জবিতে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি-দখলবাজি

সোহানুর রহমান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২৪, ০৭:৪৯ পিএম
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি : সংগৃহীত

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় দিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ উঠেছে। সমন্বয়ক পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় বিচার-সালিসের নাম করে চাঁদাবাজি, লঞ্চ মালিক সমিতিকে শেল্টারের নামে টাকা নেওয়া, পুলিশ কর্মকর্তাকে মামলা থেকে বাঁচানোর জন্য চাঁদা নেওয়া, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা, বাজার মনিটরিংয়ের নামে ব্যবসায়ীদের থেকে চাঁদা এবং জমি, ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন দোকান দখল করে দিয়ে লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি করছে একটি ‘সিন্ডিকেট’। এই সিন্ডিকেটের কয়েকজন সমন্বয়ক হলেও, বাকিরা এই সমন্বয়কদের কাছের হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। এসব সদস্যদের মধ্যে বেশিরভাগই ‘ছাত্রলীগ কর্মী’ এবং শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই চাঁদাবাজি ও দখলবাজি সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. মাকসুদুল হক, একই বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী মো. সোহান প্রামাণিক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মো. রাশিদুল ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ১১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী জসিম উদ্দিন, ফার্মেসি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের আবু বকর খান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের একেএম পারভেজ রাকিব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ১২তম ব্যাচের ফরাজি মাসুম বিল্লাহ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৬-১৭ বর্ষের সানাউল্লাহ আল ফাহাদসহ আরও কয়েকজন।

তাদের মধ্যে মো. সোহান প্রামাণিক ২৭ সদস্যের জবির সমন্বয়ক টিমে আছেন। তিনিও শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসাইনের ঘনিষ্ঠ কর্মী। বাকিরা সমন্বয়ক না হলেও বাকি সমন্বয়কদের সঙ্গে তাদের ভালো সম্পর্ক থাকায় পুরো সিন্ডিকেটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা।

মাকসুদুল হক শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম ফরাজির কর্মী হিসেবে পরিচিত হাসিনা সরকারের আমলে সর্বশেষ ডামি নির্বাচনে ছাত্রলীগের সংসদীয় আসনভিত্তিক সমন্বয়ক টিমের সদস্য ছিলেন। গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর বর্তমান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাদ্দাম-ইনান স্বাক্ষরিত একটি প্যাডে দেখা যায়, তিনি সংসদীয় আসন-১৫২, ময়মনসিংহ ৭-এর সমন্বয়ক সদস্য ছিলেন। এই মাকসুদুল সমন্বয়ক না হলেও সমম্বয়ক পরিচয় দিয়ে সোহান, রাশিদুল, আবু বকর, জসিম, মাসুমসহ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে পুরান ঢাকাসহ আশেপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কবি নজরুল কলেজ শাখার একজন সমন্বয়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মাকসুদুলের সঙ্গে আমিসহ কয়েকজন ছেলে লঞ্চ মালিক সমিতির কাছে যাই তাদের অভয় দিতে। কিন্তু সে নিজেকে জবি শাখার সমন্বয়ক পরিচয়ে তাদের যেকোনো সমস্যা হলে সমাধান করার কথা বলে লঞ্চ মালিক সমিতির কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা আদায় করে। যা আমি পরে জানতে পেরেছি।”

এ ছাড়া লালবাগ বিভাগ ও ওয়ারী বিভাগের কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে তাদের শেল্টার দেবে এবং কোনো মামলা হতে দেবে না মর্মে বড় অঙ্কের টাকা নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া জবি থেকে গ্রেপ্তার হওয়া সমন্বয়ক নূর নবীকে নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তা এডিসি বদরুলসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা না করতে নূরনবীকে চাপ দেন। তিনি নূরনবীকে এমন প্রস্তাবও দেন যে, তাদের নামে মামলা করার দরকার নাই, যত টাকা চাও, তোমায় তাদের থেকে নিয়ে দিচ্ছি।

এ বিষয়ে ছাত্র আন্দোলনে নির্যাতিত ছাত্র নেতা মো. নূর নবী বলেন, “মাকসুদুল হক এবং বাংলা বিভাগের ১২ ব্যাচের এক ভাই আমাকে এসে বলেছে, এসি মোস্তফাসহ কয়েকজন আমার সঙ্গে বসতে চান। আমি যাতে মামলা না দেই, সেজন্য তারা বসে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চান। আমাকে যে তারা নির্যাতন করেছিলেন সে জন্য তাদের নামে যাতে আমি মামলা না করি, সেই প্রস্তাব দেন তারা।”

এ ছাড়া বাজার মনিটরিংয়ের নামে পুরান ঢাকার পাশের বেশকিছু আড়ত ও দোকান থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গ্রেটওয়াল মার্কেটের যেসব ব্যবসায়ী আগে অবৈধভাবে দোকান দখল করে ব্যবসা করছিলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেসব দোকানদারের কাছ থেকে ব্যবসা চালু রাখার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন তিনি ও তার সহযোগীরা। আন্দোলনে জড়িত একাধিক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব চাঁদাবাজির টাকায় তিনি নতুন মোটর সাইকেল কিনেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রেটওয়াল মার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, “আমাদের কয়েকটি দোকান ছাত্রদলের নেতারা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। আমরা ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে সেটি ম্যানেজ করেছি। এর জন্য তাদের কিছু টাকা দিতে হয়েছে। মাকসুদুলের ছবি দেখালে তিনি ছাত্রদলের নেতৃত্বে ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন ওই ব্যবসায়ী।

এদিকে মাকসুদুল, রাশিদুল জসিম, মাসুম বিল্লাহ, সোহানসহ কয়েকজন জবি ক্যাম্পাসের সামনে আরামবাগ হোটেলে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন। সেখান থেকে ২৫ টাকা আদায় করেছেন বলে সমন্বয়কদের কয়েকজন নিশ্চিত করেছেন।

আরামবাগ হোটেলের মালিক ভয়ে মুখ না খুললেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আরামবাগ হোটেল থেকে তারা ৫০ হাজার টাকা চাইছিল। পরে ২৫ হাজার টাকা নিয়েছে। আমার সামনে এটি ঘটেছে।”

শ্যামবাজার ব্যবসায়ী সমিতির কাছ থেকে ২ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকাও চাঁদা নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।  হল আন্দোলন শুরু হলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া তিব্বত হলের জায়গায় গড়ে উঠা গুলশান আরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সনির কাছে থেকে ২০ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গুলশান আরা সিটি ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা বলেন, “ভাই কিছু বলতে পারব না ভয়ে। ছাত্ররা এসে মারধর, ভাঙচুর করবে। আমরা ব্যবসা করতে পারব না। জগন্নাথের ছাত্র পরিচয় দিয়ে এসে সমিতির কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে গেছে। আরও টাকা না দিলে দোকান সব বন্ধ করে দেবে বলে গেছে।”

এ ছাড়া মো. রাশিদুল হাসানও ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিত। ক্যাম্পাস ছাত্রলীগেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আলামিন সরকার আশিকের কাছের ছোটভাই হিসেবেও পরিচিত তিনি। এই রাজনৈতিক পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন ক্যাম্পাসসহ আশপাশের এলাকা। তিনি এই চক্রের অন্যতম হোতা হিসেবে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।

জসিম উদ্দিন ছিলেন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। তিনি শুরুর দিকে অনেক বেশি সক্রিয় থাকলেও পরে কিছুটা কমিয়ে দেন। ফরাজি মাসুম বিল্লাহ ইব্রাহীম ফরাজির কর্মী ছিলেন। তিনিসহ ও তার সহযোগীরা ক্যাম্পাসের সামনের কথিত টিএসসি এবং ছাত্রী হলের সামনের একটি দোকান বন্ধ করে দিয়ে টাকার বিনিময়ে নতুন কয়েকটি দোকান বসিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

ভুক্তভোগী কয়েকজন দোকানদার বক্তব্য না দিতে চাইলেও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এদিকে সানাউল্লাহ আল ফাহাদ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজির অনেক ঘনিষ্ঠ এবং তার বিভিন্ন অপকর্মের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। ফাহাদ বিভিন্ন সময়ে ইব্রাহিম ফরাজির থেকে পকেট মানি নিয়ে চলতেন। তিনি ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনীর দখল থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল ইসলাম হলে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের সঙ্গে থাকতেন। সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজিতে বিভিন্ন দোকানের তথ্য সংগ্রহসহ ছাত্রলীগের দখলে থাকা বিভিন্ন দোকানের তথ্য দিয়ে তিনি এই চক্রের চাঁদাবাজিতে সহযোগিতা করে আসছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের সহযোগীদের মধ্য থেকেই কয়েকজন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাকসুদুল, সোহান প্রামাণিক, রাশিদুল, ফরহাদ হোসেনের নেতৃত্বে এই চাঁদাবাজ-দখলবাজ সিন্ডিকেট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পুরান ঢাকা, কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায়  অর্থের বিনিময়ে জমি দখল, দোকান দখল, ফ্ল্যাট দখলসহ বিভিন্না বিচার সালিশের নামে অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন তারা।

গত ১২ আগস্ট ইংরেজি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রাশিদুল ও পারভেজের নেতৃত্বে একটি দল সমন্বয়ক পরিচয়ে কেরানীগঞ্জে যান একটি জমি দখল করে দিতে। সেখানে বিচার সালিশের নাম করে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জোরপূর্বক জমি দখল করে আরেকজনকে বুঝিয়ে দেন। জমি পাওয়া সেই ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা নেন। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ওই সালিশি বৈঠকের ছবি দেখালে নিশ্চিত করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপস্থিত একজন বলেন, “এসব ছাত্ররা সেদিন সালিশি বৈঠকের নাম করে জোরপূর্বক জমি দখলে নিয়ে দিয়ে যান। না মানলে আরও ছাত্র ডেকে এনে মারধর করবে বলে ভয় দেখায়। এর জন্য তারা টাকা নিয়েছে।”

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মাকসুদুল হক বলেন, “আমিও এমন শুনতেছি। কিন্তু যদি এসবের কোনো ফুটেজ থাকত, তাহলে ভালো হতো। তবে শ্যামবাজারে একটা ভাতের হোটেলের সামনের জায়গা কয়েকজন অবরুদ্ধ করে একটা দোকান বসিয়ে প্রতিদিন হাজার টাকা করে নিত। সেখানে সমাধানের জন্য আমরা গিয়েছিলাম। তবে আমাদের সঙ্গে কোনো লেনদেন হয়নি। আর কেরানীগঞ্জের সালিশে আমাদের রাশেদ ও ফরহাদ ভাই গেছিল। তারা সেখান থেকে আসার পর কিছু অভিযোগ শুনে আমি আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তারা বলেছিল কোনো লেনদেন হয়নি। এমনকি সম্প্রতি আমি একটা বাইক কিনেছি। এটা নিয়েও কয়েকজন প্রশ্ন তুলেছে। অথচ গত শীতে আমি জ্যাকেটের ব্যবসা করে বাইকটি কিনেছিলাম।”

আরেক অভিযুক্ত জসিম উদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি এসবের কিছু জানি না। আমি এমন কোনো কাজ করিনি।”

আরেক অভিযুক্ত মো. সোহান প্রামাণিক বলেন, “আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়ে কাজ করছি। আমরা কেন এসব কাজ করব? আমরা এ ধরনের কোনো কাজ করিনি। এসব আপনাদের কে বলেছে? আপনি এসব অভিযোগের প্রমাণ নিয়ে ক্যাম্পাসে এসে দেখা করেন।”

এ ‍বিষয়ে বাকি অভিযুক্তদের বক্তব্য জানতে ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। কয়েকজনের ফোনে রিং হলেও রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক হুমায়ুন কবির বলেন, “এই বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে তারা যদি এমন কাজ করে থাকেন, খুবই দুঃখজনক। শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ ধুলোয় মিশে যাবে।”

সমন্বয়কদের নামে চাঁদাবাজির বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম গণমাধ্যমকে বলেন, “সমন্বয়কদের নামে যারা চাঁদাবাজি করছে, তাদের লকারবন্দি করতে হবে। এসব কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। এসবের বিরুদ্ধে আমরা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করব।”