখনো রাখছেন না। সেজন্য আপনি খেয়াল করে দেখবেন কোথাও লকডাউন আগে হয়েছে যেমন কক্সবাজারে, আবার চাপাইনবাবগঞ্জে, যেখানে অনেক আগে হওয়ার কথা ছিল, সেখানে পরে হয়েছে।
সংবাদ প্রকাশ: সেনাবাহিনীকেও এ কাজে যুক্ত করতে অনেকে মতামত দিয়েছিলেন।
আহমেদ: দেখুন, সেনাবাহিনী যখন কোনো কিছুর দায়িত্ব নেয়, সেনাবাহিনীর একটাই কাজ— অর্ডার অ্যান্ড ফলো। তার মাঝামাঝি কিছু নেই। সুতরাং এই দায়িত্বটা যদি সেনাবাহিনী নিত, তাহলে আমরা সেখানে যা যা চাইতাম তার বাস্তবায়ন দেখতাম। যেমন ধরুন লকডাউন। সেখানে এতটুকু ব্যত্যয় ঘটতো না। সেনাবাহিনী নিলে আরেকটা সুবিধা হতো। বিভিন্ন গোষ্ঠী তারা সরকারকে চাপ দিয়ে প্রতিষ্ঠান খোলা রাখে। যেমন গার্মেন্টস, প্রত্যেকবার খোলা রাখে। দোকান মালিক সমিতি চাপ দিয়ে দোকান খোলে। কিন্তু সেনাবাহিনী যদি থাকতো তা হতো না। আরেকটা হলো কোয়ারেন্টিন। বিদেশ থেকে যারা আসছে তারা অনেকে কোয়ারেন্টিন মানেননি। সেনাবাহিনী থাকলে না মেনে কোনো উপায় ছিল না। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কথা যদি বলেন তারা শুধু টিকা দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে নিয়ে এসেছে। সেনাবাহিনী আমাদের একটি সুসংগঠিত বাহিনী এবং খুবই ভালো। আমি এ জন্য একমসয় বলছিলাম ‘স্বাস্থ্য জরুরী অবস্থা’ ঘোষণা করা। তা যদি করতাম তাহলে অব্শ্যই ভালো ফলাফল পাওয়া যেতো।
সংবাদ প্রকাশ: জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন কয়েকজন সাংসদ। এটাকে কিভাবে দেখছেন?
আহমেদ: ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ২০১৮ সালের যে আইন আছে তাতে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। তাঁরই নেতৃত্ব দেয়ার কথা। এটা হলো একটা যুদ্ধ। যুদ্ধের সেনাপতির কিছু কিছু কৌশল থাকে, একটা কমান্ড সেন্টার থাকে। তাহলে উনার একটা কমান্ড সেন্টার বানানোর কথা। এরকম কোনো কমান্ড সেন্টারের নাম শুনেছেন? কোনো কমান্ড সেন্টার নেই। এমন কি হয়েছে যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টার অথবা আর্মি স্টেডিয়াম একটা কমান্ড সেন্টার তৈরি হয়েছে? ২৪ ঘন্টা এই কমান্ড সেন্টারে কাজ হচ্ছে? গমগম করছে লোকজন, মিডিয়া ব্রিফ হচ্ছে, সারা জাতি জানছে যে কমান্ড সেন্টার কী করছে। দ্বিতীয়ত, সেনাপতির মাঝে মাঝে মাঠে যেতে হতো, সৈন্যদের উৎসাহ দিতে। উনাকে হাসপাতালে যেতে হতো, চাপাইনবাবগঞ্জ বা সাতক্ষীরা যেতে হতো। জনপ্রশাসন মন্ত্রী, যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, এই নেতৃত্বটা উনার (স্বাস্থ্যমন্ত্রীর) নিতে হতো। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে দায়িত্ব নিয়েছেন, এটা উনার নিতে হতো। ট্কিা আনার জন্য হন্যে হয়ে যেতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বারবার যেতে হতো। বলতেন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার এই লাগবে, ওই লাগবে। আমার টিকা লাগবে। আপনাকে কথা বলতে হবে। উনার দায়িত্ব ছিলো উনার অধীনে যতজন আছে, সচিব-ডিজি-পরিচালক, উনারা থাকত বিভিন্ন সেক্টরের সেনাপতি হিসেবে। উনি প্রধান সেনাপতি থাকতেন। একেক টিমের সঙ্গে একেকবার বসতেন। ধরুন, অক্সিজেন টিমের সঙ্গে বসলো যে এখানে আমার ১০ কোটি টাকা লাগবে। সাথে সাথে ১০ কোটি টাকার জন্য হন্যে হয়ে যেতে হতো। টিকা আনার উনাকে এয়ারপোর্টে যেতে হতো। তিনি বলতেন যে, আমাকে এটা দিতে হবে।
করোনায় শত শত ডাক্তার মারা গেল। উনার উচিত ছিলো তাদের বাড়িতে প্রত্যেকটি পরিবারের কাছে মাফ চাওয়া যে, আমি তাকে বাঁচাতে পারলাম না। তাহলে উনার একটা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হতো। তখন উনি হতেন আমাদের কাছে নায়ক। উনার কথা শোনার জন্য আমরা বসে থাকতাম। তিনি বলতেন যে আমরা চাপাইনবাবগঞ্জে করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছি। আবার হয়তো তিনি বলতেন, যে দুঃখিত। আমাদের এতো জন মারা গেছেন। তার জন্য তিনি কাঁদতেন। তাহলে মানুষ উনাকে সমর্থন দিতো। উনি যেদিকে বলেন, ডাক্তাররা তার উল্টো দিকে যান। উনি ডাক্তারদের সাথে নেই। ডাক্তারদের তিনি দেখেন না। আমাদের চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার এইচএরা তার বিরুদ্ধে। কারণ, তিনি ওদের স্বার্থ দেখেন না।
তাহলে একজন নেতা তিনি যদি নেতা না হয়ে ওঠেন, তাহলে কিছু করার নাই। আরো দুঃখজনক ঘটনা আমাদের নতুন সচিব এলেন। তিনি এটা সম্পর্কে কিছুই জানে না। তিনি কোনো কথা বলছেন না। একই ঘটনা ঘটল আমাদের ডিজির বেলাতেও। উনি একজন সার্জন, উনি থাকতেন ওটির ভেতরে। সেখান থেকে হঠাৎ করে বের করে এনে বসানো হলো। উনি কিছুই বুঝছেন না। এগুলো হলো মূল সমস্যা।
সংবাদ প্রকাশ: এবারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি সংক্রমণ, শনাক্তের পাশাপাশি উচ্চ মৃত্যুর হারও গ্রামেই বেশি।
আহমেদ: কারণটা খুবই সহজ। আমাদের প্রথম দিকে যে করোনা এসেছে, সেটা এসেছে উড়ে, আকাশ দিয়ে। ইতালি-যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের দেশগুলো থেকে। আর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উৎস হলো ভারত। যখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেখা গেলো, ভারত থেকে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ভারতের সাথে আমাদের যে বিশাল সীমানা আছে, এই সীমান্তগুলো গ্রামের সাথে। সুতরাং ভাইরাসটা গড়িয়ে গড়িয়ে ভারত থেকে এসেছে। ভারতে যারা আটকা পড়েছিল তারা নিয়ে এসেছে। ভারত থেকে প্রতিদিন ট্রাকে আমাদের এখানে মালামাল আসে, সেই ড্রাইভাররা আমাদের সঙ্গে গল্প গুজব করেছে, রেস্টুরেন্ট গেছে। ট্রাকের মালামাল নামানোর পর, আমাদের লোকরা তাদের সঙ্গে মেশে, তাদের মাধ্যমে এসেছে। তাছাড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধ যাতায়াত আছে। বাংলাদেশে থেকে ভারতে যায়, ভারতে থেকে বাংলাদেশে আসে। সবই গ্রাম দিয়ে। সুতরাং ওই সংক্রমণটা গ্রামে এসেছে। এবং গ্রামে আমরা যথাসময়ে ব্যবস্থা নিইনি। আবার মফস্বল শহরগুলোতে চিকিৎসার ভালো ব্যবস্থা নেই। তারা শহরের হাসপাতালগুলোতো এসেছেন। হাসপাতালে ঘোরাফেরা করছেন। অন্যরোগীর সঙ্গে মিশছেন। তাদের মধ্যে ভাইরাসও দিয়ে দিচ্ছেন। রেস্টুরেন্টে দিয়েছেন। সেখানে বিল দিয়েছেন, সাথে সাথে ভাইরাসও দিয়েছেন কিছু। একইভাবে আমাদের আট-দশটি সীমান্ত জেলা, সেখানে একই ঘটনা ঘটেছে। যথাসময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো আমরা আন্তঃজেলা পরিবহন, গণপরিবহন খুলে দিলাম। সুতরাং আগে শহর থেকে গ্রামে গিয়েছিল, এখন গ্রাম থেকে শহরে আসছে।
সংবাদ প্রকাশ: আপনি তো আইইডিসিআরের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন, এখন যদি আপনি দায়িত্বে থাকতেন, তাহলে কীভাবে এটা মোকাবেলা করতেন?
আহমেদ: ২০১১-১৫ সালে বাংলাদেশ রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রধান ছিলাম আমি। আমি বাংলাদেশে কালাজ্বর নির্মূল করেছি। আমার অধীনে বাংলাদেশে গোদরোগ নির্মূল হয়েছে। আমি যদি ঘটনাক্রমে এখন ওই পদে থাকতাম, এই যুদ্ধে আমি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতাম। মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারতাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণ হয়েছে আমি সর্বপ্রথম চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেতাম। করোনা যখন প্রথম বাংলাদেশে সংক্রমিত হলো, আমি বাংলাদেশে প্রথমেই ঢুকতে দিতাম না। বিমানগুলো বন্ধ করে দিতাম। আমি জানি আমার সেই ক্ষমতা ছিল। ইবোলা ভাইরাসের সময়ও আমি এটা করেছি। আমি সেই ব্যক্তি যে বিমান থেকে লোক নামতে দেইনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন একজন ব্যক্তি, যে কেউ যৌক্তিক কথা বললে, তিনি রাখেন। প্রধানমন্ত্রী এমন একজন ব্যক্তি ‘নিমতলী ট্রাজেডি’তে পুড়ে যাওয়াদের বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। কারণ বঙ্গবন্ধুর রক্ত আছে তার মধ্যে। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের নেতা। তিনি কোনো জেনারেল না। তিনি জিয়াউর রহমান বা এরশাদ না। তিনি একদম নীচ থেকে ওঠা মানুষ। শেখ হাসিনার জন্ম, রক্ত, বেড়ে ওঠা, সবই বঙ্গবন্ধুর সাথে। আমি উনার কাছে গিয়ে বলতাম যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজকেই বিমান বন্ধ করতে হবে। তিনি যদি বলতেন কেন? আমি বলতাম, আজকে যদি বিমান বন্ধ করি, বাংলাদেশে করোনা ঢুকবে না। তিনি সাথে সাথে নির্দেশ দিতেন। তিনি তো ১০ দিন পরে নির্দেশ দিলেন। তাহলে মাত্র সাতদিন আগে যদি নির্দেশটা হতো, তাহলে যারা বিমানে আসছে তারা কি মরে যেত? তাদের অনেকে তো তিনবছরেও আসতে পারছিল না। অনেকে তো বিদেশে দশ বছরও থাকে। কিন্তু সেটা কেন হয়নি? কারণ আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগে যারা ছিলেন, উনারা দায়িত্বটা পালন করেননি। আগের যে ডিজি অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ তিনি আমার ৪০ বছরের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে অনেক কাজ করেছি। উনার সঙ্গে আমার খুব মতপ্রার্থক্য হয়েছে। বিষয়টি লুকানোর একটা প্রবণতা তার ছিল। আমি তাকে বলেছিলাম যে, তোমার কিছু লুকানোর দরকার নেই, লুকিয়ে লাভ নাই যে করোনা হয়নি। করোনা সমস্যা, সেটা আমি কেন লুকাবো ডিজি হিসেবে? হয়েছে এটা তো সারা দুনিয়া বলছে। কেউ কি লুকাচ্ছে? জনসন লুকাচ্ছে? উনিতো নিজেই এসে বলছেন যে, আমাদের খুব খারাপ অবস্থা। কিন্তু আমরা লুকাই। লুকাতে গিয়ে কী হয়েছে? তখন তো প্রধানমন্ত্রী বলছেন—আমাদের তো করোনা নেই। একজন মন্ত্রী/ডিজি যখন বলেন যে করোনায় আমরা সফল হয়েছি, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বার্তা কী গেল? উনার কাছে যদি তথ্য যায় যে করোনা নিয়ন্ত্রণে আছে, তাহলে তিনি তো আর গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাহলে ঠিক আছে ভালো। প্রধানমন্ত্রীর তো হাজারটা কাজ থাকে। কিন্তু আমি হলে তা বলতাম না।
ম্যালেরিয়ার সময় এরকম ঘটনা ঘটেছিলো। ম্যালেরিয়ায় আমি খুব সাফল্য পাচ্ছিলাম। ২০১৪ সালে হঠাৎ করে ম্যালেরিয়া বেড়ে গেলো। আমি গেলাম মন্ত্রীর কাছে। বললাম স্যার, ম্যালেরিয়া তো বেড়ে গেছে। উনি আমাকে বলেন, বেনজির কী বলো? তুমি সবসময় বলো ম্যালেরিয়া কমছে, এখন বলছো বেড়ে যাচ্ছে? আমি বললাম, স্যার এবার বেড়েছে কিন্তু আমি থামাবো। স্যার, আমি চললাম পার্বত্য চট্টগ্রামে। প্রত্যেকটা জেলায় সাত ঘন্টা করে মিটিং করেছি। আর্মি, বিজিবি, পার্বত্য জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন সহ সবাইকে নিয়ে মিটিং করেছি, যে কেন বাড়লো। ইনশাআল্লাহ সেটা কমাতে পেরেছি। চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের ডেকে বলছি যে, আমাদের ম্যালেরিয়া বেড়ে গেছে। তারা বললো, সবাই দেখি সাফল্য দেখায়, আর আপনি ব্যর্থতা দেখাচ্ছেন, এ কোন কথা? আমি বললাম ভাই, আমি ব্যর্থতা দেখিয়ে সাফল্য পেতে চাই। সাংবাদিকরা আমার বিরুদ্ধে কেউ লাগেনি। তারাই বলছে, উনি তো বলছেই যে বাড়ছে, তারপর যখন কমতে শুরু করলো, তারাই নিউজ করতে শুরু করলো ম্যালেরিয়া কমতে শুরু করেছে। আমাকে বলতে হয়নি। এইবারও যদি আমরা এ কাজটি করতে পারতাম। এখন যদি আমাকে এই মুহুর্তে দায়িত্ব দেওয়া হয়, আমি দায়িত্ব নিতে রাজি, বাংলাদেশের করোনা নিয়ন্ত্রণে।
সংবাদ প্রকাশ: সংক্রমণের দিক থেকে এশিয়ায় বাংলাদেশ পঞ্চম, এ নিয়ে আপনি কী বলবেন?
আহমেদ: পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম যাই হোক, এটা বিষয় না। আমার কাছে প্রত্যেকটা করোনা সংক্রমণই ভয়াবহ জিনিস। কারণ, যে লোকটি সংক্রমিত হয়, তার প্রথমে শুরু হয় মৃত্যুভীতি। আরেকটি বিষয় হলো সুস্থ হওয়া। সেখানে যে বিষয়গুলো ঘটে সেটা মারাত্মক। সুতরাং ষষ্ঠে আছি নাকি পঞ্চমে আছি, তাতে কিছু যায় আসে না। একটা মৃত্যু হলো, নাকি ১০টা মৃত্যু হলো, তাতেও কিছু যায় আসে না। এটা একটা সংখ্যা। প্রত্যেকটা মৃত্যুর কাহিনীটা দেখেন, সেটা ভয়াবহ। সেখানে ধনী-গরীব আছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ লোক, খুব প্রিয় লোক আছে। এই লোকগুলোর মৃত্যু যখন হয়, প্রত্যেকটা পরিবারে শোক তৈরি হয়, মর্মান্তিক সেই মৃত্যু। সংখ্যায় কোথায় আছি সেটা বড় কথা নয়। করোনাকে মোকাবেলা করতে হবে যথার্থভাবে। আমি চাই, শূন্য করোনা। তা না পারি, শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া তো যায়।