নিহত হৃদয়ের মায়ের আহাজারি

‘আমার বাবারে পুলিশ মাইরা ফালাইছে, লাশটা দেন দেখব’

হাসান সিকদার, টাঙ্গাইল প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২৪, ০৬:৩৯ পিএম
ছেলের মৃত্যুতে পাগল প্রায় মা। ছবি : প্রতিনিধি

পরিবারের একমাত্র ছেলে হৃদয় মিয়াকে (২০) হারিয়ে পাগল প্রায় মা রেহেনা বেগম। পরিবারের দাবি, গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন হৃদয়। ঘটনার ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো হৃদয়ের লাশ খুঁজে পায়নি পরিবার ও স্বজনরা।

নিহত হৃদয় টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের আলমনগর মধ্যপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক লাল মিয়া ও রেহেনা বেগম দম্পত্তির ছেলে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নিজের লেখাপড়ার খরচ ও সংসারের হাল ধরতে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে অটোরিকশা চালাতেন হৃদয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ওইদিন বিকেলে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে বিজয় মিছিল বের করা হয়। সেই বিজয় মিছিলে অংশ নেন হৃদয়। মিছিলে পুলিশ টিয়ালশেল ও গুলি করলে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

এসময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন হৃদয়। পরে তার মরদেহ টেনে হিচড়ে একটি গলিতে নিয়ে যায় পুলিশ। এঘটনার ভিডিও ধারন করে আশপাশের লোকজন। সেই ভিডিও দেখে স্বজনরা শনাক্ত করেন গুলিবিদ্ধ মরদেহটি হৃদয়ের। তবে মরদেহ কোথায় রেখেছে পুলিশ তা এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সরেজমিনে হৃদয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় মা। বাড়িতে রাখা ছেলের জামা-কাপড়, খেলাধুলায় পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার হাতে নিয়ে কাদঁছেন আর বিলাপ করছেন। প্রতিবেশীরা তাকে শান্তনা দিচ্ছেন। তবুও তার কান্না যেন থামছেই না।

একমাত্র ছেলে শোকে যেন পাথর হয়ে গেছেন বাবা লাল মিয়া। কোনো কথাই যেন বলতে পারছেন না। শুধু অঝোড়ে কেঁদে চলেছেন তিনি।

খুবই গরীব ঘরের সন্তান ছিলেন হৃদয়। ভগ্নিপতির দেওয়া একটি ঘরে বাবা-মাকে নিয়ে থাকতেন হৃদয়। সেই ঘরেই পড়ে রয়েছে হৃদয়ের জামা-কাপড় ও বিভিন্ন জিনিষপত্র।

স্বজনরা জানান, হৃদয় গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ডিগ্রি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার দুইবোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা লাল মিয়া এলাকায় ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান। তবে অসুস্থ থাকার কারণে কয়েকমাস ধরে তিনি আর ভ্যান চালাতে পারছেন না। এই অবস্থায় নিজের পড়াশোনার খরচ ও সংসার চালানোর জন্য কাজের সন্ধানে তিন-চার মাস আগে গাজীপুরের কোনাবাড়ি যান হৃদয়। সেখানে একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতেন।

পুলিশের গুলিতে হৃদয় নিহত হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রবিন মিয়া নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “কোনাবাড়িতে আমরা বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। মেট্রো থানার সামনেই আমরা অবস্থান নিয়েছিলাম। পুলিশ আমাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ালশেল ও গুলি করে। তখন অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়। এসময় আমরা একপাশে ছিলাম। আর হৃদয় ছিল অন্যপাশে। একপর্যায়ে হৃদয় একটি বিল্ডিংয়ের পাশে লুকিয়ে ছিল। পরে সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে সড়কের ওপর নিয়ে যায়। আমরা মনে করেছিলাম মারধর করে ছেড়ে দেবে, কিন্তু তারা গুলি করে হৃদয়কে হত্যা করে। এসময় চতুর্দিকে গুলি করা হয়। ভয়ে এগিয়ে যেতে পারিনি। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম তার মৃত্যু। ভেবেছিলাম পরিবেশ শান্ত হলে তার লাশ আনতে যাব। পরে পুলিশ তার লাশ নিয়ে চলে যায়। যেখানে তাকে মারা হয়েছে সেখানে শুধু তার রক্তাক্ত লুঙ্গি পাওয়া যায়। তবে পুলিশ লাশ কোথায় রেখেছে সেটা আর পাওয়া যায়নি।”

আলমনগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার আব্দুল হামিদ বলেন, “কোনাবাড়িতে আমার দোকান রয়েছে। মিছিলের আগে হৃদয় আমার দোকানের সামনেই ছিল। এসময় তার বোন-জামাইও ছিল। তাদের সেখানে যেতে মানা করেছিলাম। তারপরও তারা আনন্দ মিছিলে যোগদান করেছে। বোনের জামাই দূর থেকে দেখেছে কীভাবে হৃদয়কে গুলি করে মেরেছে পুলিশ। কিন্তু ভয়ে কেউ সামনে যাওয়ার সাহস পায়নি। যারা হত্যা করেছে তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হোক। হৃদয়ের লাশ যেন তার পরিবার ফিরে পায়।”

হৃদয়ের ভগ্নিপতি ইব্রাহিম হোসেন বলেন, “আমরা দুজন এক বাসায় থাকতাম। ঘটনার দিন আলাদা স্থানে ছিলাম। মিছিলে গুলির ঘটনায় আমি কোনাবাড়ি থানাসংলগ্ন একটি বাসায় আশ্রয় নিই। ওই বাসার গেট থেকে দেখতে পাই চারজন পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ একজনকে চ্যাংদোলা করে থানার সামনে নিয়ে বেঞ্চের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন। হৃদয়ের মতো দেখতে হলেও গুলির ভয়ে তখন কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি। ঘটনার পর হৃদয়ের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। থানাসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও হৃদয়ের সন্ধান পাইনি। পরে ঘটনাস্থল থেকে তার পরনের লুঙ্গি পাওয়া গেলে নিশ্চিত হই যে নিহত যুবক হৃদয় এবং তার মরদেহ গুম করা হয়েছে। আমরা এর সঠিক বিচার চাই।”

হৃদয়ের বোন জিয়াসমিন আক্তার বলেন, “ফোনে ঘটনার দিন বিকেলে হৃদয়ের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়। হৃদয়কে বলেছি ‘তুমি নিরাপদে থেকে বাসায় ফিরে যাও’। তাকে আমার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। এর প্রায় আধাঘণ্টা পরই আমার স্বামী ফোনে জানালো আমার ভাই বেঁচে নেই। পরে ভাইয়ের ফোনে কল দিলে অন্য একজন ধরে বলে ফোনটি তিনি কুড়িয়ে পেয়েছেন। পুলিশ ধরে নেওয়ার পরই তার পরনের লুঙ্গি খুলে ফেলেছিল। পরনে শুধু শর্ট প্যান্ট ছিল।”

হৃদয়ের মা রেহেনা বেগম বলেন, “আমাদের ভালো রাখার জন্য কোনাবাড়িতে কাজ করতে গেছিল। ১০ হাজার টাকা কিস্তি তুলে আমার বাবাকে দিয়েছি গাড়ি চালানো শিখতে। আমার বাবা গাড়ি চালাবে। সেই কিস্তির টাকা কে দেবে। আমার বাবাটাকে পুলিশ মাইরা ফালাইছে। আমার ছেলের লাশ ফেরত দেন আমি দেখব একটা বার। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।”

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা ইয়াসমিন সুলতানা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।