তদন্ত ছাড়াই বহিষ্কার, শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ফয়েজের

নোবিপ্রবি প্রতিনিধি প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৪, ০১:০৪ পিএম

তদন্ত ছাড়াই সাময়িক বহিষ্কার করে পাঁচ দিনের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। কিন্তু মামলায় জামিন পেয়েও দীর্ঘ চার বছর ক্লাস করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ তুলেছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) আইন বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী ফয়েজ আহমেদ। 

রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। 

সংবাদ সম্মেলনে বড় ভাই রাজুসহ নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া প্রহসন এবং দুর্বিষহ কাহিনি জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। 

ফয়েজ আহমেদ বলেন, “২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর মুহম্মদ মুমিন আদদ্বীন নামক একটি আইডি থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ নামক একটি গ্রুপে নোবিপ্রবির বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে ভিপি নুরের ছবি এডিট করে পোস্ট করেন। সেই পোস্টটি সমালোচনা করে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি শাহরিয়ার নাসের আবার পোস্ট করেন। সেখানে আমি কমেন্ট করে বলি এখানে দুঃসাহসের কিছু তো দেখছি না। এই একটি কমেন্টের কারণে আমাকে জেলজুলুম খাটিয়েও বেআইনিভাবে ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।”

ফয়েজ জানায়, ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই কোনোপ্রকার তদন্ত ছাড়াই ওই দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমাকে সাময়িক বহিষ্কার দিয়ে পাঁচ দিনের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এ ঘটনায় শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান বিপ্লব মল্লিককে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

যেখানে সদস্য হিসেবে ছিলেন তৎকালীন প্রক্টর নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ফিরোজ আহমেদ, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা বিভাগের পরিচালক আফসানা মৌসুমী, ভাষাশহীদ আব্দুস সালাম হলের প্রভোস্ট আনিসুজ্জামান রিমন এবং সদস্য সচিব হিসেবে ছিলেন নোবিপ্রবি বিএনসিসির পিইউও এ কিউ এম সালাউদ্দিন পাঠান।

তিনি বলেন, “কোনো প্রকার মামলা ছাড়াই আমাকে পরেরদিন গ্রেপ্তার করা হয়। ১৬ অক্টোবর নোবিপ্রবি ফার্মেসি বিভাগের ১২ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা প্রিতম হাসান (ওরফে মোফাজ্জল প্রিতম) বাদী হয়ে আমার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননার মামলা দায়ের করেন। যেখানে সাক্ষী হিসেবে ছিল তৎকালীন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার নাসের, শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের ২০১৮-১৯ বিভাগের শিক্ষার্থী আজহারুল ইসলাম সজিব এবং বিএমএস বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও পরবর্তীতে ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন সাব্বির। দীর্ঘ চার মাস আমি কারাগারে থেকে পরবর্তীতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জামিন পেয়ে বের হয়ে আসি।”

ফয়েজের অভিযোগ, “আমি কারাগারে থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতাতো করেই নাই বরং আমার পরিবারকেও নানাভাবে হেনস্তা করেছে। কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯ অক্টোবর ২০২০ তারিখে আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আমার বড় ভাই রাজু আহম্মদ বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের চেয়ে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করেন। কিন্তু সেই প্রত্যাহার আবেদনটি রেজিস্ট্রার বরাবর ফরওয়ার্ডিং করতে বাধা দেয় আইন বিভাগের চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া। পরবর্তীতে প্রায় প্রতিদিনই আমার পরিবার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করত। কিন্তু আমার নিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ফরওয়ার্ডিং না দিয়ে উল্টো আমার পরিবারকে হেনস্তা করেছিল।”

ফয়েজের বলেন, “আমি যখন কারাগার থেকে বের হই, ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য আমি এবং আমার পরিবার প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে যেতাম। তারা বলতো তোমার বিভাগের চেয়ারম্যান অনুমতি দিলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই আবার যখন চেয়ারম্যানের কাছে যখন যেতাম তখন তিনি বলতেন আমার হাতে কিছু নেই। বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের বিষয়ে আমি কোনো আপোস করতে পারব না। আমার বন্ধুরা আমার বিষয়ে কথা বলতে গেলে তাদেরকে শিবির ট্যাগ দিয়ে দিত। পরবর্তীতে তারা নিরুপায় হয়ে বের হয়ে আসত।”

ফয়েজ বলেন, “এভাবে দীর্ঘ চার বছর নানাভাবে চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত ক্লাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারি নাই। আমার সহপাঠীরা যখন ক্লাস করত, তখন আমি চেয়ারম্যানের অফিসে বসে বসে চোখের পানি ফেলতাম। আমার বাবা একজন আলেম মানুষ, আমার ভাই শিক্ষক। তারা আমার পরিবারকে দিনের পর দিন লাঞ্ছিত করত। আইন বিভাগের চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া আমার পরিবারকে নানাভাবে হেনস্তা করতো। আজকে পড়ালেখা করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। মিথ্যা মামলা এবং হয়রানির কারণে ঋণে জর্জরিত হয়ে আমার পরিবার আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে। ”

ফয়েজ আরও বলেন, এ ছাড়াও গত ৫ আগস্টের পর আমি তাকে আমার সঙ্গে করা অন্যায় স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি নোয়াখালীতে দায়িত্বরত সেনবাহিনীর অফিসার দিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেন। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দুঃখ প্রকাশ করে তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসেন।”

ফয়েজ তার সঙ্গে করা অন্যায়ের বিচার চেয়ে বলেন, “আমি এর বিচার চাই। নোবিপ্রবি প্রশাসন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আমার সঙ্গে এবং আমার পরিবারের সঙ্গে ঘটা অন্যায়ের বিচার চাই।”

ফয়েজ আহমেদের বড় ভাই রাজু আহমেদ বলেন, “একটা মিথ্যা এবং বানোয়াট বিষয়ে আমার ভাইয়ের জীবনটা তারা নষ্ট করে দিয়েছে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিচার হলেও সে ক্লাস পরীক্ষায় ফিরতে পারেনি। দীর্ঘ তিন বছর অমানুষিক কষ্ট করেছি আমরা। শত চেষ্টা করেও নোবিপ্রবিতে পড়ালেখা চলমান করতে না পেরে আমরা তাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যারা এর জন্য দায়ী আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের বিচার চাই। বিশেষ করে যারা তদন্ত কমিটিতে ছিল, তারাও এর জন্য দায়ী। তারা কোনো প্রকার তদন্ত না করেই ফয়েজকে সাময়িক বহিষ্কার দিয়েছে এবং পরবর্তীতে এই বিষয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।”

অভিযোগের বিষয়ে আইন বিভাগের চেয়ারম্যান বাদশা মিয়া বলেন, “আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা। প্রথমত বহিষ্কার করা এবং ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বোর্ড এবং একাডেমিক কাউন্সিলের হাতে। সেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে ওর ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছি আমি। কিন্তু মামলা চলায় একাডেমিক কাউন্সিল তা আমলে নেয়নি। এর বাহিরে ওর পরিবারের সাথে আমি কখনো খারাপ ব্যবহার করিনি। ধর্ষণ মামলার আসামি হলেও আমি বিবেচনা করব।” 

‘বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের বিষয়ে কোনো আপোষ নেই’ এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, “এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।” 

৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর দায়িত্বরত অফিসার দিয়ে ফয়েজকে তুলে নেওয়া হবে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাদশা মিয়া জানান, “উল্টো ভুক্তভোগী তাকে মারার হুমকি দিয়েছে এমন পরিস্থিতিতে তিনি নিরাপত্তা নিতে সেনাবাহিনীর হেল্পলাইনে অভিযোগ জানিয়েছেন।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বিপ্লব মল্লিক বলেন, এতদিন আগের ঘটনা এখন মনে পড়ছে না। 

এ ছাড়া আর কোনো কথা বলতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।