নালায় পড়ে মৃত্যু : দোষারোপেই যেন দায়িত্ব শেষ

নুরউদ্দীন খান সাগর, চট্টগ্রাম প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২১, ০৯:২৪ এএম

যতই দিন যাচ্ছে ততই চট্টগ্রামে নালাগুলো মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন নালায় পড়ে মানুষের মৃত্যু বেড়েই চলছে। তিন মাসে নালায় পড়ে একাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নালার পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তারা এই ঘটনাতে একে অপরকে দায়ী করেছে। 

গত ৩০ জুন চশমা খালে সিএনজিচালিত ট্যাক্সি পড়ে দুইজন নিহত হন। এরপর ২৫ আগস্ট মুরাদপুরে ব্যবসায়ী সালেহ আহমদ নালায় পড়ে নিখোঁজ হন। তার লাশ পাওয়ার জন্য যখন তার পরিবারের সদস্যরা সবার কাছে আকুতি জানাচ্ছে, ঠিক তখনি গত সোমবার রাতে আগ্রাবাদে নালায় পড়ে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সাদিয়া। এর আগে মোহাম্মদ আলী রোডে নালায় পড়ে মারা গিয়েছিলেন একজন। গত বছর হালিশহর ইসলামিয়া ব্রিকফিল্ড এলাকায় মহেশখালে পড়ে মারা যান দুই কিশোরীর। নগরীতে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামবাসী। সুশীল সমাজের অনেকে এই শহরকে বসবাসের অযোগ্য মনে করছে।

ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে স্রেফ দুর্ঘটনা হিসেবে মানতে নারাজ নগরবাসী। তারা বলেন, এই দায় কেউ এড়াতে পারেন না। যেভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটছে, তাতে দুর্ভাগ্য কার, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নগরের বসবাসকারী সুশীল সমাজ।

বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক আলিউর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর দায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আগ্রাবাদে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কোনোভাবে এড়াতে পারে না। এই তিন প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণে কয়েকটি তাজা প্রাণ চলে গেল এর দায় কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমরা চাই যারা নিহত হয়েছে, তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। তা ছাড়া এ ধরনের ঘটনার আর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের অবহেলাকে দায়ী করেছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, আগ্রাবাদে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করছে সিডিএ। তাই সেখানে মেইনটেনেন্সসহ অন্যান্য দায়িত্ব তাদের। দুর্ঘটনার পর আমি নিজেও সেখানে পরিদর্শন করেছি। দেখেছি, ফুটপাত কেটে খাল বরাবর দেড় ফুটে নিয়ে আসা হয়েছে। নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। এ অবস্থায় রাতে না, দিনেও যে কেউ পড়ে মারা যেতে পারে। যারা সেখানে কনস্ট্রাকশনের কাজ করছে এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রকৌশলীদের অবহেলায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। মুরাদপুরে সিডিএর খাল খনন প্রকল্প চলছে। সেখানে তারা ব্যারিয়ার বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধক দেয়নি। সে জন্য পানিতে খাল-নালা একাকার হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এভাবে ব্যবসায়ী সালেহ আহমদ নিখোঁজ হন। একটা লাল পতাকা দিয়ে বাঁশের খুঁটি দিলেও দুর্ঘটনা ঘটত না। তাই আমার আহ্বান থাকবে, যেকোনো সেবা সংস্থাকে উন্নয়নকাজ করার সময় অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ করতে হবে। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য যা করা দরকার, তার ব্যবস্থা নিতে হবে।

চসিক মেয়র আরও বলেন, আধুনিক নগর গড়তে উন্নয়ন করতে হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেই করুক, নাগরিক দুর্ভোগ ও ভোগান্তি করা যাবে না। সিটি করপোরেশনসহ যেসব সেবা প্রতিষ্ঠান উন্নয়নকাজ করছে তাদের সবার মধ্যে সমন্বয় না হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। সাদিয়ার মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে এজন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। 
মেয়র বলেন, ড্রেন ময়লায় ভর্তি ছিল, এটা সত্য। যেহেতু কাজ চলছে, সব ময়লা তো ওখানে গিয়ে পড়ছে। এখানে মেইনটেনেন্সের সব দায়িত্ব তো সিডিএর। ড্রেনে ময়লা আছে, কিন্তু ড্রেনের পাশে ঘেরা ছিল না, রেলিং ছিল না, সেগুলো থাকলে তো এই দুর্ঘটনাটা ঘটত না। 

অপর দিকে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেছেন, সিডিএর দোষ ধরা ছাড়া মনে হয় সিটি করপোরেশনের আর কোনো কাজ নেই। তারা (চসিক) নালা পরিষ্কার করবে না, আবার কিছু ঘটলেই সিডিএর দোষ দেয়। তিনি বলেন, ময়লা পরিষ্কার না করার কারণে সেখানে পানি কতটুকু ছিল, বোঝা সম্ভব হয়নি। 

সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, সিডিএ তো মাত্র দুই বছর ধরে কাজ করছে। এর আগে ৩০ বছর ধরে তো সিটি করপোরেশন কাজ করেছে। ভালোমতো পরিষ্কার করলে দুর্ঘটনা ঘটত না। তারপরও যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। এটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। নিহতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। 

নগরীর বহু খালেরই কোনো অস্তিত্ব নেই। বহু খালই দখল হয়ে গেছে। খাল-নালা হয়ে গেছে সংকীর্ণ। নগরীর অধিকাংশ নালা ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। বেহাল অবস্থায় থাকা এসব খাল-নালায় একের পর এক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। 

চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাংস্কৃতিক কর্মী সাইফুল আলম বলেন, আমরা এ ধরনের অপমৃত্যু আশা করি না। এক মাসের ব্যবধানে দুইজন মানুষ ড্রেনে পড়ে নিহত হলো অথচ সিটি করপোরেশন দুষছে সিডিএকে আর সিডিএ সিটি করপোরেশনকে। জনগণ যাবে কোথায়। সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে আমাদের জীবন যাচ্ছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তা ছাড়া সরকারের যে অর্জন, সেটাও ম্লান হচ্ছে এ ঘটনাগুলোর কারণে। আমরা চাই এ ধরনের ঘটনা আর না হোক। নিহতের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতিনিধিদের আহ্বান জানাচ্ছি।