বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর হাত ধরেই একটি স্বাধীন দেশের জন্ম। দেশীয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ছাড়িয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু তাঁর হাত ধরেই। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশনের শেষ দিন বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার বিল উপস্থাপন করেন। পরে বিলটি পাস হয়।
যাত্রার শুরুতে ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ নাম থাকলেও পরবর্তী সময়ে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ বা এফডিসি নামে পরিচিতি পেয়েছে। ফলে ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর ৩ এপ্রিল জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হয়।
চলচ্চিত্রকে তিনি শুধু ভালোই বাসতেন তা নয়, অভিনয়ও করেছিলেন সিনেমায়। ‘সংগ্রাম’ সিনেমায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও দেখা গিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে। সিনেমাটি নির্মাণ করেছিলেন প্রয়াত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম।
এই ছবির চিত্রনাট্যের শেষ দিকে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনী বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্যালুট করছে। এই দৃশ্য কীভাবে ধারণ করা যায়, সে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম।
একপ্রকার দুঃসাহস নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন খসরু। প্রথমে না করলেও পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নানকে দিয়ে সুপারিশ করিয়ে অভিনয়ের জন্য বঙ্গবন্ধুকে রাজি করান খসরু। চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় সুচন্দা, খসরু ও বঙ্গবন্ধু অভিনীত মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘সংগ্রাম’ মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে।
স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় চলচ্চিত্রের বিশেষ দৃশ্যে বঙ্গবন্ধু অভিনয় করলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরে তাঁকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহ দেখা যায়নি নির্মাতাদের। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত বছর বঙ্গবন্ধু, তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়, যার বেশ কয়েকটি মুক্তি পেয়েছে। বাকিগুলো মুক্তির পথে।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ চলচ্চিত্র। সিনেমাটি নির্মাণ করছেন পরিচালক এখলাস আবেদিন। স্বাধীনতার এত বছর পরও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জীবনী বর্তমানে আমাদের জীবনে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করছে, তার ওপরে নির্মিত হবে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’।
‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ ছবিতে দর্শক দেখতে পাবেন, একটি থিয়েটার গ্রুপ বঙ্গবন্ধুর জীবনীর ওপর একটি নাটক মঞ্চস্থ করার প্রস্তুতি নেয়। সে নাটকটিতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কে অভিনয় করবেন, তা নিয়ে সৃষ্টি হয় জটিলতা। পরিচালকের নিজের লেখা এমনই এক গল্পে এগিয়ে যাবে ছবিটি। গল্প লেখার পাশাপাশি চিত্রনাট্য, কাহিনি ও সংলাপও লিখেছেন পরিচালক নিজেই। সাধক চলচ্চিত্রের ব্যানারে এতে অভিনয় করেছেন আলী রাজ, কাজী হায়াৎ, মামুনুর রশিদ, রোকেয়া প্রাচী ও রেবেকা।
মুজিব : একটি জাতির রূপকার
ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে জাতির পিতার বায়োপিক। সিনেমার নাম ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’। এটি পরিচালনা করছেন বলিউডের বিখ্যাত পরিচালক শ্যাম বেনেগাল। মুম্বাই ও ঢাকায় এ ছবির শুটিং করা হয়েছে। বর্তমানে সিনেমাটির এডিটিং ও ডাবিং চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে মুক্তি পাবে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯ মে বিশ্ব চলচ্চিত্রে মর্যাদাপূর্ণ কান চলচ্চিত্রের ৭৫তম আসরে ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ বায়োপিকের টিজার উন্মুক্ত করা হয়েছে। সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করছেন আরিফিন শুভ। ফজিলাতুন্নেছা রেণুর চরিত্রে কাজ করছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রে দেখা যাবে নুসরাত ফারিয়াকে। শেখ রেহানার চরিত্র করছেন সাবিলা নূর। এছাড়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চরিত্রে তৌকীর আহমেদ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার চরিত্রে তুষার খান, তাজউদ্দীন আহমদের চরিত্রে রিয়াজ আহমেদ, এ কে ফজলুল হকের চরিত্রে শহীদুল আলম সাচ্চু, আবদুল হামিদ খান ভাসানীর চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ, শওকত মিয়ার চরিত্রে সিয়াম আহমেদ, জেনারেল ওসমানীর চরিত্রে খন্দকার হাফিজ, আবুল কালাম আজাদকে দেখা যাবে জেল গার্ডের চরিত্রে। ফজলুর রহমান বাবু অভিনয় করছেন খন্দকার মোশতাকের চরিত্রে।
ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন অতুল তিওয়ারি ও শামা জায়েদি। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) ও জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন, ভারত (এনএফডিসি) ছবিটি প্রযোজনা করছে।
টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই
শাপলা মিডিয়ার প্রযোজনায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মিত আরেক ছবি ‘টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই’। সেলিম খান পরিচালিত সিনেমাটি এরই মধ্যে মুক্তি পেয়েছে। এতে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে দেখা গেছে শান্ত খানকে। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী রেণুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন দীঘি।
৫৭০
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে সপরিবার খুন হন বঙ্গবন্ধু। রুপালি পর্দায় সেই দিনটার ঘটনা তুলে ধরা হচ্ছে ‘৫৭০’ সিনেমার মাধ্যমে। এ সিনেমায় বাপ্পি চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ বহন করে নিয়ে যাওয়া একজন সেনাবাহিনীর সৈনিক চরিত্রে দেখা যাবে। মূলত তার উপস্থিতিতেই হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত মরদেহ ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গিপাড়ায়। আশরাফ শিশিরের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ছবিটি চলতি বছর মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাপ্পি ছাড়াও ছবিটিতে অভিনয় করেছেন মাসুম আজিজ, স্বাধীন খসরু, সুমনা সোমা, কাজী রাজু, এলিনা শাম্মীসহ তিন শতাধিক শিল্পী।
টুঙ্গিপাড়ার দুঃসাহসী খোকা
বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা নিয়ে নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র ‘টুঙ্গিপাড়ার দুঃসাহসী খোকা’। মাসুম রেজার চিত্রনাট্যে ২০১৯-২০ সালে সরকারি অনুদান পাওয়া এ সিনেমাটি নির্মাণ করবেন খ্যাতিমান পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার। এ সিনেমায় উঠে আসবে বঙ্গবন্ধুর কৈশোর ও যৌবনের গল্প। এতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বোনের জামাতা সৈয়দ নূরুল হকের চরিত্রে অভিনয় করবেন নিরব। তাছাড়া সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রে থাকছেন শহীদুল আলম সাচ্চু, লুত্ফর রহমান জর্জ, ফজলুর রহমান বাবু, রহমত আলী, গোলাম ফরিদা ছন্দা, এলিনা শাম্মী, সৌম্য জ্যোতি প্রমুখ।
চিরঞ্জীব মুজিব
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘চিরঞ্জীব মুজিব’। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন নজরুল ইসলাম। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত ছবিটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ১৯৪৯-৫২ সালের মধ্যকার ঘটনাপ্রবাহ উঠে এসেছে। এ চলচ্চিত্রে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন আহমেদ রুবেল। ফজিলাতুন্নেছা রেণুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা এবং বঙ্গবন্ধুর বাবা ও মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন যথাক্রমে খায়রুল আলম সবুজ ও দিলারা জামান। সিনেমাটি গত বছর ৩১ ডিসেম্বরে মুক্তি পেয়েছে।
মুজিব আমার পিতা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বই ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) অ্যানিমেশন ‘মুজিব আমার পিতা’ চলচ্চিত্রটি। এটি পরিচালনা করেছেন সোহেল মোহাম্মদ রানা। গত বছর অক্টোবরে সিনেমাটি মুক্তি পায়।
তর্জনী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে নির্মিত হতে যাচ্ছে সিনেমা ‘তর্জনী’। ভাষণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কেমন প্রভাব ফেলছে, তা তর্জনী সিনেমায় তুলে ধরবেন পরিচালক সোহেল রানা। এ সিনেমায় ১৯৭১, ১৯৭৫ ও ২০১৭—এ তিন সময়কে দেখানো হবে। পরিচালক সিনেমা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য ফার্স্ট লুক হিসেবে পোস্টার প্রকাশ করেছেন। তর্জনী সিনেমার গল্প যৌথভাবে লিখেছেন সোহেল রানা বয়াতি ও শাহাদাত রাসেল। আর চিত্রনাট্য লিখছেন শাহাদাত রাসেল।
আগস্ট ১৯৭৫
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ডের পরের দিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার ভিত্তিতে নির্মাণ হয়েছে ‘আগস্ট ১৯৭৫’। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন সেলিম খান। এতে অভিনয় করেছেন আনিসুর রহমান মিলন, মাজনুন মিজান, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, ফজলুর রহমান বাবু, তাসকিন রহমান, মাসুমা রহমান নাবিলা, দিলারা জামান, তৌকীর আহমেদ, তানভীন সুইটি প্রমুখ।
রেডিও
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসক ভাষণ প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ শুনতে পেয়েছিল রেডিওর মাধ্যমে। সেই ভাষণকে কেন্দ্র করে প্রত্যন্ত ওই গ্রামে জেগে উঠেছিল একদল মুক্তিপাগল জনতা, যা পরবর্তী সময়ে সূচিত করে স্বাধীনতার ভিত্তি। এ রকম একটি গল্প নিয়েই সাজানো হয়েছে ‘রেডিও’ সিনেমার গল্প। এতে অভিনয় করেছেন রিয়াজ, মমসহ আরও অনেকে।
মাইক
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে নির্মিত হচ্ছে শিশুতোষ চলচ্চিত্র মাইক। সিনেমাটি পরিচালনা করছেন এফ এম শাহীন ও হাজান জাফরুল বিপুল। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন তারিক আনাম খান, ফেরদৌস আহমেদ, তানভীন সুইটিসহ আরও অনেকে।
শুধু দেশেই নয়, বলিউডেও বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে ছবি নির্মিত হচ্ছে। এর নাম রাখা হয়েছে ‘ব্যাটল ফর বেঙ্গল’। পরিচালনা করবেন রিচি মেহতা। জানা যায়, পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির পাশাপাশি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে। চলতি বছর এগুলো মুক্তি পাবে।