যে কারণে পিছিয়ে পড়ছে ছেলেরা

বিজন কুমার প্রকাশিত: মে ১৯, ২০২৪, ০৯:৫৪ পিএম
এসএসসি পরীক্ষা। ফাইল ছবি

এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে পিছিয়ে পড়েছে ছেলেরা। পাসের হার আর জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিক থেকে তাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে মেয়েরা। কয়েক বছর ধরেই এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে কেন ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই কারও কাছে। এমন পরিস্থিতিতে ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন খোদ সরকারপ্রধান।

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ছেলেদের পেছনে ফেলে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত দেখা গেছে দিনাজপুরের ৪নং শেখপুরা ইউনিয়নের দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। আশা-লিপি রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৪ পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়া ১৭ জনের মধ্যে ৯ জনই মেয়ে। যাদের মধ্যে এক মেয়ে পেয়েছেন গোল্ডেন এ প্লাস।

অন্যদিকে, চাইল্ড হ্যাভেন মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের প্রতিষ্ঠানের ২৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। যার মধ্যে ৭ জনই মেয়ে। দুইটি স্কুলের ফলাফলেই জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে মেয়েরা। অর্থাৎ মেয়েদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে ছেলেরা।

জানতে চাইলে আশা-লিপির ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক ফয়সাল সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ছেলেরা মনে করে পড়ালেখা না করলে ব্যবসা বা কিছু একটা করবো। তবে মেয়েদের চিন্তা থাকে পড়ালেখা করেই কিছু করতে হবে। অন্যদিকে, ছেলেরা চাইলেই যখন যেখানে খুশি যেতে পারে। আর মেয়েরা সন্ধ্যা হলেই বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। এতে মেয়েরা লেখাপড়ায় বেশি সময় দেয়। ফলে তারা এগিয়ে যায়।”

প্রায় একই কারণ উল্লেখ করে চাইল্ড হ্যাভেনের প্রধান শিক্ষক কৌশিক দাস বলেন, “ছেলেরা একটু দুরন্ত, তাই ক্লাসে বেশিক্ষণ থাকতে চায় না। মেয়েদের ক্ষেত্রে তার উলটো। মেয়েরা সকাল থেকে ক্লাসে থাকছে। বাইরে যাওয়ারও তেমন আগ্রহ নেই। মোবাইলে আসক্তিও কম। ছেলেদের পড়ার প্রতি আগ্রহ কম থাকার একমাত্র কারণ তারা চঞ্চল। যে কারণে মেয়েরা এগিয়ে থাকে।”

ছেলেরা কেন পিছিয়ে পড়ছে তা নিয়ে কথা হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল দিনাজপুরের আশা-লিপি আর চাইল্ড হ্যাভেনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তাদের মধ্যে একজন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত রিন্তি রায় রুম্পা আর অপরজন জিপিএ-৪ দশমিক ৯৪ প্রাপ্ত শাহরিয়ার আহমেদ শুভ। পড়ালেখায় শুভর চেয়ে রুম্পা বেশি মনোযোগী ও সচেতন।

রিন্তি রায় রুম্পা বলেন, “সকাল ৭টায় উঠে স্কুলে গিয়েছি। এরপর বাড়ি ফিরেছি রাত ৮টায়। মোবাইল ফোন হাতে দেয়া নিষেধ ছিল। বাড়ি ফিরে খেয়ে ঘুম। রাত ১২টায় উঠে পড়াগুলো এক পলক দেখেছি। যেহেতু বাবা-মা আমার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছে, তাই তাদের ভালো ফলাফল দেখানোর চেষ্টা করেছি। তাছাড়া পড়ালেখা না করলে তো ভালো কিছু করতে পারবো না। তাই পড়ালেখাতেই মনোযোগ দিয়েছি, যাতে ভালো কিছু হতে পারি।”

শাহরিয়ার আহমেদ শুভ বলেন, “কেন যে ফলাফল এমন হলো জানি না। এখন মনে হচ্ছে আরেকটু ভালো করে পড়া দরকার ছিল। কোথাও তেমন আড্ডা দেইনি। সকালে ঘুম থেকে উঠেছি কখনো ৫টা, কখনো ৬টা। বোর্ড চ্যালেঞ্জ করেছি। দেখি কি হয়?”

এদিকে, শিক্ষাবিদরা বলছেন, “পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা এবং তা থেকে সৃষ্ট নারী-পুরুষ বৈষম্যতার কারণে ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে।” এছাড়া মেয়েদের জন্য সরকারের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহারকেও দুষছেন তারা।

ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম দায়ী করেন পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে। বলেন, “মেয়েরা পড়ালেখাকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়, ছেলেরা সেভাবে দিতে চায় না। ছেলেরা নানা কাজে, মা-বাবাদের টাকায় মোটরসাইকেলে ঘোরাফেরা বেশি করে। এতে দেখা যায়, মফস্বল শহরের কলেজগুলোতে মেয়েদের উপস্থিত বেশি। মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার তো আছেই। মেয়েদের তুলনায় মোবাইল সবচেয়ে বেশি ছেলেরাই ব্যবহার করে।”

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, “পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার দরুণ যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে তারই প্রভাবে ছেলেরা পিছিয়ে পড়ছে। এটা কোনো আইন করে রোধ করা যাবে না। সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে এটা চলছে। নারী-পুরুষের যে বৈষম্য, তা দূর করতে পারলে ছেলেরা অপকর্মের দিকে ছুটবে না। ফলে তারাও পড়ালেখার দিকে ঝুঁকবে এবং এগিয়ে যাবে।”

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিন লুৎফা বলেন, “আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিবার সব সময় মনে করে, ছেলেরা বাইরের কাজ করবে আর মেয়েরা ঘরে কাজ করবে। তাছাড়া পরিবার মনে করে ঘরের বাইরে মেয়েদের নিরাপত্তা কম। আর তাই পরিবার মেয়েদের ঘরেই রাখে। এ কারণে মেয়েরা পড়ালেখায় বেশি সময় দিতে পারে।”

ড. সামিন লুৎফা আরও বলেন, “আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দেখা যায়, মেয়েরা পড়ালেখায় ভালো না হলে পরিবার বিয়ে দেয়। তাই মেয়েরা প্রমাণ করতে চায়, তারা পড়ালেখায় ভালো। এতে করেও মেয়েরা এগিয়ে যায়। গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে মেয়েদের জন্য সরকার কিছু আলাদা পদক্ষেপ নিয়েছেন। এটাও মেয়েদের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ। কারণ ছেলেদের জন্য যেহেতু এমন আলাদা সুবিধা নেই, তাই তাদের পরিবার তাদের অন্য কাজে পাঠিয়ে দেয়। ফলে ছেলেরা ঝরে যায় আর মেয়েরা এগিয়ে যায়।”

সূত্রমতে, ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা ৫ বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পাশের হারে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ পিছিয়ে ছিল। এছাড়াও ২০২১ সালে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ, ২০২২ সালে দশমিক ৫৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৩ দশমিক ০১ শতাংশ পিছিয়ে ছিল। এবারের ফলাফলেও ছাত্ররা ছাত্রীদের তুলনায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ পাশের হারে পিছিয়ে রয়েছে।