‘ভাস্কর্য ফেলে রাখা ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়’

আরিফ জাওয়াদ, ঢাবি প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২৩, ০৪:৪৪ পিএম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অবস্থিত অপরাজেয় বাংলা

ভাস্কর্য শুধু শৈল্পিক অবয়ব না, এর পেছনে লুকিয়ে আছে ইতিহাস ও সংস্কৃতি। শিল্পের ভাষা অনেকটা রুচিবোধের ওপর নির্ভর করে। এমনটিই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের একদল শিক্ষার্থী।

কয়েকজন শিক্ষার্থী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঢাবি এলাকাজুড়ে অসংখ্য ভাস্কর্য রয়েছে। কখনো কখনো ভাস্কর্যের মধ্যেও একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকে। এর ওপর ভিত্তি করে ভাস্কর্যের গুরুত্ব বেশিই হয়ে ওঠে। কখনোবা এই গুরুত্বের কারণে অবহেলায় পড়ে থাকে অন্য ভাস্কর্য। আরেকটি বিষয় হলো, এসব ভাস্কর্যের নিজস্ব কিছু কথা থাকে, তৈরির পেছনের প্রেক্ষাপট থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে থেকেও কোনো কোনো ভাস্কর্য হয়ে ওঠে নির্ভরতার ঠিকানা।”

রাজু ভাস্কর্যের প্রসঙ্গ টেনে ওই শিক্ষার্থীদের একজন বলেন, “এটির গুরুত্ব সবার কাছেই রয়েছে। কেউ মনে করেন, এটি দাবি আদায় কিংবা কণ্ঠস্বর জাগ্রত করার স্থান। সবাই এখানে আসে অধিকার ও দাবি আদায়ের কথা নিয়ে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক ভাস্কর্য আছে। যেগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না। মূলত ওই সব ভাস্কর্যে জীবনাচারের বিষয়টি চলে আসে বলে মনে করি।”

কিছু ভাস্কর্য কখনো কখনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা কিংবা টিএসসির সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য।

এ বিষয়ে কথা হয় হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাকিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সালটি ২০১৭ হবে। সবে মাধ্যমিকের পাট চুকে উচ্চমাধ্যমিকের জন্য নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়েছি। একদিন ছুটিতে এক বন্ধুর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এলাম। বলে রাখা ভালো, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেই সময়েই প্রথম। ওই দিন বন্ধু আর আমি হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে একটু দূর থেকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্য দেখলাম। তখন মনে হলো, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি। বলে রাখা ভালো, আমাদের জানা ছিল না যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।”

এই শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা জানান দেয়, কোনো কোনো ভাস্কর্য একপর্যায়ে তার নিজস্ব অতীত ইতিহাসের প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচয় বহন করে।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. কামরুজ্জামান মনে করেন, ভাস্কর্যের সঙ্গে যেই বিষয়টি আমার বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, তা হলো ইতিহাসগুণ। কারণ খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রতির কিন্তু অতীত ইতিহাস রয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ‘ভাস্কর্য জীবন্ত ইতিহাস।’ ফেলে রাখা ইতিহাস চলার পথেও স্মরণ করিয়ে দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ‘অপরাজেয় বাংলা’, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে ‘শান্তির পায়রা’, সড়ক দ্বীপের ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’, টিএসসি চত্বরে ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য, বেগম রোকেয়া হলের ভেতরে ‘রোকেয়া ভাস্কর্য’, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সামনে ‘মা ও শিশু ভাস্কর্য’, মধুর ক্যানটিনের সামনে মধুদার ‘ভাস্কর্য’, জগন্নাথ ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের মাঝামাঝি ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম’সহ ছোট-বড় ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাস্কর্য বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, “ভাস্কর্য রক্ষণাবেক্ষণে যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। কেননা, মেরামত করা হলে একটি ভাস্কর্যের মধ্যে যে শৈল্পিক গুণ, সেটি হারায়। সম্ভবত গাজীপুরে ভাস্কর্যে মেরামত করা হয়েছিল মিস্ত্রি দিয়ে। জাদুঘরে ভাস্কর নভেরার একটি ভাস্কর্যের মিস্ত্রি দিয়ে মেরামত করা হয়েছিল। এসব গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য যদি মিস্ত্রি দিয়ে মেরামত করাতে হয়, তাহলে তো আর শিল্পীদের প্রয়োজন হতো না।”

সংবাদ প্রকাশকে ওই শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, “এ বিষয়গুলোতে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নয়, সবাইকেই যত্নশীল হতে হবে। একটি শৈল্পিক কাজ যদি মিস্ত্রি দিয়ে করিয়ে শৈল্পিক গুণ নষ্ট করা হয়, এটি একজন শিল্পের শিক্ষার্থী হয়ে অনেকটাই লজ্জাজনক। আমাদের ভাস্কর্যগুলো দেখভালের ক্ষেত্রেও যত্নশীল মনোভাব বাড়াতে হবে। যেন নির্দিষ্ট কোনো দিন কিংবা দিবস নয়, বছরের প্রতিটি দিনই যেন সমানভাবে ট্রিটমেন্ট পায়।”