মুশতারী বাইয়ের ছিল যমজ কন্যা। অভিজাত স্বামী দিচ্ছিলেন না স্বীকৃতি। সে আমলের অনেক তাওয়াইফ শিল্পীর মতো, স্বামীর পাঠানো অন্য লোক মারফত টাকাই ছিল আয়ের উৎস। আত্মীয়দের চক্রান্তে এক বাচ্চা মারা যায় বিষ মেশানো মিষ্টি খেয়ে। আরেক বাচ্চা বেঁচে থাকে। তাকে নিয়ে ফইজাবাদ থেকে মুশতারী বাই পালান। এক ঘরে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে মেয়েকে মানুষ করানোর চেষ্টা করেন। সেই ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে একদিন দেখা হয় বিখ্যাত গওহর জানের। গওহর জানের ওড়নার দিকে চেয়ে ছিল মেয়েটি। গওহর জান কাছে নিয়ে আদর করে বলেছিলেন, তুমিও বড় হলে এসব পরবে।
সেই আখতারী বাই একদিন হয়ে ওঠেন বেগম আখতার। যাকে পন্ডিত রবিশংকর বলেছিলেন, ‘ম্যাচলেস, দুনিয়ায় আরেকজন হবে না।’ সিন্ধি ভৈরব উৎসর্গ করেছিল তার জন্য। মুশতারী বাইয়ের সেই আশ্রয়হীন মেয়ে কলকাতায় একটা সময় এত আয় করতেন, টাকা গোনার প্রয়োজন মনে করতেন না। এক রেডিও কর্মকর্তা বলেছিলেন, আপনার আংটি টা সুন্দর। তিনি বিনা দ্বিধায় সেটি রেডিও অফিসারকে দিয়ে দেন। তার এক গুণগ্রাহী জমিদার এসেছিলেন কলকাতায়। তার জন্য গাড়ি কার্পেট অনেক কিছু কিনেছিলেন। জমিদার চলে যাওয়ার পর তিনি সব কাছের লোকদের বিলিয়ে দেন। আখতারী বাই যখন ছোট, গান শিখছেন ওস্তাদ আতাউল্লাহর কাছে কিংবা পরিচিত সারেঙ্গী ওস্তাদের কাছে, তখন বিহারের ভূমিকম্প উপলক্ষে চ্যারিটি শো হচ্ছিলো। বড় বড় শিল্পীরা আসেনি। তাকে উঠিয়ে দেওয়া হলো। পুরো আসর মাত করলেন। তখন ভারতে গানের রাজধানী ছিল কলকাতা। কলকাতায় রিপন স্ট্রিটের এক কামরার এক বাসায় থাকতে হয়েছিল কতদিন।
ম্যাগোফোনের জিতেন ঘোষই তাকে আবিষ্কার করেন। প্রথম দুই রেকর্ড তেমন চলেনি। মনে মনে ফৈজাবাদে ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। জিতেন ঘোষ তৃতীয়বারের মতো ঝুঁকিটা নেন। পুরো কলকাতা মুগ্ধ আখতারী বাইয়ে। বেগম আখতার তখন মঞ্চেও অভিনয় করেছেন। সঙ্গে লাইভ গান গেয়েছেন সব খানে। অনেক টাকা পয়সা কামিয়েছেন সেই সময়। বিত্তের চূড়ান্ত অবস্থায় ছিলেন। শাড়ি পরা বেগম আখতার কোনো আসরে গেলে অন্য শিল্পীরা গান গাইতে অনীহা প্রকাশ করতেন। উর্দু গজল থেকে বাংলা রাগাশ্রয়ী গান, কিসে তিনি নেই। সেই তিনি আবার ২৪ বছর গান না গেয়ে সিগারেট ও মদের সহায়তায় স্বামীর সংসার করেছেন। গান না গাওয়ার চুক্তি করে করা বিয়েটাও অবসাদে বিষণ্ণতার সিদ্ধান্ত, দাম্পত্যজীবনে কোনো সন্তান ছিল না। সত্তর দশকে এসে আচার্য জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ তাকে দিয়ে চারটা বাংলা গান গাওয়ান। ‘পিয়া ভোলো অভিমান’ (১৯৭২), ‘কোয়েলিয়া গান থামা’ (১৯৭২), ‘ফিরে কেন এলে না’ (১৯৭৫) ও ‘ফিরায়ে দিয়ো না মোরে শূন্য হাতে’ (১৯৭৫)। এই গানগুলো না থাকলে বেগম আখতার হয়তো কিছু দূরেই থাকতেন আমাদের।
তার সেরা গায়কী বেতারে গাওয়া লাইভে। গ্রামোফোনে খুবই কম অংশ ধরা গেছে। বেগম আখতার কত অসাধারণ ছিলেন, তার গল্প আছে এক আমলার জীবনীতে। তারা তখন নতুন সরকারি জবে ঢুকবেন। ট্রেনে লম্বা ভ্রমণ, অনেক উচ্ছ্বসিত। তো তাদের হইহুল্লোড় মাত্রা ছাড়ালে রেলের লোকেরা জানায়, পাশের কম্পার্টমেন্টে বেগম আখতার বসা। তারা খুব লজ্জায় পড়ে যান। কিছুক্ষণ পর গিয়ে ক্ষমা চান। বেগম আখতার হেসেই খুন। তিনি গল্পটল্প করেন ছেলেদের সঙ্গে। রাত বাড়লে তাদের ডেকে নিয়ে গান শোনান। ভাবুন জ্যোৎস্না রাত, ট্রেন, বেগম আখতার গাইছেন, অপার্থিবর অন্য নাম হতে পারে এটা।
১৯৭৪ সালে এই তিনি চলে যান আরেক দুনিয়ায়। বেগম আখতারের গজল এই উপমহাদেশের অন্যতম সেরা জিনিস। তবে আমি তাকে মনে রাখবো বাংলা গানের জন্যই। যার রেকর্ড শুনে পন্ডিত যশরাজ অব্ধি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তবলার সাধনা বাদ আমি স্বর সাধনা করবো। আজ জন্মবার্ষিকীতে তাকে মনে করার চেষ্টাটুকুই করা।