সুনামগঞ্জের হাওরে একটা সময় চাষ হতো দেশীয় বিভিন্ন জাতের ধান। উৎপাদনও বেশ ভালো হতো। কিন্তু বেশি লাভের আশায় হাওরজুড়ে এখন দেশীয় ধানের পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ও হাইব্রিড ধানের চাষ বাড়ছে। ফলে হাওর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দুই শতাধিক দেশি জাতের ধান।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এবার ছোট-বড় ১৩৫টি হাওরে বোরো মৌসুমে ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড ৬০ হাজার ৮৬০ হেক্টর, উফশী ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৫ হেক্টর ও ১ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে দেশি জাতের ধানের চাষ হয়েছে। অর্থাৎ শতকরা ২৮ ভাগ হাইব্রিড, ৭১ ভাগ উফশী ধান চাষাবাদ হয়েছে। আর মাত্র এক ভাগ জমিতে দেশি জাতের ধানের আবাদ হয়েছে।
দেশীয় জাতের ধান উৎপাদন খরচ কম, দ্রুত পাকে, পর্যাপ্ত পরিমাণ জিংক আছে, খেতেও সুস্বাদু। এ ছাড়া দেশীয় ধান রোগপ্রতিরোধী, সারকীটনাশকও লাগে না। এরপরও উচ্চ ফলনশীলের প্রভাবে দেশীয় জাতের ধান হারিয়ে যাচ্ছে। দেশি ধান ব্লাস্টসহ রোগপ্রতিরোধী ও জিংকসমৃদ্ধ। দেশি জাতের ধান উৎপাদন কম হওয়ায় ও কৃষি অফিসের পরামর্শে হাইব্রিডে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
হাওরপাড়ের কৃষকদের সঙ্গে কথা জানা যায়, একসময় হাওরে বোরো, গচি, বেগুন বিচি, বোনাভাতা, লিচুবিরণ, লাকাই, বগলা বোরো, কইয়া বোরো, জিরা শাইল, খাসখানী, বইয়াখাউরি, পাইজং, বেগম পেচি, কান্দি বোরো, জগলি বোরো, লতা বোরো, গাচমল, মাশিন, বাঁশফুল, তুলসীমালা, ঠাকরি, লাল ডেঙ্গি, চিনিগুঁড়া, সাদাগুঁড়া, কালিজিরা, কচু শাইল, দুর্বা শাইল, গবি শাইল, চিনি শাইল, দুধ শাইল, কালপাখরী, কাউলি, তায়েফ, রায়েন, আয়না মতি, গিজা বেরো, খইয়া, রাতা, সোনারাতা, বিচিবারই, বানাজিরা, টেপি, রঙ্গিলা, রঙ্গিলা টেপি, সাধু টেপি, সাদাবিরণ, কালাবিরণ, নলবিরণ, চন্দ্রী, শাইলসহ বিভিন্ন দেশি প্রজাতির বোরো জাতের ধান চাষ হতো।
আমন মৌসুমে মধুবিরণ, মধুমাধব, মালতি, ফুলমালতি, খাসিয়াবিন্নি, পুরাবিন্নি, নুনিয়া, জোয়াল কোট, মাতিয়ারি, আইকর শাইল, ময়না শাইল, গোয়াই, মুগবাদল, কলামাকনি, ধলামাকনি, যদুবিরণ, সোনাঝুরি, হাতকোড়া, ঘোটক, চেংরামুরি, পুনিয়া, কামিনীসরু, দুধজ্বর, বাজলা, মুগি, আশানিয়া, দেপা, বিরল, মোটংগা, আশা, গাজী, খামা, গুতি, কলামখনিয়া, খুকনি শাইল, কইতাখামা, জোয়ালভাঙা, তেরব আলী, ময়নামতি, চাপলাশ, পুঁথিবিরণ, ঝরাবাদল, জিরাভোগ, কাটারিভোগ, নাগা ঠাকুরভোগ, বাদশাভোগসহ নানান জাতের ধান চাষ হতো।
আউশ মৌসুমে কিছু এলাকায় কাচিলুইন, জালি, শিয়াইন মুরান, মুরালি, দুমাই, মারকা, বোয়ালিয়া, জমির শাইল, গোয়ালমুড়ি, সূর্যমুখি, চেংরিমুরালী, মোরালি, বগি, দোয়ালিসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ধান চাষ হতো।
জামালগঞ্জ উপজেলা সদর ইউনিয়ন কৃষক শফিক মিয়া বলেন, “তিন কিয়ার জমিতে রাতা ধান চাষ করে ৩৬ মণ পেয়েছি। এসব জাতের ধানের দাম বেশি। একই জমিতে হাইব্রিড ধান চাষ করলে ৬০-৬৫ মণ ধান পাওয়া যেত। আর বর্তমানে বাজারে ভালো মানের দেশীয় জাতের ধানের বীজ পাওয়া যায় না। তা ছাড়া দেশি জাতের ধানের উৎপাদন হয় কম ও উৎপাদনে সময়ও বেশি লাগায় এসব ধানের আবাদ করতে কেউ আগ্রহী হয় না। কেউ কেউ সামান্য ধান চাষ করেন নিজেদের খাওয়ার জন্য।”
তাহিরপুরের শনি হাওর পাড়ের বীরনগর গ্রামের বাসিন্দা ও শনির হাওরের সাদেক আলী জানান, এ বছর ১৬ কিয়ার জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষাবাদ করা হয়েছে। ফলনও ভালো হয়েছে। এবার তিন শ মণ ধান এসেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ফলন কম হওয়ায় দেশীয় জাতের ধানের চাষ কমে যাচ্ছে। কৃষকরা হাওরে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উফশী ও হাইব্রিড ধানের চাষাবাদে মনোযোগী হচ্ছে। ফলে হাওর এখন হাইব্রিডের দখলে। কিছু কৃষক আছে যারা দেশি জাতের ধানের চাল ও সুগন্ধি চাল খেতে আগ্রহী। তারাই কেবল স্থানীয় জাতের ধান চাষ করছেন। এ বছর প্রায় ১০ জাতের দেশি ধান চাষাবাদ হয়েছে এক ভাগ জমিতে।