‘এক কলমে মাইল পার।’ আশি-নব্বইয়ের দশকে জিকিউ কোম্পানি প্রথম প্লাস্টিক ‘ওয়ান টাইম কলম ইকোনো’ বাজারজাত করে। সে সময়ে জাপানি ‘রেড লিফ’ রিফিল কলম থাকলেও সাশ্রয়ী মূল্য, রকমারি রং, সাদাকালো যুগের বিটিভিতে ইকোনো কলমের চটকদার বিজ্ঞাপন, পড়ুয়াদের মনে দ্রুত প্রভাব ফেলে। রাতারাতি ঝর্ণা কলম বিক্রি কমে যায় । জেম ইয়ুথ কোম্পানিসহ অনেক কোম্পানি তরল কালি বিক্রি বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পরে ইকোনো কোম্পানিও ম্যাটাডোরের পাশাপাশি মেরিট ও অলিম্পিক কোম্পানির কলমের ভিড়ে টিকতে না পেরে হারিয়ে যায়। সে সময়ের শিশুরা ওয়ান টাইম কলমে লেখালেখি শুরু করে বুকের বাম পকেটে শুধু ধারণই করেননি; আস্তে আস্তে বুকের বাম পাশটা করে নিয়েছে ওয়ান টাইম। সেই হাতেখড়ি নিয়ে এই পর্যন্ত চারিদিকে চলছে হৃদয়হীন ওয়ান টাইম মিছিল। প্রেম বিরহ ঘর সংসার স্নেহ বিশ্বাস মানবতা পরিবার পরিজন হাসি সবই যেন, প্রাণহীন ওয়ান টাইম।
এখন ইকোনো বন্ধুদের চালশে জীবন পেরিয়ে যাচ্ছে। সেই যে, সাদা-কালো বিজ্ঞাপনের হাতেখড়ি নিয়ে যাপিত জীবনে কত কত প্রাণহীন সম্পর্কে কোকিলের সুর হারা বসন্ত, কখন যে নিভৃতে উপহাস করে ওয়ান টাইম মনে হারিয়ে গেছে; কেউ কখনো মনে রাখেনি। সেই যে, পুত্র-পুত্রীর হৃদয়হীন বিজ্ঞাপনী সমস্বরে চিৎকার: “আব্বুর জন্য ইকোনো, আম্মুর জন্য ইকোনো, সবার জন্যে ইকোনো।” বিজ্ঞাপনী ইকোনো পুত্র-পুত্রীর মনে ধীরে ধীরে দানা বাঁধা বদ্ধমূল ওয়ান টাইম ইশহেতার ভাবনা মেরিট অলিম্পিক হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়েছে নগর শহর গ্রাম বাংলার কিষাণ কিষাণি বুকে। ওয়ান টাইম ইকোনো হৃদয় ঝড় বৃষ্টির আবহাওয়া সংকেত কেড়ে দিয়েছে কিষাণি হাতের প্রতীক্ষিত কুপি বাতি, হাসির ঝরনা কলম।
ওয়ান টাইম সিংহী আদুরে চাহনি, গ্রাম-শহুরে হৃদয়হীন হায়েনা মুচকি হাসি, বার বার আতঙ্কিত প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে এই জনপদের সমাজ-সভ্যতা বিশ্বাস সংস্কৃতি। কে কাকে বিশ্বাস করবে? কখন বিশ্বাস করবে? কীভাবে করবে? কতোটা করবে? আপেক্ষিক স্তূতি স্থিতি কেউই বুঝতে পারেনি, বুঝতে চায়ওনি! ছিন্নবিচ্ছিন্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থায়ী পিলার। মুখে মুখে যে যত কথাই বলুক না কেন? হৃদয়ের আসমান জমিনে
লেগে আছে, ধর্মের বিভাজন। জগদ্দল হিংসা পাথরে খোদাই করা ‘তালগাছ আমার, কাঁঠাল গাছ তোমার’ সারি সারি বাগান।
হৃদয়হীন সাংঘর্ষিক কথামালা ঘাঁটিতে যোগ দিয়েছে ধর্মের অনলবর্ষী স্নাইপার রাইফেল, মেশিন গান কামান। এইদিকে সেইদিকে ছোটাছুটি করছে যে যার মতো সবাই। কেউ কারোর ধার ধারছে না,মানতে চাইছে না, সুনাগরিক সংজ্ঞা, সংবিধান। এই জনপদের মানু্ষ বার বার দেখেছে, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, মন্বন্তর, দাঙ্গা, কথিত মানবতা সাহায্যদানের নামে হরহামেশা ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া। থেমে থেমে ভেসে আসছে, চালচুলোহীন নিরন্ন বুভুক্ষু জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচা মানুষের চিৎকার।
একমাত্র বাঁচার তাগিদে মৃত্যুক্ষুধা নাটকে সমাজ সভ্যতার সংকট প্রকটিত হচ্ছে ঘরে বাইরে প্রতিনিয়ত। এখনো চলছে, জীবনমুখী পণ্যের বিনিময়ে ধর্মের বহুমুখী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। টাকা যার আছে, ধর্মের ধ্বজাধারী ও আছে তার পাছে। হৃদয়হীন ওয়ান টাইম হাসিখুশি, বারোমাসি ইকোনো বন্ধুরা মাইল পেরিয়ে হাজার মাইল চলে যাচ্ছে। বারোমাসি ইকোনো বন্ধুদের কেউ চিনতে পেরেছেন কী?