শান্তিসৈনিকের সাহিত্যযাত্রা

স্বকৃত নোমান প্রকাশিত: মে ২৮, ২০২২, ১০:০৫ পিএম

লিখতে পারাটা একটা বড় ক্ষমতা। আমার কাছে মনে হয় লেখকরা হচ্ছেন প্রকৃতির বিশেষ সন্তান। বিশেষ কিছু গুণাবলী দিয়ে, যা সাধারণের মধ্যে থাকে না, লেখকদের সৃষ্টি করেছে প্রকৃতি। সাধারণ মানুষ প্রকৃতিকে দেখে, কিন্তু বিশ্লেষণ করতে পারে না। বিশ্লেষণ করেন লেখকেরা। ধনবান বহু  মানুষকে দেখেছি অর্থ-বিত্তে যাদের কোনো অতৃপ্তি নেই। অতৃপ্তি শুধু একটা জায়গায়―তারা লিখতে পারে না। এই জ্ঞান তারা লাভ করেছে যে, অর্থ-বিত্ত শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে আসে না, উত্তরপ্রজন্ম ধন-সম্পদের কথা স্মরণে রাখে না। স্মরণে রাখে সেই জিনিস, যা বিশেষ, যা সবার পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভবপর হয় না। সেই বিশেষ জিনিসটি হচ্ছে লেখালেখি। অর্থাৎ জ্ঞান। আর জ্ঞানকে ধরে রাখার মাধ্যম হচ্ছে বই। বড় বড় ব্যবসায়ী বা রাজনীতিককে দেখেছি যারা লিখতে চায়, কিন্তু লিখতে পারেন না। এই ক্ষমতা তাদের নেই। সেই কারণে তারা অতৃপ্তিতে ভোগেন। কেউ কেউ অন্যকে দিয়ে লিখিয়ে নেন এবং টাকাপয়সা খরচ করে বই প্রকাশ করেন।

রাজীব দাশের পরিচয় একাধিক। তিনি কবি, গদ্যকার; একই সঙ্গে একজন পুলিশ পরিদর্শক। কোনো পুলিশ, নৌসদস্য বা সেনাসদস্যকে লেখালেখি করতে দেখলে ভালো লাগে। তারা দেশ রক্ষার, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকেন। সেটি তাদের প্রারব্ধ। পাশাপাশি যখন তারা লেখালেখির কাজও চালিয়ে যান, তখন মনে হয়, সত্যিকার অর্থেই প্রকৃতি তাদের বিশেষভবে তৈরি করেছে, বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে জন্ম দিয়েছে। শান্তিসৈনিক রাজীব দাশ দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। তাঁর লেখালেখির প্রতি আমার মনোযোগ ছিল, এখনো আছে। লেখালেখির প্রতি রাজীব দাশের প্রীতি আমাকে মুগ্ধ করেছে। মনে হয়েছে, তিনি বিশেষ মানুষ। সংসারলোকের সবকিছু সুচারুরূপে সম্পন্ন করেও তিনি মননলোকের গভীর পরিচর্যায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেন। লেখালেখির মধ্য দিয়ে তিনি মননলোককে সজীব, সুন্দর এবং প্রফুল্ল রাখতে পারেন।

কবি রাজীব দাশ

গত অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে রাজীব দাশের তিনটি বই : ‘তুমি ছাড়া মৌনতা খাব প্রতিদিন’, ‘নিরন্ন ললাট‘ এবং ‘সততা জেনারেল স্টোর’। প্রথম বইটি নির্বাচিত উক্তির। পড়লেই বোঝা যায় এসব উক্তি তিনি ফেসবুকে লিখেছেন। কর্মের সময়, বিশ্রামের সময়, ভ্রমণের সময়, প্রেমের সময় এবং ভোগ-উপভোগের সময়ে যখন যা তাঁর ভাবনায় এসেছে তিনি তা খাতায় কিংবা ফেসবুকে টুকে রেখেছেন। টুকে রাখা সেসব উক্তিগুলোর সংকলন বইটি। বইটি পড়লে রাজীব দাশের চিন্তা-চেতনা বোঝা যায়, বোধের গভীরতা উপলব্ধ করা যায়। দ্বিতীয় বইটি কবিতার। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। প্রত্যেক লেখককে জটিলতাকে পরিহার করতে হয়, সহজকে বরণ করে সহজ হতে হয়, সহজ হয়ে মানুষের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে হয়। ‘নিরন্ন ললাট’ হচ্ছে রাজীব দাশের ভেতরের সহজ মানুষটির শিল্পিত বহিঃপ্রকাশ।

‘নিরন্ন ললাট’ পড়ে মনে হয়েছে রাজীব দাশের ভেতরে একটি সহজ মানুষ আছে, একটি সংবেদনশীল সত্তা আছে, তাঁর একটি সহজাত কবিসত্তা আছে। তিনি নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেই সত্তাটির পরিচর্যার। দেশে এমন অনেক মানুষ আছে যারা মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারেন, বাংলার গায়েন-কবিয়ালরা যেমন করেন। রাজীব দাশও তেমনি। গায়েন-কবিয়ালদের উত্তরসুরী, বাংলা কবিতার মহীরুহদের উত্তরসুরী। শব্দের সঙ্গে শব্দের মাধুর্যপূর্ণ মিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি কবিতা রচনা করতে পারেন। কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি সুন্দরকে স্পর্শ করতে চান, সুন্দরের বাণী তাঁর পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে চান, প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করতে চান, মানুষের ভেতরের দ্বেষ-হিংসা-জিঘাংসা-লোভ ও পরশ্রীকাতরতাকে চিহ্নিত করতে চান। যা কিছু অসুন্দর, কুৎসিৎ, কদাকার; যা কিছু মানুষের জন্য অকল্যাণকর, প্রকৃতির জন্য অকল্যাণকর, তা নিয়ে তিনি নিজের অভিমত ব্যক্ত করতে চান। বারবার এই কথা বলতে চান―এই পৃথিবী সুন্দর, মানুষ সুন্দর, সকল জীব সুন্দর। মানুষ চেষ্টা করলে এই পৃথিবীকে আরো সুন্দর করে তুলতে পারে, এই পৃথিবীকে স্বর্গ বানিয়ে তুলতে পারে। যেমন তাঁর একটি কবিতা :

‘...বারবার বলেছি, এখনো বলছি 
তুমি ধর্মের ধ্বজাধারী সেজো না, ধর্মের ভার ওঠাও
আজ তোমার শ্রেষ্ঠতা নন্দন প্রশ্নবিদ্ধ 
পাষণ্ড নেকড়ে চিৎকার করে পালিয়ে গেছে
তুমি আজ নেকড়ে প্রজাতির শতভাগ একজন হয়ে 
তীক্ষèধার দাঁতে মানবতার শত্রু
অহর্নিশ নমরুদ ফেরাউন সীমার রক্তবীজ অসুর
সুরাসুর যুদ্ধের দামামা এ মুহূর্তে বেশ দরকার
সময়ের চোরাবালিতে ধরনীতে লুকিয়ে থেকেছ বারবার
মনবতা-সাম্য-বিশ্বাস পাটাতন ফুটো করে 
কান্নার নোনাজলে ডুবিয়েছ সবার
আজ স্বপ্নহীন নিপীড়িত অসহায়ের কান্না
বন্দিনি হেরেমখানা ভীষণ অভিশাপে
মনুষ্যত্বের অহংকার চির অভিশপ্ত।’

বেশ দক্ষতার সঙ্গে তিনি মিথ ও ইতিহাসের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তাঁর কবিতায়। নমরুদ, ফেরাউনের কথা আমরা ইতিহাসে পাই এবং রক্তবীজ অসুরের কথা পাই পুরাণে। ইতিহাসমতে, নমরুদ-ফেরাউন পৃথিবীকে অস্থিতিশীল করেছিল। পুরাণমতে, দেবলোক ও পাতাললোক অস্থিতিশীল করেছিল রক্তবীজ অসুর। রাজীব দাশ তাদের উদহারণ টেনেছেন তাঁর কবিতায়। কবিকে আসলে জানতে হয়, ইতিহাসের গভীরে ডুব দিয়ে ইতিহাসের নুড়ি কুড়িয়ে আনতে হয়। মিথকে ছেঁকে খুঁজে বের করে আনতে হয় তার নির্যাস। রাজীব দাশের সেই ক্ষমতা আছে। তাঁর প্রতিটি কিবতায় এভাবে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কার, কুসংস্কার, ইতিহাস, পুরাণের সার্থক সম্মিলন ঘটেছে। কবিরা এভাবেই তাঁর পাঠকদের শিক্ষিত করে তোলেন, সচেতন করে তোলেন, বোধসম্পন্ন করে তোলেন, চেতনাকে শাণিত করে তোলেন।

একই সঙ্গে রাজীব দাশের কবিতায় যেমন দেখতে পাই প্রেম, যেমন দেখতে পাই নারীর প্রতি ভালোবাসা, তেমনি দেখতে পাই নৈঃসঙ্গ চেতনা, ক্ষোভ ও হাহাকার। কবিমাত্রেই নিঃসঙ্গ। কবির ভেতরে ক্ষোভ থাকে, আগুন থাকে। সমাজের অসঙ্গতি দেখে, বিকার দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নিজের অস্তিত্ব কতটুকু, তা ভাবতে গিয়ে তার ভেতরে হাহাকার জাগে। রাজীব দাশ তাঁর নৈঃসঙ্গ চেতনা, ক্ষোভ ও হাকাকারকে ব্যক্ত করেছেন এভাবে :

‘সবাই একদিন আমায় ছেড়ে চলে যাবে, চলে যাক
আপত্তি-অনাপত্তি নথি বেঁধে অনুযোগ অনুনয় করবো না
সবাই চলে যাক, সবদিকে চলে যাক
মহাকাশ হয়ে মঙ্গল-অমঙ্গল গ্রহে যাক
ভোগের উপাচারে বারবার বাসরে যাক
সৈকত-কটেজ-রিসোর্ট হয়ে হেরেমখানা বেশ্যালয়ে যাক
সুযোগের সধবা-বিধবা-অনূঢ়া-বধূ হয়ে সবদিকে চলে যাক
আমার কোনো আপত্তি নেই...।’

রাজীব দাশের কাব্যক্ষমতার কথা তো আগেই বলেছি। নিরন্তর চর্চা চালিয়ে গেলে কাব্যকাননে তিনি ‘নিরন্ন ললাটে’র মতো আরও বিস্তর ফুল ফোটাতে পারবেন। তবে একটা কথা আছে। তাঁর একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তাঁকে এ কথা না বললেই নয়। বন্ধু সে, যে প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনাও করে। কবিতা হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীন সাহিত্যকর্ম। চিত্রকর্মকে যদি প্রাচীনতম ধরি, তারপরেই কবিতার স্থান। অর্থাৎ কবিতার অনেক বয়স হয়েছে। নানা পথ পরিক্রমায়, নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে কবিতা এখন পরিপক্ব। কবিতার বাঁক অনেক বদলেছে। অতীতের কবিরা কবিতাকে নিয়ে নান নীরিক্ষা করেছেন, বর্তমানের কবিরা করে যাচ্ছেন। বর্তমানের একজন কবিকে বিস্তর জানতে হয়। কবিতার দীর্ঘ যাত্রা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হয়। হোমার, বেদব্যাস, বাল্মিকী, দান্তে, এলিয়ট, গ্যাটে কিংবা এই বাংলার কালীদাস, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ হয়ে কবিতা এখন কোন পথে হাঁটছে, কবিতা এখন কী ধরতে চাইছে, কী বলতে চাইছে, মানবজীবনকে কীভাবে দেখতে চাইছে বা দেখাতে চাইছে কিংবা এই মহা প্রকৃতিকে একজন কবি কীভাবে বিশ্লেণ করতে চাইছে―এসব সম্পর্কে একজন আধুনিক কবিকে জানতে হয়। এই জানার মধ্য দিয়ে তার কলম হয়ে ওঠে আরো শাণিত, তার চেতনা হয়ে ওঠে আরো তীক্ষ্ণ, তার শব্দবোধ হয়ে ওঠে আরো জোরালো। রাজীব দাশ যদি তাঁর পঠন-পাঠনের আরেকটু বিস্তার ঘটান, পূর্বজ এবং বর্তমান কবিদের কবিতার প্রতি আরেকটু মনসংযোগ দেন, তবে নিঃসন্দেহে তিনি কবিতায় আরো ভালো করবেন, দেবী সরস্বতীর বিশেষ বর প্রাপ্ত হবেন।

এবার রাজীব দাশের গদ্যের বই ‘সততা জেনারেল স্টোর’ সম্পর্কে পাঠউপলব্ধি ব্যক্ত করা যাক। বইয়ের নামেই বোঝা যাচ্ছে তিনি বিশেষ কিছুর প্রতি ব্যাঙ্গ করেছেন, কোনো একটা অসঙ্গতিকে ধরতে চেয়েছেন লেখার মধ্য দিয়ে। তাঁর তিনটি বইয়ের মধ্যে এ বইতে লেখক হিসেবে তাঁকে পরিশীলিত মনে হয়েছে। যা কিছু তাঁর কাছে খারাপ, যা কিছু মলিন, যা কিছু অমঙ্গল―সেসব কিছুকে তিনি চিহ্নিত করেছেন বইটিতে। বইটির প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। একাধিক লেখা আমি জাতীয় পত্রিকাগুলোতে পড়েছি। তাঁর এ বইটি পড়ে মনে হয়েছে কবিতার চেয়ে তাঁর গদ্যের হাত ভালো, পরিপক্ব। তাঁর গদ্য পাথরের মতো কিংবা নিরস শুকনো মাটির মতো খটকটে নয়, তাঁর গদ্যে রস আছে। তিনি শুধু মুখের কথাকে লেখ্য রূপ দেন না, শব্দের মধ্য দিয়ে তিনি এমন এক রস সৃষ্টি করেন, যা পড়ে পাঠক শিল্পরসে সিক্ত হয়।

পঞ্চাশাধিক গদ্যের সংকলন তাঁর ‘সততা জেনারেল স্টোর’। প্রায় ১৬০ পৃষ্ঠার বই। বইটি পড়ার সময় মনে হয়েছে কবিতায় তিনি কিছুটা সংশয়ী, কিছুটা দ্বিধান্বিত, কিছুটা আড়ষ্ট। কিন্তু প্রবন্ধে তিনি নিঃসংশয়, দ্বিধাহীন। যা বলতে চান, তা স্পষ্ট করে বলে দেন। কোনো রাখঢাক করেন না, কোনো সত্যকে উপমা দিয়ে ঢেকে দিয়ে দুর্বোধ্য করে তোলার চেষ্টা করেন না। আমার মনে হয় রাজীব দাশ যদি গদ্যচর্চার প্রতি আরেকটু মনোযোগ দেন, পূর্বজ এবং সমকালীন গদ্যকারদের লেখাজোখা ভালো করে পড়েন, তবে তিনি কবিতার চেয়ে গদ্যে অনেক বেশি ভালো করবেন। কারণ তাঁর দেখার চোখ আছে, নৈতিক-অনৈতিক, মঙ্গল-অমঙ্গলকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা আছে এবং তা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত ভাষা তাঁর দখলে আছে।

পুলিশের চাকরি সহজ নয়। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবসময় নিবেদিত থাকতে হয়। এ দেশের মানুষ বড় বেশি অশান্তিপ্রবণ, বড় বেশি কলহপ্রবণ। সে কারণে শান্তি রক্ষার সৈনিক পুলিশ সদস্যদের সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। একজন পুলিশ সদস্য হিসেবে রাজীব দাশকেও ব্যস্ত থাকতে হয়। এই ব্যস্ততার মধ্যেও যে তিনি শিল্প-সাহিত্য নিয়ে ভাবতে পারেন, সুযোগ পেলেই যে লিখতে বসে যান―এটা অনেক বড় ব্যাপার, আশাজাগানিয়া ব্যাপার। আশা করছি ভবিষ্যতে লেখালেখিতে রাজীব দাশ আরো প্রতিশ্রুতিশীল হবেন, প্রসিদ্ধ হবেন এবং লেখালেখির মধ্য দিয়ে তাঁর পাঠকদের শিল্পরসে সিক্ত করবেন। তাঁর জন্য নিরন্তর শুভ কামনা।