রবির আলো নিভে গেল

রাজীব কুমার দাশ প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৩, ০৫:২৩ পিএম

রবির বয়স কতই বা হবে? বড়জোর বছর দশেক। রবির বাবা তার টগবগে যৌবনের উচ্ছ্বাস প্রেমিকা রেশমির মামলার ঘানি টানছে। রবি ছোট মনে প্রতিবেশী চাচা-চাচির মুখে জেনেছে, তার বাবা অবাধ্য যৌবনে প্রেম করেছিল। জোছনা রাতে ধান খেত পাট খেতে গোখরা দাঁড়াশ সাপের মতো পেঁচিয়ে ফোঁস ফোঁস ফুসফাস শব্দ করেছিল। প্রতিবেশি কেউ কেউ চুপিচুপি দেখেছে। কেউ কেউ শুনেছে। রবির দাদা দাদি জানে, বাবার প্রেমিকা রেশমি আন্টির বাবা-মাও জানে। সে সময়ে পরপারে পাড়ি দেয়া সমাজ সর্দার মুন্সী মিয়া পাপের দণ্ড দিতে রেশমিকে বিয়ে করার ফরমান জারি একমতে, নেই কারোর অজানা।  

খুশির ঠেলায় রবির বাবা এককথায় রাজি। প্রথমে দাদা-দাদি অবশ্য অমত করেছিল। কিন্তু পরে ছেলের উচ্ছ্বাস ভালোবাসার কাছে পাক-ভারত ক্রিকেট টিমের পরাজয় বেদনার প্রেস্টিজ হার-জিৎ মনে নীরবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

যাই হোক, শিশু রবি তার মায়ের মুখে বাবার সাথে গোস্বা করা কথার ফাঁকে ফাঁকে অনেক কিছু জানতে পেরেছে। রবি এও জেনেছে, পরে মহিষ উপঢৌকন নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে বাবার সাথে রেশমি আন্টির বিয়েটা হয়নি। পরে রেশমি আন্টি রবির বাবা চাচা-জ্যাঠার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন।

রবি বদর নগর সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ফাইভ ক্লাসের ফার্স্ট বয়। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হতে মাস তিনেক এখনো বাকি। আজ সকালে বাবার প্রেমিকা রেশমি আন্টির মামলার হাজিরা দিতে বাবা চাচা-জ্যাঠা মিলে জেলা সদরের আদালতে যান। সেই যে বাবা গেলেন, ফিরলেন না। রবির মায়ের কান্না থামছে না। বড় বোনটাও কিছু খেতে চাইছে না। চাচা জ্যাঠা এসে রাতে জানান, নতুন জজ সাহেব। মাথা বেশি গরম।

রবির বাবাকে জিজ্ঞেস করেন :
—আপনি কী করেন?
—হুজুর, হালচাষ করি।
—আপনার কিছু বলার আছে?
—হুজুর! আপনি বিচারটা করে দেন। আমার যৌবনের মামলা। এখন মামলার বয়স আটাশ। তারিখে তারিখে কোর্টে হাজির থাকি। টানা রোগে ধরেছে। শ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হয়। গাড়ি ভাড়া, উকিল খরচ, নাস্তা ভাতে অনেক টাকা চলে যায়। হুজুর! আর পারি না।

বিজ্ঞ বিচারক সাহেব সবকিছু শুনলেন। পেশকার সাহেব আদালত  মুখে  বলল, “আসামি তাহের মিয়া হাজতে যাবে।”—তাহের মিয়া করজোরে চিৎকার করে বলছে—

—হুজুর বিশ্বাস করেন, আমি রেশমিকে এসিড মারিনি। আমি ওকে  অনেক  ভালোবাসতাম। গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব নিয়ে আমরা সব হারিয়ে পথে বসতে চলেছি। আপনি আল্লার প্রতিনিধি স্বয়ং। এই মামলার পরে, আমি বছরের পর বছর জেল খেটেছি। গোষ্ঠী অহঙ্কারী শত্রুরা যদি জানে, আমি আবার জেল হাজতে চলে যাচ্ছি? কেড়ে নেবে আমার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন ধানি জমি, প্যারাবনে ছেড়ে দেয়া মোষ। কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির সহজে বিয়ে হবে না। বাদী-রেশমির জামাই বশীর আপসরফা করে আমাদের অনেক টাকা খেয়েছে। বিশ্বাস না হলে তাকে জিজ্ঞেস করেন। হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে বলেন, হুজুর রেশমির সাথের উনিই বশীর মিয়া। আমার মান ইজ্জত সন্তানের সামনে কেড়ে নিবেন না। হুজুর, দয়া করে আমাকে বাঁচান।

মামলার বয়স চলছে বছর আটাশ। রবির মা মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলেন, “আমি নিরীহ মানুষ। রবির বাবার সাবেক প্রেমের ইজারা টেনে অঙ্গ জ্বলে বারোমাস। হাতে টাকা-পয়সা নাই। বাবার কারণে মেয়ে খাদিজার ভালো ঘরের সম্বন্ধের দেখা নাই। কেন বাবা-মা বিয়ের আগে রবির বাবার প্রেম জ্বালার কোনো খবর নিল না, জানি না। চারিদিকে আমার হয়েছে মহাজ্বালা মরণ।”

বছর খানেক ধরে রবির বাবা তাহের মিয়া জেল হাজতে। তারিখের পরে পড়ে তারিখ। জামিন মেলে না। শিশু মনে বাবার জামিন পানে তাকিয়ে উকিল মুহুরির তাঁবেদারি তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের কাড়াকাড়ি ফাঁদের বাহাদুরি দেখার অদম্য অগ্রযাত্রার টাকাকড়ি শেষ করে শিশু রবির বিকশিত মেধার আলো চিরতরে নিভে গেছে এখন।

মোষগুলো গোষ্ঠী তাণ্ডবের শিকার। নিকটাত্নীয় প্রতিবেশিরা কেটে নিয়ে গেছে জমির ধান। আদরের বাবা পুলিশ ভ্যানের কুঠরি ধরে চিৎকার করে বলে, “রবি কিছু খেতে মন চায় রে বাপধন।”

শিশু রবির হাতে নাই বই কলম। তুলতুলে কোমল দুটি হাতের তালুতে কড়া পড়া আসমান জমিন সাক্ষী দিচ্ছে বেদনার অষ্টপ্রহরে নানান রং। শিশু রবি ট্রাক্টর চালায় এখন। পুলিশ ভ্যানের কুঠরি অসহায় চোখের নোনাজলে ঘুরছে রবির নিয়তি ট্রাক্টরের হাতল।