গত আগস্টে আফগানিস্তানের দখল নেয় তালেবান বাহিনী। ক্ষমতা নেওয়ার পর ষষ্ঠ শ্রেণির ওপরে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। ফলে দেশটিতে নারী শিক্ষার জন্য আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। আফগান মেয়েদের স্কুলে পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হলেও তালেবানের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতার মেয়েদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি।
তালেবান প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতার মেয়ে দেশের বাইরে পড়াশোনা করছে। তালেবান নেতারা তাদের মেয়েদের দোহা, পেশোয়ার ও করাচির বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষা দিচ্ছেন। এ নিয়ে এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য প্রিন্ট।
সূত্রের বরাতে দ্য প্রিন্ট বলছে, যেসব নেতা তাদের মেয়েদের দেশের পড়াশোনা করাচ্ছেন এর মধ্যে রয়েছেন, তালেবান প্রশাসনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কালান্দার এবাদ, উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই ও মুখপাত্র সুহেল শাহীন।
তালেবানের মুখপাত্র সুহেল শাহীনের দুই মেয়ে ইসলামিক আমিরাতের রাজনৈতিক কার্যালয়ের বাড়ি দোহার রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত স্কুলে পড়াশোনা করে। সেখানে তার আরও তিন ছেলে পড়াশোনা করে। শাহীনের পরিবারের সঙ্গে পরিচিত একটি সূত্র এসব জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, এমনকি শাহীনের বড় মেয়ে স্কুলের দলের হয়ে ফুটবলও খেলছে।
তালেবান প্রশাসনের বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী কালান্দার এবাদ একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক। তিনি নাঙ্গারহার বিশ্ববিদ্যালয় ও পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস ডিগ্রি নিয়েছেন।
তার মেয়েও চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। যিনি বর্তমানে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে একজন ডাক্তার হিসেবে কাজ করছেন।
এদিকে তালেবান প্রশাসনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাইয়ের মেয়েও কাতারে একটি সুপরিচিত স্কুল থেকে পড়া শেষ করেছেন। তার মেয়ে বর্তমানে দোহায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করার পথে আছে।
এ বিষয়ে তালেবানের মুখপাত্র সুহেল শাহীনের বক্তব্যের জন্য যোগাযোগ করেছিল দ্য প্রিন্ট। কিন্তু তার পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
গত বছর আগস্টে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে তালেবান। এরপর থেকে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করে তারা। যদিও পরে স্কুল খোলার ঘোষণা দিয়েছিল তালেবান প্রশাসন। এ বছরের ২৩ মার্চ স্কুল খোলার কথা থাকলেও সেদিনই এক বিবৃতি দিয়ে স্কুল না খোলার কথা জানায় তারা।
সে সময় তালেবান মুখপাত্র বিলাল কারিমি বলেন, “তাদের নেতৃত্ব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। সেখানে মেয়েদের স্কুল খোলা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়। পরবর্তী বৈঠক না হওয়া পর্যন্ত স্কুলগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তালেবান।”
ইসলামিক আমিরাত নারীদের চাকরি করা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া পুরুষ আত্মীয় ছাড়া নারীদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারা।
ইসলামি আমিরাত নেতারা গত বছর দাবি করেছিলেন, পাঠ্যক্রম ও ইউনিফর্ম সংক্রান্ত সমস্যা ছাড়াও স্কুলের জন্য তহবিলের অভাব ছিল।
এরপর জানুয়ারীতে মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি টম ওয়েস্ট বলেছিলেন, আফগানিস্তানের মেয়েদের জন্য স্কুল পুনরায় চালু করা হলে তারা সমস্ত শিক্ষকের বেতন পরিশোধ করবেন।
একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ইসলামিক আমিরাতের বেশ কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রী ও বেসামরিক কর্মচারীদের সন্তানরা এখন পেশোয়ার এবং করাচিতে ‘ইকরা’ স্কুলে পড়াশোনা করছে। যেখানে ইসলামিক বিষয়ের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার মিশ্রণে পাঠদান হয়।
গত বছর কাবুল দখল করার আগে তালেবানের শক্তিশালী সামরিক কমিশনের অন্তত চার সদস্যের মেয়েরা ইকরা স্কুলে পড়াশোনা করেছে বলে মনে করা হয়।
ইকরা স্কুল পরিচালনাকারী ট্রাস্ট বলছে, ঐতিহ্যগতভাবে ইংরেজি, বিজ্ঞান এবং কম্পিউটারের মতো বিষয়ের সঙ্গে সেমিনারিতে দেওয়া ধর্মীয় অধ্যয়নের বিষয়বস্তুকে একত্রিত করে ইকরা স্কুল। মুসলিম ও তাদের সন্তানদের সত্যিকারের মুসলমান তৈরি করতে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে এই স্কুল।
তালেবান নেতাদের স্কুল পরিচালনা করা ও তাদের সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন আফগান গবেষক সাবাউন সামিম। এই বছরের শুরুতে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেন তিনি।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কোয়েটায় মেয়েদের জন্য নিজস্ব ইকরা-শৈলীর স্কুল পরিচালনা করেন একজন তালেবান কমান্ডার। সেখানে গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজিতে ক্লাসের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসার বিষয়গুলো পড়ানো হয়।
গবেষক সামিম জানান, শীর্ষ তালেবান অনেক নেতারা দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করেছেন।
দ্য প্রিন্ট বলছে, যেসব তালেবান কর্মীরা নিজের মেয়েদের আফগানিস্তানের বাইরে শিক্ষা দিচ্ছেন তারা তালেবানের অভ্যন্তরীণ কাউন্সিলে মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে কথা বলেছেন বলে মনে করা হয়।
একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, মেয়েদের স্কুল বন্ধ করার ইসলামি আমিরাতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তর্ক করেছিলেন মুখপাত্র শাহীন ও উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্তানেকজাই।
সেমিনারিয়ান পটভূমিতে শিক্ষাপন্থী দলটিকে ইসলামিক আমিরাতের ডি-ফ্যাক্টো ডেপুটি হেড অব স্টেট সিরাজুদ্দিন হাক্কানির মতো ইসলামপন্থীদের সমর্থন ছিল বলে মনে করা হয়।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, হাক্কানিকে উপপ্রধানমন্ত্রী আবদুল গনি বারাদার ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মুহাম্মদ ইয়াকুবের সমর্থন ছিল।
গত সপ্তাহে আফগান ধর্মগুরুদের একটি শক্তিশালী জোট মেয়েদের স্কুল পুনরায় চালু করার আহ্বান জানিয়েছিল। নারীদের শিক্ষা ইসলামিক আইন ও ধর্মগ্রন্থের সমর্থন করে এই যুক্তিতে তারা দাবি জানায়।
শিক্ষাপন্থী সংখ্যালঘুরা অবশ্য আফগানিস্তানের দক্ষিণের জেলাগুলোর পশতুন ঐতিহ্যবাদীদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। যারা সরকারে আধিপত্য বিস্তার করে।
ঐতিহ্যবাদীরা যুক্তি দেখান, মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে তালেবানদের ব্ল্যাকমেইল করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে উন্নয়ন সহায়তা। শিক্ষার বিষয়ে সাহায্য-সম্পর্কিত ইস্যুতে ইসলামিক আমিরাতেকে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। তাদের পদে বিভাজন তৈরি করতে এসব করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক সূত্রে বলছে, মেয়েদের শিক্ষার প্রধান বিরোধীদের মধ্যে রয়েছেন, ইসলামিক আমিরাতের প্রধান হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা, প্রধান বিচারপতি আব্দুল হাকিম এবং ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী নুর মুহাম্মদ সাকিব।
গত বছর ইসলামিক আমিরাতের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী আব্দুল বাকী হাক্কানি নতুন শাসনামলের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার খুব কম মূল্যের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, আধুনিক অধ্যয়নগুলো কেরানির চেয়ে ‘কম মূল্যবান’।
১৯২০ এর দশকে রাজা আমানুল্লাহ খান ও ১৯৭৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণকারী সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার ফলে আফগানিস্তানে মেয়েদের শিক্ষা একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা উভয় শাসনের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধের দিকে পরিচালিত করে।
৯/১১ এর পরে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে।
আফগানিস্তানে শিক্ষার পর্যালোচনায় জাতিসংঘ উল্লেখ করেছে, উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের সংখ্যা ২০০১ সালে প্রায় ৫ হাজার থেকে বেড়ে ২০১৮ সালে প্রায় ৯০ হাজার হয়েছে।