মৃণাল সেন : এক দীর্ঘ আত্মানুসন্ধান

সৌভিক গুহসরকার প্রকাশিত: মে ১৪, ২০২৩, ০৪:১৬ পিএম

মৃণাল সেন এমন একজন চলচ্চিত্রকার, যিনি সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন, যিনি অসাফল্য ও শৈল্পিক অতৃপ্তির দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পৌঁছেছেন নিজস্ব সৃষ্টির আলোয়। রবীন্দ্রনাথের থেকে ধার করে বলা যেতে পারে – তিনি এড়িয়ে যাননি, পেরিয়ে গেছেন। দীর্ঘকাল আত্মখননের ফলে তিনি নিজের ভাষার কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন, যা আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয়। প্রভাব আত্মস্থ করে, প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে নিজেস্ব চিত্র-প্রতিমা নির্মাণ করতে যাবেন যাঁরা, মৃণাল সেনের ছবির ক্রমবিবর্তন তাঁদের অনুধাবন করতে হবে।

বাংলায় পথের পাঁচালীর আগে সত‍্যজিৎ রায়ের লড়াই যতটা আলোচিত, ততটা আলোচিত নয় মৃণাল সেনের লড়াই। মোটামুটি ছবি দেখে এমন দর্শককে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তিনি মৃণাল সেনের কোন ছবি দেখেছেন, অধিকাংশ বলবেন ‘ভুবন সোম’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’ বা ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘খারিজ’। অল্প কিছু মানুষ ‘বাইশে শ্রাবণ’ বলবেন, আর ‘নীল আকাশের নীচে’ তো “কালী ব্যানার্জীর ছবি। মৃণাল সেনের পরিচালনা? তাই নাকি? ঐ যে ‘ও নদীরে’ গানটা রয়েছে তো?”
মজা হলো উইকিপিডিয়াতেও সেই ‘ভুবন সোম’কেই মৃণাল সেনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ছবি হিসেবে ধরা হয়েছে। দেখার বিষয়, ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৯ সালে। মৃণাল সেনের বয়স তখন ৪৬। ততদিনে সত‍্যজিৎ আর ঋত্বিক বাংলায় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন, তপন সিংহ প্রবল জনপ্রিয়। পাশাপাশি রয়েছেন অজয় কর, তরুণ মজুমদারের মতো শক্তিশালী চলচ্চিত্র নির্মাতারা। ১৯৬৯ পর্যন্ত মৃণাল সেনের ছবির সংখ্যা আট। কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই বিপুল সাংস্কৃতিক প্রভাব তৈরি করতে পারেনি, যা ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘মেঘে ঢাকা তারা’ তৈরি ক‍রতে পেরেছিল।

মৃণাল এ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি এই ব্যাপারটা বুঝেছিলেন বলেই নিরন্তর আত্মসমীক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছেন। বুঝেছেন যে, পায়ের তলার শক্ত মাটি তিনি পাননি, নিজের কণ্ঠস্বর পাননি। তখনো তিনি ঠিক ‘মৃণাল সেন’ হয়ে উঠতে পারেননি।

চিন্ময় গুহর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে মৃণাল বলছেন “… সবটাই ঘটল অ্যাকাডেমিকালি, হাতে-কলমে নয়। একেবারেই নয়। আমার প্রথম ছবির (রাত-ভোর) বেলায় ওই হলো আমার কাল, আমার অধঃপতন।

জানি সত‍্যজিৎ রায়ের বেলায় এরকম হয়নি। হয়নি, কিন্তু আমার হয়েছে। কারণ, হয়তো আমার মধ্যে মস্ত একটা ফাঁক ছিল। দু-তিন বছর দেরি ক‍রা যেত না কি? তাই হলো শেষ পর্যন্ত। তিন বছর পরে করলাম ‘নীল আকাশের নীচে’। …

‘নীল আকাশের নীচে’ অবশ্য ভালো লেগেছে অনেকেরই। আমার অবশ্য একাধিক প্রশ্ন ছিল। সেলফ কনট্রোলের অভাব কি তুমি বোধ করোনি? আঙ্গিকের দুর্বলতা? ক‍্যামেরা কি ছুঁতে পেরেছিল সময়টাকে? খোলাখুলি বলছি ভুলগুলো আমারই।”

‘বাইশে শ্রাবণ’ সম্পর্কে বলছেন, “ছবিটাকে আজও ভালোবাসি। দেখে মনে হয়েছিল, ‘না, আর বোধহয় ছবির রাজ‍্য থেকে বিদায় নিতে হবে না।’

এই জায়গাটা দেখার মতো। একটি মানুষ শিল্পের ক্ষেত্রে নিজের ভুলগুলোকে সনাক্ত করতে করতে এগিয়ে চলেছেন। নিজেকে পাল্টাচ্ছেন, ভাঙছেন অনবরত। সিনেমার ভেতর দিয়ে নিজেকে খুঁজে চলেছেন বারবার। তিনি বুঝছেন যে তাঁর সতীর্থরা এগিয়ে গেছেন, কিন্তু তিনি মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, কিছুতেই থামছেন না।

ভাবতে অবাক লাগে সত‍্যজিৎ বা ঋত্বিক কেউই সেই সময় হিন্দিতে ছবি করার কথা ভাবেননি, কিন্তু মৃণাল ওড়িয়া এবং হিন্দিতে ছবি করে ফেলেছেন। যে ছবিটার কারণে মৃণালের ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতি, সেটা হিন্দি এবং ভাঙচুরময়, অন্যরকম। ভারতে এর আগে ভুবন সোমের মতো ছবি দর্শক দেখেনি। এইবার মৃণাল পেলেন নিজের জায়গা। ভারতে সিনেমার আঙ্গিক নিয়ে নতুন ভাবনা তৈরি হলো। এরপর বহু ছবিতে মৃণাল সিনেমার ফর্ম নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন এবং ক্রমশ নিজের প্রতিভাকে শান দিয়ে ধারালো করে তুলেছেন। ধীরে ধীরে সত‍্যজিৎ ও ঋত্বিকের পাশাপাশি উচ্চারিত হতে থাকলেন তিনি। ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম পুরোধা হিসেবে পরিগণিত হতে থাকলেন। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়োতে লাগল তাঁর একটার পর একটা ছবি। রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে নিয়ে এলেন ছবির কেন্দ্রে। ক‍্যামেরার দৌড়, সম্পাদনার কৌশল– এসবের মধ্যে দিয়ে মৃণাল জন্ম দিতে শুরু করলেন নতুন চলচ্চিত্র ভাষার, যা সত্যজিতেরও নয়, ঋত্বিকেরও নয়। কেবল তাঁর।
চিন্ময় গুহ প্রশ্ন করেছিলেন মৃণাল সেনকে “হয়তো আপনি বোঝেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভাষাকে ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্তে আপনি নতুনভাবে লিখছেন। আপনার অনুভূতিটা কীরকম? একটা পরিপূর্ণতার বোধ না লুকোনো এক অতৃপ্তি?”

মৃণাল সেন বলছেন “বলছ, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ভাষাকে আমি নতুনভাবে লিখেছি। তাই কি? যখন এসব কথা শুনি, দৈবাৎ তোমার মুখে, অন‍্য কারো মুখে— সত‍্যি বলতে কী, তখন বেশ অস্বস্তিবোধ করি। ভালো কথা শুনতে ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু তুমি যে ভাষার কথা বলছ এবং লুকোনো এক অতৃপ্তির কথা … আমি সেসবের কতটা কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছি আজ পর্যন্ত? কতখানি নাগাল পেয়েছি?’

এখানেই তিনি ব্যতিক্রমী। আত্মতুষ্টিহীন একজন জাগ্ৰত স্রষ্টা, যিনি দীর্ঘ পরিশ্রম ও শিল্প জিজ্ঞাসার মাধ্যমে নিজের একক ভাষা খুঁজে পেয়েও সেই ভাষা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র মোহগ্ৰস্ত নন। একটি টিভি চ‍্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মৃণাল সেন বলছেন “আমরা যারা ভুবন সোম করছিলাম, তারা ভেবেছিলাম ওটা বোধহয় মাত্র একদিন চলবে। … ছবি জনপ্রিয়তা লাভের পর বম্বের তিনজন প্রোডিউসার আমার সঙ্গে দেখা করে বলেছিল ভুবন সোমের মতো আরও ছবি করো। আমরা টাকা দেব। আমি বললাম, ভুবন সোম তো করে ফেলেছি, আবার কেন করব? এবার অন্য কিছু করব। আমার পছন্দমতো ছবি করব।”

মৃণাল সেনের ছবির নেপথ্যে যে অসম্ভব প্রাণবাণ লড়াকু ছক ভাঙা এক্সপেরিমেন্টাল মানুষটি রয়েছেন, সেই মানুষটা বারবার আমার বিস্ময়ের উদ্রেক করে। কারণ তিনিই তো জীবন সায়াহ্নে এসে অকপটে বলতে পারেন “দ্যাখো … ক্বচিৎ কখনও অসম কথা বলিনি তা নয়, মন থেকেই বলেছি। কিন্তু সত্যজিৎ রায় একমেবাদ্বিতীয়ম। ঋত্বিক ঘটকও বড় কম যায় না, কিন্তু সত্যজিতের সমকক্ষ বলা সম্ভব নয়। …”

মৃণাল সেনের সিনেমা আমাদের ধারাবাহিকভাবে দেখা দরকার, কারণ এর মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাব কীভাবে ধাপে ধাপে একজন স্রষ্টা নিজের উত্তরণ ঘটাচ্ছেন এবং পালটে দিচ্ছেন ভারতীয় সিনেমার ভাষা।