মাছের বিষে হারিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের পাখি

এমএম ফিরোজ, মোংলা প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২৪, ১২:৩৯ পিএম
মদনটাক, সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় জলচর পাখি। ছবি : সংগৃহীত

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি হিসেবে পরিচিত সুন্দরবন একসময় জলচর পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকত। এদের মধ্যে মদনটাক, বক, ঈগল, শঙ্খচিল, গাংচিল, মাছরাঙা উল্লেখযোগ্য। শীত মৌসুমে সুন্দরবনের কালিরচর, পুটনিরচর, দুবলা, নীলকমল, মান্দারবাড়িয়া, কচিখালীসহ প্রায় সব এলাকায় দেশি-বিদেশি পাখির দেখা মেলে। কাগজে-কলমে ৩২০ প্রজাতির পাখি থাকার কথা থাকলেও সুন্দরবনে এখন সেই চিত্র নেই। 

স্থানীয় প্রকৃতিপ্রেমী ও বনজীবীরা বলছেন, হরহামেশা রাসায়নিক দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা বাড়ায় সুন্দরবনে আগের চেয়ে পাখির প্রজাতি ও সংখ্যা কমেছে। সুন্দরবনে বৃক্ষনিধন, বনের ভেতর দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল, চোরা শিকারিদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি ও খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের ফলে সুন্দরবন থেকে অন্যত্র পাখি চলে যাচ্ছে।

অন্যদিকে বন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের পাখি নিয়ে গবেষণার অভাব রয়েছে। বাঘশুমারি হলেও কখনো বনের অন্য প্রাণী বা পাখি নিয়ে আলাদা কোনো শুমারি হয়নি। পাখি নিয়ে আলাদা গবেষণার পরামর্শ তাদের।

খয়রাপাখা মাছরাঙা। ছবি : সংগৃহীত

সুন্দরবনের জলচর পাখির প্রধান খাবার নদী ও খালের ছোট মাছ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনের নদী-খাল থেকে মাছ শিকার করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কীটনাশক ও বিষ। এই বিষে মাছের পাশাপাশি খালের পানিতে থাকা বিভিন্ন পোকামাকড়ও বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। বিষাক্ত এসব প্রাণী খাবার হিসেবে গ্রহণ করে পাখি। ফলে বিষক্রিয়ায় অনেক প্রজাতির পাখি মারা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবনের বনজীবীরা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছরে ২৯৩টি নৌকা ও সুন্দরবন থেকে ৩ হাজার ৬৬০ কেজি বিষ দেওয়া মাছ জব্দ করা হয়েছে। এতে ২১৬টি মামলা ও ২২৪ জন জেলেকে আটক করা হয়।

কথা হয় বন ও পাখি বিষয়ক লেখক মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, “সুন্দরবনে যেসব পাখি বাস করে, এদের বেশিরভাগই বুনোফল ও মৎস্যভোজী পাখি। এর কারণ হলো সুন্দরবনে কোনো শস্যক্ষেত নেই। আশঙ্কাজনকভাবে পাখির সংখ্যা কমে গেছে সুন্দরবনে। আগে দেখা যেত এমন অনেক পাখিই এখন দেখা যায় না। কমে গেছে পাখির কলরব। এমনটা হওয়ার জন্য প্রধানত দায়ী কিছু লোভী মানুষ, যারা বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করে। বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের কারণে শুধু পাখি নয়, গোটা সুন্দরবনই বিপদগ্রস্ত। জীববৈচিত্র হুমকির মুখে। কারণ সেখানে এক প্রাণীর সঙ্গে অন্য প্রাণীর জীবন জড়িত। বিষযুক্ত পানি খেয়ে মাছ মারা যায়। বিষওয়ালা মাছ খেয়ে পাখি মারা যায়।”

সুন্দরবন ঘেঁষা মোংলার বৈদ্যমারী গ্রামের চিকিৎসক ও প্রকৃতিপ্রেমী এমদাদুল হক টুটু বলেন, “আগে সুন্দরবরে বন মোরগ, মুরগিসহ অনেক প্রকারের পাখি দেখেছি। হঠাৎ করেই কয়েক বছর বনে পাখি কম দেখা যাচ্ছে। বনের গভীরে গেলে মাঝে মাঝে কিছু পাখির দেখা মেলে। খালের ভেতর অনেক পাখি মরে পড়ে থাকতে দেখেছি। নদীতে মরা পাখি ভেসে যেতেও দেখি মাঝে মাঝে। অনেকে খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে।” সেই বিষাক্ত মাছ খেয়ে এসব পাখি মারা যাচ্ছে বলে ধারণা তার।

বড়বক

সুন্দরবনের জেলে মুজিবর গাজী বলেন, “প্রায় সময় খালের মধ্যে বড় বড় বক, সারস, মদনটাকসহ মাছ খাওয়া অনেক পাখি মরে থাকতে দেখেছি। যেসব খালে বিষ দিয়ে মাছ মারা হয় ওই সব খালের মাছ খেয়ে অনেক পাখি মারা যাচ্ছে। আগে বনে অনেক পাখি ছিল। এখন তেমন একটা বড় আকারের পাখি দেখা যায় না।”

সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকি ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “সুন্দরবনের নদীতে এখন মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। খালের পানিতে বিষ দিলে শুধু মাছ মরে না, পানিতে থাকা সব জলজ প্রাণীই মারা যায়। এই বিষক্রিয়া দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী। বিষাক্ত মাছ খেয়ে মানুষের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি অনেক প্রজাতির পাখিরও মৃত্যু হচ্ছে।”

সুন্দরবনের করমজল পর্যটন স্পর্টের ওসি হাওলাদার আজাদ কবির সুন্দরবনের পাখির সংখ্য কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, কয়েক বছর আগেও সুন্দরবনের বিভিন্ন খাল পাড়ে মাছ খেকো মদনটাক পাখি দেখা যেত। কিন্তু বর্তমান কালে ভদ্রে দেখা মেলে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে অসাধু জেলেদের সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারকে তিনি বেশী দায়ী করেছেন।

সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, অভিযান চালিয়ে অসাধু ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তারা দ্রুত জামিনে এসে আবার একই কাজ করেন।