গণজাগরণ মঞ্চের পরিচিত মুখ লাকি আক্তার। অনেকের কাছে তিনি স্লোগানকন্যা নামে পরিচিত। বুধবার (১২ মার্চ) মধ্যরাতে সেই লাকি আক্তারকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। মিছিল থেকে তারা লাকিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
লাকি আক্তারের বিরুদ্ধে মিছিলকারী ঢাবি শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তিনি শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ-২ আয়োজনের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র করছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছেন। এ জন্য শিক্ষার্থীরা তাকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানিয়েছেন।
দেশজুড়ে অব্যাহত নারী নিপীড়ন, ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অপসারণ, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ মোট ৯ দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ অঙ্গন। প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। ধর্ষণ, খুন, ছিনতাইসহ আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার (১১ মার্চ) বিকালে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের সদস্যের সঙ্গে পুলিশের মারামারি হয়েছে। সন্ধ্যায় মশাল মিছিল করেছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলো। এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি করেছেন তাঁরা। পাশাপাশি আগামী ১৫ মার্চ (শনিবার) বেলা ১১টায় রাজধানীর শাহবাগে গণমিছিলের ডাক দেন তারা।
এ অবস্থায় শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ-২ হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। দ্বিতীয় গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে ইঙ্গিতে স্ট্যাটাস দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অন্যতম নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ। পাশাপাশি তিনি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সতর্ক বার্তা উচ্চারণ করেছেন।
অন্যতম নেতা লাকি আক্তার মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মশাল মিছিলে অংশ নিয়েছেন, পাশাপাশি বক্তব্য রেখেছেন। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এবং গণজাগরণ মঞ্চের পরিচিত মুখ লাকি আক্তার বলেন, ‘দেশজুড়ে মানুষ ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছেন। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে এ সরকার নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে তার ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।’
লাকি আক্তার পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, ‘ধর্ষণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিরসনের দাবিতে আগামী ১৫ মার্চ সকাল ১১টায় শাহবাগে গণমিছিল আয়োজন করা হবে।’ সাধারণ মানুষকে মিছিলে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
লাকি আক্তারের গ্রেপ্তার দাবিতে জগন্নাথের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক লাকি আক্তারের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার নিশ্চিত না হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন এবং তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার দাবি জানান।
মঙ্গলবার (১১ মার্চ) রাত দেড়টায় ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হয়ে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকে— ‘শাহবাগিদের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘শাহবাগের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, “ল তে লাকি, তুই হাসি না, তুই হাসিনা, তুই হাসিনা”, ‘শহীদেরা দিচ্ছে ডাক, শাহবাগ নিপাত যাক’, ‘১, ২, ৩, ৪, শাহবাগ নো মোর", "শাহবাগের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না’
পরে তারা মিছিল নিয়ে রায় সাহেব বাজার ঘুরে ভাস্কর্য চত্বরে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন।
সমাবেশে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নূর নবী বলেন, ‘শাহবাগ এখন ঘৃণার প্রতীক। নতুন করে কোনো পরিচয় দিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না। পরিকল্পিতভাবে লাকি আক্তারদের মাঠে নামানো হয়েছে। জগন্নাথের মাটি থেকে তাকে চিরতরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে হবে।’
আইন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু কিছু ভারতীয় দালাল সেই স্বাধীনতাকে ধ্বংস করতে চায়। ২০১৩ সালে যারা শাহবাগে ঘেউ ঘেউ করেছিল, তারা আবারও মাঠে নেমেছে। লাকি আক্তারসহ সেইসব ষড়যন্ত্রকারীদের কেন এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি? আবার দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইলে, নতুন করে জুলাই বিপ্লব হবে।’
ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তৌফিক বলেন, ‘২০১৩ সালে যারা দেশকে অস্থিতিশীল করেছিল, তারা আবারও নতুন করে ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু এবার তারা সফল হতে পারবে না। আমরা আবু সাঈদ, মুগ্ধদের মত রুখে দাঁড়াবো।’
শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, লাকি আক্তারসহ সকল ষড়যন্ত্রকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে এবং দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা ঘোষণা দেন, প্রয়োজনে শাহবাগ বিরোধী আন্দোলন আরও তীব্র হবে।
লাকি আক্তারকে গ্রেপ্তারের দাবিতে রাবিতে বিক্ষোভ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে হুমকি, দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ ও দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের উপর হামলার প্রতিবাদে শাহবাগের বিরুদ্ধে মধ্যরাতে বিক্ষোভ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণঅভ্যুত্থান মঞ্চ।
মিছিল থেকে শিক্ষার্থীরা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে ২০১৩ সালে শাহবাগে গড়ে ওঠা প্ল্যাটফরম ‘গণজাগরণ মঞ্চের’ আলোচিত মুখ লাকি আক্তারকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি জানান। এছাড়াও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সূচনাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান তারা।
মঙ্গলবার (১১ মার্চ) দিবাগত রাত দেড়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান সড়ক ও আবাসিক হল প্রদক্ষিণ শেষে একই জায়গায় এসে মিলিত হোন।
এ সময় `শাহবাগিদের আস্তানা, ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও`, `ল` তে লাকি, তুই হাসিনা তুই হাসিনা`, `শ তে শাহাবাগী, তুই হাসিনা তুই হাসিনা`, `শাহাবাগীর বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন`, শাহবাগিদের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে`, `বিচার বিচার বিচার চাই, শাহাবাগীদের বিচার চাই`, `শাহাবাগীরা হামলা করে, ইন্টেরিম কী করে?, `উদ্যানের গাঁজাখোর উদ্যানে ফিরে যা`, `১৩ আর ২৫, এক নয় নয়`, `শাহবাগ না শাপলা, শাপলা শাপলা`, `হলে হলে খবর দে, শাহবাগীদের কবর দে`, `জুলাইয়ের বাংলায়, শাহাবাগীদের ঠাঁই নাই`, `২৪-এর বাংলায়, শাহাবাগীদের ঠাঁই নাই`
এসময় গণঅভ্যুত্থান মঞ্চের সদস্য সচিব ইকরামুল হক মামুন বলেন, আমরা এই শাহবাগীদের বাংলাদেশের মাটিতে থাকতে দেবো না। আমাদের রক্তের বিনিময়ে হলেও তাদের থেকে দেশ থেকে মুক্ত করব। আমরা তাদের বাংলার জমিনে তাদের উত্থান ঘটতে দেবো না। তারা একদিনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
বায়োকেমেস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিম রেজা বলেন, আমরা সবাই জানি শাহবাগিরা আওয়ামী লীগের এক্সটেনশন। নীরবে আওয়ামী লীগের অপকর্ম বাস্তবায়ন এবং বিরোধী দলগুলোর উপর হামলার নিপীড়ন অত্যাচারের বৈধতা জুগিয়েছে এই শাহবাগিরা। ২৪বিপ্লবের পরে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের লোকজন একত্রিত হয়ে আবারো শাহবাগ কায়েম করতে চাচ্ছে। ছাত্রজনতা যতদিন রাজপথে আছে, শাহবাগীদের যে চাওয়া সেটি পূরণ হতে দেবে না।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জিএস সাব্বির বলেন, ২০১৩ সালে হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারকে কায়েম করার জন্য যারা ইন্ধন জুগিয়েছে সেই শাহবাগিরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, ২৪-এর পর আমরা আরেকটি ফ্যাসিবাদের জন্ম হতে দেবো না। রোজাদার পুলিশের উপর হামলা করে দেশের আইন-শৃঙ্খলাকে অপদস্থ করার জন্য এই শাহাবাগীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চের নেতাকর্মীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও করতে গেলে পথে পুলিশ তাদের বাঁধা দেয়। এসময় অগ্নিকন্যা খ্যাত গণজাগরণ মঞ্চের নেত্রী লাকী আক্তারের নির্দেশে পুলিশের উপর হামলা চালান সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেন রাবির গণঅভ্যুত্থান মঞ্চ।
লাকি আক্তারকে গ্রেপ্তারের দাবিতে উত্তাল চবি
গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক লাকি আক্তারকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মধ্য রাতে উত্তাল হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাস।
বুধবার (১৩ মার্চ) রাত ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলের মোড় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থী। বিক্ষোভ মিছিলটি বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করে জিরো পয়েন্টে এসে শেষ হয়।
এ সময় তাদের ‘ওয়ান টু-থ্রি-ফোর, শাহবাগ নো মোর’, ‘তেরো না চব্বিশ, চব্বিশ চব্বিশ’, ‘শাহবাগ না জাস্টিস, জাস্টিস জাস্টিস’, ‘ল-তে লাকি, তুই হাসিনা তুই হাসিনা’, ‘চব্বিশের বাংলায়, শাহবাগের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
বিক্ষোভ মিছিল শেষে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-আহ্বায়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, যতদিন জুলাই যোদ্ধারা জেগে থাকবে, ততদিন ১৩ এর শাহবাগ ফেরত আসতে পারবে না। যতবার লাকিরা ফেরত আসার চেষ্টা করবে, ততবার জুলাই ফিরে আসবে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, তোমরা বোনদের ধর্ষণকে কেন্দ্র করে যে নোংরা রাজনীতি করার চেষ্টা করছো, তা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ রুখে দেবে।
ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলি বলেন, শাহবাগ কায়েম করে দেশের প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করে নিরপরাধ রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। রায় ঘোষণার পরে মবের মাধ্যমে রায়কে চেঞ্জ করেছিল শাহবাগ। শাহবাগের মাধ্যমে শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিবাদকে পাকাপোক্ত করেছিল। এই শাহবাগকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হতে দেব না। চব্বিশে যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি, সেভাবে ভবিষ্যতেও ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে শাহবাগের ষড়যন্ত্র রুখে দেব।