দেশের অন্যতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভর্তি পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে সোমবার (২৯ মে) থেকে। এতে ৩ হাজার ৯৩০টি আসনের বিপরীতে তিনটি ইউনিটে চূড়ান্ত পর্যায়ে আবেদন করেছেন ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫৭৪ জন শিক্ষার্থী।
এই ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজশাহীতে আগমন ঘটতে যাচ্ছে তিন লক্ষাধিক মানুষের। তবে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের আবাসন সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে মহানগরের বেশির ভাগ হোটেল-মোটেলের কক্ষ বুকিং হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মেস এবং আবাসিক হলগুলোতেই এখন ভরসা করছেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় অনেকটা গাদাগাদি করেই সেখানে থাকতে হবে তাদের। সেই সঙ্গে যাতায়াতের ক্ষেত্রেও আছে নানা ভোগান্তি। এমতাবস্থায়, প্রশ্ন উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে আয়োজন করতে বাধা কোথায়?
গত বছর ভর্তি পরীক্ষার আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার জানিয়েছিলেন, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ভোগান্তি এড়াতে বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চিন্তাভাবনা আছে। এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
কয়েকটি সূত্র বলছে, প্রশ্নফাঁসের শঙ্কায় ক্যাম্পাসের বাইরে পরীক্ষা নিতে রাজি নন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকগণের একটি বড় অংশ। রাবির এই ভর্তি পরীক্ষাকে ঘিরে শহরের আবাসিক হোটেলগুলোতেও চলে রমরমা বাণিজ্য। গুঞ্জন আছে, রাজশাহী মহানগরের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীদের একটি প্রচ্ছন্ন চাপও আছে যেন পরীক্ষাটি ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ থাকে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ঢাবির ন্যায় বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা আয়োজনের মতো বৃহৎ কার্যক্রম সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত লোকবল এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের শঙ্কা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো ঘটনা ঘটেনি। বেশ কিছু জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেলেও, ক্যাম্পাসেই ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্র থাকায় প্রশ্নের নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ঢাবির মতো বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা আয়োজন করতে গেলে প্রশ্নফাঁসের আশঙ্কা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র কয়েকজন অধ্যাপক।
এ প্রসঙ্গে বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী বলেন, “বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে; তবে আমাদের বুঝতে হবে, যেই বলয়ের মধ্যে আমরা ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রমটি সম্পন্ন করে থাকি, তা যেন কোনোভাবেই দুর্বল না হয়ে যায়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দীন খান বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিভাগীয় শহরে সফলভাবে ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারে, তবে রাবি কেন পারবে না? প্রশ্নফাঁস এড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বিধান করবে এবং আমি মনে করি এই কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় লোকবল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেই শিক্ষার্থীদের এই ভোগান্তি নিরসন করতে পারত।”
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রচ্ছন্ন চাপ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে ঘিরে চাঙ্গা হয়ে উঠে রাজশাহী মহানগরীর হোটেল-মোটেলের ব্যবসা-বাণিজ্য।
জানা গেছে, বছরের এই সময়টুকুতেই হোটেলগুলো সবচেয়ে বেশি আয় করে থাকে। আবাসন সংকটকে কাজে লাগিয়ে হোটেলে রুম ভাড়া তিন থেকে চার গুণ বাড়িয়ে দেন হোটেল মালিকেরা। ভর্তি পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে হলে এই আয় অনেকটাই কমে যাবে।
জানা যায়, মহানগরের প্রভাবশালী স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একটি প্রচ্ছন্ন চাপও আছে, যেন বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা না হয়।
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দীন খান এই প্রচ্ছন্ন চাপের প্রসঙ্গে বলেন, “ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে স্থানীয় যেই রাজনীতি বা প্রশাসন তারা নানাভাবে অ্যাডমিশন টেস্টের সঙ্গে ইনভলভ হচ্ছেন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা দেখি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সমন্বয় সভা হয় সিটি করপোরেশনের মেয়র মহোদয়ের কার্যালয়ে। অথচ এটা হওয়ার কথা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। অবশ্যই সেখানে মেয়র মহোদয়, স্থানীয় প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সমিতিসহ অন্যান্যদের আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আমন্ত্রণ জানাবে এবং আলোচনা করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা যখন হয়, আমরা তো দেখিনা ঢাবি প্রশাসনকে ঢাকার মেয়র অফিসে যেয়ে আলোচনা করতে। বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান; ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় স্বাধীনভাবে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিকে পুঁজি করে একটা বড় বাণিজ্য হয় রাজশাহী শহরে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।”
রাবির ভর্তি পরীক্ষাকে ঘিরে আনুমানিক কত টাকার বাণিজ্য হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, “এখানে যদি তিন লাখ মানুষের আগমন ঘটে। যদি গড়ে ৫ হাজার টাকাও খরচ ধরি তাহলেও তো দেখা যায় কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার কথা। তা ছাড়া আমাদের শিক্ষার্থীরা যারা সারা বছর মেসের যেই সিটে থাকে, সেখানে একজন গেস্টকে রাখার জন্য মেস মালিকরা বাড়তি টাকা নেয়। রাজশাহী শহরের মানুষদের এমন বাণিজ্যিক মনোভাব দেশবাসীর কাছে একটি নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে বলে আমি মনে করি।”
জনবল সংকট ও একক ভর্তি পরীক্ষা
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে নেওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিক কিছু আলোচনা হলেও বিষয়টি খুব বেশি দূর এগোয়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় অনুযায়ী একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় গত ১৫ এপ্রিল। তবে তারও আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। যেহেতু সামনের বছরগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না, তাই আলাদা করে শুধু একটি শিক্ষাবর্ষের জন্য বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের সিদ্ধান্ত থেকে অনেকটাই সরে আসে রাবি প্রশাসন।
এছাড়া গত দুই বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রকার নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। ফলে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ সম্পন্ন করতেই বেগ পোহাতে হচ্ছে প্রশাসনকে। এমতাবস্থায়, ভর্তি পরীক্ষাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা বেশ কষ্টসাধ্য বলে মনে করে রাবি প্রশাসন।
বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকট রয়েছে। এছাড়া আগামীতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কী সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে তাও বলা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যেই আপনারা জেনে গেছেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায় অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একক ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছে। এসব বাস্তবতায় এ বছর বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।”
বর্তমানে চলমান ভর্তি প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা রেখে রাবি উপাচার্য আরও বলেন, “এটি একটি কম্পিটিটিভ এক্সাম, এখানে একটু কষ্ট করতেই হয়। ভর্তি পরীক্ষার সার্বিক কার্যক্রমকে আমরা ‘বেস্ট রোবাস্ট’ হিসেবেই মনে করি। এর মাধ্যমে আমরা ভালো শিক্ষার্থীদেরকেই বেছে নিই। তবে যদি ভর্তিচ্ছুদের অতিরিক্ত ভোগান্তি হয়। এজন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। আগামীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকবল বাড়লে পরীক্ষাটিকে হয়ত ডিসেন্ট্রালাইজড করা সম্ভব হবে।”