লেখকের গোয়েন্দা মামা বইটি নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে

মো. ইসহাক ফারুকী প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩, ০৬:৩৯ পিএম

মনে হয়েছে যেন কোনো ইংরেজি চলচ্চিত্র দেখছি। আসলে পড়তে গেলে মনের চোখ দিয়ে দেখতে হয়। পড়তে গিয়ে মনে মনে ভেবেছি, আরে এভাবে করলেই তো হয়। গাধা নাকি? পরে যখন দেখি, আমার চিন্তার বাইরে গল্পের নায়ক অন্য ফন্দি এঁটেছিল এবং তাতে সফল হয়েছে, তখন আমিই পাঠক হিসেবে বোকা বনে যাই।

ঔপন্যাসিক সাদত আল মাহমুদের ‘গোয়েন্দা মামা : মেয়েটির নিখোঁজ রহস্য’ এবারের বইমেলায় কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনে এনে রাতেই গোগ্রাসে গিলে ফেললাম। একটা কথা, বই কিনে বই পড়ুন, তাতে আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। কখনো কখনো ধাক্কা খেয়েছি, লেখক আমাকে প্রশ্ন করছেন না তো? কখনো কখনো অবাক হয়েছি, পরিচিত পথে অপরিচিতভাবে হাঁটানোর কায়দাটা দেখে। গোয়েন্দা মামা বাদশা হাজির, নামটি বেশ অদ্ভুত। সাথে ভাগ্নে টাইগার টগর ও ভাতিজা বাহাদুর বদিউল। পুরো টিমের নাম বেশ লেগেছে। আসলে নাম একটা ব্যাপার! চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জালাল সাহেবের একমাত্র কন্যা নাজনীনের নিখোঁজ হওয়াকে নিয়ে গোয়েন্দা গল্প ফেঁদে বসেছেন লেখক। শুধু সন্দেহ থাকলেই কি হয়? চাই প্রমাণ। সেই প্রমাণের খোঁজে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ঘুরে গোয়েন্দা মামার দল গিয়ে পড়ে ভারতের সিকিম রাজ্যে। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে গল্পটি ভিন্ন মাত্রা পায়। 

সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত জাদুকর সত্যজিৎ রায়ের গ্যাংটকে গণ্ডগোল নামটি মনে পড়ে যায়। আরো মনে পড়ে অঞ্জন দত্তের গাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘা গানটির কথা। ষোড়শী কন্যার সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার বদলে যাওয়া প্রতিটি রঙের অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন সাদত আল মাহমুদ। আদতে ঔপন্যাসিক হলেও তাতে তাকে কবি বললেও ভুল হবে না। লেখক তার পূর্ববর্তী সাহিত্যেও প্রকৃতিবন্দনা করেছেন। সাহিত্যের রস আস্বাদন করাতে পাঠককে কখনো ইতিহাসের পাঠ পড়িয়েছেন। কখনো সমাজ, দর্শন, ভূগোল, মনোবিজ্ঞানের পথেও হাঁটিয়েছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হালকা রসের উদাহরণ হিসেবে পঁচা শশা শব্দটি ব্যবহার করেছেন সাদত। দুলাভাইয়ের আদরমিশ্রিত শাসনকেও হালকা রসে ডুবিয়ে দুর্দান্ত পারিবারিক শীতের পিঠাও তৈরি করেছেন। সবমিলিয়ে তথাকথিত গোয়েন্দা গল্পের প্যাটার্নে না গিয়ে বাস্তবতার নিরিখে সাহিত্যরস ঢেলে কিছুটা পোস্ট মডার্ন উপন্যাস লিখেছেন সাদত আল মাহমুদ। 

বিভ্রান্তি ও হতাশার চাদরে মোড়ানো জালাল সাহেব ও তার স্ত্রী সাবিনা, পরিস্থিতি মোকাবিলায় যৌক্তিক-অযৌক্তিকতার দোলাচলে হানিফ-কফিল, আনন্দ-বন্দিত্বের মিথস্ক্রিয়ায় নাজনীন। আর সাথে আত্মবিশ্বাস ও নিয়ত অনুসন্ধান নিয়ে মত্ত গোয়েন্দা মামা ও তার দল। লেখকের লেখনী পড়ে কখনো কখনো রুশ মঞ্চ অভিনেতা-পরিচালক কনস্তান্তিন স্তানিস্লাভ্‌স্কির ‘অভিনয় পদ্ধতি’র কথা মনে পড়ে গেছে। 

উপন্যাসের কল্যাণে কিছু কিছু জায়গায় সাদত আল মাহমুদ নিজেই হয়ে পড়েছেন গোয়েন্দা মামা। প্রশ্ন করে বসেছেন পাঠককে। বিষয়টি আমার কাছে চমৎকার দর্শন বলে মনে হয়েছে। প্রথম গোয়েন্দা গল্প লিখেই একজন লেখক অসাধারণ হয়ে যাবেন, সে কথা বলা যায় না। খামতি তো থাকেই। তবে তার গঠনমূলক সমালোচনা হওয়া চাই। আগেই বলেছি, তথাকথিত প্যাটার্ন ফলো করেননি সাদত। যারা প্রচুর সাহিত্য পড়েন, চলচ্চিত্র দেখেন, তারা বুঝবেন উপন্যাসের বাঁক বদলের পেছনের গল্প? কোন পথে, কিভাবে, কোন কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মূল উদ্দেশ্য হাসিল করা যাবে? তার কৌশল বের করাটাই আসল বিষয়। লেখক তা করেছেন। এখানে দুঃসাহস দেখিয়ে ঝুঁকি নিয়েছেন লেখক। আমার কাছে অন্তত ঝুঁকিটা বেশ ভালো লেগেছে। কারণ ঝুঁকি না নিলে নতুন কিছু আসে না।