বক্স অফিসে ঝড় তুলেছে ঐশ্বরিয়ার ‘পন্নিয়িন সেলভান’

সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০২২, ০২:৫৯ পিএম

ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মণি রত্নমের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‍‍`পন্নিয়িন সেলভান‍‍` ঝড় তুলেছে ভারতের বক্স অফিসে। মুক্তির পর মাত্র প্রথম সপ্তাহেই বাজিমাত করেছে এই ছবি। তর্কসাপেক্ষে, তামিল সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত ‍‍`পন্নিয়িন সেলভান‍‍` অবলম্বনে এই পিরিয়ড সিনেমা নির্মাণ করেছেন মণি রত্নম। আপাতত ছবির প্রথম পর্ব মুক্তি দিয়েছেন পরিচালক, যেখানে অভিনয় করেছেন বলিউড অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাই, দক্ষিণী অভিনেত্রী তৃশা কৃষ্ণণ, অভিনেতা কার্থি শিবকুমার, জয়াম রবি প্রমুখ।

নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত তামিল ভূখন্ডে রাজত্ব চালিয়েছিল যে চোল সাম্রাজ্য, তার রাজা আরুলমোজি বর্মণকে (ছবিতে জয়াম রবি অভিনীত) তার অনুগত প্রজারা খুশি হয়ে ‍‍`পন্নিয়িন সেলভান‍‍` উপাধিতে ভূষিত করে, যার অর্থ ‍‍`সকল রাজাদের রাজা‍‍`।

চোল সাম্রাজ্যের প্রথম রাজা না হলেও, রাজারাজার শাসনামলেই সাম্রাজ্য খ্যাতি ও সমৃদ্ধির চূড়ায় ওঠে। ছোট্ট একটি সাম্রাজ্য থেকে তিনি এটিকে ভারতের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। রাজারাজার শাসনামলে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, সুমাত্রা এবং থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার কিছু অঞ্চল পর্যন্ত চোল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে; এমনকি চীনের সাথেও কূটনৈতিক বন্ধন তৈরি হয় তাদের।

তারকায় ঠাসা সিনেমা ‍‍`পন্নিয়িন সেলভান: ১‍‍` নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৭০ মিলিয়ন ডলার। ইতিহাসবিদ সুনীল খিলনানি লিখেছেন- "রাজারাজা এমন কিছু কাজের নজির রেখে গিয়েছেন যা ভারতের অন্য কোনো সম্রাট এর আগে দেখাননি: তিনি বাণিজ্যিক নৌকা ও কাঠের পালতোলা নৌকায় করে নেতৃত্ব দিয়ে দূরদেশ থেকে সম্পদ নিজ দেশে ফিরিয়ে আনতেন।"

‍‍`পন্নিয়িন সেলভান: ১‍‍`-এর কাহিনী আবর্তিত হয়েছে রাজারাজা চোলের বাবা সিংহাসন ছেড়ে দেওয়ার পর তার সিংহাসনে আরোহণকে কেন্দ্র করে। ছবিতে দেখানো হয়েছে, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন হবু রাজা। রাজপরিবারের অন্য সদস্যরা মিলে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাজারা মিলে তাকে খুন করার পরিকল্পনা করে।

আর এ ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব দেন একজন ক্ষমতাধর অভিজাত না্রী নন্দিনী (ঐশ্বরিয়া রাই অভিনীত)। তিনি রাজারাজা চোলের ভাই আদিত্য কারিকালানের (বিক্রম অভিনীত) প্রণয়ী। প্রতিহিংসাবশত তিনি বিক্রম ও হবু রাজাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চান। কিন্তু বাধ সাধেন রাজকুমারী কুন্দাবাই (তৃষা কৃষ্ণণ অভিনীত)। তিনি সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ভাইদের রক্ষা করতে চান এবং তার যোগ্য ভাইটিই যেন সিংহাসনে বসেন তা নিশ্চিত করতে চান।


ছবিতে রাজকুমারদের বিশ্বস্ত বন্ধু ও যোদ্ধা বান্দিয়াথিবানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা কার্তিক শিবকুমার, যিনি অত্যন্ত কুশলতার সাথে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন।

‍‍`পন্নিয়িন সেলভান‍‍` চোল সাম্রাজ্যের গৌরবগাঁথা নিয়ে লিখিত, তামিল সাহিত্যের এক অসাধারণ উপন্যাস। আজও তামিলনাড়ুতে এই সাম্রাজ্যের অবদান চোখে পড়ার মতো। থানজাভুর শহরের গ্রানাইটের মন্দির আর চোখ ধাঁধানো সুন্দর ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে আজও রাজারাজা চোলের নৈপুণ্যের ছাপ পাওয়া যায়।

১৯৫৫ সালে প্রথম তামিল ম্যাগাজিন ‍‍`কালকি‍‍`তে ‍‍`পন্নিয়িন সেলভান‍‍` উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন লেখক-সাংবাদিক কালকি কৃষ্ণমূর্তি। ২০০০ পৃষ্ঠার এই ঐতিহাসিক কল্পকাহিনীর একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং ইংরেজি ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে।

এ উপন্যাসকে ভিত্তি করে লেখা কমিক বই এবং চলচ্চিত্র সংস্করণের মাধ্যমে আজও লোকমুখে পন্নিয়িন সেলভানের কাহিনী জনপ্রিয়। চেন্নাইভিত্তিক চলচ্চিত্র বিশ্লেষক প্রীতম চক্রবর্তী বলেন, "তামিলদের মধ্যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে এই ইতিহাস।  এখন দেখার পালা যে একবিংশ শতাব্দীর দর্শকেরা, যারা ‍‍`গেম অব থ্রোনস‍‍` বা ‍‍`বাহুবলি‍‍`র মতো চলচ্চিত্র দেখে অভ্যস্ত, তারা দশম শতাব্দীর তামিল রাজনীতি, চক্রান্ত ও প্রতারণাকে কেন্দ্র করে নির্মিত সিনেমা ‍‍`পন্নিয়িন সেলভান‍‍`কে কিভাবে গ্রহণ করেন।"

এদিকে পরিচালক মণি রত্মম ‍‍`পন্নিয়িন সেলভান‍‍` সম্পর্কে বলেছেন, তিনি এই সিনেমার মাধ্যমে দর্শকদের এমন একটি অভিজ্ঞতা দিতে চেয়েছেন যেন তারা সম্পূর্ণভাবে এই চলচ্চিত্রের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে পড়েন!

‍‍`পন্নিয়িন সেলভান‍‍`-এর সংলাপ মধ্যযুগীয় তামিল আবহে লিখিত হলেও আধুনিক দর্শকের তা বুঝতে সমস্যা হয় না। সিনেমার সঙ্গীতায়োজনের মধ্যেও রয়েছে বৈচিত্র্য... পশ্চিমা, ফোক ও সুফি সঙ্গীতের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে এই ছবিতে। ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রহমান।

তবে পাঁচ পর্বের একটি বিশাল বইকে দুই পর্বের চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়ার জন্য মণি রত্নমের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সমালোচকরা। জানা গেছে, আগামী বছর মুক্তি পাবে ‍‍`পন্নিয়িন সেলভান: ২‍‍`। দুই বছর মহামারির কবলে পড়া সত্ত্বেও মাত্র ১৫০ দিনে ছবির দুটি পর্বের শ্যুটিং শেষ করতে সক্ষম হয়েছেন মণি রত্নম; প্রতি পর্বের দৈর্ঘ্য আড়াই ঘণ্টা।

মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই বক্স অফিস কাঁপিয়েছে ‍‍`পন্নিয়িন সেলভান‍‍`। এমনকি দর্শকের চাহিদা মেটাতে গিয়ে চেন্নাইয়ের সিনেমা হলগুলোতে মধ্যরাত থেকে চলছে বিশেষ শো, তার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে দেখা গেছে দর্শকদের। তামিলনাড়ুর বিভিন্ন জায়গায় সিনেমা হলের বাইরে ঢোলের আওয়াজের তালে নাচতেও দেখা গেছে ভক্তদের।

‍‍`পন্নিয়িন সেলভান‍‍` দক্ষিণ ভারতে এতটাই উন্মাদনা ছড়িয়েছে যে তামিলনাড়ুর যেসব অঞ্চল আগে চোল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, দেশের সেসব অঞ্চলে এখন ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন ভক্তরা। ভক্তরা জানিয়েছেন, তারা অধীর আগ্রহে ছবির দ্বিতীয় পর্বের জন্য অপেক্ষা করছেন।