‘আমাকে অভিনয়ে এনে সাফল্য দেখে যেতে পারেননি মুনীর ভাই’

সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ১১:৩৭ এএম
মুনীর চৌধুরী,ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

নন্দিত নাট্যকার, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী। শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। বুধবার (২৭ নভেম্বর) তার শততম জন্মদিন। বেঁচে থাকলে আজ ৯৯ পেরিয়ে পা রাখতেন শতবর্ষে। স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয়ের প্রাক্কালে পাক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন নন্দিত এই নাট্যজন।

প্রিয় মানুষের জন্মদিনে স্মৃতির ডায়েরি খুললেন তারই ছোট বোন বরেণ্য অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার।

তিনি বলে ‘জন্মদিনে ভাইকে মিস তো করি। উনি এত বড় মাপের ব্যক্তিত্ব ছিলেন, আমি বোন হলেও আমার চেয়ে উনাকে বেশি ভালোবাসত, বেশি জানত অন্যরা। সেসবের কিছুটা আমিও জেনেছি।
যেমন, উনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতেন, তখন অন্য ক্লাসের শিক্ষার্থীরাও এসে পেছনে দাঁড়িয়ে শুনত। উনার বক্তৃতা, ক্লাস নেওয়া এত আকর্ষণীয় ছিল, শুনলে মনেই হতো না যে পড়াশোনার ক্লাস। ওই যে অনেকে বলেন, ‘অমুক খুব ভালো কথা বলেন’, আগে ভাবতাম, কথা আবার ভালো-মন্দ কী! বয়স হওয়ার পর বুঝেছি, সবাই কথা বলতে জানে না। সবার কথা অতটা চিত্তাকর্ষক হয় না। উনি যেকোনো কথা রস দিয়ে বলতেন। উনার রসজ্ঞান খুব ভালো ছিল।’

ভাই যখন উর্দুভাষী একজন নারীকে (লিলি চৌধুরী) বিয়ে করে আনলেন, তিনি (ভাবি) খুব তাড়াতাড়ি বাংলা শিখে নিলেন। একদিন ভাবি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, মুনীর কি বাংলায় কথা বলে?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, বাংলায়ই তো বলেন। পরে তিনি বলেন, ‘উনার বাংলাটা ঠিক তোমাদের বাংলার মতো না।

মুনীর ভাই অত্যন্ত বিশুদ্ধ বাংলা বলতেন, একদম বইয়ের ভাষায়। একটা উদাহরণ দিই অনেকক্ষণ দরজায় টোকা দিচ্ছিলেন উনি। দরজা খোলার পর উনি বললেন যে ‘এত দেরি হলো কেন? কী করছিলি?’ আমিও উনার মতো শুদ্ধ ভাষায় জবাব দিলাম, ‘ভক্ষণ করিতেছিলাম।’ উনি বললেন, ‘তোরা আবার কিসের ভক্ষণ করিস? তোরা তো গিলিস। রাজা-বাদশাহরা ভক্ষণ করে।’ এই ধরনের রসবোধসম্পন্ন কথা তিনি তাৎক্ষণিক বলতেন। যেকোনো মানুষ ১০ মিনিট উনার সঙ্গে কথা বললেই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বললেও সেটার মধ্যে আনন্দ থাকত।

নাটক তো লিখতেনই। আমার প্রথম টিভি নাটক ‘একতলা দোতলা’ উনারই লেখা। মুনীর ভাইকে মানুষ যেভাবে দেখে, আমরা ভাই-বোন হয়েও একটু অন্যরকমভাবে দেখতাম। কারণ তিনি অনেক জ্ঞানী ছিলেন, অনেক কিছু জানতেন, পড়তেন। নাটক লিখে লিখে আমাদের পড়ে শোনাতেন। ছোট ভাই-বোনদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। বাজারে যে মৌসুমে যেই ফল আসত, সেটাই এনে আমাদের দিতেন। দিয়েই চলে যেতেন। আমাদের প্রতিক্রিয়াও শুনতেন না। এত সাধারণ, সহজ ছিলেন। তখন হয়তো সেভাবে বুঝিনি। চলে যাওয়ার পরই আমরা বুঝি। সেই ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করল। আমরা তার মরদেহও পাইনি। অনেক সময় চিন্তা করি, না জানি আমার ভাইকে কত কষ্ট দিয়েছিল। কারণ বুদ্ধিজীবীদের খুব কষ্ট দিয়ে মারা হয়েছিল। শুধু তো মুনীর ভাই নন, আরো অনেকে ছিলেন।

মুনীর ভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ স্মৃতি ১৯৭১ সালে। আমরা যখন ওপারে (ভারত) চলে গিয়েছিলাম। তাকেও অনেকে বলেছিল যাওয়ার জন্য। কিন্তু উনি বলতেন, ‘আমি কেন যাব? আমি তো কারো কোনো ক্ষতি করিনি।’ ওই কথাটা খুব মনে পড়ে। দিল্লিতে থাকাকালীন খবর পাই, উনাকে নিয়ে গেছে। শুনে মানসিকভাবে একদম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। দুই-তিন দিন বিছানায় পড়ে ছিলাম, খাওয়াদাওয়া করিনি। সে সময় আমার এক শিক্ষক আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, বুঝিয়েছেন যে পাকিস্তানি বাহিনীরা আমার ভাইসহ বুদ্ধিজীবীদের বুঝে-শুনেই নিয়েছে। কারণ ওই মেধাবীরাই দেশকে এগিয়ে নেয়। সেই মেধার অপূর্ণতা এখনো পূরণ হয়নি।

আমাকে অভিনয়ে আসার উৎসাহ দিতেন মুনীর ভাই। অথচ আমার সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। এ নিয়ে মন তো খারাপ হয়। মঞ্চে আমার প্রথম নাটক শওকত ওসমানের ‘ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা’। আমি কিন্তু খুব বৈরী পরিবেশ থেকে উঠে এসেছি। আমার বাবা নাটক-গান-থিয়েটার পছন্দ করতেন না। নোয়াখালীর ভাষায় তিনি বলতেন, ‘কুনোগা (কেউ) যদি নাটক করে, জবাই করি দিউম।’ তখন তো প্রশ্নই আসে না নাটক করার। একদিন আমি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছি, মুনীর ভাই এসে বললেন, ‘তুই কি আমার একটি নাটকে অভিনয় করে দিবি?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, কী বলেন আপনি এসব! বাবা তো জবাই দিয়ে দেবে। পরে ভাই বলেন, ‘সে দায়িত্ব আমি নেব। তুই করবি কি না বল।’ আমি তো অভিনয় জানি না, কিছু বুঝি না, কী করব? মুনীর ভাই বলেন, ‘কিছু করতে হবে না, এটা একটা রোবটের চরিত্র। যন্ত্রমানব, কিছু বুঝতে হবে না। শুধু সংলাপ বলে যাবি। চোখ-মুখের কোনো ভঙ্গিমার দরকার নেই।’ উনি দায়িত্ব নেওয়ায় সাহস পাই। অভিনয় করে আসার পর মুনীর ভাই কী যে আনন্দিত হলেন, কত আদর করলেন!

আমাদের বিশাল পরিবার ছিল, ১৪ ভাই-বোন। পারিবারিক সেই বন্ধন, ভালোবাসা তো নেই এখন। হিংসা, রেষারেষি এত বেড়ে গেছে। ভাই-বোনের মধ্যে হিংসা, ছেলে বাপকে গুলি করে মারছে। এগুলো বিশ্বাসই করতে পারি না। এখন তো সমাজ অসুস্থ। আমাদের মতো এ রকম বড় পরিবার আগে অনেক ছিল। ভাই-বোনরা ছোটাছুটি করতাম, এর গায়ে ওর ধাক্কা, পড়ে যাওয়া, চোট পাওয়া, এই সবের আনন্দ ছিল। এখন পরিবারে অত সদস্যও নেই, আবার তিন-চারজন যা থাকে, তাদের মধ্যেও রেষারেষি। আমি বলছি না সব এ রকম, কিছু ভালো পরিবারও আছে। কিন্তু ওরকম আর পাওয়া যাবে না। সময় তো পরিবর্তনশীল।

শহীদ মুনীর চৌধুরী স্মরণে ১৯৮৯ সাল থেকে একজন গুণীকে সম্মাননা দেওয়া হয়। এবার এই সম্মাননা পাচ্ছেন নাট্যব্যক্তিত্ব শিমুল ইউসুফ। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে নাট্যদল থিয়েটার। এই সম্মাননার অর্থমূল্য পঞ্চাশ হাজার টাকা। নাট্যদল থিয়েটারের পরিচালক রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘গত বছরও আমরা সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেছিলাম, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি তাদের হাতে তুলে দিতে পারিনি। এবার আমরা দুই বছরের সম্মাননা ও পদক একই অনুষ্ঠানে প্রদান করব। শিগগরি অনুষ্ঠানটির তারিখ সবাইকে জানানো হবে।’

রামেন্দু মজুমদার আরো বলেন, ‘মূলত মুনীর চৌধুরীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছর এই সম্মাননা দেওয়া হয়। কিন্তু কভিড মহামারির কারণে ২০২০ সালে অনুষ্ঠানটি করা সম্ভব হয়নি। পরের বছর একসঙ্গে দুই বছরের সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্তদের নিয়ে অনুষ্ঠান করা হয়। এবারও তাই হবে।’