শরীরে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় রক্তস্বল্পতা বলা হয়। হিমোগ্লোবিন হলো রক্তের লোহিত কণিকায় (RBC) বিদ্যমান একটি প্রোটিন, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পরিবহন করে। যখন হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়, তখন শরীরের কোষ ও টিস্যুগুলো যথেষ্ট অক্সিজেন পায় না, ফলে ক্লান্তি, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্টসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে_
আয়রনের ঘাটতি
হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য আয়রন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন না থাকলে হিমোগ্লোবিন তৈরি ব্যাহত হয়। এটি হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। বিশেষ করে নারীরা মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে, গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান প্রসবের পর আয়রনের ঘাটতিতে ভোগে।
ভিটামিন ও খনিজের অভাব
ফোলেট, ভিটামিন বি১২ এবং ভিটামিন সি’র অভাব হিমোগ্লোবিন তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ফোলেট এবং বি১২ রক্তকণিকা তৈরিতে সহায়তা করে, আর ভিটামিন সি আয়রনের শোষণ বৃদ্ধি করে। এই ভিটামিনগুলোর অভাব হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
রক্তক্ষরণ
রক্তক্ষরণ হিমোগ্লোবিন হ্রাসের সরাসরি কারণ। এটি অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক উভয়ভাবেই হতে পারে। গ্যাস্ট্রিক আলসার, হেমোরয়েডস, ক্যান্সার, অথবা দুর্ঘটনার ফলে রক্তক্ষরণ হলে রক্তের সঙ্গে হিমোগ্লোবিনও কমে যায়। দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষরণ ধীরে ধীরে শরীরকে নিঃশেষ করে দিতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী রোগ
কিডনি রোগ, ক্যান্সার, থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল এনিমিয়া, হাইপোথাইরয়েডিজম ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী রোগ হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। কিডনি থেকে উৎপন্ন ‘ইরিথ্রোপয়েটিন’ নামক হরমোন লোহিত কণিকা তৈরিতে সাহায্য করে। কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস পেলে এই হরমোনের উৎপাদন কমে যায় এবং হিমোগ্লোবিনও কমে যায়।
হরমোনজনিত সমস্যা
শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি রক্তকণিকা তৈরির গতি কমিয়ে দেয়।
পুষ্টিহীনতা
সুষম খাদ্যের অভাবে শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ হয় না, যার ফলে হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে, যারা একঘেয়ে ও কম পুষ্টিকর খাবার খায়, তাদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চাহিদা বেড়ে যাওয়া
গর্ভাবস্থায় নারীদের শরীরে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে হিমোগ্লোবিনের ঘনত্ব কমে যায়। এছাড়া গর্ভের শিশুর বিকাশের জন্য অতিরিক্ত আয়রন ও অন্যান্য উপাদানের চাহিদা সৃষ্টি হয়। যদি এই চাহিদা পূরণ না হয়, তবে হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কিছু ওষুধ রক্তকণিকা ধ্বংস করে বা হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। যেমন- কেমোথেরাপির ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল ইত্যাদি।
অতিরিক্ত কফি বা চা পান
চা ও কফিতে থাকা ট্যানিন এবং ক্যাফেইন আয়রনের শোষণ ব্যাহত করে। যদি কেউ অতিরিক্ত চা-কফি পান করে এবং পর্যাপ্ত আয়রনযুক্ত খাবার না খায়, তাহলে তার হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে।
পরজীবী সংক্রমণ
ডায়রিয়া বা কৃমি সংক্রমণের ফলে শরীর থেকে রক্ত বা পুষ্টি উপাদান বের হয়ে যেতে পারে। হুকওয়ার্ম বা রাউন্ডওয়ার্ম শরীরে আয়রনের ঘাটতি তৈরি করে, যা হিমোগ্লোবিন কমিয়ে দেয়।
হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা। যা প্রতিরোধে সুষম খাদ্যগ্রহণ, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পরজীবী নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে আয়রন ও ভিটামিন সম্পূরক গ্রহণ করা উচিত বলে পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।