জুতা সেলাই করে ভাগ্যবদল মঙ্গল রবি দাসের

সুজন সেন, শেরপুর প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৩, ০৯:১৯ এএম
মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে জুতা সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন মঙ্গল রবি দাস

সংসারে চরম অভাব-অনটনের কারণে মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার হাত ধরে মুচির পেশায় আসেন মঙ্গল রবি দাস (৫০)। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দীর্ঘ ৩৫ বছরের কর্মজীবনে নিজের অবস্থানে আমূল পরিবর্তন এনেছেন। চামড়া থেকে তৈরি বাহারি রকমের পণ্য তৈরি করে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। মুচি বা রবি দাস সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, কঠোর পরিশ্রমের কারণেই মঙ্গল আজ জিরো থেকে হিরো হয়েছেন।

মঙ্গলের বাড়ি শেরপুর সদর উপজেলার লছমনপুর ইউনিয়নের জামতালা গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত শ্রীনাথ রবি দাসের ছেলে। মঙ্গল বর্তমানে জেলা শহরের অষ্টমীতলা এলাকার টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডের টিকিট কাউন্টার ঘেঁষা একটি ভাড়া দোকানে জুতা সেলাই, তৈরি এবং মেরামতের কাজ করে আসছেন।

সরেজমিনে মঙ্গল রবি দাসের দোকানে গেলে তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এ সময় মঙ্গল তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্যোগপূর্ণ সময় পার করে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার গল্প শোনান।  

মঙ্গল রবি দাস জানান, ৭ ভাই, ২ বোন আর মা-বাবা নিয়ে ছিল তাদের সংসার। ভাই বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। বাবা শ্রীনাথ মুচির কাজ করতেন। সারা দিন স্থানীয় কুসুমহাটি বাজারে সড়কের পাশে বসে গ্রাহকদের জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। প্রতিদিন আয় হতো ৩০-৪০ টাকা। কিন্তু ওই আয়ে তার বাবার পক্ষে ১১ জনের সংসার চালানো ভীষণ কষ্ট হয়ে যেত। এ কারণে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। তাই আয় বাড়াতে জুতা তৈরি ও সেলাইয়ের কাজ শেখানোর জন্য বাবা তাকে সঙ্গে রাখতে শুরু করেন। তখন তার বয়স ১২ বছর। ওই বয়সেই জুতা তৈরির অন্যতম উপকরণ গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার কাটার কাজ রপ্ত করেন। এরপর ধীরে ধীরে বাবা তাকে শিখিয়ে দেন কাঠ ও টায়ারের সমন্বয়ে জুতা তৈরির কৌশল। গ্রাম্য ভাষায় যা খড়মের জুতা নামে পরিচিত। তখন থেকে দিনে দুই জোড়া খড়মের জুতা তৈরি করা শুরু করেন। আর প্রতি জোড়া জুতা বাজারে বিক্রি করতেন ৮ টাকা দরে।    

মঙ্গল রবি দাস আরও জানান, এভাবে বেশ কিছু দিন কাজ করার পর এক সময় ভাবেন সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে জুতার ডিজাইনে পরিবর্তন আনা জরুরি। গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করতে এবং জুতায় নতুনত্ব আনতে আরও কাজ শিখতে চলে যান পাশের জেলা জামালপুরে। সেখানে এক বোন জামাইয়ের জুতার কারখানায় দীর্ঘ দিন শ্রমিকের কাজ করেন। এরপর নিজ জেলায় ফিরে বাজিতখিলা গ্রামে এক মামাতো ভাইয়ের জুতার দোকানে থেকে আরও কিছু কাজ আয়ত্ত করেন। পরে চিন্তা করেন এবার নিজেই নতুন জুতা তৈরি এবং মেরামতের দোকান দেবেন। ওই অবস্থায় তার হাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ না থাকায় চিন্তিত হয়ে পড়েন।  

মঙ্গল রবি দাস বলেন, “ওই সময়ে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়ে নিরাশ হই। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে ১৯৮৮ সালে পৈত্রিক জমি বিক্রি করে ২৬ হাজার ৫০০ টাকা সিকিউরিটি মানি আর মাসিক ৩০০ টাকা ভাড়ায় জেলা শহরের অষ্টমীতলা এলাকায় দোকান নেই।”

এভাবে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে শুরু হয় নতুন পথ চলা। প্রথম দিকে শুধু জুতা মেরামতের কাজ করা হতো। কাজের মান ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে গ্রাহকের আনাগোনা বাড়তে থাকে। এরপর টায়ার কেটে নানা ডিজাইনের স্যান্ডেল জুতা তৈরি করে তিনি। ওইসব জুতা জেলা সদর ছাড়াও নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী থেকে আসা গ্রাহকরা অর্ডার দিয়ে তৈরি করে নিয়ে যেতেন। এক পর্যায়ে ব্যবসা আরও জমজমাট হয়ে ওঠে। ২০০০ সালের দিকে বাজারে পশুর প্রক্রিয়াজাত চামড়া চলে আসে। ওই সময় থেকে শুরু হয় চামড়া দিয়ে জুতা তৈরির কাজ। লাভের টাকায় কেনা হয় জুতা তৈরি করার সরঞ্জাম বক মটার, স্প্রে মেশিন, জুতা তৈরির ৭০ জোড়া ফর্মাসহ আরও অনেক কিছু। আর একার পক্ষে সব অর্ডার ডেলিভারি দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না বিধায় দোকানে পাঁচজন লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়।

মঙ্গল রবি দাস জানান, বর্তমানে তার কারখানায় তৈরি হচ্ছে সু, স্যান্ডেল, নাগরা চটিসহ বিভিন্ন ডিজাইনের লেডিস এবং জেন্টস সামগ্রী। গড়ে প্রতিদিন ১০-১৫ জোড়া নতুন জুতা তৈরির অর্ডার পাওয়া যায়। আর দুই ঈদ, দুর্গা পূজা এবং অন্যান্য উৎসব পার্বণে জুতার চাহিদা বেড়ে ২-৩ গুণ হয়। ওইসব জুতা ২০০-১৮০০ টাকার মধ্যে ডেলিভারি দেওয়া হয়। এ ছাড়া পঙ্গু এবং প্রতিবন্ধীদের জুতাও তৈরি করা হয়। কাজ বুঝে সেগুলোর দাম পড়ে ২০০০-১৬০০০ টাকার মধ্যে। পাশাপাশি চাবির রিং ২০০, মানিব্যাগ ৩০০-১০০০, কোমরের বেল্ট ৪০০-১২০০, চামড়ার জ্যাকেট ৯০০০-১৬০০০, চামড়ার ব্যাগ ৭০০০-১৪০০০, চামড়ার মোজা ১০০০-২০০০ টাকার মধ্যে গ্রাহকদের চাহিদা মাফিক তৈরি করে দেওয়া হয়।

দীর্ঘ কর্ম জীবনে ওইসব পণ্যের মানের সঙ্গে আপোষ না করায় গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে। এ কারণে জামালপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও ঢাকা থেকে অনেক গ্রাহক তাদের পছন্দমত ডিজাইনের জুতা তৈরি করে নিয়ে যান।

মঙ্গল রবি দাস জানান, জুতা সেলাই, তৈরি ও মেরামতের কাজ করে প্রতি মাসে অন্তত দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আমদানি হয়। তার দুই সন্তান, বড় ছেলে সুশান্ত (১৪) নবম শ্রেণির ছাত্র।  সে শেরপুর শহরের সৃষ্টি স্কুলের বোর্ডিংয়ে থেকে পড়াশোনা করে। আর ছোট ছেলের বয়স তিন বছর।

শহরের চকপাঠক এলাকার নারায়ণ রবি দাস বলেন, “মঙ্গল ছোট বেলা থেকে জুতার কাজ করছে। এ কারণে সব ধরণের জুতা তৈরির কলা-কৌশল সহজেই সে রপ্ত করতে পেরেছে। আমার মত আরও অনেকেই ওর কাছে নানা ধরণের কাজ শিখতে যায়। সে অনেক পরিশ্রম করেই জিরো থেকে আজ হিরো হয়েছে।”

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের জেলা শাখার ব্যবস্থাপক বিজয় কুমার দত্ত বলেন, জুতা তৈরিতে মঙ্গল রবি দাসের আরও উন্নত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হলে সে অনুযায়ী তাহলে সহায়তা দেওয়া হবে।