ইসলাম থেকে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর প্রাণনাশের আশঙ্কায় ইরান থেকে পালিয়েছিলেন ২৭ বছর বয়সী তরুণী আর্টেমিস ঘাসেমজাদেহ। পরে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে আশ্রয়ের আশায় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তে পৌঁছান। কিন্তু আশ্রয় পাওয়ার পরিবর্তে আর্টেমিসকে হাতকড়া পরিয়ে পানামায় পাঠিয়ে দিয়েছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। সেখানে ঘন জঙ্গলে অবস্থিত প্রত্যন্ত একটি ক্যাম্পে তাকে রাখা হয়েছে।
ইরান ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে অবৈধ অভিবাসন কঠোরভাবে দমন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে তার প্রশাসন যেসব অভিবাসীকে ‘অবৈধ’ ও ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করছে তাদের দ্রুততার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে।
আর্টেমিস এই অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ইরান ইন্টারন্যাশনালকে একাধিক ভয়েস বার্তা পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি শুধু নিরাপত্তা চাই। যেন ইসলামপন্থী শাসকদের হাতে মৃত্যুদণ্ডের শিকার না হই।’
ইরানের ইশফাহান শহরের বাসিন্দা ছিলেন আর্টেমিস। খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তিনি যাদের সঙ্গে বাইবেল শিক্ষা গ্রহণ করতেন, সেই দলের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এ অবস্থায় আর্টেমিস ভেবেছিলেন, এবার বুঝি তাকে গ্রেপ্তার করা হবে!
ইরানের আইন অনুসারে, ইসলাম থেকে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ। তাই ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় দেশ থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন আর্টেমিস। ইরান থেকে পালিয়ে প্রথমে তিনি দুবাই যান। সেখান থেকে মেক্সিকোর কর্মসংস্থান ভিসার জন্য আবেদন করেন। মেক্সিকোর রাজধানীতে পৌঁছানোর পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী শহর তিহুয়ানায় যান। পরে সীমান্ত দেয়াল পাড়ি দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেন।
ইরান থেকে পালানোর পর যুক্তরাষ্ট্রে পা রেখে তিনি প্রথমবারের মতো কিছুটা স্বস্তি অনুভব করেছিলেন। কিন্তু সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আর্টেমিসসহ অন্তত ১২ জন ইরানি নাগরিককে একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাঁরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের অনুমতি চেয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগোতে অবস্থিত মার্কিন অভিবাসন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের (আইসিই) একটি ক্যাম্পে ছিলেন। কিন্তু সেই ক্যাম্প থেকে তাঁদের বের করে একটি বিমানে তুলে বলা হয়—এটি টেক্সাসে যাবে।
কিন্তু বিমান থেকে নামার পর স্থানীয় সাইনবোর্ড পড়ে আর্টেমিসসহ অন্যরা বুঝতে পারেন, তাঁরা আসলে পানামায় আছেন। পানামা কর্তৃপক্ষ প্রথমে তাঁদের শহরের একটি হোটেলে রাখে। হোটেলের চারপাশে ছিল সশস্ত্র প্রহরী।
এ অবস্থায় হোটেলের জানালায় লাল লিপস্টিক দিয়ে ইংরেজিতে ‘হেল্প আস’ লিখে রাখেন আর্টেমিস। পরে এই লেখার একটি ছবি ধারণ করে নিউইয়র্ক টাইমস। ছবিটি প্রকাশের পর তা ভাইরাল হয়ে যায় এবং এটি ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে শরণার্থীদের দুর্দশার প্রতীক হয়ে ওঠে।
কিছুদিন পর অবশ্য আর্টেমিসসহ অন্যদের কুখ্যাত দারিয়েন গ্যাপ জঙ্গলের কাছে সান ভিসেন্তে অভিবাসনকেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। এই অঞ্চলে সশস্ত্র গেরিলা, মাদক পাচারকারী, বিষধর সাপ এবং ডেঙ্গুর মতো প্রাণঘাতী রোগের ভয় রয়েছে।
সাংবাদিক ও ত্রাণ সংস্থাগুলোকে এই কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সেখানে পৌঁছানোর পর আর্টেমিসের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে বন্দীদের মধ্যে লুকিয়ে রাখা একটি ফোনই বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়।
আর্টেমিস জানান, ক্যাম্পের অবস্থা ভয়াবহ। এখানে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের কোনো বালাই নেই। বন্দিশিবিরের অনেকেই নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করছে। কারণ সেখানে অপরাধী ও গ্যাং সদস্যদেরও রাখা হয়েছে। তাই তাঁরা জঙ্গলের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে বেঞ্চে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ভয়েস বার্তায় তিনি বলেন, ‘প্রথম দিন আমাদের মাত্র এক বোতল মিনারেল ওয়াটার দেওয়া হয়েছিল। এরপর আমাদের কলের পানি পান করতে বলা হয়, যা ময়লা ও চুনে ভরা।’
তিনি বলেন, ‘আমার মতো সবাই স্বাধীনতা ও শান্তির স্বপ্ন দেখে, যা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের অধিকার। কিন্তু আমি এখন এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি, যা শুধুই বেদনা ও যন্ত্রণায় ভরা।’