প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার গল্প শুনিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় কবির প্রেমিকা বরুণা কথা রাখেনি, ফলে অভিমানী কবি বিলাপ করে বলেছিলেন, ‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি।’ ঠিক তেমনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।
দীর্ঘ ৩১ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন বন্ধ থাকার ফলে ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১তম সিনেট অধিবেশন।
শনিবার (২৯ জুন) বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে ৪১তম বার্ষিক সিনেট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গত ৩১ বছর কথা রাখেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর ফলে সাধারণ ছাত্রদের দাবি-দাওয়া অধিকার নিয়ে কথা বলার মতো নেতৃত্ব গড়ে উঠেনি এখানে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বিরাজ করছে ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য। ভিন্নমতাবলম্বীদের মতামতের কোনো মূল্য থাকছে না বলে অভিযোগ রয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
এর আগে গত ৪০তম সিনেট অধিবেশনে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম বলেছিলেন, “জাকসু নির্বাচনের জন্য সরকারের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা এবং অতিরিক্ত ফোর্স প্রয়োজন। সেজন্য আমরা চাইলেই নির্বাচন দিতে পারিনি। ডিসেম্বরের আগে নির্বাচন দেওয়াও সম্ভব হবে না। যেহেতু আমি কথা দিয়েছি, সুযোগ বুঝে জাকসু নির্বাচন দেবো।”
তবে এর আগেও শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের নভেম্বরের মধ্যেই জাকসু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। সে অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনারও নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপরেও জাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে দীর্ঘদিন জাকসু অচল থাকলেও সচল রয়েছে এ খাতের আয়।
তবে ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া এই সিনেট অধিবেশন ‘অপূর্ণাঙ্গ’ আখ্যা দিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ছাত্র নেতারা জানান, ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ অনুযায়ী জাবির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ সিনেট।
সেই সিনেটে অন্যান্য প্রতিনিধির সঙ্গে অধ্যাদেশের ১৯(১) এর (ক) ও ১৯ (২) ধারা মেনে জাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সিনেটে ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধির বিষয়টি ৩১ বছরে নিশ্চিত করা হয়নি। দীর্ঘ সময় ছাত্র-প্রতিনিধিদের মনোনীত সদস্য ছাড়াই সিনেটের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটেনি। অন্যদিকে, জাকসু ও হল সংসদ না থাকায় বর্তমানে ক্যাম্পাসে যোগ্য ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না।
পাশাপাশি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড মন্থর গতিতে চলতে বলে অভিযোগ ছাত্রনেতাদের। অ্যাক্ট অনুযায়ী সিনেটের মোট সদস্য ৯২ জন (উপউপাচার্য একজন হলে)। তবে এবারের সিনেটে রয়েছেন ৮৭ জন সদস্য। বাকি আসনগুলো শূন্য রয়েছে।
এদিকে শনিবার অনুষ্ঠিত ৪১তম সিনেট অধিবেশনে সিনেট সদস্য অধ্যাপক মোতাহার হোসেন অতি দ্রুত জাকসু নির্বাচনের দাবি জানান।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, “সিনেটে আমাদের ছাত্রপ্রতিনিধি থাকা অতীব জরুরি। বাজেট অধিবেশনে ছাত্রপ্রতিনিধি না থাকায় আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশ ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য জাকসু প্রতিনিধি থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা চাই অতি দ্রুত জাকসু নির্বাচন দিয়ে বাজেট অধিবেশনে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের যুক্ত করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমি এর আগেও বারবার উপাচার্যকে জাকসু নির্বাচন দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের জন্য সিনেটে দ্রুত জাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধি যুক্ত করার জন্য উপাচার্য স্যারকে অনুরোধ করব।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ও ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, “শিক্ষার্থীপ্রতিনিধি ছাড়া সিনেট অসম্পূর্ণ। অসম্পূর্ণ সিনেটের সকল সিদ্ধান্তও অসম্পূর্ণ। গত ৩১ বছর ধরে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি না থাকলেও সেদিকে প্রশাসনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নির্বাচন না হলেই যেন ভালো। তারা যে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আ্যাক্ট ব্যবহার করে নিজেদের সকল কাজকে স্বীকৃতি দিতে ব্যস্ত, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ছাড়া সিনেট অধিবেশন সেই আ্যাক্টের স্পষ্ট লঙ্ঘন। আমি এর আগেও বারবার জাকসু নির্বাচনের কথা বলেছি। আগামীকালকে অধিবেশনেও আমি জাকসুর কথা উল্লেখ করব।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নূরুল আলমের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।