দীর্ঘ চব্বিশ বছরের শাসন-শোষণ আর নির্যাতনের শিকার সয়ে অবশেষে দেখা মিলেছিল আলোর। আর সেই আলোটা হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে বাঙালিরা পেরেছিল তাদের স্বাধীকার অর্জন করতে।
একইসঙ্গে স্বাধীনভাবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ৩০ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছিল সেদিন। আর সম্ভ্রম হারিয়েছে দুই লাখ মা-বোন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর হাসিমুখে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ আমাদের এনে দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। তাদের স্মৃতি ধরে রাখতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এমনই একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি)। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘চেতনা-৭১’।
জানা যায়, ২০১১ সালের ৩০ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন ‘এ’ এর উত্তরপশ্চিম পাশে ‘চেতনা-৭১’ নামে স্থায়ীভাবে একটি মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। এটি বৃহত্তর সিলেটের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ উদ্দিন এই ভাস্কর্যটির উদ্বোধন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৫-০৬ সেশনের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ও ডাচ বাংলা ব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় শাবিপ্রবির এ মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্যটি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে এক কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে গোলচত্বরে এসে একটু সামনে গেলেই পাওয়া যায় শাবিপ্রবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগার থেকে একটু এগুলে একাডেমিক ভবন-এ এর উত্তর পাশেই তাকালে চোখে পড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ‘চেতনা-৭১’।
এছাড়া ভাস্কর্যটির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য একাডেমিক ভবনগুলোর আদলে সিরামিকের লাল ইট দিয়ে এর ভিত্তি নির্মাণ করা হয়েছে। তিনটি প্লেটে এর ভিত্তি নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি প্লেটের উচ্চতা ১০ ইঞ্চি করে বানানো হয়েছে। এর প্রথম প্লেটটির ব্যাস ১৫ফুট, দ্বিতীয়টি ১৩ ফুট এবং উপরের প্লেটটির ব্যাস ১২ ফুট। তিনটি প্লেটের উপরে মূল বেদিটির উচ্চতা ৪ ফুট এবং এর উপরে ৮ ফুট উচ্চতা নিয়ে রয়েছে ভাস্কর্যটির মূল ফিগার।
ভাস্কর্যটিতে দেখা যায়, একজন ছাত্র বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উঁচু করে তুলে ধরার ভঙ্গিমায় এবং একজন ছাত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের প্রতীকী বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যা দেখলে মনে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মনে প্রবল সাহস নিয়ে মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে তারা। ভাস্কর্যটির নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণে কাজ করেন ঢাকার নারায়ণগঞ্জে স্থাপিত ‘নৃ-স্কুল অব স্কাল্পচার’ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং শিল্পী মোবারক হোসেন নৃপাল।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেটের প্রথম নির্মিত এই মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য ‘চেতনা-৭১’ দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ আসা যাওয়া করে। এছাড়া ক্যাম্পাসে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এটা একটা আবেগের জায়গা। সারাদিন শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় ভরপুর থাকে ভাস্কর্যটির চারপাশ। চলে গান, আড্ডা আর ফটো তোলার হিড়িক। বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নিজেকে সেলফি বন্ধি করে রাখেন শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া চারিদিকে গাছগাছালি, আলো-বাতাসের অনুকূল পরিবেশ, বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ আর নয়নাভিরাম ফুলের সৌরভ তাদের মন মাতিয়ে রাখে। এভাবেই শিক্ষার্থীদের ও বাহিরে থেকে আসা পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত থাকে ‘চেতনা-৭১’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী সোহানা আবেদীন লামিসা বলেন, “বাবার চাকরি সূত্রেই ক্যাম্পাসে বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনা-৭১ নিয়ে যখন মনে প্রশ্ন জাগে তখন বাবার কাছ থেকে জানতে পারি এর মাহাত্ম্য। দেশের জন্য মানুষের ভালোবাসা ও দেশকে স্বাধীন করতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মানুষের যে চেতনা জাগ্রত হয়েছিল তার স্মৃতি স্বরুপ ক্যাম্পাসে চেতনা-৭১ নামে এ মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। এ ভাস্কর্যর দিকে তাকালেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়ে।”
একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী হাসিবুর রহমান বলেন, “১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। দেশ স্বাধীন করার জন্য মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দেশকে স্বাধীন করার যে চেতনা মানুষের মধ্যে কাজ করেছে তার বহিপ্রকাশ আমাদের ক্যাম্পাসের মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য ‘চেতনা-৭১’।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের একই সেশনের শিক্ষার্থী সানজিদা নওরিন সুবর্ণা বলেন, “ভাস্কর্য ‘চেতনা-৭১ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে রাখছে। ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ বীরঙ্গনার ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তাদের অসীম সাহস আর ত্যাগের জন্য আজ বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি জায়গা দখল করে আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই ভাস্কর্যটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আরো জানার অনুপ্রেরণা জোগায়।”